এখনও ভাল করে আলো ফোটেনি। ঠিক যেন একটা পাতলা চাঁদরের মতো অন্ধকার গুটিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। জেগে উঠছে পাখিরা। কতরকম ডাক তাদের। ছোট্ট ছোট্ট পাখিগুলো কী জোর শিস দিতে পারে।
একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে গাছপালা। কাল সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে গাছগুলো আজ একেবারে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন।
একটাই রাস্তা ঘুরে ঘুরে উঠে গিয়েছে পাহাড়ের উপরের দিকে। পরপর দুটো গাড়ি, সামনেরটা কর্নেলের, পিছনের জিপটা বনবিভাগের। ফরেস্ট রেঞ্জার ত্রিলোক সিংহ উঠেছেন কর্নেলের গাড়িতে। ওঁর জন্ম জলপাইগুঁড়িতে, তাই ভালই বলতে পারেন বাংলা।
খানিকটা উপরে উঠে দেখা গেল, আকাশ একেবারে নীল, একটুও মেঘ। নেই, পুব দিকে লাল রঙের ছোপ ধরেছে। এখনই সূর্য উঠবে।
জোজো বলল, ওঃ, কতদিন সানরাইজ দেখিনি। হাউ বিউটিফুল!
সন্তু বলল, দাঁড়া, দাঁড়া, এখনও তো সানরাইজ হয়নি। আগেই বিউটিফুল বলে ফেললি?
কাকাবাবু বললেন, সত্যি, অনেক দিন সূর্যোদয় দেখা হয়নি। কর্নেল, গাড়িটা একটু দাঁড় করান। ভাল করে দেখি।
অনেক দূরেও একটা পাহাড়ের ঢেউ। তার আড়াল থেকে উঠে আসছে। প্রথম সূর্যের ছটা। সমস্ত গাছের পাতায় এখন লাল রঙের আভা। প্রতি মিনিটে একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে সব কিছু।
অনেক দূরে পিয়াও পিয়াও করে ডেকে উঠল একটা ময়ূর।
কর্নেল বললেন, ঝরনাটার কাছে কয়েকটা গুহামতো আছে। ওই দিকটায় আগে খোঁজ করতে হবে। বাঘটা দিনেরবেলা ওখানে লুকিয়ে থাকতে পারে।
কাকাবাবু বললেন, কর্নেলসাহেব, আমরা জঙ্গলে এসে শুধু জন্তুজানোয়ার খুঁজি। প্রত্যেক জঙ্গলের যে নিজস্ব রূপ আছে, তা আমাদের চোখেই পড়ে না।
ত্রিলোচন সিংহ বললেন, স্যার, আজ বোধহয় আমাদের শুধু জঙ্গলের রূপ দেখেই ফিরে যেতে হবে। বাঘ দেখার কোনও আশা নেই।
কর্নেল বললেন, সে কী মশাই, আপনি আগেই এই কথা বলছেন কেন?
ত্রিলোচন সিংহ বললেন, আমি এখানে তিন বছরের জন্য পোস্টেড। এই তিন বছরে কখনও এদিকের কোনও জঙ্গলে বাঘ দেখিনি। বাঘের কথা শুনিওনি। মাঝে মাঝে গুজব ওঠে অবশ্য, তার কোনওটাই সত্যি বলে প্রমাণিত হয়নি। আমার দৃঢ় ধারণা, এ অঞ্চলে কোনও বাঘ নেই। মাণ্ডু শহরে বাঘ ঢুকেছে বলে এখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
কর্নেল বললেন, এখন তো আর অবিশ্বাস করার উপায় নেই। পরপর দুদিন বাঘ হানা দিয়েছে, কয়েকটা জন্তু মেরেছে। বাঘ তো শিকারের খোঁজে বহু দূর দূর পর্যন্ত চলে যায়। এক জঙ্গল থেকে আর-এক জঙ্গলে চলে আসে, তাই না! হয়তো সেই রকমই এই বাঘটা অনেক দূর থেকে এসে পড়েছে।
জোজো বলল, আমাদের সুন্দরবনে বাঘেরা নদী সাঁতরে ওদিকের বাংলাদেশে চলে যায়। ওদিকেও একটা সুন্দরবন আছে। বাঘ তো সীমান্তটিমান্ত কিছু মানে না!
ত্রিলোচন সিংহ তবু বললেন, আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারব না।
কাকাবাবু বললেন,আমার কী মনে হয় জানেন? ওই যে রহস্যময় চোর, তাকে ধরে ফেলতে পারলে তার কাছ থেকে বাঘটার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।
ত্রিলোচন সিংহ বললেন, চোর ধরা পুলিশের কাজ। আমাদের সেটা কাজ নয়। আমাদের কারবার বুনো জন্তু-জানোয়ার নিয়ে।
কর্নেল কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এ কথাটা কেন বলছেন? চোরের সঙ্গে বাঘের কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
কাকাবাবু বললেন, সম্পর্ক থাকবেই, তা আমি বলছি না। তবে, যেখানেই বাঘ, সেখানেই চোর, এটা শুনে আমার মানিকরামের ঘটনা মনে পড়ছে। আপনি জানেন সে ঘটনা? বছর দুয়েক আগে, আমাদের কলকাতার কাছে সল্টলেকে আর উলটোডাঙায় হঠাৎ খুব চোরের উপদ্রব শুরু হয়েছিল। রহস্যময় চুরি। ফ্ল্যাটবাড়ির আটতলা, দশতলা। সেই সব ঘর থেকেও চুরি। দরজা বন্ধ, তবু। গরমকালে অনেকেই জানলা কিংবা বারান্দার দরজা খুলে রাখে। অত উঁচুতে তো চোর উঠতে পারে না। তবু চুরি হতে লাগল। টাকাপয়সা, গয়না। শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ল, চোর একটা বাঁদর। সে পাইপ বেয়ে উপরে উঠে আসে। তারপর কোনও দরজা বা জানলা খোলা পেলে ঢুকে পড়ে। কোনও শব্দও হয় না।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, বাঁদর? সে গয়না কিংবা টাকাপয়সা নেবে কেন?
কাকাবাবু বললেন, সেই হচ্ছে কথা। ওই বাঁদরটার নামই মানিকরাম। আসলে ওটা একটা পোষা বাঁদর। যে-লোকটা পুষেছে, সে বাঁদরটাকে ট্রেনিং দিয়েছে টাকাপয়সা, গয়না চুরি করার।
ত্রিলোচন সিংহ বললেন, তার মানে, আপনি কী বলতে চান, একজন কেউ একটা বাঘ পুষেছে, আর তাকে দিয়ে চুরি করাচ্ছে? অত সোজা নয়। আজ পর্যন্ত কেউ বাঘ পুষতে পারেনি। আর বাঘ কখনও চুরি করতে শিখবেও না। মানুষই চুরি করে, বাঘ চুরিটুরির ধার ধারে না।
কাকাবাবু বললেন, বাঘ কেন চুরি করবে? চোরটা বাঘ নিয়ে গিয়ে মানুষদের ভয় দেখায়, তারপর নিজেই চুরি করে।
কর্নেল বললেন, কিন্তু এত সব কাণ্ড করে চোরটা শুধু দু-এক প্যাকেট বিস্কুট আর দুধ নেবে, টাকাপয়সা ছোঁবে না! এ কি চোর না সাধু?
এবার কাকাবাবু নিজেই হো হো করে হেসে উঠে বললেন, এই ধাঁধাটার উত্তর আমি এখনও জানি না। নিশ্চয়ই একটা কিছু উত্তর আছে।
ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরি করা হল জঙ্গলে। বাঘের কোনও নামগন্ধ নেই। চোখে পড়ল দু-চারটে খরগোশ আর ময়ূর। এক জায়গায় একদঙ্গল বাঁদর। তারা মনের সুখে লাফালাফি করছে।
ঝরনাটার কাছে গাড়ি থেকে নেমে দেখা হল ভাল করে। সেখানে গুহা ঠিক নেই, কয়েকটা বড় বড় পাথর, মাঝে একটু একটু ফাঁক। কিছু নেই সেখানে।
ক্রমশ রোদ চড়া হচ্ছে।
ত্রিলোচন সিংহ বললেন, এবার বোধহয় আমাদের ফিরতে হবে। বেশি রোদে কোনও প্রাণীই বেরোতে চায় না। আর ঘোরাঘুরি করে লাভ নেই।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, ফেরাই উচিত। আমার কাজের লোক ফ্লাস্কে চা আর স্যান্ডউইচ দিয়ে দিয়েছে। কোনও একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে খেয়ে নেওয়া যাক।
কাকাবাবু বললেন, একটা ফাঁকা জায়গা দেখে থামুন।
কর্নেল গাড়িটা আস্তে আস্তে চালিয়ে ফাঁকা জায়গা খুঁজছেন, হঠাৎ সামনের রাস্তায় তিড়িং তিড়িং করে দুবার লাফিয়ে একটা হরিণ এদিক থেকে ওদিকে চলে গেল।
ত্রিলোচন সিংহ উত্তেজিতভাবে বললেন, দেখলেন, দেখলেন, একটা হরিণ!
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, দেখলাম তো সবাই। ত্রিলোচন সিংহ বললেন, এই জঙ্গলে হরিণ আছে। তার মানে বাঘের খাবার আছে। বাঘ তা হলে হরিণ না মেরে শহরে ঢুকে ছাগল-মোষ মারার ঝুঁকি নিতে যাবে কেন? এটা তো বাঘের স্বভাব নয়?
কর্নেল বললেন, একটা কারণ থাকতে পারে। যদি বাঘটা বুড়ো হয় কিংবা আহত হয়, তা হলে আর হরিণের সঙ্গে দৌড়ে পারে না। তখন দড়ি দিয়ে বাঁধা পোষা জন্তু-জানোয়ার মারাই তো ওদের পক্ষে সহজ!
ত্রিলোচন সিংহ বললেন, বুড়ো বাঘ যদি মানুষের কাছাকাছি যায়, তা হলে মানুষ আর কতদিন তাকে ভয় পাবে? মানুষই একদিন তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। তখন আর আমাদের কিছু করার থাকবে না।
স্যান্ডউইচের প্যাকেটটা খুলে কাকাবাবু বললেন, এ তো দেখছি অনেক খাবার। পিছনের গাড়ির লোকদেরও ডাকুন। ওরাও খাবে।
ত্রিলোচন সিংহ বললেন, ওরাও নিজেদের খাবার এনেছে। পুরি আর ভাজি। ওদের ডাকার দরকার নেই।
গাড়িটা থেমেছে সুন্দর জায়গায়। সামনে অনেকখানি খাদ। তারপর নীচে দেখা যাচ্ছে উপত্যকা। খানিক দূরে রুপোলি রঙের নর্মদা নদী।
সবাই নেমে পড়েছে গাড়ি থেকে। সন্তু আর জোজো লাফিয়ে লাফিয়ে একটা গাছের ডাল ছোঁওয়ার চেষ্টা করছে।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে কাকাবাবু ত্রিলোচন সিংহকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা যে ফাঁদ পেতে বাঘ ধরেন শুনেছি, সেটা ঠিক কী ব্যাপার? মাটিতে গর্ত করতে হয়?
ত্রিলোচন বললেন, না, না, ওসবের দরকার হয় না। বাঘটাকে একবার স্পট করতে পারলে আমরা কাছাকাছি কোথাও ওয়েট করি। দলে তিনচারজন থাকলে ভয়ের কিছু থাকে না। দলের একজন শুয়োরের ডাক নকল করে ডাকতে পারে। তাই শুনে বাঘটা কাছে এলেই তার উপর জাল ছুড়ে দেওয়া হয়। সেই জালে আটকা পড়লেই বাঘ কাবু হয়ে যায়।
কাকাবাবু বললেন, যদি জালটা ঠিকমতো বাঘের গায়ে না পড়ে?
ত্রিলোচন বললেন, ওই গাড়িতে আছে সুরজমল নামে একজন, সে দারুণ এক্সপার্ট। সুরজমল কখনও মিস করে না।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এইভাবে আপনারা কটা বাঘ ধরেছেন?
ত্রিলোচন হেসে বললেন, বললাম না, তিন বছরে এখানে একটাও বাঘ দেখিনি। ধরব কী? তবে, যখন আমি চিত্রকূটে পোস্টেড ছিলাম, সেখানে একটা লেপার্ড ধরেছি, সেটা দারুণ হিংস্র ছিল। এই সুরজমলও ওখানে ছিল তখন, আমার সঙ্গে ট্রান্সফার হয়ে এসেছে।
কাকাবাবু বললেন, বাঘটা ধরার পর কী করেন?
ত্রিলোচন বললেন, জালে বেঁধে ওকে গাড়ির মাথায় তোলা হয়। তারপর সোজা চিড়িয়াখানায়।
কর্নেল খাদের ধার দিয়ে হাঁটছিলেন, এবারে কাকাবাবুর কাছে এসে বললেন, রায়চৌধুরীবাবু, একটা আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন?
কাকাবাবু বললেন, কীসের আওয়াজ?
কর্নেল বললেন, কেউ যেন চিৎকার করছে। মানুষের গলা।
কাকাবাবু কানখাড়া করে শোনার চেষ্টা করে বললেন, আমি শুনতে পাচ্ছি না। কোন দিক দিয়ে আসছে আওয়াজটা?
কর্নেল বললেন, ওই খাদের তলা থেকে। কোনও মানুষ নীচে পড়েটড়ে গিয়েছে নাকি?
কাকাবাবু বললেন, চলুন, দেখা যাক।
সবাই মিলে খাদের ধারে এসে উঁকি দিলেন।
কর্নেল ডান দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বললেন, এই দিকে আসুন। এখানে শোনা যাচ্ছে।
ডান দিকে আরও খানিকটা এগোনোর পর আওয়াজটা একটু স্পষ্ট হল। কেউ যেন কাঁদছে।
একটা সরু পায়েহাঁটা রাস্তা নেমে গিয়েছে খাদের নীচের দিকে। এখানে খাদটা খুব গভীর নয়, খানিকটা নীচেই কিছুটা সমতল জায়গা, সেখানে কয়েকটা বড় বড় গাছ।
সন্তু সেই রাস্তাটা দিয়ে নেমে গেল। উপর থেকে সবাই দেখছে।
সন্তু এক জায়গায় থেমে একটা হাত তুলে বলল, আওয়াজটা আসছে। ওই বড় গাছটা থেকে। ওখানে কেউ বসে আছে।
এবার কর্নেল আর ত্রিলোচন সিংহও নেমে গেলেন সেদিকে। কাকাবাবুর পক্ষে ঢালু রাস্তায় নামা মুশকিল, তবু তিনি ক্র্যাচে ভর দিয়ে নামতে লাগলেন কষ্ট করে।
বড় গাছটায় অনেক ডালপালা, ওপরের দিকটা পাতায় ঢাকা। সেই গাছের তলা পর্যন্ত গিয়ে সন্তু বলল, এখন দেখতে পাচ্ছি। একটা ছেলে বসে আছে। ওখানে।
এবার সে আরও জোরে কেঁদে উঠে কী যেন বলতে লাগল। তার ভাষা বোঝা যাচ্ছে না।
ত্রিলোচন সিংহ গাছের তলায় গিয়ে তাকে কী সব জিজ্ঞেস করলেন।
তারপর কাকাবাবুদের দিকে ফিরে বললেন, ছেলেটা একটা অদ্ভুত কথা বলছে। ও নাকি একটা শেরের প্রায় সামনাসামনি পড়ে গিয়েছিল, তাই তাড়াতাড়ি গাছে উঠে গিয়েছে। এখন ভয়ে নামতে পারছে না।
এতক্ষণ জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করে বাঘের লেজও দেখা যায়নি। ধরেই নেওয়া হয়েছিল, বাঘ এখানে নেই। এখন ছেলেটা বলছে…ও কী দেখতে
কী দেখেছে কে জানে!
কর্নেল চেঁচিয়ে বলল, উতরো, উতরো। ডর নেহি। মেরে পাস রাইফেল হ্যায়।
এবারে ছেলেটা প্রায় সরসর করে নেমে এল নীচে। ষোলো-সতেরো বছর বয়স, রোগা, কালো চেহারা, শুধু একটা নেংটি পরা, খালি গা।
জোজো কাকাবাবুকে বলল, ছেলেটা এই জঙ্গলে একা একা ঢুকেছে। ওর সাহস তো কম নয়।
কাকাবাবু বললেন, বুঝতেই তো পারছ, ওরা খুব গরিব। শুকনো কাঠ কুড়োতে জঙ্গলে আসে। সেই কাঠ বিক্রি করে ওরা চাল-ডাল কেনে। সাহস থাকলে ওরা বাঁচবে কী করে?
কর্নেল ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কোথায় শের দেখেছিস?
ছেলেটার মুখ এখনও ভয়ে শুকিয়ে আছে। সে একদিকে হাত দেখাল। সেটা ফাঁকা জায়গা।
এখানে গুহাটুহাও কিছু নেই। শুধু একটা বড় গাছ ঝড়ে উলটে পড়ে আছে। একদিকে।
ত্রিলোচন সিংহ বললেন, আমরা এত চেষ্টা করেও শের দেখতে পেলাম। আর তুই দেখে ফেললি? শুয়োরটুয়োর কিছু দেখিসনি তো?
সন্তু বলল, কাল অত বৃষ্টি হয়েছে, বাঘ এলে তো পায়ের ছাপ থাকবে।
কর্নেল বললেন, সবই তো পাথর, এখানে আর পায়ের ছাপ পড়বে কী করে?
পাথর হলেও এক জায়গায় কিছু ঘাসও আছে। সেখানে পায়ের ছাপ পাওয়া যায় কি না, সন্তু তা দেখতে লাগল উবু হয়ে।
ত্রিলোচন সিংহ ছেলেটিকে বললেন, চল আমাদের সঙ্গে। আজ আর তোকে কাঠ কুড়োতে হবে না। আমি তোকে অন্য কাজ দেব।
হঠাৎ শোনা গেল বুক কাঁপানো বাঘের গর্জন। ভেঙে পড়া গাছটার আড়াল থেকে একলাফে চলে এল একটা বাঘ। সত্যিকারের বাঘ।
সরু রাস্তাটা দিয়ে কাকাবাবু পুরোটা নীচে নামেননি। দাঁড়িয়ে আছেন মাঝখানে। জোজো তাঁর পাশে। ত্রিলোচন সিংহ সবেমাত্র কাঠ-কুড়োনো ছেলেটার কাঁধে হাত দিয়ে উপরে উঠতে শুরু করেছেন, আর একটু নীচে কর্নেল, আর সন্তু বসে আছে সেই ঘাসের পাশে।
এই সময় বাঘের আবির্ভাব।
সবাই কয়েক মুহূর্তের জন্য ছবির মতন চুপ। কে কী করবে বুঝতে পারছেন না।
ত্রিলোচন সিংহ ফিসফিস করে বললেন, এ তো একটা বেশ বড় বাঘ। না, বাঘিনি, বুড়ি হয়ে গিয়েছে। এরা খুব হিংস্র হয়। মানুষকে অ্যাটাক করতে পারে।
বাঘিনিটা থাবা গেড়ে বসে গর-র গর-র করছে। এত মানুষজন দেখে ভয় পাওয়ার বদলে সে বোধহয় বিরক্ত হয়েছে খুব। তার খুব কাছে সন্তু।
ত্রিলোচন সিংহ এবার চেঁচিয়ে উঠলেন, সুরজমল, জালটা নিয়ে এসো। জালটা।
বনবিভাগের লোকরা দাঁড়িয়ে আছে খাদের ওপারে।
সন্তু উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই বাঘিনিটা লাফ দিল তার দিকে। সন্তুর ঘাড়ে যদি সে পড়ত, তা হলে আর তার রক্ষে ছিল না। কিন্তু ঠিক সময়ে সন্তুও সরে গিয়েছে অন্য দিকে।
ত্রিলোচন সিংহ এবার আরও জোরে চেঁচিয়ে বললেন, কর্নেলসাহেব, মারুন, ওকে মারুন।
কর্নেল এর মধ্যে রাইফেল তাক করেছেন। গুলি চালালেন ঠিক দুবার।
বাঘিনিটা প্রচণ্ড গর্জন করে দুপায়ে উঠে দাঁড়াল একবার, কিন্তু আর লাফাতে পারল না। ধপ করে পড়ে গিয়ে কাঁপল কয়েকবার, ঘোলাটে হয়ে গেল চোখ। তারপর একেবারে নিঃস্পন্দ।
জোজো বলে উঠল, শেষ? খতম।
ত্রিলোচন সিংহ বললেন, স্যার, আপনার হাতের টিপ তো দারুণ। ঠিক সময় মেরে ফেলেছেন। নইলে, সন্তু ছেলেটিকে বাঁচানো যেত না।
রাইফেলের নলের ডগায় ফুঁ দিতে দিতে কর্নেল গম্ভীরভাবে বললেন, আমি জীবজন্তু মারা অনেক দিন ছেড়ে দিয়েছি। এবারও মারিনি। মিস্টার সিংহ, যে-জিনিস আপনাদের কাছে থাকা উচিত ছিল, তা আমি নিজের কাছে রাখি। ঘুমের বুলেট। বাঘিনিটা মরেনি, দু-তিন ঘণ্টার জন্য নিশ্চিন্ত, ও অজ্ঞানের মতো ঘুমোবে।
সন্তু নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। সে জিজ্ঞেস করল, ঘুমোচ্ছে?
কর্নেল বললেন, কাছে গিয়ে দেখো, নাক দিয়ে নিশ্বাস পড়ছে কি না! আই অ্যাম শিয়োর, ও ঘুমোচ্ছে।
জোজো চেঁচিয়ে বলল, সন্তু, এদিকে চলে আয়।
সন্তু তবু বাঘিনিটার কাছে গিয়ে নাকে হাত নিয়ে বলল, হ্যাঁ, নিশ্বাস পড়ছে।
ত্রিলোচন সিংহ বললেন, উফ, যদি গুলি চালাতে একটু দেরি হত…ভাবতেও এখনও ভয় করছে।
কর্নেল বললেন, আমরা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। বাঘ নিয়ে এরকম ছেলেখেলা করা উচিত হয়নি। জঙ্গলে সব সময় সাবধানে থাকতে হয়। আমরা ওই কাঠুরে ছেলেটার কথা বিশ্বাস করিনি। এখনই বাঘিনিটাকে জালে বেঁধে গাড়িতে তোলো।
কাকাবাবু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, ওদিকের ঝোপটা নড়ছে! সাবধান, সাবধান?
সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল।
সেই ঝোপটা থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল একটা বাচ্চা-বাঘ। কয়েক লাফে সে চলে এল বাঘিনিটার কাছে। সন্তুই এখনও সবচেয়ে কাছে, সে ঝাঁপিয়ে পড়ল সন্তুর উপরে।
কাকাবাবু বললেন, কর্নেল, গুলি করবেন না। গুলি করবেন না।
সন্তু এক ঝটকায় বাচ্চা-বাঘটাকে ফেলে দিল মাটিতে। তারপর সে-ও খুব অবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, এ কী! এটা তো বাঘ নয়!
এবারে বোঝা গেল, বাচ্চা-বাঘটা সত্যিই বাঘ নয়। একটা ছেলে। তার গায়ে বাঘের চামড়া জড়ানো। এখন মুখটা বেরিয়ে এসেছে। একটা দশ-বারো বছরের ছেলের মুখ।
ঠিক বাঘেরই মতন গরগর করে সে আবার উঠে সন্তুর একটা হাত কামড়ে ধরল। সন্তু এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমায় কামড়াচ্ছিস? এবার আমিও মারব কিন্তু!
কর্নেল কাছে গিয়ে বাঘের বাচ্চা নয়, মানুষের বাচ্চাটাকে এক চড় কষিয়ে বললেন, অ্যাই, তুই কে রে?
কাকাবাবু আপন মনে বললেন, মনে হচ্ছে, এই সেই বিস্কুট-চোর!