আরবে আরোবার মধ্যে প্রাচীন ইয়েমেনী গোত্রের নাম ছিলো কওমে সাবা। ইরাকে আবিষ্কৃত প্রাচীন শিলালিপি থেকে জানা যায়, খৃষ্টপূ্র্ব আড়াই হাজার বছর আগে সাবা জাতির এখানে বসতি ছিলো। তবে এ জাতির উন্নতি অগ্রগতির সূচনা হয়েছিলো খৃষ্টপূর্ব একাদশ শতাব্দীতে। উল্লেখ্যযোগ্য ঐতিহাসিক সময়কাল নিম্নরূপ,
(এক) খৃষ্টপূর্ব ৬৫০ সালের পূর্বেকার সময়। সেই সময়ে সাবার বাদশাহদের উপাধি ছিলো মাকরাবে সাবা। এদের রাজধানী ছিলো সরওয়াহ নামক জায়গায়। এই রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ মা-আবের থেকে পশ্চিমে একদিনের পথের দূরত্বে পাওয়া যায়। সেই জায়গায় বর্তমান নাম খারিবা। সেই যুগে মা-আরেবের বিখ্যাত বাঁধের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিলো। ইয়েমেনের ইতিহাসে এটা এক উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা। সেই সময়ে সাবার বাদশাহদের শাসনামলের বহুলোক আরবের ভেতর এবং বাইরে বিভিন্ন স্থানে নতুন বসতি স্থাপন করেছিলো।
(দুই) খৃষ্টপূর্ব ৬৫০ খৃষ্টপূর্ব ১১৫ সাল। এ সময়ে সাবার বাদশাহরা মাকরাব উপাধি পরিত্যাগ করে বাদশাহ উপাধি ধারন করে এবং সরওয়াহ এর পরিবর্তে মায়ারেবকে রাজধানী মনোনীত করে। এই শহরের ধ্বংসাবশেষ সান-য়া থেকে ৬০ মাইল পূর্বে পাওয়া যায়।
(তিন) খৃষ্টপূর্ব ৩০০ থেকে ১১৫। এ সময়ে সাবার বাদশাহদের ওপর হেমইয়ার গোত্র আধিপত্য বিস্তার করে এবং তারা মায়া’বের পরিবর্তে রাইদানকে নিজেদের রাজধানী মনোনীত করে। পরবর্তী সময়ে রাইদানের নাম পরিবর্তন করে জেফার রাখা হয়। এর ধ্বংসাবশেষ ইয়মেনের কাছাকাছি একটি পাহাড়ে পাওয়া যায়।
এই যুগে সাবা জাতির পতন শুরু হয়। প্রথমে নাবেতিরা হেজাযের উত্তরাঞ্ঝলে আধিপত্য বিস্তার করে এবং সাবার নতুন জনবসতি উৎখাত করকে শুরু করে। এরপর রোমকরা মিসর, সিরিয়া এবং হেজাযের উত্তরাঞ্ঝলে আধিপত্য বিস্তার করে এতে তাদের স্থলপথে ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে কাহতানি গোত্রসমূহ নিজেদের দেশ ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
(চার) খৃষ্টপূর্ব ১১৫ থেকে ইসলামের সূচনাকাল পর্যন্ত। এ সময়ে ইয়েমেনের ক্রমাগত বিভেদ বিশৃঙ্খলা চলতে থাকে। বিপ্লব,গৃহযুদ্ধ এবং বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপ চলতে থাকে। এমনি করে এক পর্যায়ে ইয়মেনের স্বাধীনতাও কেড়ে নেয়া হয়। এই সময়ে রোমকরা আদানের ওপর সামরিক হস্তক্ষেপ করে এবং তাদের সাহয্যে হাবশী অর্থাৎ আবিসিনীয়রা হেমইয়ার ও হামদান গোত্রের পারস্পরিক সংঘাত থেকে লাভবান হয়ে ৩৪০ সালে প্রথমবার ইয়েমেন দখল করে নেয়। এই দখল ৩৭৮ সাল পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ থাকে। এরপর ইয়েমেন স্বাধীনতা লাভ করে বটে, কিন্তু মা’য়ারেবের বিখ্যাত বাঁধে ভাঙ্গন দেখা দেয়। ৪৫০ বা ৪৫১ সালে এই বাঁধ ভেঙ্গে যায়। পবিত্র কোরআনের এই ভাঙ্গনকে বাঁধভাঙ্গা বন্যা বলে অভিহিত করা হয়েছিলো। সূরা সাবায় এর উল্লেখ রয়েছে। এটা ছিলো বড় ধরনের একটা দুর্ঘটনা। এ বন্যায় বহু জনপদ বিরান ও জনশূন্য হয়ে পড়েছিলো এবং বহু গোত্র বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিলো।
৫২৩ ঈসায়ী সালে আরেকটি বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটে। বাদশাহ জুনুয়াস ইয়েমেনের ঈসায়ীদের ওপর হামলা করে তাদের খৃষ্টধর্ম ত্যাগে বাধা করার চেষ্টা করে। তারা রাযি না হওয়ায় তাদেরকে পরিখা খনন করে প্রজ্জলিত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপে করা হয়। পবিত্র কোরআনের সূরা বুরুজে ধ্বংস হয়েছিলো কুন্ডের অধিপতিরা বলে এই লোমহর্ষক ঘটনার কথা উল্লেখ্য করা হয়েছে। এতে রোমক বাদশাহদের নেতৃত্বে ঈসায়ী ধর্মের উজ্জীবনকারীরা তৎপর এবং প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে ওঠে। আবিসিনীয়রা রোমকদের সমর্থন পেয়ে ৫১৫ সালে আরিয়াতের নেতৃত্বে ৭০ হাজার সৈন্যসহ পুনরায় ইয়েমেনে হামলা চালিয়ে ইয়েমেনে হামলা চালিয়ে ইয়েমেনে অধিকার করে নেয়। অধিকারের পর আবিসিনিয়ার সম্রাটের গর্ভনর হিসাবে আরিয়াত ইয়মেন শাসন করতে থাকেন। কিছুকাল পর আরিয়াতের সেনাবাহিনীর এক অধিনায়ক আরিয়াতকে হত্যা করে ক্ষমতা গ্রহণ করে। এ অধিনায়কের নাম ছিলো আবরাহা। ক্ষমতা গ্রহণের পর আবরাহা শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং আবিসিনিয়ার সম্রাটকেও তার বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করায়।
এই আবরাহাই পরবর্তীকালে কাবাঘর ধবংস করতে চেষ্টা করেছিলো। দুর্ধুর্ষ একদল সৈন্য এবং কয়েকটি হাতী নিয়ে আবরাহা মক্কা অভিযান পরিচলনা করেছিলো। এই অভিযানকে আসহাবে ফীল নামে সূরা ফীলে উল্লেখ্য করা হয়েছে।
আসহাবে ফীলের ঘটনার আবিসিনীয়দের যে ক্ষতি হয়েছিলো, তার প্রক্ষিতে ইয়মেনের অধিবাসীরা পারস্য সরকারের কাছে সাহায্য চায়। তারা আবিসিনীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্র্রোহ করে এবং সায়ফে যী ইয়াযান ইময়ারীর পুত্র মাদি কারারের নেতৃত্বে আবিসিনীদের দেশ থেকে বের করে দেয়। এরপর তারা একটি স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি হিসাবে মাদিকারাবকে ইয়েমেনের বাদশাহ বলে ঘোষনা করে। এটা ছিল ৫০৫ সালের ঘটনা।
স্বাধীনতার পর মাদিকারাব তার সেবা এবং রাজকীয় বাহিনীর সৌন্দর্যের জন্যে কিছূ সংখ্যক হাবশী অর্থাৎ আবিসিনীয়কে রেখে দেয়। তার এ শখ পরবর্তীতে বিপজ্জনক প্রমাণিত হয়। কর্মরত হাবশীরা একদিন ধোঁকা দিয়ে বাদশাহ মাদিকারাবকে হত্যা করে। এর ফলে যী ইয়াযান পরিবারের রাজত্ব চিরতরে শেষ হয়ে যায়। এ পরিস্থিতি থেকে সুবিধা আদায়ের জন্য এগিয়ে আসেন পারস্য সম্রাট কিসরা। তিনি সনয়া’য় পারস্য বংশোদ্ভুত একজন গর্ভণর নিয়োগ করে ইয়েমেনকে পারস্যের একটি প্রদেশে পরিণত করেন। পরবর্তী সময়ে ইয়েমেনে একের পর এক ফরাসী গর্ভণর নিযুক্ত করতে থাকেন। সর্বশেষে গভর্ণর বাযান ৬২৮ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। এর ফলে ইয়েমেনে পারস্য আধিপত্য লোভ পায় এবং ইয়মেন ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হয়।