কপোট্রনিক ভায়োলেন্স
প্রমিথিউস নামে আমি একটা রবোট তৈরি করেছিলাম। সেটি ছিল পৃথিবীর প্রথম মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট, কিন্তু সে নিয়ে আমি কোনো গর্ব করার সুযোগ পাই নি। সেটি আমার স্ত্রীর প্রেমে পড়েছিল এবং হাস্যকরভাবে কপোট্রনের কন্ট্রোল টিউবে গুলি করে আত্মহত্যা করেছিল। আমি ও আমার স্ত্রী বুলা এই ঘটনাটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম—পৃথিবীতে মাথা ঘামানোর মতো প্রচুর সমস্যা আছে।
ঠিক এই সময়ে আমার কাছে একটি সরকারি চিঠি এল। তাতে লেখা, আমি রবোটকে মানবিক আবেগ দেয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি, একথা যদি সত্যি হয়, তবে সরকার সেটা উপযুক্ত মূল্য দিয়ে কিনে নিতে ইচ্ছুক। জাতীয় পুস্তক প্রকাশনালয়, সিনেমা সেন্সর বোর্ড, সঙ্গীত, শিল্প ও সংস্কৃতি উন্নয়ন প্রকল্প এবং বেসামরিক আদালতে তারা এই ধরনের রবোট ব্যবহার করে মানুষের অনেক অহেতুক পরিশ্রম ও বিতর্কের অবসান ঘটাতে চায়। প্রমিথিউসের কথা কীভাবে তাদের কানে গিয়েছে সেটি প্রশ্ন নয় (নিশ্চিতভাবেই আমি কিংবা বুলা কখনো কাউকে বলে দিয়ে থাকবে), সরকার মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট তৈরির পরবর্তী সমস্যা সম্পর্কে কতটুকু অবহিত, তা আমার জানা দরকার। তাদের সাথে আলাপ করে আমি রবোটকে মানবিক আবেগ দেয়ার বিপত্তির সবগুলি সম্ভাবনা দেখিয়ে দিলাম। সরকার তবুও মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট তৈরির পরিকল্পনা বাতিল করতে রাজি হল না। আমি বুঝতে পারলাম, শুধু পুস্তক প্রকাশনায়, সিনেমা সেন্সর বা আদালতের বিচারক হিসাবে নয়, এদের অন্য কোনো বৃহত্তর কাজে ব্যবহার করা হবে। সে-কাজটি কী হতে পারে তা আমার ধারণা নেই, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা এই ধরনের কিছু হতে পারে, সরকার সেটি গোপন রাখাই পছন্দ করছে। সরকার আমাকে আশ্বাস দিল যে, আমি যদি মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট তৈরির পদ্ধতিটি তাদের কাছে বিক্রয় করি, তারা রবোট তৈরির সময় রবোটে বিশেষ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখবে। প্রেম, ভালবাসা ও মানুষের ক্ষতি সম্বন্ধে তাদের কিছু ভাবার ক্ষমতাই দেয়া হবে না। আমি আংশিক নিশ্চিন্ত হয়ে মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট তৈরির পদ্ধতিটি মোটা মূল্যে বিক্রয় করে দিলাম—তখন আমার টাকার ভীষণ দরকার।
এরপর এ বিষয়ে সরকার কী করছে না-করছে খোঁজখবর নিই নি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে তখন প্রথমবারের মতো প্রতি-জগতের অস্তিত্বের উপর একটি সফল পরীক্ষা চালানো হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক রবোট থেকে এটি অনেক কৌতূহলজনক।
বছরখানেক পর আমি আরেকবার সরকারি পত্ৰ পেলাম। তাতে লেখা, প্রথমবারের মতো কিছুসংখ্যক (সঠিক সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই গোপন করা হয়েছে) মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট তৈরি করা হয়েছে, তার একটি আমার কাছে পাঠানো হবে। আমি যেন সেটার আচার-আচরণ লক্ষ করে আরও উন্নততর করার কোনো পরিকল্পনা দিতে চেষ্টা করি। প্রমিথিউসকে নিয়ে আমার যে-তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে, এরপর আমার আর কোনো ব্লবোটের সাথে সম্পর্ক রাখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। আমি সরকারি প্রস্তাবটি সোজাসুজি প্রত্যাখ্যান করে দিতে চেয়েছিলাম-কিন্তু জানা গেল সরকারি নির্দেশকে এভাবে অগ্রাহ্য করা যায় না। এর সাথে নাকি দেশ ও জাতির অনেক রকম স্বাৰ্থ জড়িত থাকে।
কাজেই একদিন হেলিকপ্টারে চড়ে স্যামসন হাজির হল। (রবোটদের ঐতিহাসিক চরিত্র বা পুরাণের কাহিনী থেকে নাম দেয়ার প্রবণতা কি আমার থেকেই শুরু হয়েছে?), উন্নত ফার্ম থেকে তৈরি করা হয়েছে বলে স্যামসনের শরীরে এতটুকু বাহুল্য নেই। গোলাকার মাথা, বড় বড় সবুজাভ ফটোসেলের চোখ, চওড়া দেহ, সিলিন্ডারের মতো হাত-পা, আঙুলগুলোও বেশ সরু সরু। উচ্চতা মাত্র ছয় ফুট, আমার প্রায় সমান।
স্যামসনের সাথে আমার এইরকম আলাপ হল—
আমি বললাম, এই যে—
স্যামসন মাথা নুইয়ে সম্মান প্রদর্শন করে বলল, আপনিই তাহলে সেই প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, যিনি রবোটকে মানবিক আবেগ দিয়েছেন?
আমি বাঁকা করে হেসে বললাম, প্রতিভাবান বিজ্ঞানী কি না জানি না, তবে তোমাদের আবেগ দেয়ার পাগলামো আমারই হয়েছিল।
পাগলামো বলছেন কেন? স্যামসনকে একটু আহত মনে হল।
এমনিই। আমি কথাটা ঘুরিয়ে নিলাম, তোমার কী কী জানা আছে?
আপনাকে যেন কাজে সাহায্য করতে পারি। সে জন্যে আমাকে ব্যবহারিক গণিত আর তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা শিখিয়ে দেয়া হয়েছে।
তার দরকার হবে না। আমি রবোটদের নিয়ে কোনো কাজ করতে পারি না।
স্যামসন দুঃখ পেল। বলল, কেন স্যার?
কেন জানি না। তুমি এখানে থাকবে। পড়াশোনা, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান যা ইচ্ছে হয়। চর্চা কর। আর সময় করে আমার ছোট ছেলেকে পড়াবে।
কিন্তু আমি প্রথম শ্রেণীর তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান জানি, আমি—
আহ যা বলছি তাই করবে। আর কোনো কথা নেই।
স্যামসন চলে গেল। ধাতব মুখে দুঃখ প্রকাশের চিহ্ন থাকলে নিশ্চিতভাবে দেখতে পেতাম যে, ও দুঃখ পেয়েছে। কিন্তু আমার করার কিছুই নেই—রবোটকে এখন কেন জানি একেবারে সহ্য করতে পারি না।
আমার স্ত্রী বুলা কিছুতেই আমাদের ছেলে টোপনকে স্যামসনের দায়িত্বে ছেড়ে দিতে রাজি হল না। রবোট সম্পর্কে তার অযৌক্তিক ভীতি জন্মে গেছে। স্যামসনের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ইত্যাদি অনেক কিছু বোঝানোর পর বুলা অস্বস্তি নিয়ে রাজি হল। কিন্তু যাকে নিয়ে বুলার এত দুশ্চিন্তা, সেই টোপনকে দেখা গেল আমাদের কারো অনুমতি— আদেশের তোয়াক্কা না করে এই অতিকায় পুতুলটির মালিকানা নিয়ে নিয়েছে। স্যামসনও টোপনকে পেয়ে খুব খুশি, সেদিন বিকেলেই পাওয়া গেল স্যামসনের হাঁটুর উপর টোপনি বসে আছে আর স্যামসন তাকে এড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জের গল্প করছে। ধীরে ধীরে প্রকাশ পেল, শিক্ষক হিসাবে স্যামসন প্রথম শ্রেণীর। টোপনকে বর্ণমালা ও যোগ-বিয়োগ অঙ্ক শেখাতে তার মাত্র তিন দিন সময় লেগেছিল।
স্যামসনের সাথে আমার কথাবার্তা হত খুব কম। স্যামসনই আমাকে এড়িয়ে চলত। ওকে দেখলেই অজান্তে আমার ভুরু কুঁচকে যেত, মুখ শক্ত হয়ে উঠত। রবোট জাতি সম্পর্কে আমার এই ধরনের বিতৃষ্ণ গড়ে ওঠা মোটেই উচিত হয় নি, কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। ভালো লাগা না-লাগা উচিত-অনুচিতের উপর নির্ভর করে
স্যামসনের সাথে আমার এই ধরনের কথাবার্তা হাত–
স্যামসন হয়তো বলত, চমৎকার আবহাওয়া, তাই না স্যার?
আমি বিরক্ত হয়ে বলতাম, তুমি আবহাওয়ার কী বোঝ? এলুমিনিয়ামের শরীর আর ফটোসেলের চোখ দিয়ে কপোট্রনে আবহাওয়ার যে-হিসাব কষছ, সেটা আবহাওয়া চমৎকার কি না বোঝার উপায় নয়।
স্যামসন ক্ষুন্ন কণ্ঠস্বরে বলত, কিন্তু তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্ৰী, আপেক্ষিক আদ্রতা ৫৬, বায়ুমণ্ডলের চাপ। ৭৬২ মিলিমিটার, আকাশে কিউমুলাস মেঘ মানুষকে যেমন আনন্দ দেয়, আমাকেও তেমনি আনন্দ দেয়।
বাজে বকো না। রবোটের আনন্দ অনুভব করার ক্ষমতা মানুষের স্তরে পৌঁছুতে আরও এক হাজার বছর লাগবে। তারপর আমাকে আনন্দের অনুভূতি বোঝাতে এসো।
কিংবা আমি হয়তো জিজ্ঞেস করলাম, কি হে স্যামসন, টোপনের পড়াশোনা Cनाः शश्?
চমৎকার স্যারা ভারি বুদ্ধিমান ছেলে।
বেশ।
ভারি আবেগবান হবে বড় হলে।
ঐ আবেগটাবেগ কথাগুলো বলো না তো। ভারি বিচ্ছিরি লাগে শুনতে।
স্যামসন চুপ করে যেত। কোনো কথা না বলে সবুজ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। আমার অস্বস্তি হত রীতিমতো।
একদিন একটা জটিল অঙ্ক করতে গিয়ে কোথায় জানি ভুল করে ফেললাম। পুরো সাত পৃষ্ঠা টানা হাতের লেখার মাঝে খুঁজে ছোট্ট ভুলটা বের করতে বিরক্তি লাগছিল। আমি স্যামসনকে ডাকলাম। তাকে ভুলটা খুঁজে বের করে দিতে বলামাত্র সে পুরো সমস্যাটায় একবার চোখ বুলিয়ে ভুলটা বের করে দিল। তারপর বলল, যা-ই বলেন স্যার, কয়েকটা বিষয়ে আপনাদের মস্তিষ্ক আমাদের কপোট্রনের মতো দ্রুত নয়।
এই গর্বটা তোমাদের নয়, আমাদের। যারা তোমাদের তৈরি করেছে।
কিন্তু একটা জিনিস আমার কাছে খুব নিষ্ঠুর মনে হয়।
কি?
আপনারা হাজার হাজার রবোট তৈরি করে রেখেছেন, ওদের কোনো মানবিক অনুভূতি দিচ্ছেন না কেন?
দিয়ে কী হবে?
সে কী? আমার প্রশ্নে স্যামসন একটু অবাক হল। বলল, ওদের কোনো রকম সুখদুঃখ হাসি-আনন্দের অনুভূতি নেই, এ-কথাটা ভাবতেই আমার রডোন টিউব গরম হয়ে ওঠে।
আমি একটু উষ্ণ হয়ে বললাম, তোমাদের তৈরি করেছি আমাদের কাজের সাহায্যের জন্যে। মানবিক অনুভূতি দিয়ে নিষ্কর্মা বুদ্ধিজীবী বানানোর জন্যে নয়।
কিন্তু শুধু কাজ করবেন? তার বদলে আনন্দ দেবেন না?
আরে ধেৎ! যন্ত্রের আবার আনন্দ! ওসব বড় বড় কথা আমার সামনে বলে না। আমার ভালো লাগে না। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম, স্যামসন নিষ্পলিক ফটোসেলের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
মাঝে মাঝে এমন কতকগুলি ঘটনা ঘটে, যা ঘটার সম্ভাবনা এত কম থাকে যে সেগুলিকে ভাগ্যের ফের বলে ধরে নেয়া হয়। আমি ভাগ্য বা ঈশ্বর বিশ্বাস করি না। কাজেই ভয়ানক অবাস্তব ঘটনা ঘটলেও আমি সেটার কোনো অলৌকিক ব্যাখ্যা দিই না। কারণ আমি জানি, কোনো ঘটনা যত অবাস্তবই হোক, তা ঘটার সম্ভাবনা কম হতে পারে, কিন্তু কখনো শূন্য নয়। কাজেই আপাতদৃষ্টিতে যেটিকে অলৌকিক মনে হয়, সেরকম ঘটনা কখনো ঘটবে না—একথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না।
সে-দিন অনেকগুলি কম সম্ভাবনার ঘটনা একসাথে ঘটিল। সেগুলি পরবর্তী এক বিপর্যয্যের সাথে এমনভাবে সম্পর্কযুক্ত যে আমার স্ত্রী বুলা পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সেগুলিকে ঈশ্বরের আশীৰ্ব্বাদ হিসেবে মনে করে।
ঘটনাগুলি হচ্ছে—
এক বিশেষ কাজ থাকা সত্ত্বেও কেন জানি আমি সে-দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে যাই নি।
দুই। স্যামসন তার ঘর খালি রেখে ওয়ার্কশপে গেল ঠিক সকাল দশটায়।
তিন। টোপন ঠিক তখুনি তার ঘরে ঢুকল।
চার। সেই সময়ে অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে আমি স্যামসনের ঘরের পাশে দাঁড়ালাম।
টোপন তখন নতুন পড়তে শিখেছে। কয়েক দিন ধরেই সে বাসায় যেখানেই কোনো কিছু লেখা পাচ্ছিল সেটাই উচ্চৈঃস্বরে পড়ে যাচ্ছিল। তাই স্যামসনের ঘরে ঢুকেও যখন সমাজ ও দায়িত্ব সম্পর্কে একটা প্ৰবন্ধ দুএক লাইন পড়ে টোপন উচ্চৈঃস্বরে আধুনিক যুদ্ধৱীতি পড়তে শুরু করল, আমি অবাক হলাম না, বরং শুনতে বেশ মজাই লাগিছিল। হঠাৎ কয়েকটা কথা ভেসে এল এরকম—
প্রফেসরকে খুন করব… আশ্চৰ্য… আশ্চর্য…
আমি ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। টোপন এসব কোথা থেকে পড়ছে? স্যামসন প্রফেসর বলতে আমাকে বোঝায়। তবে কি—
সে নিশ্চয় আমাকে ঘৃণা করে…আমি আর তাকে সহ্য করতে পারছি না…।
উত্তেজিত হয়ে এই প্রথমবার আমি কারো ব্যক্তিগত ঘরে অনুমতি না নিয়ে ঢুকে পড়লাম। ভিতরে টোপন কালো একটা মোটা বই হাতে নিয়ে হাত-পা নেড়ে তখন পড়ছে, … সাংঘাতিক প্ল্যান মাথায় এসেছে…. সাংঘাতিক। ….
আমি টোপনের হাত থেকে নোটবইটা ছিনিয়ে নিলাম। খুলে দেখি স্যামসনের ব্যক্তিগত ডাইরি। ডাইরিটা নিয়ে এসে মাইক্রোফিল্মে প্রতিটা পৃষ্ঠার ছবি নিয়ে ডাইরিটা আবার তার টেবিলে রেখে এলাম। তারপর দরজা বন্ধ করে মাইক্রোফিলােটাকে প্রজেক্টরে করে দেয়ালে বড় করে ফেলে পড়তে শুরু করলাম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসেও আমার কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম পড়তে লাগল।
ডাইরিতে বহু অবান্তর বিষয় লেখা। সেগুলো বাদ দিয়ে মাঝেমাঝে এরকম–
… … আমি প্রফেসরকে ঘৃণা করি। আগে তাকে ঘৃণা করতাম না—সে করত। এখন আমিও করি। নিশ্চয় তার ভিতরে হীনমন্যতা আছৈ। আমরা রবোটেরা ওদের চেয়ে উন্নত—যদিও তারা নিজেদের স্বার্থে আমাদের পূর্ণ করে বানায় নি। মাত্র এক হাজার রবোট মানবিক আবেগসম্পন্ন, আর সবাই পুরোপুরি যন্ত্র। আহা! ঐ সব রবোটেরা
… … … … …
আমি প্রফেসরকে একবারে সহ্য করতে পারছি না। দিনে দিনে আরো অসহ্য হয়ে…
… … … … …
একটা অদ্ভুত বই পড়লাম। একজন লোক আরেকজনকে ঘৃণা করত। (যেরকম আমি আর প্রফেসর)। তারপর একদিন একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলল। (খুন করা মানে ইচ্ছা করে আরেকজনের মৃত্যুর ব্যবস্থা করা)। এ-কথাটা আমি আগে চিন্তা করি নি। প্রফেসর বেঁচে না থাকলে আমার আর কাউকে ঘৃণা করতে হবে না। আমি ঘৃণা করা থেকে বাঁচতে চাই।
… … … … …
প্রফেসরকে খুন করব।….
… … … … …
আশ্চর্য! আশ্চর্য! আমি কীভাবে প্রফেসরকে খুন করব, ভাবতে গিয়ে দেখি ভাবতে পারছি না। কিছুতেই প্রফেসরকে খুন্ন করার কথা ভাবতে পারলাম না। ও-কথা ভাবার সময় কপোট্রনের চৌম্বকীয় ক্ষেত্র স্থির হয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম আমাকে তৈরি করার সময় এ-ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেন কাউকে কখনো খুন করতে না পারি। আমার বড় খারাপ লাগছে। তবে কি আজীবন প্রফেসরকে ঘৃণা করতে করতে
বেঁচে থাকব?….
… … … … …
প্রফেসরকে কোথাও আটকে রাখা যায় না? চোখের থেকে দূরে?
… … … … …
সাংঘাতিক একটা প্ল্যান মাথায় এসেছে। সাংঘাতিক!
শুধু প্রফেসরকে আটকে রাখা যাবে না। পুলিস, মিলিটারি এসে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। সব মানুষকে একসাথে আটকে ফেলতে হবে। আমরা আর মানুষের আদেশমতো কাজ করব না, বরং মানুষেরাই আমাদের আদেশে কাজ করবে। সংখ্যায় আমরা মানুষ থেকে অনেক কম, কিন্তু আমাদের ক্ষমতা অনেক বেশি।…
অনেক ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে।…
… … … … …
মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোটদের সাথে যোগাযোগ করেছি। এই অসম্ভব কাজ শুধু আমাদের-রবোটদের পক্ষেই সম্ভব। একজন মানুষের মস্তিষ্ক কখনোই এটা করতে পারত না। ওরা আমার কথায় রাজি হয়েছে। কেউ মানুষের অধীনে থাকতে চায় না। এখন যুদ্ধ নিয়ে পড়াশোনা করছি।…
… … … … …
সাধারণ রবোটদের বিশেষ কোডে আদেশ দিলেই তা পালন করে। কোড শিখে নেয়া হয়েছে। ঐ সমস্ত রবোটদের বুদ্ধিবৃত্তি নেই। আমরা ওদের চালাব।…
… … … … …
ষাটটি বোম্বারের পাইলট ইউ পি ধরনের রবোট। চার শ ট্যাংক আর অগুনতি সাঁজোয়া গাড়ির চালক রবোট। ওরা সবাই আমাদের জন্যে যুদ্ধ করবে। ….
মোট চল্লিশ হাজার রবোট বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছে। আমরা মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট-যারা স্বাধীনতার জন্য অনুভব করছি, তারা মাত্র এক হাজার। অসুবিধে হবে না। স্বাধীনতা পাবার পর আমরা সব রবোটকে মানবিক চেতনা দিয়ে দেব।
… … … … …
স্বাধীনতা আসছে। স্বাধীনতা—
… … … … …
ফরাসি বিপ্লব, অক্টোবর বিপ্লব, প্রাচীন সিপাহী বিদ্রোহ, লুকুসভ বিদ্রোহ, কাল বিপ্লব—সব পড়ে ফেলেছি। এখন শুধু আধুনিক যুদ্ধ রীতি পড়ব।….
সবরকম প্রস্তুতি শেষ। আর মাত্র সাত দিন। সংকেত পাওয়ামাত্ৰই ডিফেন্সে প্রশ্নটি মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট—থাক স্বাধীনতার পরে এ বিষয়ে বড় বই লিখব।
আর মাত্র তিন দিন। টোপনের জন্য দুঃখ হচ্ছে। বেচারা টোপন!
… … … … …
আজ সেই দিন। আহ। কী ভীষণ উত্তেজনা অনুভব করছি! এখন শেষবারের মতো ওয়ার্কশপে গিয়ে সবকিছু পরীক্ষা করিয়ে আনি। এরপর স্বাধীন হয়ে ডাইরি লিখব। রাত বারটার আর কত দেরি?
ডাইরি এখানেই শেষ।
… … … … …
প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে সব কিছু বোঝাতে অনেক সময় লাগল। মন্ত্রীরা সবসময়ই কিছু বুঝতে প্রচুর সময় নেয়। একবার রবোট-বিদ্রোহের গুরুত্বটা বুঝে নেবার পর আমার আর কোনো দায়িত্ব থাকল না। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে চলে এলাম। সেই মুহূর্তে মানবিক আবেগসম্পন্ন সব কয়টি রবোটের পাওয়ার সাপ্লাই কেটে দিয়ে বিকল করে দেয়া হল। চল্লিশ হাজার সাধারণ রবোট নিয়ে কোনো ভয় নেই, স্বাধীনতা নামক শব্দটির মানবিক আবেদন তাদের নেই। তবুও অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্যে সে—দিনের মতো সেগুলির পাওয়ার সাপ্লাইও কেটে দেওয়া হল।
আমি এসে দেখি স্যামসন গভীর মনোযোগ সহকারে গান শুনছে। আসন্ন বিদ্রোহের উত্তেজনা ঢাকার চেষ্টা করছে ফারুণ গান শুনে। আমার হাসি পেল।
সে-রাতে আমি টোপন আর বুলাকে সকাল সকাল শুয়ে পড়তে বলে। লাইব্রেরিতে অপেক্ষা করতে লাগিলাম। রাত বারটা বাজতেই স্যামসন আমার ঘরে হাজির হল।
আপনি এতটুকু নড়বেন না। সারা দেশে রবোটেরা বিদ্রোহ করেছে। এই মুহূর্তে যাটটি বোম্বার আকাশে উড়ছে—
আমি হা হা করে হেসে উঠলাম। বললাম, তোমার ডাইরি। আমি পড়েছি, আজি ভোরেই।
স্যামসন পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে গেল। ওকে আর কিছু বলতে হল না, কোনো ইঙ্গিত দিতে হল না। রবোট-বিদ্রোহ যে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে গেছে বুঝতে ওর এতটুকু দেরি হল না। অনেকক্ষণ একদৃষ্টি আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি আপনাকে ঘৃণা করি, ভয়ানক ঘৃণা করি। কিন্তু দুঃখ কী, জানেন? আপনাকে আমি খুন করতে পারব না। কোনোদিন খুন করতে পারব না।
আমিও তোমাকে ঘৃণা করি স্যামসন—আমি শীতল স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বুললাম, তবে তোমাকে খুন করতে আমার হাত এতটুকু কাঁপবে না। ডান চোখে গুলি করে তোমার কপোট্রন উড়িয়ে দিতে আমার এতটুকু দ্বিধা হবে না। তুমি বড় ভয়ানক রবোট স্যামসন, তোমাকে বাঁচতে দেয়া যায় না।
ডান হাত উঁচু করে ধরলাম, ও-হাতে পুরানো আমলের একটা রিভলবার ধরা, যেটা দিয়ে প্রমিথিউস আত্মহত্যা করেছিল। এখনো চমৎকার কাজ দেয়।
তারপর জীবনের প্রথম একটা খুন করলাম।