০৪. এগারো নম্বর রোল্যান্ড রোড

॥ ৪ ॥

এগারো নম্বর রোল্যান্ড রোড সাহেবী আমলের দোতলা বাড়ি। দরজার বেল টিপতে একজন উর্দিপরা বেয়ারার আবির্ভাব হল। সে কার্পেট ঢাকা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে আমাদের দোতলায় নিয়ে গিয়ে বৈঠকখানায় বসালো। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই মিঃ সেনগুপ্ত প্রবেশ করলেন। বাড়ির সঙ্গে মানানসই সাহেবী মেজাজ; পরনে ড্রেসিং গাউন, পায়ে বেডরুম স্লিপার, হাতে চুরুট।

পরিচয় পর্ব শেষ হলে পর ভদ্রলোক জিগ্যেস করলেন, ‘আপনারা ড্রিংক করেন?’

‘আজ্ঞে না’, বলল ফেলুদা।

‘আমি যদি বিয়ার খাই আশা করি আপনারা মাইন্ড করবেন না?’

‘মোটেই না।’

ভদ্রলোক বেয়ারাকে ডেকে নিজের জন্য বিয়ার আর আমাদের তিনজনের জন্য চায়ের অর্ডার দিয়ে ফেলুদার দিকে দৃষ্টি দিলেন। ফেলুদা বলল, ‘আপনি আমাকে কেন ফোন করতে যাচ্ছিলেন সেটা আগে বলতে আপনার কোনো আপত্তি আছে? তারপর আমি আমার দিকটা বলব।’

‘বেশ তো। জে. পি. চাওলার নাম শুনেছেন?’

‘ব্যবসাদার? গুরুপ্রসাদ চাওলা? যার নামে চাওলা ম্যানসনস?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাঁর এক নাতি তো—?’

‘হ্যাঁ। মিসিং। সম্ভবত কিড্‌ন্যাপ্‌ড।’

‘কাগজে দেখছিলাম বটে।’

‘গুরুপ্রসাদ আমার অনেকদিনের বন্ধু। পুলিশ তদন্ত করছে বটে, কিন্তু আমি ওকে আপনার নাম সাজেস্ট করি। ভুলু সেহানবিশের কাছে আপনার খুব সুখ্যাতি শুনেছি।’

‘হ্যাঁ, একটা ব্যাপারে ওঁকে আমি হেল্‌প করি।’

‘তাহলে চাওলাকে কী বলব?’

‘মিঃ সেনগুপ্ত, দুঃখের বিষয় আমি অলরেডি একটা কেস হাতে নিয়ে ফেলেছি।’

‘আই সী।’

‘আর সেই ব্যাপারেই আমি আপনার কাছে এসেছি।’

‘কী ব্যাপারে শুনি?’

‘আমি ডাঃ মুনসীর কাছ থেকে আসছি।’

‘হোয়াট!’

ভদ্রলোক সোফা থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন।—‘মুনসী আপনাকে আমার পরিচয় দিয়ে দিয়েছে? তার মানে তো আর কদিনে রাজ্যিসুদ্ধ লোক জেনে যাবে মুনসীর ডায়রির “এ” ব্যক্তিটি আসলে কে।’

‘মিঃ সেনগুপ্ত, আমি অত্যন্ত সাবধানী লোক। গোপন ব্যাপার কী করে গোপন রাখতে হয় তা আমি জানি। আমার উপর আপনি সম্পূর্ণ ভরসা রাখতে পারেন। তবে আপনি যদি ঘন ঘন ডাঃ মুনসীকে হুম্‌কি চিঠি দেন, তার ফল কী হবে সেটা আমি জানি।’

‘আমি হুম্‌কি চিঠি দেব না কেন? আপনি ডায়রিটা পড়েছেন?’

‘পড়েছি।’

‘আপনার কী মনে হয়েছে?’

‘ত্রিশ বছরের পুরানো ঘটনা। এর মধ্যে অন্তত শ’ পাঁচেক ব্যাঙ্কে তহবিল তছরুপ হয়েছে। যারা এ কাজ করেছে হয়ত তাদের অনেকেরই নামের প্রথম অক্ষর “এ”। সুতরাং আপনার ভয় সম্পূর্ণ অমূলক।’

‘মুনসী কি ব্যাঙ্কের নাম করেছে?’

‘না।’

‘আমার ব্যাঙ্কে দুজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিল যারা চুরির ব্যাপারে আমাকে সন্দেহ করে, কারণ ঠেকায় পড়ে আমি দুজনের কাছে টাকা ধার চেয়েছিলাম। দুজনেই অবিশ্যি রিফিউজ করে।’

‘মিঃ সেনগুপ্ত, আমি আবার বলছি—আপনার ভয়ের কোনো কারণ নেই। আর এই ধরনের চিঠি দিয়ে আপনার লাভটা কী হচ্ছে? ডাঃ মুনসী আইনের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ নিরাপদ। অর্থাৎ আপনি কোনো লিগ্যাল স্টেপ নিতে পারছেন না। তাহলে কি আপনি আইনের বাইরে কোনো রাস্তা ভাবছেন?’

‘আমার বিপদের আশঙ্কা দেখলে আমি আইন-টাইন মানব না মিঃ মিত্তির। আমার অতীতের ইতিহাস থেকেই আপনি বুঝছেন যে প্রয়োজনে বেপরোয়া কাজ করতে আমি দ্বিধা করি না।’

‘আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, মিঃ সেনগুপ্ত। তখনকার আপনি আর এখনকার আপনি কি এক? আজ আপনি সমাজে সম্মানিত’ব্যক্তি। এই অবস্থায় আপনি এমন একটা ঝুঁকি নেবেন?’

মিঃ সেনগুপ্ত মিনিট খানেক কিছু না বলে কেবল চুক্‌ চুক্‌ করে বিয়ার খেলেন। তারপর তাঁর চাউনির সামান্য পরিবর্তন দেখা গেল। তারপর তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক চুমুকে বাকি বিয়ারটা শেষ করে গেলাসটা টেবিলে রেখে বললেন, ‘ঠিক আছে—ড্যাম ইট! লেট হিম গো অ্যাহেড।’

‘আপনি তাহলে হুম্‌কির ব্যাপারে ইতি দিচ্ছেন?’

‘ইয়েস ইয়েস ইয়েস!—তবে বিপদের বিন্দুমাত্র আশঙ্কা দেখলেই কিন্তু’—

‘আর বলতে হবে না’, বলল ফেলুদা, ‘বুঝেছি।’