০৪. আসবাবপত্রহীন ছোট একটি ঘরে

আসবাবপত্রহীন ছোট একটি ঘরে রুথ অপেক্ষা করছে। স্কাউটশিপের পাইলট–রসকসহীন, নির্লিপ্ত এবং কথা বলতে অনিচ্ছুক একটি রোবট তাকে এখানে পৌঁছে দিয়ে গেছে। রুখ ঘরের দেয়াল, ছাদ এবং মেঝে ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে পরীক্ষা শেষ করার আগেই হঠাৎ করে একটা দরজা খুলে গেল এবং সেখানে প্রায় মানুষের আকৃতির একটা এনরয়েড উঁকি দিল। রুখের বুকের মাঝে হঠাৎ রক্ত ছলাৎ করে ওঠে–এইটি কি বুদ্ধিমত্তায় মানুষ থেকেও দুই কিংবা তিন মাত্রা উপরের স্তরের?

এনরয়েডটি ঘরের ভিতরে ঢুকে রুখের কাছাকাছি এসে অনেকটা যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেল। বুদ্ধিমত্তায় উপরের স্তরের হলেও এনরয়েডটির চলাফেরার ভঙ্গিটি পুরোনো ধাচের। রুখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এনরয়েডটির দিকে তাকিয়ে থাকে, মাথার কাছে দুটি ফটোসেলের চোখ, সেখানে বুদ্ধিমত্তার কোনো চিহ্ন নেই।

এনরয়েডটি রুখের দিকে তাকিয়ে এক ধরনের যান্ত্রিক গলায় বলল, তোমার কাপড় জামা খুলে টেবিলটাতে শুয়ে পড়।

কাপড়–জামা খুলে? মানে সবকিছু খুলে?

হ্যাঁ। এখানে আর কেউ নেই। তোমার লজ্জা পাবার কিছু নেই। আমি যন্ত্র। মানুষ যন্ত্রের সামনে লজ্জা পায় না।

রুখ কাপড় খুলতে খুলতে হঠাৎ লজ্জা নামক সম্পূর্ণ মানবিক এই ব্যাপারটি কীভাবে কাজ করে বোঝার চেষ্টা করল কিন্তু তার সময় পেল না। কারণ তার আগেই এনরয়েডটি শীতল হাত দিয়ে তার পাজরে স্পর্শ করে কিছু একটা দেখতে শুরু করেছে। রুখ কষ্ট করে নিজেকে স্থির রেখে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমরা পাইয়ের মান দশমিকের পর কত ঘর পর্যন্ত বলতে পার?

বারো।

বারো? রুখ অবাক হয়ে বলল, মাত্র বারো? আমিই তো বারো থেকে বেশি বলতে পারি!

আমার যে ধরনের কাজকর্ম করতে হয় তাতে দশমিকের পর বারো ঘরের বেশি প্রয়োজন হয় নি।

কিন্তু কিন্তু

কিন্তু কী?

আমি শুনেছি তোমরা কয়েক মিলিয়ন পর্যন্ত বলে যেতে পার।

ভুল শুনেছ। আমরা পারি না। এনরয়েডটি রুখকে ছোট একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, টেবিলটাতে শুয়ে পড়।

রুখ টেবিলটাতে শুয়ে পড়ে এনরয়েডটার দিকে তাকাল, সেটি উপর থেকে কিছু যন্ত্র নিচে টেনে নামাতে থাকে। রুখের বুকের উপর চতুষ্কোণ এবং মসৃণ একটি মনিটর বসিয়ে এনরয়েডটি বলল, তুমি এখন জোরে জোরে নিশ্বাস নাও।

রুখ কয়েকবার জোরে জোরে নিশ্বাস নেয়, সাথে সাথে আশপাশে কয়েকটা যন্ত্রের ভেতর থেকে নিচু কম্পনের কিছু ভোঁতা শব্দ শুনতে পায়। এনরয়েডটি হেলমেটের মতো দেখতে একটি গোলাকার জিনিস তার মাথার মাঝে লাগাতে থাকে। রুখ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে এনরয়েডটি লক্ষ করতে করতে বলল, তুমি কী করছ?

মানুষের বসতি থেকে কেউ এলে তাদের পরীক্ষা করতে হয়। জিনেটিক মিউটেশান কী পর্যায়ে আছে সেটি লক্ষ রাখতে হয়। এগুলো রুটিন কাজ, তোমার ভয় পাবার কিছু নেই।

আমি–আমি আসলে ঠিক ভয় পাচ্ছি না–

পাচ্ছ। আমি জানি তোমার শরীরের সমস্ত অনুভূতি আমার সামনে মনিটরে দেখানো হচ্ছে। আমার কাছ থেকে তোমার ভয় পাবার কিছু নেই। আমি তোমার মতো একজন।

আমার মতো?

হ্যা আমার বুদ্ধিমত্তা মানুষের সমান। নিনীষ স্কেলে আট।

তুমি তুমি এখানে কী করছ? আমি ভেবেছিলাম নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে সব এনরয়েড আমাদের থেকে বুদ্ধিমান।

না সবাই নয়। রুটিন কাজ করার জন্যে আমাদের মতো অনেকে আছে। এখন কথা বোলা না, তোমার প্রিয় কোনো জিনিস নিয়ে চিন্তা করতে থাক।

কেন?

তোমার মস্তিষ্ক স্ক্যান করা হচ্ছে।

মস্তিষ্ক কীভাবে স্ক্যান করে?

খুব সোজা। কিছু ইলেকট্রড তোমার করোটিকে স্পর্শ করে। উচ্চ কম্পনের বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ সেই ইলেকট্রড দিয়ে তোমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করে তার প্রতিফলিত আবেশ রেকর্ড করা হয়।

কী লাভ তাতে?

সেই স্ক্যান দেখে তোমার সম্পর্কে সবকিছু জানা যাবে। তুমি কী জান, তুমি কীভাবে চিন্তা কর সবকিছু।

কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?

তোমার কিংবা আমার জন্য সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু যাদের বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে দুই মাত্রা উপরে তারা পারে। কাজেই তুমি কথা না বলে চুপ করে শুয়ে থাক। সুন্দর কিছু একটা ভাব।

রুখ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে এনরয়েডটির দিকে তাকিয়ে রইল, একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি সত্যি বলছ?

হ্যাঁ। আমি মিথ্যা বলতে পারি না

এই যারা বুদ্ধিমান এনরয়েড, তারা–মানে তারা কী রকম?

তারা অসম্ভব বুদ্ধিমান। সত্যি কথা বলতে কী তুমি কিংবা আমি সেটা কল্পনা করতে পারব না। তুমি নিজেই দেখবে।

আমার কি কোনো বিপদ হতে পারে?

এনরয়েডটা কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। রুখ ভয়–পাওয়া গলায় বলল, কী হল? কথা বলছ না কেন?

বিপদ?

হ্যাঁ।

তুমি যদি স্বাভাবিক একজন মানুষ হও–তোমার চিন্তা–ভাবনা যদি খুব সাধারণ হয়, তোমার কোনো বিপদ নেই। কিন্তু যদি তোমার মাঝে কোনো অস্বাভাবিকতা থাকে তারা তোমাকে নিয়ে কৌতূহলী হতে পারে।

কৌতূহলী হলে তারা কী করে?

তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। শেষবার একজনের মস্তিষ্ক খুলে দেখেছিল।

রুখ আতঙ্কে শিউরে উঠল, বলল, কী বলছ? এটা তো নিষ্ঠুরতা!

আমি যদি তোমার মস্তিষ্ক খুলে নিই সেটা হবে নিষ্ঠুরতা। বুদ্ধিমত্তায় যারা অনেক উপরে তাদের জন্যে এটা নিষ্ঠুরতা নয়। তুমি কি ল্যাবরেটরিতে ইঁদুর কেটে দেখ নি? সেটা কি নিষ্ঠুরতা ছিল?

কিন্তু

আর কথা নয়। চুপ করে শুয়ে থাক কিছুক্ষণ। তোমার প্রিয় কোনো জিনিসের কথা ভাব।

রুখের ক্রীনার কথা মনে পড়ল। তার কান, চোখ, কোমল ত্বক। সতেজ দেহ। তার নরম কণ্ঠস্বর। কুখ চোখ বন্ধ করে ক্রীনাকে দেখতে চাইল কিন্তু একটু পর পর তার মনোযোগ ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল–বুকের ভিতর এক অজানা আশঙ্কা কেঁপে কেঁপে উঠছিল।

.

রুখ যে–ঘরটির ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা বিশাল এবং গোলাকার। ঘরের দেয়াল ঈষৎ আলোকিত এবং অর্ধস্বচ্ছ কিন্তু দেয়ালের অন্যপাশে কী আছে সেটা দেখার কোনো উপায় নেই। রুখ দেয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে আবিষ্কার করেছে দেয়ালটি তার কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। সম্ভবত তাকে ঘিরে কোনো দেয়াল নেই, সম্ভবত সে ছোট একটা

• প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে এবং সে হাঁটলে প্ল্যাটফর্মটি উলটোদিকে সরতে থাকে, কাজেই সে আসলে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে নড়তে পারে না। হয়তো আসলে এখানে কোনো ঘর নেই, পুরো ব্যাপারটি এক ধরনের দৃষ্টিবিভ্রম। হয়তো সে আসলে একটা ছোট অর্ধগোলকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, যার বাইরে থেকে কিছু বুদ্ধিমান এনরয়েড তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে দেখছে। কেউ তাকে লক্ষ করছে। অনুভূতিটি এত তীব্র যে রুখের মনে হতে থাকে অনেকে যেন নিচু গলায় কথা বলছে। কুখ তার সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে কথা শোনার চেষ্টা করে। একটি–দুটি কথা সে শুনতে পায় কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না।

রুখ যখন কথা শোনার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিচ্ছিল তখন কে যেন খুব কাছে থেকে বলল, মানব–সদস্য।

রুখ চমকে উঠল, কে?

আমি।

আমি কে?

তুমি আমাকে চিনবে না।

আপনি কি বুদ্ধিমান এনরয়েড?

কে যেন নিচু গলায় হাসল, বলল, বুদ্ধিমত্তা অত্যন্ত আপেক্ষিক ব্যাপার।

কিন্তু বুদ্ধিমত্তার একটি পরিমাপ তৈরি হয়েছে। সেই পরিমাপ অনুযায়ী আপনি সম্ভবত মানুষ থেকে বুদ্ধিমান।

সম্ভবত।

আমি মানুষ থেকে বুদ্ধিমান কোনো অস্তিত্ব কখনো দেখি নি। আমি কি আপনাকে দেখতে পারি?

মানুষ বুদ্ধিমত্তার যে পর্যায়ে আছে সেখানে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য আকৃতির একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে। তুমি সম্ভবত আমার আকৃতিকে গ্রহণ করতে পারবে না।

আমি–আমি তবু একবার দেখতে চাইছিলাম।

ঠিক আছে।

খুব ধীরে ধীরে অর্ধগোলাকৃতির ঘরটির বাইরে আলোকিত হয়ে গেল এবং রুখ দেখতে পেল তার খুব কাছাকাছি একটি কদাকার এনরয়েড দাঁড়িয়ে আছে। এনরয়েডটি দেখতে অস্পষ্ট জ্বণের মতো, মানুষের অনুকরণে তৈরি ছোট একটি দেহের উপরে একটি বড় মাথা। মাথার ভিতর থেকে অনেকগুলি ছোট ছোট নল বের হয়ে শরীরের নানা জায়গায় প্রবেশ করেছে। মাথার ভিতরে শক্তিশালী কপোট্রনটিকে শীতল করার জন্য নিশ্চয়ই সেখানে কোনো ধরনের তরল প্রবাহিত হচ্ছে। এনরয়েডটির দুটি হাত, হাতের প্রান্তে আঙুলের মতো সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি। যে দুটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে সেগুলো শক্তিশালী এবং জটিল। এনরয়েডটির মাথার কাছে দুটি চোখ, রুথ সেদিকে তাকিয়ে শিউরে ওঠে, সেখানে এক ধরনের অমানুষিক দৃষ্টি। এনরয়েডটি নিচু গলায় বলল, আমি বলেছিলাম তুমি আমার আকৃতিকে গ্রহণ করতে পারবে না। আমার হিসাব অনুযায়ী তুমি আমাকে কদাকার এবং কুৎসিত মনে করছ।

না মানে

তাতে কিছু আসে–যায় না। প্রাণিজগতে অক্টোপাসকে বুদ্ধিমান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অক্টোপাস যদি বিবর্তনে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে গড়ে উঠত তারা সম্ভবত মানুষকে অত্যন্ত কুৎসিত প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করত।

আপনি ঠিকই বলেছেন মহামান্য—

আমার কোনো নাম নেই।

আপনি যদি অনুমতি দেন আমি আপনাকে কি একটা প্রশ্ন করতে পারি?

কর।

আপনাদের দেহের আকৃতি মানুষের কাছাকাছি। পুরোপুরি মানুষের আকৃতি না নিয়ে তার কাছাকাছি কেন?

মানুষের আকৃতির যে সকল বিষয় উন্নত শুধু সেগুলো গ্রহণ করা হয়েছে।

মহামান্য এনরয়েড, আপনার ভিতরে কি মানুষের অনুভূতি আছে?

হ্যাঁ আছে। অনেক তীব্রভাবে আছে।

আপনার ভিতরে কি ক্রোধ, ঘৃণা বা হিংসা আছে?

হ্যাঁ আছে।

আমি ভেবেছিলাম বুদ্ধিমত্তা যখন বিকশিত হয় তখন মানুষের নিচু প্রবৃত্তিগুলো লোপ পায়।

এনরয়েডটি হঠাৎ হাসির মতো শব্দ করল, বলল, প্রবৃত্তি কখনো নিচু কিংবা উঁচু হয়। অস্তিত্বের জন্য প্রবৃত্তির প্রয়োজন আছে।

মহামান্য এনরয়েড, নিচু শ্রেণীর প্রাণীর তুলনায় আমাদের মাঝে অনুভূতি অনেক বেশি। সেরকমভাবে আমাদের তুলনায় আপনার মাঝেও কি অনুভূতি বেশি? যে অনুভূতি আমাদের নেই সেরকম কিছু কি আপনাদের আছে?

হ্যাঁ। আছে।

সেটি কী রকম মহামান্য এনরয়েড?

আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না। তবে তুমি যদি আমার চোখের দিকে তাকাও তা হলে সেই অনুভূতিটির একটু তোমাকে অনুভব করাতে পারি। তুমি কি চাও?

রুখ ভয়ে ভয়ে বলল, আমি চাই মহামান্য এনরয়েড।

তা হলে আমার কাছে এস। আমার চোখের দিকে তাকাও।

রুখ এক পা এগিয়ে এনরয়েডটির দিকে তাকাল। এনরয়েডটির চোখের গভীরে হঠাৎ একটি বিশাল শূন্যতা উঁকি দিতে শুরু করে। হঠাৎ রুখ এক ভয়াবহ আতঙ্কে চিৎকার করে দুই হাতে নিজের চোখ ঢেকে ফেলে। সে হাঁটু ভেঙে নিচে পড়ে যায়, তার সারা শরীর অনিয়ন্ত্রিতভাবে থরথর করে কাঁপতে থাকে।

মানব–সদস্য এনরয়েডটি নরম গলায় বলল, তুমি সম্ভবত এখনো এই অনুভূতির সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও নি।

রুখ কোনোমতে নিজের পায়ের উপর উঠে দাঁড়াল। দুই হাতে মুখ ঢেকে বড় বড় নিশ্বাস নিতে নিতে বলল, না, হই নি। এ ধরনের ভয়ঙ্কর শূন্যতার অনুভূতি আমাদের নেই।

আমরা এটিকে বলি বিস্থিতি। যখন স্থিতি হতে ইচ্ছে করে না সেটি হচ্ছে বিস্থিতি।

কী আশ্চর্য! এবং কী ভয়ঙ্কর!

মানব–সদস্য—

মহামান্য এনরয়েড, আমার নাম রুখ।

আমি জানি। তোমার সাথে পরিচয়পর্ব শেষ হয়েছে, আমরা কি এখন কাজ শুরু করতে পারি?

রুখ হঠাৎ করে নিজের ভিতরে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকে। সে। দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল, বলল, পারেন মহামান্য এনরয়েড।

তোমার মস্তিষ্কের স্ক্যানটি আমি দেখেছি। সেখানে কিছু দুর্বোধ্য তথ্য রয়েছে।

দুর্বোধ্য?

হ্যাঁ। দুর্বোধ্য এবং কৌতূহলী। তোমার ধারণা মেতসিসে মানুষের উপস্থিতির প্রয়োজন আছে। তুমি কেন এই ধারণা পোষণ কর?

মহামান্য এনরয়েড–পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব নেই। মেতসিসে পাঠানোর জন্য যদি মানুষের জিনস থেকে তাদেরকে নতুন করে সৃষ্টি করা না হত তা হলে আমাদের জন্ম হত না। আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী আমরা এখানে (কালি নি, এখানে আপনারা আমাদের এনেছেন।

হ্যাঁ। কিন্তু তোমরা এখানে বাহুল্য। তোমরা মেতসিসের জন্য একটি বিশাল সমস্যা। আমরা প্রায়ই মেতসিসের জৈবজগৎটি অবলুপ্ত করে দেওয়ার কথা ভাবি। তোমরা এখানে পুরোপুরি আমাদের করুণার উপরে বেঁচে আছ। কিন্তু তোমার মস্তিষ্ক স্ক্যান করে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জিনিস দেখতে পেয়েছি।

রুখ শুকনো গলায় বলল, কী দেখতে পেয়েছেন মহামান্য এনরয়েড?

দেখতে পেয়েছি তুমি বিশ্বাস কর মেতসিসে মানুষ না থাকলে তার উদ্দেশ্য অসম্পূর্ণ হত।

রুখ দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকাল। বলল, মহামান্য এনরয়েড, আপনি বলেছেন আপনাদের মানুষের মতো ক্রোধ এবং ঘৃণা রয়েছে। আমার কথা শুনে সম্ভবত আপনার মাঝে ক্রোধের সৃষ্টি হবে। আপনাদের অনুভূতি অত্যন্ত তীব্র হয়তো সেই ক্রোধ আমার ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনবে। সেই কথা চিন্তা করে আমি অত্যন্ত তীত মহামান্য এনরয়েড।

আমি জানি। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। বুদ্ধিমত্তায় অত্যন্ত নিচু স্তরের অস্তিত্বের জন্য আমরা কখনো সমবেদনা অনুভব করতে পারি না। তোমাদের অস্তিত্বের আমার কাছে। কোনো মূল্য নেই। প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে আমি তোমাদের সৃষ্টি করতে পারি কিংবা ধ্বংস করতে পারি।

রুখ কদাকার এনরয়েডটির দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল, মাথা নিচু করে বলল, আপনার কাছে আমার সুকানোর কিছু নেই। আপনি জানেন আমি কেন মেতসিসে মানুষের অস্তিত্বকে প্রয়োজনীয় মনে করি।

তুমি মনে কর আমাদের বুদ্ধিমত্তার উন্নতি খুব দ্রুত হচ্ছে, তার পরিণতি কী হবে জানা নেই।

হ্যাঁ মহামান্য এনরয়েড। সেই তুলনায় মানুষের উন্নতি হয়েছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। বিবর্তন পরীক্ষিত একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে কোনো ঝুঁকি নেই। মেতসিস কোথায় পৌঁছাবে আমরা জানি না কিন্তু মানুষকে এখানে রাখা হলে তারা তাদের বুদ্ধিমত্তা সেখানে পৌঁছে দেবে।

বুদ্ধিমান এনরয়েডটি হঠাৎ খলখল করে হেসে উঠল, হাসতে হাসতে বলল, তোমার জন্য আমার করুণা হচ্ছে মানব–সন্তান।

রুখ আতঙ্কে শিউরে উঠে বলল, কেন মহামান্য এনরয়েড?

তোমার বিশ্বাস যে কত ভিত্তিহীন সেটা তুমি জান না।

কেন আপনি এটা বলছেন মহামান্য এনরয়েড। মানুষ যে–বিবর্তনের মাঝ দিয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে সেটি তো ভিত্তিহীন তথ্য নয়।

কিন্তু মেতসিসে তোমরা বিবর্তনের মাঝ দিয়ে যাবে সেটি সত্য নয়।

আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।

তুমি আমার সাথে এস। আমি তোমাকে একটি জিনিস দেখাই। তবে

তবে কী?

তুমি যে জিনিসটি দেখবে সেটি তুমি অন্য মানব–সদস্যকে বলতে পারবে না।

রুখের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, সে কাঁপা গলায় বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

তুমি যেন বলতে না পার সে জন্য আমি তোমার অস্তিত্বকে ধ্বংস করে দেব।

না। রুখ কাতর গলায় বলল, না। তাহলে আমি দেখতে চাই না।

তোমাকে দেখতে হবে। এনরয়েডটি অত্যন্ত কঠোর গলায় বলল, স্বল্প বুদ্ধিমত্তার প্রাণীদের জন্য অহঙ্কার অত্যন্ত বিপজ্জনক।

রুখ অনুনয় করে বলল, মহামান্য এনরয়েড, আমি আপনার কাছে আমার প্রাণ ভিক্ষা চাইছি।

আমি তোমাকে বলেছি মানব–সদস্য। নির্বোধ প্রাণীদের জন্য আমাদের ভিতরে কোনো সমবেদনা নেই। তুমি কি কখনো অবলীলায় নিচু স্তরের প্রাণী হত্যা কর নি? করেছ। আমরাও করি। এস।