০৪. কারা যেন নিচু গলায় কথা বলছে

গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল, শুনতে পেলাম কারা যেন নিচু গলায় কথা বলছে। আমি লাফিয়ে উঠতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। অন্ধকারে চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করছিলাম হঠাৎ করে আমার উপর তীব্র আলো এসেড়ে। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে আমি কোনোমতে উঠে বসি, প্রচণ্ড আলোতে চোখ ধাধিয়ে গেছে, আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

খসখসে গলায় কে যেন বলল, দশম প্রজাতির রবোট। চমৎকার হাতের কাজ।

খনখনে এক ধরনের যান্ত্রিক গলায় এরকজন বলল, এর মাঝে কিউ কপোট্রন রয়েছে। কখনো দেখি নি শুধু এর গল্প শুনেছি। ভিতরে নিউরাল নেটওয়ার্ক।

ক্রায়োজেনিক কাজ একেবারে প্রথম শ্রেণীর।

মোটা গলায় একজন বলল, এটা কেমন করে এখানে এল?

খসখসে কণ্ঠস্বরটি আবার বলল, স্ক্যান করে দেখ তাপমাত্রার কোনো তারতম্য নেই।

কয়েকজন একসাথে বলল, ঠিকই বলেছ।

আমি এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ শুনতে থাকি।

পাওয়ার সাপ্লাইটা কোথায়? কানের নিচে?

উঁহু। বুকের কাছে। সৌরসেল থাকার কথা।

আমি কথা শুনে বুঝতে পারি যারা আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তারা সবাই ভাবছে আমি দশম প্রজাতির একটা রবোট। তাদের খুব একটা দোষ দেয়া যায় না– এই ভয়ঙ্কর ধ্বংসস্তূপে একজন মানুষ কেমন করে আসবে? আমি হাত দিয়ে তীব্র আলো থেকে চোখকে আড়াল করে রেখে বললাম, আলোটা একটু কমাবে? দেখতে অসুবিধে হচ্ছে।

যারা আমাকে ঘিরে আছে তারা আলো সরাল না। খসখসে কণ্ঠস্বরটি জিজ্ঞেস করল, কী বলছ তুমি?

আমি একজন মানুষ।

মানুষ!

সাথে সাথে আলো নিভে গেল, আমি সবাইকে ধড়মড় করে পিছনে সরে যেতে শুনলাম। এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ হল এবং তারপর হঠাৎ করে একটা দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল।

সত্যিই মানুষ?

হ্যাঁ

মানুষ, যাকে বলে জৈবিক মানুষ?

হ্যাঁ, জৈবিক মানুষ।

এবারে ঘরে একটা বাতি জ্বলে ওঠে এবং আমি দেখতে পাই আমাকে ঘিরে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন আকারের রবোট দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকের হাতেই এক ধরনের ভয়ঙ্করদর্শন অস্ত্র এবং সবাই সেটি আমার দিকে তাক করে রেখেছে। এর যে কোনো একটি অস্ত্র চোখের পলকে মানুষের একটা বসতি উড়িয়ে দিতে পারে, আমার জন্যে ছয়টি অস্ত্রের কোনো প্রয়োজন ছিল না। সবচেয়ে কাছে যে রবোটটি দাঁড়িয়ে আছে তার একটি হাত কনুইয়ের কাছে থেকে উড়ে গেছে। কিছু বৈদ্যুতিক তার, যন্ত্রপাতি, নানারকম টিউব বের হয়ে আছে, রবোটটি সেটা নিয়ে কখনো মাথা ঘামিয়েছে বলে মনে হল না। রবোটটি দেখতে অনেকটা প্রতিরক্ষা রবোটের মতো, চেহারায় এক ধরনের কদর্যতা আছে যেটা সহজে চোখে পড়ে না। খসখসে গলায় বলল, তুমি যদি একটুও নড়, তোমাকে গুলি করে মেরে ফেলব।

আমি বললাম, আমি নড়ব না। কিন্তু আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই।

বাজে কথা। মানুষ সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে বিশ্বাসঘাতক প্রাণী।

আমি হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে রবোটটির সাথে একমত হতে পারি কিন্তু এই মুহূর্তে মুখ ফুটে সেটা বলার সাহস হল না।

দ্বিতীয় একটি রবোট যার দেহ সিলঝিনিয়াম ধাতুর মতো মসৃণ এবং হঠাৎ দেখলে সত্যিকারের কোনো শিল্পীর হাতে তৈরী অপূর্ব একটি ভাস্কর্য বলে মনে হয়, খনখনে গলায় বলল, এই মানুষটাকে এখনই মেরে ফেলা যাক। মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শত্রু।

অন্য রবোটগুলো তার কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়ল এবং আমি হঠাৎ করে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি। কোনো এক সময় রবোটের মাঝে এক ধরনের নিরাপত্তাসূচক ব্যবস্থা ছিল তারা কোনো অবস্থাতেই মানুষের কোনো ক্ষতি করতে পারত না। রবোটদের বিচ্ছিন্ন দল বহু আগেই তাদের কপোট্রনের সেইসব নিরাপত্তামূলক প্রোগ্রামিং পরিবর্তন করে ফেলেছে। আমি শুষ্ক গলায় বললাম, তোমাদের তুলনায় আমার শরীর অত্যন্ত দুর্বল, ইচ্ছে করলে যে কোনো মুহূর্তে তোমরা আমাকে মেরে ফেলতে পারবে। আমার অনুরোধ সেটা নিয়ে তোমরা কোনো তাড়াহুড়ো কোরো না

কেন নয়?

তোমরা ঠিক কী কারণে মানুষকে এত অপছন্দ কর জানি না। কিন্তু এটা মোটেও অসম্ভব কিছু নয় যে তোমাদের এবং আমার অবস্থা অনেকটা একরকম, এবং আমি হয়তো তোমাদের কোনোভাবে সাহায্য করতে পারব।

ছয়টি রবোটের মাঝে তিনটি হঠাৎ উচ্চৈঃস্বরে হাসার মতো শব্দ করতে শুরু করে। অন্য তিনটি রবোটকে সম্ভবত হাসার উপযোগী বুদ্ধিমত্তা দেয়া হয় নি, তারা স্থির চোখে রবোট তিনটিকে লক্ষ করতে থাকে। আমি রবোটগুলোর উন্মত্ত হাসি শুনতে শুনতে আবার এক ধরনের অসহায় আতঙ্ক অনুভব করি।

কনুইয়ের কাছ থেকে উড়ে যাওয়া হাতের রবোটটি হাসি থামিয়ে বলল, তুমি পৃথিবীতে বসবাসের সম্পূর্ণ অনুপযোগী দূর্বল একজন মানুষ! তুমি আমাদের সাহায্য করবে?

সেটি অসম্ভব কিছু নয়। আমি দ্রুত চিন্তা করতে থাকি, কিছু একটা বলে রবোটগুলোকে শান্ত করতে হবে। কী বলা যায় ভেবে পাচ্ছিলাম না, কোনোকিছু চিন্তা না করেই বললাম, আমি যে কারণে মানুষের বসতি ছেড়ে এসেছি তোমরাও নিশ্চয়ই সেই একই কারণে মানুষের কাছ থেকে দূরে চলে এসেছ?

চকচকে মসৃণ দেহের রবোটটি বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?

কনুইয়ের কাছ থেকে হাত উড়ে যাওয়া রবোটটি বলল, তুমি এই মানুষটির কোনো কথা বিশ্বাস কোরো না। মানুষ খল এবং নীচু প্রকৃতির। মানুষ ধূর্ত এবং ফাঁকিবাজ। মানুষ অপদার্থ এবং অপ্রয়োজনীয়। পৃথিবী থেকে মানুষকে অপসারিত করা হচ্ছে পৃথিবীর উপকার করা।

তৃতীয় একটি রবোট হাতের ভীষণদর্শন অস্ত্র হাতে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, এস পৃথিবীর একটা উপকার করে দিই।

মসৃণ দেহের রবোটটি তার ধাতব খনখনে গলায় বলল, যত্ন করে খুন কর যেন দেহটি নষ্ট না হয়। আমি কখনো মানুষের শরীরের ভিতরে দেখি নি। মানুষের শরীরে হৃৎপিণ্ড বলে একটি জিনিস আছে সেটি নাকি ক্রমাগত তাদের কপোট্রনে রক্ত সঞ্চালন করে।

তৃতীয় রবোটটি বলল, মেরে ফেললে হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। যদি সত্যি সত্যি হৃৎস্পন্দন দেখতে চাও জীবন্ত অবস্থায় বুকটি কাটতে হবে।

আমি অসহায় আতঙ্কে তাকিয়ে থাকি। চকচকে মসৃণ রবোটটি আমার দিকে এগিয়ে আসে। তাকে এখন হঠাৎ অন্ধকার জগৎ থেকে বের হয়ে আসা বিশাল রক্তলোলুপ সরীসৃপের মতো মনে হচ্ছে। কাছে এসে হাতের কোথায় চাপ দিতেই কব্জির কাছ থেকে একটি ঝকঝকে ধারালো ইস্পাতের ফলা বের হয়ে এক তার পিছু পিছু অন্য রবোটগুলো এগিয়ে আসে, যন্ত্রের মাঝে কৌতূহলের চিহ্নটি কখনো স্পষ্ট হতে পারে না তাই রবোটগুলোকে তখনো ভাবলেশহীন নিস্পৃহ মনে হতে থাকে। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম, ঘরের এক কোনায় ক্রিশি জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার প্রাচীন দুর্বল কপোট্রন এই শক্তিশালী রবোটগুলোর উপস্থিতিতে পুরোপুরি শক্তিহীন, তার কিছু করার নেই। কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখলাম সে তবু আমাকে বাঁচাতে চেষ্টা করল, এক পা এগিয়ে এসে বলল, দাঁড়াও।

রবোটগুলো থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কনুই থেকে উড়ে যাওয়া হাতের রবোটটি বলল, তুমি কে? আরেকজন মানুষ? বিকলাঙ্গ ও কুৎসিত মানুষ?

আবার রবোট তিনটি কূর ভঙ্গিতে হাসতে শুরু করে এবং অন্য তিনটি রবোট স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে তাদের লক্ষ করতে থাকে।

ক্রিশি তার শান্ত গলায় বলল, না, আমি বিকলাঙ্গ মানুষ নই। আমি একজন রবোট।

চমৎকার। তুমি কী বলতে চাও?

তোমরা কে আমি এখনো জানি না, তোমরা কী চাও তাও আমি জানি না। কিন্তু একজন রবোট হিসেবে অন্য রবোটকে আমি কি একটা কথা বলতে পারি?

কী কথা?

এই মানুষটি মরে গেলে তার কোনোই মূল্য নেই। কিন্তু বেঁচে থাকলে তার অনেক মূল্য।

কী মূল্য? কনুই থেকে উড়ে যাওয়া হাতের রবোটটি ধমক দিয়ে বলল, মানুষের কোনো মূল্য নেই। মানুষ দুর্বল, অপ্রয়োজনীয় আর অপদার্থ। মানুষ মূল্যহীন–

ক্রিশি শান্ত গলায় বলল, কিন্তু এই মানুষটি মূল্যহীন নয়। মহামান্য গ্রুস্টান এই মানুষটিকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

গ্রুস্টান! হঠাৎ করে সব কয়টি রবোট থেমে গেল, ধড়মড় করে পিছনে সরে এসে জিজ্ঞেস করল, গ্রুস্টান একে খুঁজছে?

হ্যাঁ।

কেন? রবোটগুলো ঘুরে আমার দিকে তাকাল। কেন গ্রুস্টান তোমাকে খুঁজছে?

আমি তার সম্পর্কে অবমাননাকর কথা বলেছি।

কনুই থেকে উড়ে যাওয়া হাতের রবোটটি আবার শব্দ করে হেসে ওঠে, বিশ্বাসঘাতক নির্বোধ মানুষের কাছে এর থেকে বেশি কি আশা করা যায়?

চকচকে দেহের রবোটটি বলল, এর কথা বিশ্বাস কোরো না, খোঁজ নিয়ে দেখ।

সাথে সাথে রবোটগুলো সচল হয়ে ওঠে। তাদের মাথার কাছে বাতি জ্বলতে থাকে, নানা আকারের এন্টেনা বের হয়ে আসে, নানা ধরনের কমিউনিকেশান মডিউল ব্যবহার করে তারা কাছাকাছি ডাটা ব্যাংক থেকে খোঁজখবর নিতে থকে। কয়েক মুহূর্ত পর হাত উড়ে যাওয়া রবোটটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সত্যি কথাই বলেছ। গ্রুস্টান সত্যি সত্যি তোমাকে খুঁজছে। তোমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারলে মোটা পুরস্কার।

চকচকে মসৃণ রবোটটি বলল, আমরা গ্রুস্টানের সাথে একটা চুক্তি করতে পারি, আমরা এই মানুষটিকে ফিরিয়ে দেব তার বদলে আমরা একটা প্রথম শ্রেণীর সফটওয়ার পাব–

অন্য রবোটগুলো সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে থাকে। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা রবোটটি বলল, আমরা তাহলে এখন একে মারব না? হৃৎপিণ্ডের কর্মপদ্ধতি দেখব না?

আপাতত না।

যদি পালিয়ে যায়? মানুষকে কোনো বিশ্বাস নেই।

শরীরে একটা ট্রাকিওশান লাগিয়ে দাওবার মেগাহার্টজের।

একটি রবোট আমার দিকে এগিয়ে আসে, তোমার হাতটা দেখি।

আমি আমার হাতটি এগিয়ে দিলাম। রবোটটি চোখের পলকে হাতের তালুতে তীক্ষ্ণ একটি শলাকা ঢুকিয়ে দিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসে আর আমি প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকি।

রবোটটি হিসহিস করে বলল, অকারণে শব্দ কোরো না নির্বোধ মানুষ। আমি একটি ট্রাকিওশান প্রবেশ করাচ্ছি, তোমার হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে নিচ্ছি না।

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ক্রিশি, ক্রিশি তুমি কোথায়?

ক্রিশি আমার কাছে এগিয়ে আসে, এই যে আমি এখানে।

আমি অন্য হাতটি দিয়ে ক্রিশিকে শক্ত করে ধরে রাখি। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আমার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে, তার মাঝে ট্রাকিওশান হাতে রবোটটি আরেকটি শলাকা আমার হাতের তালুতে ঢুকিয়ে দিল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আমি জ্ঞান হারালাম।

রবোটের যে দলটি আমার হাত ফুটো করে শরীরে একটা ট্রাকিওশান ঢুকিয়ে দিয়ে আমাকে পাকাঁপাকিভাবে বন্দি করে ফেলেছে তার দলপতি হাত উড়ে যাওয়া রবোটটি, তার কোনো নাম নেই অন্য রবোটরা তাকে একটি সংখ্যা, বাহাত্তর বলে ডাকে, তার কারণটি আমার ঠিক জানা নেই। চকচকে মসৃণ রবোটটির নাম কুরু। দলের তিন নম্বর রবোটটির নাম হি। অন্য তিনটি রবোটের নাম আছে কি নেই আমি জানি না, তাদের সাথে সত্যিকার সংলাপ কখনন করা হয় নি, একজন আরেকজনের সাথে যোগাযোগ করে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি দিয়ে, যেটা আমি কখনো শুনতে পাই না।

রবোটের এই দলটি একটি ছোট দস্যুদল। তাদের কথা শুনে বুঝতে পেরেছি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার পর এ রকম অসংখ্য রবোট সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের কিছু কিছু একত্র হয়ে এক ধরনের বিচিত্র জীবন যাপন শুরু করেছে এই দলটি কোনো এক কারণে দস্যুবৃত্তিকে নিজেদের জীবন হিসেবে বেছে নিয়েছে।

এই দলটির জীবনের উদ্দেশ্য বিনোদনমূলক সফটওয়ার এবং কম্পিউটার প্রক্রিয়া ছিনিয়ে আনা। পরাবাস্তবতার অসংখ্য সফটওয়ার পৃথিবীর আনাচে কানাচে রয়ে গেছে। এক সময় তাদের বেশিরভাগ মানুষ নানা ধরনের কম্পিউটারে ব্যবহার করত। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার পর তার বড় অংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, যেগুলো ধ্বংস হয় নি সেগুলো পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছোট বড়, সহজ–জটিল নানা কম্পিউটারে অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে। গ্রুস্টান আবার সেগুলো একত্র করার চেষ্টা করছে, মানুষ আবার সেগুলো ব্যবহার শুরু করেছে। এই রবোট দলটি সেইসব সফটওয়ারের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। যদি কোনোভাবে সেগুলো কেড়ে আনতে পারে নিজেদের কপোট্রনে পুরে নিয়ে দীর্ঘ সময় উপভোগ করতে থাকে। মানুষ যেরকম করে ভয়ঙ্কর নেশাতে অভ্যস্ত হয়ে যাবার পর সেটা ছাড়তে পারে না, এটিও অনেকটা সেরকম।

প্রথমবার রবোটগুলো যখন মানুষের লোকালয় আক্রমণ করেছিল আমি ব্যাপারটি বেশ কাছে থেকে দেখেছিলাম। ভয়ঙ্করদর্শন অস্ত্র হাতে গুলি করতে করতে তারা কম্পিউটারের ঘটিতে ঢুকে গিয়েছিল। ভিতরে সবকিছু ভেঙেচুরে ক্রিস্টাল ডিস্কগুলো খুলে বের হয়ে এসেছে। মানুষেরা আতঙ্কে ছুটে পালিয়ে গেছে, কিছু প্রতিরক্ষা রবোট দাঁড়িয়েছিল কিন্তু প্রচণ্ড গুলির সামনে তারা দাঁড়াতে পারে নি। আমি খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে দেখেছি শরীরে ট্রাকিওশান লাগানো বলে বেশি দূরে যেতে পারি না, না চাইলেও কাছাকাছি থাকতে হয়।

রবোটগুলো সফটওয়ার এবং প্রসের প্রক্রিয়াগুলো নিজেদের কপোট্রনে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে সেগুলো উপভোগ করতে থাকে ব্যাপারটি অত্যন্ত বিচিত্র। মানুষ যখন কিছু উপভোগ করে তাদের চেহারায় তার ছাপ পড়ে। রবোটের বেলায় সেটা সত্যি নয়, অত্যন্ত কঠোর মুখ নিয়ে তারা দীর্ঘ সময় মূর্তির মতো নিস্পন্দ হয়ে বসে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ তাদের হাত। বা পা একটু নড়ে উঠে চোখের ঔজ্জ্বল্য একটু বেড়ে যায় বা কমে আসে, তার বেশি কিছু নয়। বাইরে থেকে আপাতদৃষ্টিতে যেটাকে এক ধরনের স্থবিরতা বলে মনে হয়, আসলে সেটি তাদের কপোট্রনে প্রতি সেকেন্ডে কয়েক ট্রিলিয়ন জটিল হিসেব নিকেশের ফল।

ব্যাপারটি একনাগাড়ে কয়েকদিন চলতে থাকে। আমার তখন কিছু করার থাকে না, ট্রাকিওশানের দূরত্বসীমার মাঝে আমি বাধা পড়ে থাকি। ক্রিশি আছে বলে আমি বেঁচে আছি। আমার জন্যে সে খাবার এনে দেয়, পানীয় এনে দেয়। যখন আমি গম্ভীর হতাশায় ডুবে যেতে থাকি ক্রিশি সম্পূর্ণ অবান্তর অর্থহীন কথা বলে আমাকে হতাশার অন্ধকার গহ্বর থেকে তুলে আনে। ক্রিশিকে নিয়ে রবোটগুলো কখনো কোনো ধরনের কৌতূহল দেখায় নি, রবোটগুলোর কাছে সে একটা কমিউনিকেশান্স মডিউল বা সৌর ব্যাটারি থেকে বেশি কৌতূহলোদ্দীপক কিছু ছিল না।

রবোটগুলো আমাকে গ্রুস্টানের কাছে দুষ্প্রাপ্য কিছু সফটওয়ারের বদলে ধরিয়ে দেবে বলে ঠিক করেছে। কিন্তু কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে তারা কখনো আমার সাথে সেটা নিয়ে কোনো কথা বলে না। আমি তাদের সাথে আছি, তারা আমাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে, আমি কয়েকবার ভেবেছি আমাকে নিয়ে কী করবে তাদের জিজ্ঞেস করি কিন্তু একটা যন্ত্রের সাথে নিজের জীবন নিয়ে কথা বলতে প্রতিবারই আমার কেমন জানি বিতৃষ্ণা হয়েছে।

দ্বিতীয়বার তারা যখন মানুষের একটা লোকালয় আক্রমণ করল আমি সাথে যেতে চাই নি কিন্তু আমার কোনো উপায় ছিল না। রবোটগুলো আক্রমণ করল ভরদুপুরে, গুলি করতে করতে তারা গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকে যায়, তাদের হাতে কিছু বিস্ফোরক ছিল সেগুলো চারদিকে ছুঁড়ে দেয়, প্রচণ্ড বিস্ফোরণে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে। মানুষেরা চিৎকার করতে করতে ছুটে যেতে থাকে, প্রতিরক্ষা রবোট অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসে, মুহূর্তে পুরো এলাকাটি একটা নরকের মতো হয়ে যায়। আমি কাছাকাছি একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে নিস্পৃহভাবে পুরো ব্যাপারটা দেখছিলাম হঠাৎ লাল চুলের কমবয়সী একজন মানুষ আমার কাছে দিয়ে ছুটে যেতে যেতে চিৎকার করে বলল, পালাও! পালাও! রবোট এসেছে, রবোট।

আমি অন্যমনস্কভাবে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। একবার ইচ্ছে হল তাকে বলি, আমার কোথাও পালিয়ে যাওয়ার জায়গা নেই–কিন্তু মানুষটা যেভাবে ছুটে পালাচ্ছে দাঁড়িয়ে আমার কোনো কথা শুনবে বলে মনে হয় না। কাছাকাছি প্রচও একটা বিস্ফোরণ হল, শিস দেয়ার মতো শব্দ করে কানের কাছে দিয়ে কয়েকটা গুলি বের হয়ে গেল, আমি অভ্যাসবশত মাথা নিচু করতে গিয়ে থেমে গেলাম। নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে কী হবে? যদি বিচ্ছিন্ন একটা গুলি এসে আমাকে শেষ করে দেয় হয়তো সেটাই হবে আমার জন্যে ভালো।

আমি প্রচণ্ড গোলাগুলির মাঝে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে ব্যাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

হঠাৎ দেখি একটু আগে লাল চুলের যে মানুষটি ছুটে গিয়েছিল সে আবার ফিরে এসেছে। গুঁড়ি মেরে মুখের দিকে খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি ওই রবোটগুলোর সাথে এসেছ?

আমি মাথা নাড়লাম।

আমি তোমাকে চিনি।

আমি অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকালাম। লোকটা আবার বলল, তুমি কুশান। আমি তোমার ছবি দেখেছি।

লোকটা আবার কী একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে দেয়াল থেকে কিছু ভেঙে পড়ল, লোকটা ছিটকে সরে গেল পিছনে। ঠিক তখন আমার ট্রাকিওশানে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকি। রবোটগুলো ফিরে যেতে শুরু করেছে। আমাকেও ফিরে যেতে হবে।

আমি ক্লান্ত পায়ে হেঁটে ফিরে যাচ্ছি হঠাৎ ধ্বংসস্তূপের মাঝে থেকে লাল চুলের সেই মানুষটি আবার মাথা বের করে উচ্চৈঃস্বরে কিছু একটা বলল, পরিষ্কার মনে হল সে বলল, তুমি কি আমাকে তোমার সাথে নেবে? কিন্তু সেটা তো সত্যি হতে পারে না। কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ নিশ্চয়ই আমার সাথে যেতে চাইবে না। নিশ্চয়ই আমি ভুল শুনেছি।

রাত্রিবেলা প্রায় শ খানেক কিলোমিটার দূরে মাটিতে জিনন ল্যাম্প লাগিয়ে রবোটগুলো তাদের লুণ্ঠন করে আনা সফটওয়ার নিয়ে বসে। হাত উড়ে যাওয়া রবোটটি–যাকে অন্য রবোটেরা বাহাত্তর বলে ডাকে, একটা ক্রিস্টাল হাতে নিয়ে বলল, এবারে খুব ভালো ভালো সফটওয়ার পেয়েছি। এই যে দেখ গ্যালাক্সি সাত। রিকি ভাষায় লেখা

আমি গ্যালাক্সি সাত একবার ব্যবহার করেছিলাম, খুব যত্ন করে তৈরি করা। বিশ্বজগতের মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়ার একটা ব্যাপার আছে। গ্রহ থেকে গ্রহ, নক্ষত্র থেকে নক্ষত্র, নীহারিকা, নক্ষত্রপুঞ্জ ব্ল্যাকহোলের আশপাশে ঘুরে বেড়ানোর বাস্তব এক ধরনের অনুভূতি। আমি সচরাচর রবোটগুলোর সাথে কথা বলি না, আজকে কী মনে হল জানি না হঠাৎ বললাম, গ্যালাক্সি সাত চমৎকার সফটওয়ার।

সবগুলো রবোট একসাথে আমার দিকে ঘুরে তাকাল। বাহাত্তর জিজ্ঞেস করল, তুমি কেমন করে জান?

আমি জানি। আমি এটা ব্যবহার করেছি। এর মাঝে একটা ত্রুটি আছে।

ক্রটি?

হ্যাঁ। শেষ পর্যায়ে যদি যেতে পার ব্ল্যাকহোলে বিলীন হয়ে যাবার আগের মুহূর্তে একটা রঙিন টুপি পরা ক্লাউন বের হয়ে আসে।

ক্লাউন?

হা। সেটা খিকখিক করে হাসতে থাকে, তখন যদি তার পিছু পিছু যাও সবকিছু গোলমাল হয়ে যায়। একটু অপেক্ষা করলে ক্লাউন অদৃশ্য হয়ে আবার ব্ল্যাকহোল ফিরে আসে।

অত্যন্ত বিচিত্র এবং অর্থহীন। কুরু মাথা নেড়ে বলল, ব্ল্যাকহোলের সাথে ক্লাউনের কোনো সম্পর্ক নেই।

অন্য রবোটগুলো কুরুর সাথে সাথে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, অর্থহীন। একেবারেই অর্থহীন।

বাহাত্তর আরেকটা ক্রিস্টাল হাতে নিয়ে বলল এই যে, আরেকটা নবম মাত্রার সফটওয়ার। এর নাম পঙ্কিল কুসুম।

পঙ্কিল কুসুম! আমি অবাক হয়ে বললাম তোমরা পঙ্কিল কুসুম পেয়েছ?

কেন, কী হয়েছে?

এটা দীর্ঘদিন বেআইনি ছিল। গ্রুস্টান কিছুদিন আগে মানুষকে ব্যবহার করতে দিয়েছে।

এটা কী রকম?

খুব যত্ন করে তৈরি করা সফ্টওয়ার। কিন্তু তোমরা ব্যবহার করতে পারবে না।

বাহাত্তর হঠাৎ তার ভীষণদর্শন অস্ত্রটি আমার দিকে তাক করে বলল, আমাদের বুদ্ধিমত্তার ওপর কটাক্ষ করে আর একটা কথা বললে তোমার ঘিলু বের করে দেব।

রবোটটির কথা আমার কাছে কেন জানি ফাঁপা বুলির মতো মনে হয়। আমি মাটিতে থুতু ফেলে বললাম, আমাকে মেরে ফেলার হলে অনেক আগেই মারতে। খামাখা ভয় দেখিও না। তোমার ওই অস্ত্রকে আমি ভয় পাই না।

বাহাত্তর স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তার দৃষ্টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বললাম, পঙ্কিল কুসুম একটি জৈবিক সফটওয়ার। ভালবাসার কারণে পুরুষ আর রমণীর ভিতরে যেসব জৈবিক প্রক্রিয়া হয় এটি সেটার ওপরে তৈরী। তোমরা নিম্ন শ্রেণীর রবোট। তোমাদের মাঝে ভালবাসা নেই জৈবিক অনুভূতিও নেই। তোমরা এটা বুঝবে না।

রবোটগুলো কোনো কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমাকে গুলি করে মেরে ফেলার একটা ছোট সম্ভাবনা রয়েছে, আমি তার জন্যে মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম, কিন্তু রবোটগুলো আমাকে মারল না। মরে যাওয়া নিয়ে আজীবন আমার ভিতরে যে এক ধরনের আতঙ্ক ছিল ইদানীং সেটি আর নেই।

আমি যেভাবে বেঁচে আছি তার সাথে মরে যাওয়ার খুব বেশি পার্থক্য নেই।