০৪. এরপর তিন মাস কেটে গেছে

॥ ৪ ॥

এরপর তিন মাস কেটে গেছে; এর মধ্যে মহীতোষবাবুর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তিনি যে আততায়ীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন তাতে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। অপ্সরা থিয়েটারে আরেকবার যাওয়া হয়েছিল ওখানে যদি কোনো খবর থাকে জানবার জন্য, কিন্তু তাতেও কোনো সুবিধা হয়নি। শুধু এই খবরটা পাওয়া গেছে যে মহীতোষ রায়ের জায়গায় আরেকজন অভিনেতা বহাল হয়েছে। এঁর নাম সুধেন্দু চক্রবর্তী। ইনি প্রফুল্লতে অভিনয় করছেন মহীতোষের জায়গায় এবং বেশ ভালো করছেন।

ফেলুদা এর মধ্যে মহীতোষ রায় সম্পর্কে আরো খবর নিয়েছে। ওঁর ছোট ভাই শিবতোষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছে যে সে দাদার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখেনি।

ফেলুদা জিগ্যেস করল, ‘আপনার দাদার সঙ্গে আপনার বিরোধের কারণ কি শুধু সম্পত্তি?’

শিবতোষবাবু বললেন, ‘তার বেশি আর কারণের দরকার আছে কি? দাদা বাবাকে খোশামোদ করতেন। আমি সে দিকে যাইনি। খোশামোদ আমার ধাতে নেই। ছোট ছেলে বলে আমাকে সব সময় ছোট করে দেখা হয়েছে। বাবাও তাই করেছেন—দাদা ত বটেই। তাই আমি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হলাম। এতে বিরোধের সৃষ্টি হবে তাতে আর আশ্চর্য কী?’

কথাগুলো শুনে আমার মনে হচ্ছিল শিবতোষবাবুর এখনো পুরোমাত্রায় আক্রোশ রয়েছে দাদার উপর।

ফেলুদা বলল, ‘আপনি মহীতোষবাবুর মৃত্যু সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করতে চান কি? এটা হয়ত আপনি বোঝেন যে তিনি যদি আততায়ীর হাতেই প্রাণ হারান, তাহলে সেই আততায়ী আপনি হওয়া কিছু আশ্চর্য নয়।’

‘আমি গত পাঁচ বছর দাদার মুখ পর্যন্ত দেখিনি। তাঁর সঙ্গে আমার সমস্ত সম্পর্ক চুকে গিয়েছিল। আর তাঁর থিয়েটারের জীবনের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না।’

‘যেদিন মহীতোষবাবু নিখোঁজ হন সেদিন সন্ধ্যাবেলা ছটা থেকে আটটার মধ্যে আপনি কী করছিলেন মনে পড়ে?’

‘রোজ যা করি তাই করছিলাম; আমার বন্ধুদের সঙ্গে তাস খেলছিলাম।’

‘কোথায়?’

‘সর্দার শঙ্কর রোড। এগারো নম্বর। অনুপ সেনগুপ্তর বাড়ি। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।’

ফেলুদা এটা চেক করার জন্যে সর্দার শঙ্কর রোডে শিবতোষবাবুর বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিল। তিনি বলে দেন যে তাদের বাড়িতে রোজ তাসের আড্ডা হয় এবং শিবতোষবাবু নিয়মিত আসেন।

একটা বড় সাসপেক্টকে তাই ফেলুদাকে নাকচ করে দিতে হল।

পরদিন সকালে লালমোহনবাবু এসে বললেন, ‘মশাই, এ কেসটা কোনো কেসই না। আপনি মিথ্যে এটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। তার চেয়ে চলুন আমরা দিন চারেকের জন্য কোথাও ঘুরে আসি। আমারও মাথায় একটা প্লট আসছে বলে মনে হচ্ছে, আর আপনিও মাথাটা একটু সাফ করে নিতে পারবেন।’

‘কোথায় যাবেন?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।

‘দীঘা গেলে কেমন হয়? ওটা ত এখনো দেখা হয়নি।’

‘বেশ তাই হোক। আমারও মনে হয় এ কেসটার কোনো নিষ্পত্তি হবে না। মহীতোষের হত্যাকারী আইনের হাত থেকে পার পেয়ে যাবে।’

আমরা পরদিনই দীঘা গিয়ে হাজির হলাম। টুরিস্ট লজে বুকিং ছিল, দিব্যি আরামে থাকা যাবে বলে মনে হল। আর তার উপর সমুদ্রে স্নান। লালমোহনবাবু একটা নতুন লাল সুইমিং কসট্যুম কিনে এনেছিলেন।

দীঘাতে কলকাতার খবরের কাগজ আসতে আসতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। তিনদিনের দিন আনন্দবাজারটা হাতে নিয়ে প্রথম পাতা দেখেই ফেলুদা প্রায় লাফিয়ে উঠল।

‘সর্বনেশে খবর।’

‘কী ব্যাপার?’ লালমোহনবাবু আর আমি একসঙ্গে বলে উঠলাম।

‘অপ্সরা থিয়েটারের প্রধান অভিনেতা খুন!’ বলল ফেলুদা, ‘এ কি আরম্ভ হয়েছে বল্‌ ত দেখি!’

খবরটা পড়ে দেখলাম। বলেছে অপ্সরা থিয়েটারের প্রধান অভিনেতা নেপাল লাহিড়ী দুদিন আগে থিয়েটারের পর ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরছিলেন, পথে এক বন্ধুর বাড়িতে যাবেন বলে ট্যাক্সি থেকে নামেন। বন্ধুর বাড়ি একটা গলির মধ্যে। সেই গলিতেই তাকে ছোরা মেরে খুন করা হয়। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে, তারা তদন্ত চালাচ্ছে। নেপালবাবুর স্ত্রী ও একটি বারো বছরের ছেলে আছে; তাঁরা এ বিষয় কোনো আলোকপাত করতে পারেননি।

‘তাহলে কী হবে?’ লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন।

‘তাহলে একবার আপনাকে যেতে হবে অপ্সরা থিয়েটারে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে।’

‘কেন, আমাকে কেন?’

কারণ আমার পা-টা আজ মচকেছে সমুদ্রে স্নান করার সময়। কাল ভালো রকম ব্যথা হবে বলে মনে হচ্ছে।’

‘তাহলে চলুন আজই ফেরা যাক। কলকাতায় গিয়ে চুন-হলুদ দিয়ে পা-টা বেঁধে ফেলবেন।’

‘আপনি পারবেন ত আমার ভূমিকা নিতে?’

‘তা অ্যাদ্দিন যখন আপনার সঙ্গে রয়েছি তখন কিছুটা জ্ঞানগম্মি ত হয়েইছে।’

আমরা সেদিনই কলকাতায় ফিরে এলাম। কথা হল পরদিন সকাল ন’টায় লালমোহনবাবু আমাদের বাড়ি আসবেন, ফেলুদা তাঁকে কিছুটা তালিম দিয়ে দেবে, তারপর দশটা নাগাদ আমরা দুজনে যাব অপ্সরা থিয়েটার।

পরদিন সকালে ফেলুদার কাছে তালিম নিয়ে আমরা ঠিক দশটায় পৌঁছে গেলাম অপ্সরা থিয়েটারে। লালমোহনবাবুর গদগদ ভাব, বললেন, ‘আমার অনেকদিনের আপশোষ ছিল যে তোমার দাদাকে আরেকটু সক্রিয় ভাবে সাহায্য করতে পারি না। এইবারে তার সুযোগ এসেছে।’ ভদ্রলোক আজ ধুতি পাঞ্জাবীর বদলে প্যান্ট শার্ট পরে এসেছেন; বললেন এতে কাজটা অনেক চটপটে হয়। ‘ওভারনাইট কার্ড ছাপিয়ে নিলুম আমার নামে, দেখতে কেমন হয়েছে।’

কার্ড নিয়ে দেখি তাতে ইংরিজিতে লেখা রয়েছে ‘লালমোহন গাঙ্গুলী, রাইটার।’

‘দিব্যি হয়েছে’, আমি বললাম।

দারোয়ানের হাতে একটা কার্ড ম্যানেজারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হল, তিন মিনিটের মধ্যে আমাদের ডাক পড়ল।

কৈলাসবাবুকে দেখে মনেই হল না আমাদের উনি চিনতে পেরেছেন। বেশ রুক্ষভাবেই বললেন, ‘শুনুন, আমার এখানে এখন বিশেষ গোলমাল। আপনি যদি নতুন নাটক নিয়ে এসে থাকেন ত সে অন্য সময় হবে। এই কটা দিন বাদ দিন।’

লালমোহনবাবু জিভ কেটে বললেন, ‘নতুন নাটক নয় স্যার; আমি এসেছি প্রদোষ মিত্র প্রাইভেট ইনভেসটিগেটরের প্রতিভূ হয়ে। উনি অসুস্থ, তাই নিজে আসতে পারলেন না। উনি এর আগে মহীতোষ রায়ের ব্যাপারে একবার আপনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তখন আমিও এসেছিলাম ওঁর সঙ্গে।’

‘হ্যাঁ—মনে পড়েছে। তা আপনি কী জানতে চাইছেন? খবরের কাগজে যা বেরিয়েছে তার বেশি কিছু বলার নেই।’

‘একটা প্রশ্ন ছিল—নেপালবাবুও কি মহীতোষবাবুর মতো হুম্‌কি চিঠি পেয়েছিলেন?’

‘পেয়েছিল, তবে সে বিষয় প্রথম কদিন চেপে রেখেছিল। কোনো পাত্তা দেয়নি। তারপর তিনদিন আগে প্রথম আমাকে বলে। চিঠি পাচ্ছিল প্রায় দশদিন থেকে।’

‘সে চিঠি আপনি দেখেছেন?’

‘দু-তিনটে দেখেছি। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। হুম্‌কি চিঠি যেরকম হয় সেরকমই আরকি। আমি ওকে সাবধানে থাকতে বলি, কিন্তু নেপাল মঞ্চে হিরো সাজত বলে নিজেকেও একটা হিরো বলে মনে করত। সে বলে, “এসব হুম্‌কিতে আমি ঘাবড়াই না”।

‘তিনি থাকতেন কোথায়?’

‘নকুলেশ্বর ভট্টাচার্য লেনে; সাতাশ নম্বর।’

‘উনি কি বিবাহিত ছিলেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘কাগজে লিখেছে উনি ওঁর এক বন্ধুর বাড়ি যাবেন বলে ট্যাক্সি থেকে নেমেছিলেন। এই বন্ধুটি কে আপনি জানেন?’

‘গলিতে বাড়ি বলে যখন বলছে তখন শশধর চাটুজ্যে বলে মনে হয়। সেও অভিনেতা, রূপম্‌ থিয়েটারে অভিনয় করে।’

‘অপ্সরা থিয়েটারে ওঁর কোনো শত্রু ছিল না?’

‘সে আর আমি কি করে বলব বলুন। প্রধান অভিনেতাকে সকলেই ঈর্ষা করে। সে অর্থে শুধু আমাদের থিয়েটারে কেন, অন্য থিয়েটারেও নেপালের শত্রু ছিল। তাকে সরাতে পারলে আমার থিয়েটার কানা হয়ে যাবে এটা অনেকেই জানত।’

‘আপনাদের থিয়েটার কি তাহলে এখন বন্ধ?’

‘আজ প্রফুল্লর লাস্ট শো ছিল—সেটা আর হবে না। আমরা ত নতুন নাটক আলমগীর নামাবো বলে তোড়জোড় করছিলাম। নাম ভূমিকায় ত নেপালেরই করার কথা ছিল। এখন অন্য অ্যাকটরকে ট্রাই করা হচ্ছে। একজন নতুন লোক এসেছে।’

‘কেমন?’

‘মন্দ নয় বোধহয়। দাড়ি গোঁফ নিয়ে আলমগীর সাজবার চেহারা নিয়ে চলে এসেছে। তার আর মেক-আপ লাগবে না।’

এবার আমার একটা কথা মনে পড়ল। বললাম, ‘এখানকার মেন অ্যাকটরদের বাড়ির ঠিকানাগুলো নিয়ে নিন। ফেলুদা হয়ত ওদের কারুর কারুর সঙ্গে কথা বলতে চাইবে।’

‘হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছ’, বললেন লালমোহনবাবু।

কৈলাসবাবুকে বলতে আবার ঘণ্টা টিপে ওর সেক্রেটারিকে আনিয়ে আমাদের সব নাম ঠিকানাগুলো আনিয়ে দিলেন।

‘যেই বন্ধুর বাড়িতে সেদিন নেপালবাবু যাচ্ছিলেন, তিনি কোথায় থাকেন বলতে পারেন?’

‘কাগজে দেখেননি? খুনটা হয়েছে মতি মিস্ত্রি লেনে। কাজেই তিনিও সেখানেই থাকতেন।’

আমরা ভদ্রলোককে আর বিরক্ত না করে উঠে পড়লাম। একবার মতি মিস্ত্রি লেনে শশধর চাটুজ্যের বাড়ি যাওয়া দরকার।