পাশাপাশি এগারোটি ক্রায়োজেনিক সিলিন্ডার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রত্যেকটার ভেতরে একজন করে মানুষ। নিয়ন্ত্রণকক্ষে বড় প্যানেলের সামনে দুজন দাঁড়িয়ে আছে। একজন মাথা ঘুরিয়ে পেছনে দাঁড়ানো ক্যাপ্টেন ক্রবকে জিজ্ঞেস করল, আমি কি শীতল করতে শুরু করব?
হ্যাঁ। কর।
মানুষটি মাইক্রোফোনের বোতামটি স্পর্শ করে বলল, তোমাদের দেহকে শীতল করার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। বিষয়টি তোমাদের জন্যে অনেক সহজ হবে যদি তোমরা আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোন। শরীরকে শীতল করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তোমাদের শরীরে স্বাভাবিক রক্ত সঞ্চালন হওয়ার জন্যে আমরা চাই তোমরা সবাই তোমাদের হাত দুটি বুকের ওপর নিয়ে এসো, বাম হাতের ওপর ডান হাতটি রাখ।।
এগারোজন বন্দীর ভেতর মাত্র চারজন সেই নির্দেশ অনুযায়ী হাত দুটো বুকের ওপর আনল। য়ুহা মনিটরগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল, সে দেখল মধ্যবয়স্ক রূঢ় ধরনের মানুষটি মুখ বিকৃত করে একটা অশালীন শব্দ উচ্চারণ করেছে। য়ুহা মাথা ঘুরিয়ে রায়ীনার দিকে তাকালো, মেয়েটি দুই হাত সামনে এনে হাতের আঙুলে কিছু একটা গুনছিল, সে মাইক্রোফোনে দেয়া নির্দেশটি শুনেছে বলে মনে হলো না।
কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে দাঁড়ানো মানুষটি মাইক্রোফোনের কাছে মুখ এনে নিচু গলায় বলল, আমরা এখন তোমাদের সিলিন্ডারে নিহিলা গ্যাসের মিশ্রণ পাঠাচ্ছি। তোমাদের শরীর অবসন্ন হয়ে আসবে, চোখের পাতা ভারি হয়ে আসবে। তোমাদের শরীরের জন্যে পুরো বিষয়টি সহজ হবে যদি তোমরা পুরো শরীরটাকে ঢিলে করে রাখ, স্নায়ুকে নরম করে রাখ। আমি এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনব তার মাঝে তোমাদের সবার চোখে ঘুম নেমে আসার কথা।
কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি নিচু গলায় গুনতে শুরু করে, এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ-ছয়…
য়ুহা দেখতে পায় দশ পর্যন্ত গোনার অনেক আগেই একজন একজন করে সবাই অচেতন হয়ে পড়ছে। সবার শেষে অচেতন হলো রায়ীনা এবং অচেতন হওয়ার পরও তার মস্তিষ্কে এক ধরনের কর্মকাণ্ডের স্ক্যান দেখা যেতে লাগল।
ক্যাপ্টেন ক্ৰব বলল, এই মেয়েটা একটু অন্য রকম।
য়ুহা জানতে চাইল, কী রকম?
সব সময় কিছু না কিছু চিন্তা করছে। মস্তিষ্কটাকে ব্যবহার করছে।
কী নিয়ে চিন্তা করছে বলা সম্ভব?
কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি বলল, মস্তিষ্কের যে জায়গা থেকে সিগন্যাল আসছে সেটা গাণিতিক চিন্তাভাবনার জায়গা। মেয়েটা সম্ভবত কোনো গাণিতিক সমস্যার কথা ভাবছে।
য়ুহা অবাক হয়ে বলল, মেয়েটা অচেতন হয়েও ভাবছে।
ক্যাপ্টেন জব বলল, আমরা সবাই ভাবি। কেউ বেশি কেউ কম।
কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি ক্যাপ্টেন ক্ৰবের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আমি এদের ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রায় নেবার অনুমতি চাইছি ক্যাপ্টেন ক্ৰব।
ক্যাপ্টেন ক্ৰব অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, অনুমতি দিলাম।
মানুষটি প্যানেলের একটি বোতাম স্পর্শ করতেই মৃদু একটা হিস হিস শব্দ শোনা যেতে থাকে, সিলিন্ডারগুলোর পাশ থেকে এক ধরনের সাদা ধোয়া বের হতে শুরু করে। য়ুহা ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হচ্ছে?
কিছু না।
সাদা ধোয়াগুলো কী?
জলীয় বাষ্প। সিলিন্ডার থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে।
তাদের শরীর কী শীতল হতে শুরু করেছে?
হ্যাঁ। শুরু করেছে। মানুষটি মনিটরের এক জায়গায় হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, এইখানে তাদের শরীরের তাপমাত্রা দেখতে পাবে।
য়ুহা দেখতে পায় খুব ধীরে ধীরে তাদের শরীরের তাপমাত্রা কমে আসছে। ঠিক কী কারণে জানা নেই সে নিজের বুকের ভেতরে এক ধরনের বেদনা অনুভব করে। একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, পুরোপুরি শীতল হতে কতক্ষণ সময় নেবে?
দুই থেকে তিন ঘণ্টার মাঝে করার নিয়ম। আমরা হয়তো আরো একটু তাড়াতাড়ি করব।
দুই ঘণ্টা পর য়ুহা শীতলঘরটিতে আবার ফিরে এসে প্যানেলগুলোর দিকে তাকালো। এগারোজন মানুষকে এগারোটি পাথরের মূর্তির মতো দেখাচ্ছে। তাদের শরীরে প্রাণের স্পন্দন দূরে থাকুক কোনো ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার কোনো চিহ্ন নেই। য়ুহা দীর্ঘ সময় রায়ীনার নিষ্প্রাণ মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটির দেহে সত্যি কি আবার প্রাণ সঞ্চার করা যাবে? সেটি কি এই মেয়েটির জন্যে একটি জীবনের শুরু হবে না কি একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের শুরু হবে?
য়ুহা কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে জিজ্ঞেস করল, এই এগারোজনকে দেখে-শুনে রাখবে কে?
আমাদের কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক।
য়ুহা ভুরু কুঁচকে বলল, যদি কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কে কোনো সমস্যা হয়
মানুষটি শব্দ করে হেসে বলল, সমস্যা হবে না।
যদি হয়।
হবে না।
আমি কথার কথা বলছি। যদি হয়?
মানুষটি বলল, তুমি কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক সম্পর্কে জান না বলে এ রকম বলছ। কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কে কখনো সমস্যা হয় না। এখানে চারটি স্তর আছে। একটি স্তর নষ্ট হলে অন্যটা দায়িত্ব নেয়। সেটা নষ্ট হলে অন্যটা। যখন কোনো স্তর নষ্ট হয় সেটা নিজে থেকে নিজেকে সারিয়ে নেয়। অনেকটা জৈবিক প্রাণীর মতো শুধু প্রাণী থেকে অনেক বেশি চৌকস!
য়ুহা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, যদি কেউ কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক একটা নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেয় তাহলে কি এই এগারোজন মারা যাবে?
না। মারা যাবে না। এই সিলিন্ডারের যে ব্যাকআপ সিস্টেম আছে সেটা দায়িত্ব নেবে। তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। মানুষটি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এ রকম অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন কেন জিজ্ঞেস করছ?
রুহা মাথা নাড়ল, বলল, মোটেও অদ্ভুত প্রশ্ন নয়। এগুলো অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। এগারোজন মানুষের জীবনের দায়িত্ব খুব সহজ দায়িত্ব নয়।
মানুষটি হা হা করে হেসে বলল, এই কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক পুরো মহাকাশযানটা মহাকাশে উড়িয়ে নেবে। শুধু এই এগারোজন নয় আমাদের সবার জীবনের দায়িত্ব কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের।
য়ুহা মাথা নেড়ে বলল, ভাগ্যিস আমার কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক হয়ে জন্ম হয়নি–আমি কখনো এত বড় দায়িত্ব নিতে পারতাম না!
মানুষটি হেসে বলল, কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার এই দায়িত্বটি নেয়। রুটিনমাফিক নেয়।