০৪. একজন লোক সকালবেলায়

একজন লোক সকালবেলায় একরকম, দুপুরে অন্যরকম, বিকেলে একেবারে আরও অন্যরকম। ধরা যাক লোকটার নাম রমেন বা শ্যামলী। সকালের রমেন বা শ্যামলী বেশ নরম সরম, উদারচেতা, হাস্যমুখ। দুপুরের রমেন বা শ্যামলী নানা উদ্বেগ ও চাপে তিরিক্ষি, রগচটা, মারমুখী এবং কঞ্জুষ। বিকেলের রমেন বা শ্যামলী ক্লান্ত, উদ্দেশ্যহীন, হতাশ, পর্যদস্ত। এই যে একজনেরই নানা প্রকাশ বা স্ফুরণ এটা ধরতে পারাই হচ্ছে চূড়ান্ত বিচক্ষণতা। রমেন বা শ্যামলীর মধ্যেও তফাত আছে। রমেন হয়তো সকালে তিরিক্ষি বিকেলে নরম, শ্যামলী তার উলটো। একজন মানুষ নানা অবস্থা, নানা পরিস্থিতি, নানা চাপ, নানা উদ্বেগ ও ব্যস্ততায় অন্য অন্য সব মানুষ হয়ে যায়। সকালের রমেনকে দুপুরে দেখলে রমেন বলে মনেই হবে না। দুপুরের শ্যামলীকে যদি মনে হয় বনলতা সেন, রাতে তাকেই মনে হতে পারে বান্ধবগড় জঙ্গলের ভালুক বলে। জীবন তো এরকমই। রবীন্দ্রনাথ তো বলেই দিয়েছেন, তার জীবনটা হল নানা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গাঁথা একখানা মালা। হোয়াট অ্যান এক্সপ্রেশন! লা জবাব।

এই যে সমীরণের মনুষ্যচরিত্র সম্পর্কে সুগভীর গবেষণালব্ধ জ্ঞান, আজ সেই জ্ঞানটাকেই হাতিয়ার করে এগোতে হবে। শ্রীরাধিকার অভিসারে যাওয়ার মতোই। পথ দুৰ্গম, ক্ষুরস্য ধারা, ফণী ফোঁস ফোঁস করছে, পিছলে পড়ে আলুর দম হওয়ার চান্স আছে। তবু রাধা যেমন রোজই কুঞ্জে পৌঁছে যেত, সেও পৌঁছে যাবে।

রিস্কটা নেওয়ার দরকার ছিল না। কিন্তু গতকাল জুলেখা বলেছে আজ রাত থেকে থাকতে পারবে না। তার হাজব্যান্ড বাঙ্গালোর থেকে ফিরে আসছে। এই নতুন খবরে যথেষ্ট বিচলিত হয়ে সমীরণ বলল, তুমি তো বিয়েই করোনি!

মৃদু হেসে জুলেখা বলল, ওরকম বলতে হয়।

কোনটা সত্যি বলো তো? আগে যেটা বলেছিলে, না এখন যেটা বলছ!

যে-কোনও একটা। বাট আই অ্যাম লিভিং।

এ খবরে মাথায় বজ্রাঘাত হল তার। সে পাপী। আর কে না জানে, পাপীদের জন্যই পৃথিবীতে যত ভয়-ভীতির আয়োজন। নেশা করলে সে নানা অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস দেখতে পায়। একা ফ্ল্যাটে তার পক্ষে থাকা অসম্ভব। ক্ষণিকাকে ফিরিয়ে না এনে আর উপায় নেই।

তবে হিউম্যান নেচার সম্পর্কে তার জ্ঞান গভীর বলেই তার দৃঢ় বিশ্বাস। সকালের দিকে ক্ষণিকার মেজাজ ভাল থাকে। এ সময়টায় সে হাসে, ঠাট্টা ইয়ারকি বুঝতে পারে, বেশ দয়ালু হয়ে ওঠে তার চোখের দৃষ্টি। ফুল অফ হিউম্যান কাইন্ডনেস। তার হৃদয়ের বালতি তখন উপচে পড়ে দয়া-দুগ্ধে।

তাই আজ সকালে অর্থাৎ বেলা সাড়ে আটটায়–সে অত্যন্ত মলিন মুখে এসে বসে আছে ক্ষণিকার বাপের বাড়ির বাইরের ঘরে। সে দাড়ি কামায়নি, পরিষ্কার জামাকাপড় পরেনি এবং মুখে হাসি নেই। ডোরবেল বাজানোর পর ঝি এসে দরজা খুলে বসিয়ে রেখে গেছে। ফঁকা ঘর। সোফাসেট, বুক কেস, কাশ্মীরি কাঠের পার্টিশন দিয়ে বেশ সাজানো ঘর। একটা বছর চারেকের বাচ্চা মেয়ে ঘরের কোণে বসে ডল নিয়ে খেলছে। খানিকক্ষণ তাকে লক্ষ করে হঠাৎ বলল, তুমি কে গো?

আমি! আমি একজন পাপী।

পাপী কী?

এ ম্যান ফুল অফ ভাইসেস। এ সিনফুল ম্যান।

তুমি আমার মায়ের বয়ফ্রেন্ড?

ওঃ, তা হলে এই মেয়েটিই ক্ষণিকার মেয়ে। ক্ষণিকা খুব তার মেয়ের গল্প করে। বাপের বাড়িতে তার নিঃসঙ্গ দিদির জিম্মায় থাকে। তাতে ক্ষণিকা মুক্ত থাকতে পারে। উড়ে উড়ে বেড়াতে পারে।

সে বলল, আমি একজন পাপী খুকি।

ঝি চা নিয়ে এল। ক্ষণিকা এল না। তবে চা আসাটা ভাল লক্ষণ। বরফ গলতে চাইছে। ইগোর চৌকাঠটা ডিঙোতে পারছে না। লজ্জার লতা যেন জড়িয়ে ধরছে অভিসারে গমনোদ্যোগী শ্রীরাধিকার দুখানি পা। একটু গলা খাঁকারি দিল সমীরণ।

বাচ্চা মেয়েটা হাম্পটি ডাম্পটি গানটা গাইছে। আজকাল কত বাচ্চাই গায়। সমীরণ চায়ে চুমুক দিল। এই সময়টায় ক্ষণিকার হৃদয়-বালতি ভরে আছে ফেনশীর্ষ দয়ার দুধে। এ সময়ে সে ভিখিরিকেও ফেরায় না। বাচ্চা মেয়েটার গানে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমীরণ একটু গুনগুন করল, ফেরাবে কি শূন্য হাতে?

ঘুমঘুম চোখে সামান্য একটু আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে শ্লথ পায়ে ভিতরের দরজায় এসে দাঁড়াল ক্ষণিকা। চোখে নিস্পৃহ দৃষ্টি। ঢিলা একটা ড্রাগনের ছবিওলা কিমোনো পরনে। চুলগুলো অবিন্যস্ত। চোখে অপার বিস্ময়।

এর সবটাই যে অভিনয় তা জানে সমীরণ। ওই চাহনি, ওই শ্লথ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিমা, ওই উপেক্ষার ভাব ওর আড়ালেই রয়েছে সেই অমোঘ বালতিটা। টলটল করছে ভরভরন্ত দুধে।

উদ্বেল হতে নেই। চায়ের কাপটা ধীরে নামিয়ে রেখে মাথা নত করে অপরাধীর মতো বসে রইল সে। এও অভিনয়। কমল হাসান বা নাসিরুদ্দিন শা-র সঙ্গে সে এখন পাঞ্জা কষতে পারে।

তুমি?

প্রশ্নটার জবাব দিল না সমীরণ। দিতে নেই। খুব ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়াল। মাথা

নিচু।

বাচ্চা মেয়েটা হঠাৎ বলে উঠল, ও লোকটা পাপী জানো মা?

ক্ষণিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, জানি। ওরকম বলতে নেই। ছিঃ।

বাঃ রে, ও-ই তো বলল।

বেশিক্ষণ ঘাড় নিচু করে থাকার ফলে সমীরণের ঘাড় টনটন করছিল। তবু থাকতে হচ্ছে।

ক্ষণিকা মুখোমুখি সোফায় এসে আলতোভাবে বসল। বলল, বোসো।

গলার স্বরটা নরম। সমীরণ খুব সাবধানে ধীরে ধীরে বসল।

জুলেখা চলে গেল বুঝি? রাখতে পারলে না?

সমীরণ একটু জিভ কেটে ফেলল। ভুলে। সামান্য খসখসে গলায় বলল, জানতে?

ওমা! জানব না কেন? তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রায়ই তো গিয়ে সব দেখে আসতাম। নবর মার সঙ্গে কথা হত।

সমীরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, পাপ কখনও গোপন থাকে না।

তা জানি না। তবে যাকে তাকে ডেকে আনছ, আজকাল কী ভীষণ এইডস হচ্ছে তা জানো?

পাপের বেতন মৃত্যু। জানি। কেন আমাকে একা ফেলে চলে আসো বলল তো। তুমি কি জানো না আমি একা থাকতে পারি না? বিশেষ করে তোমাকে ছাড়া? সেইজন্যই জুলেখাকে তাড়িয়ে দিয়েছি। হয় তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাব, নইলে বাবা পার্মানেন্টলি বাঙ্গালোর পাঠাতে চাইছে, সেখানেই চলে যাব।

জুলেখাকে তুমি মোটেই তাড়াওনি।

আলবত তাড়িয়েছি। চলো, দেখবে।

দেখার দরকার নেই। জুলেখাকে তাড়িয়েছি আমি।

তুমি?

হ্যাঁ। কাল আমি টেলিফোনে ওকে বিকেলবেলায় ধরেছিলাম।

ওঃ, তুমি মহীয়সী। তুমি কি জানো তোমার মতো—

থাক।

ক্ষণিকা, ক্ষমা—

আর হয় না সমীরণ। আর কিছুতেই—

আর কক্ষনও—

তোমার কথার কোনও দাম—

প্রমিজ। এই একবারটা–

না, প্লিজ। ফিরে যাও—

দয়া করো–

ওঃ সমীরণ—

তোমাকে ছাড়া—

মা, ও লোকটা কি পাপী?

ছিঃ তোটন—

আমি পাপী। পঞ্চ ম-কার—

উঃ ওরকম কোরো না তো—

এবারকার মতো—

কী জ্বালা বাবা—

লক্ষ্মী সোনা—

বাঙ্গালোরেই যাও না–

না, না, তোমাকে ছেড়ে স্বর্গেও—

মিথ্যুক–মিথ্যুক–ভূতের ভয়ে—

পায়ে পড়ি—

আচ্ছা আচ্ছা, হয়েছে–

চল্লিশ মিনিট বাদে গাড়িতে পাশাপাশি বসে তারা ফিরে আসছিল। ক্ষণিকার গোল মুখশ্রীতে এখনও সকালের সেই অপারগ ক্ষমাশীলতা। ঘুমঘুম চোখ। অলস দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে থেকে বলল, মিঠু মিত্রের লাভারটি কে বলো তো?

মিঠুর লাভার? যাঃ। কেউ নেই।

আছে।

কী করে বুঝলে?

জানি। হি হ্যাজ এ লাভার। তোমার বান্ধবী বলেছে।

কে বান্ধবী?

দ্যাট পুয়োর রেচে গার্ল। মিতালি।

কী বলেছে?

বেশ মাতাল মাতাল হয়ে গিয়েছিল সেদিন। আমার কাঁধে মাথা রেখে কাদছিল একটা সময়ে। তখন বলল, ডু ইউ নো হি হ্যাজ এ লাভার? শি লাভস হিম।

কিছুক্ষণ চুপচাপ গাড়ি চালাল সমীরণ। তারপর সতর্ক গলায় জিজ্ঞেস করল, মেয়েটার নাম কী?

সেটা বলেনি। সেজন্যই তো জানতে চাইছি।

সমীরণ মাথা নেড়ে বলল, আমিও জানি না। তবে তোমাকে একটা কথা বলি, মাতালদের কথায় কখনও বিশ্বাস কোরো না।

করি না। কিন্তু মিতালিকে সেদিন লক্ষ করেছ? শি ওয়াজ এক্সট্রিমলি ডিস্টার্বড। আর সেইজন্যই ওরকম আনাড়ির মতো মদ খাচ্ছিল। ডিস্টার্বড থাকার একটা কারণ তো আছে।

ব্যাপারটা লজিক্যাল নয়, কিন্তু শি ওয়াজ ইন লাভ উইথ মিঠু।

লজিক্যাল নয় কেন?

ডিভোর্সের এতদিন পর এবং এত দূরের দেশে থেকে হঠাৎ প্রেমে পড়ে যাওয়াটা কি স্বাভাবিক?

খুব স্বাভাবিক। মিতালির বিয়ে হয়েছিল অল্প বয়সে। তখন ওর ম্যাচিয়োরিটি ছিল না। পরে যখন ধীরে ধীরে পুরো ব্যাপারটা শান্তভাবে ভেবেছে তখন হঠাৎ বুঝতে পেরেছে, কাজটা ঠিক হয়নি। মিঠু মিত্র তো চমৎকার মানুষ। টল, হ্যান্ডসাম, কারেজিয়াস অ্যান্ড কাম। কোয়াইট লাভেবল।

সমীরণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, এনিওয়ে সেই রিডিসকভারি অফ লাভ থেকেই হয়তো ও ওরকম রেস্টলেস হয়ে পড়েছিল।

মোটেই নয়। শি ওয়াজ ডিস্টার্বড বিকজ শি কেম টু নো দ্যাট দেয়ার ওয়াজ অ্যানাদার উওম্যান।

তুমি শিয়োর?

শিয়োর।

কে হতে পারে?

লেট আস থিঙ্ক।

ইয়েস লেট আস থিঙ্ক।

ক্ষণিকা চোখ বুজে ধ্যানস্থ হল। সমীরণ ধ্যানস্থ হতে সাহস করল না, কারণ সে গাড়ি চালাচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে ক্ষণিকা চোখ খুলে বলল, একটা ব্যাপার মনে পড়েছে।

কী সেটা?

একটা মেয়ে টেবিলে বিরিয়ানি সার্ভ করছিল। বছর কুড়ি-একুশ বয়স। পরনে একটা সবুজ রঙের গাদোয়াল ছিল। মুখখানা ভারী মিষ্টি। একটু ড্রিমি মুখ। চোখ দুখানা খুব নরম। মনে আছে?

একটু গম্ভীর হয়ে সমীরণ বলে, তোমার মনে থাকা উচিত, ডিনারের সময় আমার বাহ্যজ্ঞান ছিল না।

ডিনারের অনেক আগেই তাকে দেখতে পেয়েছ নিশ্চয়ই। মনে পড়ছে?

আমি মেয়েদের দিকে তাকাই না।

শুধু তাকাও না, চোখ দিয়ে গিলে খাও।

আচ্ছা আচ্ছা, আমাকে মেডিটেট করতে দাও। তার আগে বলো এই মেয়েটি সম্পর্কে কী বলেছিল মিতালি?

কিছু বলেনি। মেয়েটা যখন বিরিয়ানির প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকছিল তখনই মিতালি একটু শিউরে উঠে যেন হিসিং সাউন্ড করে বলল, শি, শি ইজ ইন লাভ উইথ হিম!

ওই মেয়েটাকেই মিন করছিল?

অফকোর্স! মেয়েটাকে দেখেই যেন রিঅ্যাক্ট করল। আমি জানতে চাই মেয়েটা কে?

সবুজ শাড়ি আর অবুঝ মুখ তো!

অবুঝ মুখ মোটেই বলিনি।

এনিওয়ে, মনে পড়ছে না। শোনো, ছেলেরা কখনও মেয়েদের পোশাক মনে রাখতে পারে না।

তা হলে কী মনে রাখে?

বেশি মনে রাখে চোখ। দু’নম্বর, মুখশ্রী।

মুখশ্রীর কথা তো বললাম।

ডেসক্রিপশন ইনকমপ্লিট। আমি ভিসুয়ালাইজ করতে পারছি না।

চুলগুলো স্টেপকাট করা।

আর কিছু?

দু’দিকে দুটো মিষ্টি গজাত আছে। হাসলে বেশ দেখায়।

যাঃ, ও তো জয়িতা!

সে কে?

জয়িতা হল মিতালির খুড়তুতো বোন।

যাঃ বলছ কেন?

ও সেরকম মেয়েই নয়।

কীরকম মেয়ে?

ভীষণ ভাল টাইপের। ছেলেদের সঙ্গে মেশে না। খুব লাজুক।

ক্ষণিকা একটু হেসে বলল, লাজুকরা বুঝি প্রেমে পড়ে না?

তা নয়। কিন্তু মিঠুর সঙ্গে ওর কোনও কানেকশনই নেই যে।

খোঁজ নাও।

নিয়ে লাভ?

জাস্ট কৌতূহল।

সমীরণ মিটিমিটি হাসছিল। বলল, জয়িতা যদি কারও প্রেমে পড়ে তা হলে সে বেচারি ইহজীবনেও জানতে পারবে না যে একটা মেয়ে তার প্রেমে পড়েছিল।

তা হলে মিতালি জানল কী করে?

ইউ ক্যান্ট বি শিয়োর।

আই অ্যাম শিয়োর।

ওকে ওকে। মেনে নিচ্ছি। তবু মনে রেখো, মিতালি ও কথা বলার সময় মাতাল হয়ে গিয়েছিল।

জানি। আমি মিতালিকে সামলাচ্ছিলাম। ন্যাপকিন দিয়ে চোখ মুখ মুছিয়ে দিয়ে ঠান্ডা জল খাইয়ে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসিয়ে দিয়ে আসি। সোফায় বসেই হড়হড় করে বমি করে দিল। ভাগ্যিস উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম, নইলে ডিনারটাই নষ্ট হত।

সমীরণ ভ্রু কুঁচকে বলল, সামথিং ইজ টিকিং।

হোয়াইট টিকিং?

ইউ মে বি রাইট।

আই অ্যাম রাইট।

ক্ষণিকা, শবর দাশগুপ্তের কানে কথাটা গেলে হি উইল মেক দি গার্ল আপ সাইড ডাউন।

কেন?

লোকটা ভীষণ পাজি। তোমাকেও জ্বালাবে।

মেয়েটাকে জ্বালালে তোমার ক্ষতি কী? হ্যাভ ইউ গট এ সফট কর্নার ফর হার?

আরে না। শি ইজ জাস্ট এ কিড।

মোটেই নয়। কুড়ি-একুশ যথেষ্ট বয়স। কীরকম বোন বললে?

আপন খুড়তুতো বোন। ওর বাবা অরুণ ঘোষ আমাদের প্রফেসর ছিলেন। মাই গড!

কী হল?

একটা কথা মনে পড়ল। জয়িতা হল ওনলি চাইল্ড। দুই ভাইয়ের ওই একটিই সারভাইভিং সন্তান। মিতালির নেক্সট অফ কিনা জয়িতা উইল ইনহেরিট এভরিথিং অফ মিতালি।

*

তখন কি তার তেরো বছর বয়স? নাকি চৌদ্দ? বোধহয় মাঝামাঝি। এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের একটা বিশেষ ব্রাঞ্চে অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য তার বড় ব্যাকুলতা দেখা দিয়েছিল হঠাৎ। বিশেষ একটা কাউন্টারে ছোট্ট মুখখানা বাড়িয়ে সে করুণ গলায় বলেছিল, আমি কি একটা

অ্যাকাউন্ট খুলতে পারি?

মিঠু কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে চিনতে পারল। বাসরঘরে মেয়েটি অনেক রবীন্দ্রসংগীত শুনিয়েছিল। মিঠুর কানে লেগে আছে একটা কলি, সখি ভালবাসা কারে কয়, সে কি সকলি যাতনাময়…

একটু হেসে মিঠু বলেছিল, কেন পারবে না?

মেয়েটি হাস্যহীন মুখে করুণ দৃষ্টিতে মিঠুর দিকে চেয়ে ছিল। ওই বয়সেও সে বুঝত, তার দিদি মিতালি এই লোকটাকে যাচ্ছেতাই অপমান করেছে। নাকচ করেছে। অথচ মিঠুদাকে তার কী ভালই লেগেছিল বিয়ের রাতে। কেমন ভদ্র, কেমন গম্ভীর, কী পারসোনালিটি, আর কী দারুণ ম্যানলি চেহারা! মুগ্ধ, সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিল সে। ওই বয়সে ওই তার প্রথম উথালপাথাল বুক। মিঠু যদি জামাইবাবু হয়ে থাকত তবে ঠিক সামলে নিত নিজেকে সে। কিন্তু বিয়ের পরই মিতালিদি এমন করতে লাগল। তারপর ছেড়েই দিল। বড্ড কষ্ট হয়েছিল তার। আবার সেই সঙ্গে অদ্ভুত এক আনন্দও।

অ্যাকাউন্ট খোলার পর একদিন, মাত্র একদিনই একটা ভুল করে ফেলেছিল, যার জন্য আজও নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না সে। একদিন টাকা তুলবার অছিলায় চেক-এর সঙ্গে জেমস ক্লিপে আঁটা একটা চিরকুট দিয়েছিল মিঠুকে। তাতে ইংরেজিতে লেখা ছিল, হাউ ডিপলি আই লাভ ইউ।

মিঠু চেকটা নিল, চিরকুটটা দেখল। তারপর গম্ভীর হয়ে গেল। ভীষণ গম্ভীর। আর একটাও কথা বলেনি সেদিন।

ভয়ে লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে সেদিন চলে এসেছিল জয়িতা। পনেরো দিন বাদে আবার গিয়েছিল। না, আর কখনও ভুল করেনি সে। শুধু কাউন্টারের এক পাশ থেকে অন্য পাশে চোখ তুলে তাকাতে পারেনি। কিন্তু তার হৃৎপিণ্ড এত জোরে শব্দ করেছিল সেদিন, মিঠু কি শুনতে পায়নি?

পেয়েছিল নিশ্চয়ই। তবু শুধু ভদ্র গলায় একবার জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন আছ?

তারপর তিন বছর ধরে যতবার ব্যাঙ্কে গেছে ততবারই ওই ভদ্র গলায় একটি প্রশ্ন, কেমন আছ? তার বেশি একটি কথাও নয়। কখনও নয়।

জয়িতা মৃদু স্বরে বলত, ভাল। আর তার বুকের ভিতরে উত্তাল হয়ে উঠত হৃৎপিণ্ড।

তিন বছর বাদে অন্য ব্রাঞ্চে প্রমোশন পেয়ে চলে গেল মিঠু। একবার বলেও গেল না। জয়িতা অ্যাকউন্ট তুলে নিল না। অপেক্ষা করল।

রসা রোডের দিকে তার যাওয়ার কথাই নয়। তবু স্কুলের পর তার মাঝে মাঝে লেকের দিকে যাওয়ার খুব দরকার পড়তে লাগল, প্রথম প্রথম বন্ধুদের সঙ্গে। তারপর এক-একদিন একা। এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক তখন তার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। ব্যাঙ্কের দরজা থেকে একটু দূরে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকত। দেখা হত না। একদিন সাহস করে ঢুকেছিল। অনেককে দেখল, যাদের দেখার দরকার ছিল না।

তারপর একদিন দেখল। মিঠু বেরিয়ে এল। কোনওদিকে না তাকিয়ে তার বিশাল মোটরবাইকে উঠে ভোঁ করে কোথায় চলে গেল।

যথেষ্ট। ওটুকুও তখন কম নয়। তিন দিন ধরে সেই দেখার রেশ রইল।

একদিন মাকে বলেছিল, আচ্ছা, মিঠুদা তো ইচ্ছে করলেই এখন বিয়ে করতে পারে, না মা?

পারেই তো! অত ভাল ছেলে!

তবে করছে না কেন?

করবে করবে। হয়তো কথা চলছে। কে খবর রাখে বাবা?

কেউ খবর রাখেও না। সে রাখত। জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি মাত্র দু’স্টপ দূর। সে হঠাৎ হঠাৎ গিয়ে হাজির হত। এ কথা সে কথা। তারপর মিঠুদার কথা।

জ্যাঠামশাই নিজের মেয়ের ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। বলতেন, আমি কিছু ভুল করিনি। মিতালি একদিন বুঝবে।

জ্যাঠামশাই, মিঠুদা কি বিয়ে করবে?

তা কি জানি মা? মাঝে মাঝে আসে, খোঁজখবর নিয়ে যায়। লজ্জায় সংকোচে তাকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারি না। বিয়ে তো করাই উচিত।

বেশি দিনের কথা নয়। মাত্র এক-দেড় বছর আগে একদিন জ্যাঠামশাই বললেন, সামনের শনিবার মিঠুকে খেতে বলেছি। ভারী সংকোচ। কিছুতেই রাজি হয় না। আমি বেশ লম্বা ছুটিতে আমেরিকা চলে যাচ্ছি বলে রাজি করিয়েছি। তুইও একটু আসিস তো মা। হরেনই রাঁধবে, কিন্তু সে পুরনো মানুষ, এখনকার রান্না জানে না। তুই একটু ওই চাইনিজটাইনিজ কিছু একটা রান্না করিস তো। ছেলেটা নিজে বেঁধে খায়, সেদ্ধপোড়া খেয়েই থাকে হয়তো।

তখন তার উনিশ বছর বয়স। তখন তার কী উদ্বেল হৃদয়! মারাত্মক শনিবারটা যেন ডবল ডেকারের মতো ধেয়ে আসছিল।

সেদিন তার মা-বাবারও ছিল নিমন্ত্রণ। রেসিপির বই দেখে খুব যত্ন করে সে বেঁধেছিল চিলি চিকেন আর প্রন ককটেল। জ্যাঠামশাইয়ের ছোট খাওয়ার টেবিলে চারজন খেতে বসেছে। জ্যাঠামশাই, মা, বাবা আর মিঠু। মুখ তুলে মিঠুই হঠাৎ বলল, এ কী, তুমি বসবে না?

সবেগে মাথা নেড়ে সে বলেছিল, না। আমি সার্ভ করব।

তাই কি হয়? বসে যাও, সবাই একসঙ্গে খাই।

শুনে সবাই হাঁ হাঁ করে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, তুইও বসে যা। হরেন সার্ভ করবে।

কেমন একটা অ্যারেঞ্জমেন্ট হল, তাকে বসতে হল মিঠুর বাঁ পাশে, কাছ ঘেঁষে। চোখমুখ লজ্জায় ঝা ঝা করছিল তার। মুখ তুলতে পারে না, খাবে কী? আর তখন মিঠুর গা থেকে একটা মিষ্টি পুরুষালি উত্তাপ আসছিল। আর মাদক একটা গন্ধও। কথাবার্তা হচ্ছিল, সে একটুও বুঝতে পারছিল না কারও কথা।

মিঠু হঠাৎ বলল, এসব তুমি বেঁধেছ? বাঃ, খুব ভাল রাঁধতে পারো তো তুমি! আর কী কী পায়রা বলল তো। গান গাইতে পারো, জানি। আর কিছু?

কিছু না।

মা বলল, ফিলজফিতে অনার্স নিয়ে বি এ পড়ছে।

সে আমি জানি।

জানে! কী করে জানে মিঠু?

ডিনারের পর অনেক রাত অবধি গল্প হয়েছিল। না, জয়িতা কথাই বলেনি। শুধু কাছাকাছি একটা দূরত্বে বসে অনুভব করেছে মিঠুকে। সে এক অতলান্ত অনুভূতি। কী যে হচ্ছিল তার বুকের ভিতরে!

মিঠু কি তাকাচ্ছিল তার দিকে? সে দেখেনি। কিন্তু সে জানে, চোর-চোখে মিঠু বহুবার দেখেছিল তাকে। বহুবার।

মা বাবার সঙ্গে সে যখন বেরিয়ে আসছিল তখন সঙ্গে সঙ্গে মিঠুও। বিদায় নেওয়ার একটু আগে হঠাৎ দু’পা পিছিয়ে তার সঙ্গ ধরে বলল, তোমার চিরকুটটার জবাব দেওয়া হয়নি। একদিন দেব।

লজ্জায় মরে যাচ্ছিল সে। নার্ভাস। মিঠুর মোটরবাইকের শব্দ যতক্ষণ শোনা গিয়েছিল ততক্ষণ তার শরীরে ঝংকার।

চিরকুটের জবাব দেবে বলেছিল মিঠু। জবাবটা এল মাসখানেক পর। এবং অভিনব উপায়ে। ডাকে তার কাছে এল সাদার্ন ক্লাবে ভরতি হওয়ার একটা ফর্ম। সেই ফর্মের এক কোণে ছোট্ট করে লেখা “প্লিজ। মিঠু।” হাসবে না কাদবে ভেবেই পেল না জয়িতা। এটা কি রসিকতা? নাকি অন্য কিছু?

অনেক ভেবে সে বুঝতে পারল, মিঠু হয়তো তার সঙ্গ চায়। কিন্তু সঙ্গ পাওয়ার অন্য কোনও উপায় হয়তো ভেবে পায়নি। অল্পবয়সিদের মতো মাঠে ময়দানে বা হোটেলে রেস্টুরেন্টে বসে প্রেম করা হয়তো মিঠুর পছন্দ নয়। হয়তো সাদার্ন ক্লাবে ব্যায়াম বা মার্শাল আর্টের ক্লাসে তারা অনেক কাছাকাছি হতে পারবে।

অনেক লজ্জা সংকোচ, অনেক দ্বিধা জয় করতে হয়েছিল জয়িতাকে। একদিন কুণ্ঠিত পায়ে হাজিরও হল সাদার্ন ক্লাবে। তাকে দেখে মিঠুর মুখে ভারী চমৎকার একটা হাসি ফুটে উঠেছিল। সেই হাসিটাই তার প্রথম উপহার।

জয়িতা জীবনে কখনও কোনও খেলাধুলো বা ব্যায়াম করেনি। প্রথম প্রথম তার শরীরে কী ব্যথাই না হয়েছিল। তবু করত। মিঠু বলত, ক’দিন পরেই দেখবে শরীর কেমন হালকা আর ফিট লাগবে।

কখনও তাদের মধ্যে স্পষ্ট করে কোনও ভালবাসার কথা হয়নি। সব সময়ে তার দরকারও হয় না। ভালবাসার মধ্যে একটা নীরবতাও কি নেই? সে নিজে প্রগলভ নয়। মিঠুও কম কথার মানুষ। তারা খুব কাছাকছি হত, যখন ক্যারাটে ক্লাসের পর মিঠু তাকে মোটরবাইকের পিছনে চড়িয়ে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দিত। কখনও পাড়ায় ঢুকত না বা বাড়িতেও আসত না। বলত, মেলামেশাটা একটু গোপন থাকাই ভাল, নইলে তোমাকে লোকে বদনাম দিতে চেষ্টা করবে। বাড়ির লোকের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

কিন্তু গোপন করলেও খুব গোপন থাকেনি তাদের সম্পর্ক। মাস কয়েক বাদে একদিন মা তাকে ধরল, হারে, কী ব্যাপার বল তো?

কী ব্যাপার মা?

তোর কি মিঠুকে পছন্দ?

কী লজ্জা! কী লজ্জা! মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল তার। জবাব এলই না মুখে।

মা বলল, মিতালির সঙ্গে ওর বিয়েটা হয়েছিল, সেইটেই একটা খারাপ ব্যাপার, নইলে মিঠু তো চমৎকার ছেলে। ভাল করে ভেবে দেখ।

ভেবে দেখবে? ভেবে দেখার কী আছে! তার তো মিঠুময় জগৎ। মিঠু ছাড়া সে আর কিছু ভাবতেই পারে না।

মা তার নীরবতারও অর্থ ধরতে পারল। বলল, বেশ, তোর বাবাকে বলি। মনে হয়, অমত করবেন না। কিন্তু বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে মেলামেশাটা বন্ধ করতে হবে।

এক অপার্থিব আলোয় যেন ভরে গেল জয়িতার জগৎ। এত আনন্দও যে জীবনে আছে তার জানাই ছিল না।

সেদিন সন্ধেবেলা সে খুব লাজুক গলায় মিঠুকে বলল, মা জানতে পেরেছে।

মিঠু সামান্য অবাক হয়ে বলল, কী করে জানলেন?

তা তো জানি না। তবে অমত করেনি।

মিঠু একটু চুপ করে থেকে খুব ধীর কণ্ঠে বলল, মিতালি আমার আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দিয়ে গিয়েছিল। তুমি তা ফিরিয়ে দিয়েছ। আমার জন্য আর কেউ এতটা করেনি, তোমার মতো।

জয়িতা খুব ফিসফিস করে বলেছিল, এখন কী হবে?

মিঠু একটু হেসে বলল, কী হবে জানো না বুঝি?

মাথা নেড়ে জয়িতা বলল, না তো?

এই প্রথম তাদের মধ্যে ভালবাসার সংলাপ। এইটুকুই মাত্র কথা, কিন্তু উত্তাপ আর আবেগে যেন মাখামাখি। মিঠুর মোটরবাইক সেদিন যেন মাটিতে নয়, আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল।

কথাটা বাবার কানেও তুলল মা। তার বাবা মাত্র এক মিনিট চিন্তা করে বলল, হোয়াই নট? বয়সের তফাতটা একটু বেশি, তা হোক। তাতে ভালই হবে। মিঠুর প্রতি যে অন্যায়টা হয়েছে এতে তারও খানিকটা শোধবোধ হবে।

কোথাও কোনও আপত্তি উঠল না। মসৃণ একটা পরিণতির দিকেই যাচ্ছিল তারা।

কিন্তু আপত্তি উঠল অপ্রত্যাশিত একটা জায়গা থেকে। জ্যাঠামশাই আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর বাবা একদিন গিয়ে তাঁকে বললেন ব্যাপারটা। জ্যাঠামশাই যেন ভীষণ চমকে উঠে বললেন, না না, তা হয় না। তা কিছুতেই হয় না।

জয়িতার বাবা অবাক হয়ে বললেন, কেন হয় না? কোথাও তো বাধক দেখছি না।

জ্যাঠামশাই বারবার বললেন, বাধা আছে। সে তুই বুঝবি না।

জ্যাঠামশাই আর ব্যাখ্যা করেননি। ব্যাখ্যা করার সময়ও আর পাননি। পরদিনই গভীর রাতে বাথরুমে পড়ে গিয়ে তিনি মারা যান। সেরিব্রাল।

খুব কেঁদেছিল জয়িতা। একটা সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল। মিঠু তার ভূতপূর্ব শ্বশুরের শ্মশানবন্ধু হয়েছিল।

দু’দিন বাদে এয়ারপোর্টে মা-বাবার সঙ্গে জয়িতা গিয়েছিল মিতালিকে নিয়ে আসতে। কী উদভ্রান্ত, শোকাহত চেহারা মিতালির! এক ঝটকায় যেন বয়স বেড়ে গেছে অনেক। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল মিতালিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। মিতালি বলল, না কাকু, তার দরকার নেই। ও বাড়িতে বাবার কত স্মৃতি আছে বলো তো! বরং জয়িতা কয়েকদিন আমার সঙ্গে থাক। নইলে আমার একা লাগবে।

প্রথম দু’-চারটে দিন শোকের ভাবটা কাটিয়ে ওঠার পরই তাদের দুই বোনের মধ্যে কথার ফোয়ারা খুলে গেল। দিনের বেলায় জয়িতার কলেজ, মিতালিরও উকিল অ্যাটর্নির কাছে বা ব্যাঙ্কে যাওয়া। গল্প হত রাতে। দোতলায় শোওয়ার ঘরে মস্ত খাটে পাশাপাশি শুয়ে।

শ্রাদ্ধ বা নিয়মভঙ্গ কোনও অনুষ্ঠানেই মিঠু আসেনি। কিন্তু এক সন্ধেবেলা সাদার্ন ক্লাব থেকে বেরিয়ে মাঠের ওপর খানিকটা একসঙ্গে হেঁটেছিল দু’জন। মিঠু একটু চিন্তিত। বলল, জয়িতা, মিতালি আমাকে কিছু বলতে চায়।

কী?

তা জানি না। কিন্তু তোমাকে একটা অনুরোধ করব।

বলুন না।

তুমি আমাদের কথা, তোমার আমার কথা মিতালিকে জানিয়ে দিয়ো।

কেন? আমার যে ভীষণ লজ্জা করবে।

তোমার লজ্জা নিয়েই তো হয়েছে আমার বিপদ।

মিতালিদির সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে?

হ্যাঁ, মিতালি আমার ব্রাঞ্চে গিয়েছিল।

ও মা!

শি ইজ এ বিট অফ রিপেন্টেন্ট।

জয়িতার বুক অজানা ভয়ে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। সে উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করল, তা হলে কী হবে?

মিঠু একটু হাসল, কী হবে তুমি জানো না?

বলুন না!

মিতালি অনেক দূরে সরে গেছে জয়িতা।

জয়িতার বুকে সে যে কাঁপুনি উঠল সে বোঝাতে পারবে না। মিতালি মস্ত পার্টির আয়োজন করল। ককটেল ডিনার। জয়িতার ইচ্ছে ছিল পার্টির পর মিতালিকে ফঁক বুঝে বলবে কথাটা। কিন্তু কী হল, আগের রাতে যখন দু’বোনে কথা হচ্ছিল তখন মিতালি বলল, তুই কি প্রেমে পড়েছিস?

জয়িতা অবাক হয়ে বলল, কেন বলো তো!

তোর মুখচোখ বলছে, তোর গলার স্বর বলছে, তোর আনমনা ভাব বলছে, তুই প্রেমে পড়েছিস।

জয়িতা দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলেছিল।

লজ্জার কী আছে? বল না।

জানি না।

তার মানে সত্যিই প্রেমে পড়েছিস। কে রে?

জয়িতা একটা বুদ্ধির কাজ করল। বলল, আজ নয় মিতালিদি। কাল বলব।

কেন? কাল কেন?

জয়িতা বলেনি। সেই রাতটা সে ভাল করে ঘুমোতেও পারেনি।

পরদিন সকাল থেকেই ঘরদোর সাজানো, পরিষ্কার করা এসব নিয়ে ব্যস্ত রইল তারা। দুপুরে খাওয়ার টেবিলে যখন দু’জনে মুখোমুখি তখন মিতালি জিজ্ঞেস করল, কাল বলিসনি। আজ বলবি?

বলব। খেয়ে নাও। তারপর বলব।

খেতে খেতেই মিতালি বলল, ছেলেটা ভাল?

জানি না।

ভাল করে বলছিস না কেন?

বলব মিতালিদি? বললে তুমি রাগ করবে না?

রাগ করব? তুই কাউকে ভালবাসলে আমার রাগ করার কী?

খাওয়া তখন শেষের মুখে। জয়িতা শুধু মিঠুর আদেশ পালন করার জন্যই তার সব লজ্জা সংকোচ আর ভয় মুঠোয় ধরে রেখেই বলল, মিঠুদা।

কে বললি? বলে অবাক হয়ে চেয়ে রইল মিতালি।

জয়িতা মাথা নিচু করে টেবিল ছেড়ে পালিয়ে গেল।

সে কী বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে সেটা বুঝতে একটু সময় লেগেছিল তার। মিতালি বজ্রাহতের মতো কিছুক্ষণ বসে রইল খাওয়ার টেবিলে। তারপর একতলার লিভিং রুমের সোফায় অনেকক্ষণ পড়ে ছিল চুপচাপ। তারপর ডেকোরেটরের লোকেরা এল ডাইনিং হলে টেবিল চেয়ার সাজাতে। এল ক্যাটারার। তাকে উঠতে হল। আড়াল থেকেই তাকে লক্ষ করছিল জয়িতা। সামনে যায়নি।

মিঠু এল বিকেলের দিকে। হঠাৎ।

দৃশ্যটা এ জীবনে কখনও ভুলতে পারবে না জয়িতা। দোতলায় সাজছিল মিতালি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে মিঠুর দিকে চেয়ে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর হঠাৎ একটা অস্ফুট চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ল মিঠুর বুকে। ভগ্নস্তূপের মতো। শুধু বলছিল প্রবল কান্না

ভেদ করে বলছিল, বিশ্বাস করি না–বিশ্বাস করি না

মিঠু পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। জয়িতা চলে গেল পিছনের বাগানে। এ দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব।

তাকে গিয়ে পিছনের বাগানে ধরল মিতালিই। চোখের জল মুছে ফেলেছে, মুখে একটা হাসি ফুটিয়েছে অনেক কষ্টে। তাকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে বলল, বেশ করেছিস। বেশ করেছিস। আমি খুশি হয়েছি। বিশ্বাস কর।

জয়িতা বিশ্বাস করেনি। তবু বলেছিল, আমি তো জানতাম না মিতালিদি—

মিতালি একটু চুপ করে থাকার পর বলল, এ কি জানার মতো কথা? কিছু নয় রে। আমি তো একটা পাগল, কত ভুল করেছি জীবনে। সব ঠিক হয়ে যাবে।

মুখে বলল, কিন্তু কিছুই ঠিক ছিল না সেদিন মিতালির। জন্মে মদ ছোঁয়নি। সেদিন জলের মতো খেল। কত কী উলটোপালটা বলতে লাগল লোকজনকে। কেঁদে ফেলল, হাসতে লাগল। কিছু ঠিক ছিল না।

পার্টি শেষ হওয়ার একটু বাদেই চলে এসেছিল জয়িতা। বুক ভার, মনে ভয়, অনিশ্চয়তা, এই অদ্ভুত পরিস্থিতি থেকে কীভাবে মুক্তি ঘটবে।