০৪. আজ আর জিপ নয়

আজ আর জিপ নয়, অসীম দত্ত নিলেন একটা কালো রঙের অ্যাম্বাসাডার গাড়ি। এইরকম বড়বড় পুলিশ অফিসারের সঙ্গে সবসময় একজন বডিগার্ড থাকে। সেই বডিগার্ড আর অসীম দত্ত বসলেন সামনে, পেছনে কাকাবাবু, সন্তু আর অলি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর গাড়ি যখন বেহালা পার হয়ে গিয়ে অনেকটা ফাঁকা রাস্তায় পড়ল, তখন অসীম দত্ত বললেন, সবাই এত গোমড়ামুখে রয়েছ। কেন? কাকদ্বীপ পৌঁছবার পরে কাজ শুরু হবে, তার আগে তো কিছু করার নেই। অলি, তুই বরং একটা গান ধর।

অলি করুণভাবে বলল, আমার এখন গান গাইতে ইচ্ছে করছে না।

অসীম দত্ত বললেন, পরীক্ষার আগে তোর প্র্যাকটিস হয়ে যেত।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী গান শিখছ অলি?

অলির বদলে তার বাবা উত্তর দিলেন, ক্ল্যাসিকাল আর রবীন্দ্রসঙ্গীত।

আমার মেয়ে বলে প্রশংসা করছি না। সত্যিই ওর গানের গলা বেশ ভাল।

কাকাবাবু বললেন, অলি, তুমি খরবায়ু বয় বেগে, চারিদিক ছায় মেঘে, এই গানটা জানো?

অলি মাথা হেলিয়ে বলল, জানি।

কাকাবাবু বললেন, আমি যদি এ গানটা গাইতে গিয়ে সুর ভুল করি, তুমি ঠিক করে দেবে?

সঙ্গে-সঙ্গে কাকাবাবু ওই গানটা ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা-এর সুরে গাওয়া শুরু করলেন, সবাই হেসে উঠল। কাকাবাবু বললেন, এবার তুমি সুরটা ঠিক করে দাও!

অলি আস্তে-আস্তে খরবায়ু বয় বেগে গাইতে গেল, কিন্তু তারও সুর ধনধান্য পুষ্প ভরার মতো হয়ে গেল অনেকটা!

কাকাবাবু হেসে বললেন, দেখেছ, নকল গান কীরকম আসল গান ভুলিয়ে দেয়! আমি আর একটা গান গাইছি। দ্যাখো, এটা আগে শুনেছ কি না!

শুনেছো কি বলে গেল সীতানাথ বন্দ্যো
আকাশের গায়ে নাকি টক টক গন্ধ!
টক টক থাকে নাকো হলে পরে বৃষ্টি
তখন দেখেছি চেটে একেবারে মিষ্টি।

অসীম দত্ত বললেন, এটা তো সুকুমার রায়ের লেখা। সুর দিয়েছে কে?

সন্তু বলল, এটা কাকাবাবুর খুব প্রিয় গান। কাকাবাবুই সুর দিয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, নিজে সুর দেওয়ার কী সুবিধে বলো তো? এক-একবার এক-এক সুরে গাওয়া যায়, কেউ বলতে পারবে না যে সুর ভুল হয়েছে!

গান আর গল্প করতে করতে ডায়মন্ড হারবার এসে গেল।

অসীম দত্ত বললেন, অর্ক মজুমদারকে ডেকে নেওয়া যাক, কী বলো?

কাকাবাবু বললেন, তাতে খানিকটা দেরি হয়ে যাবে। আগে চলো কাকদ্বীপ ঘুরে আসি।

গাড়ি থামল না, এগিয়ে চলল।

কাকাবাবু অলিকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ভাল নাম রূপকথা, এমন সুন্দর নাম আগে শুনিনি। এ নাম কে রেখেছে?

অলি বলল, ঠাকুমা।

অসীম দত্ত বললেন, আমার মা অনেক ছেলেমেয়েদের নাম দেন। আমাদের আত্মীয়স্বজন কিংবা পাড়ার মধ্যে কারও ছেলে বা মেয়ে জন্মালেই সে মাকে নাম ঠিক করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে। মা সব নতুন ধরনের নাম ভেবে বার করেন। কদিন আগে একটা ছেলের নাম রেখেছেন নির্ভয়।

সন্তু বলল, এই রে, যদি ছেলেটা পরে ভিতু হয়?

কাকাবাবু বললেন, ওইরকম নামের জন্যই সে ভিতু হতে পারবে না।

অসীম দত্ত বললেন, নামের সঙ্গে কি সকলের মিল থাকে? যার নাম পদ্মলোচন, তার কি কখনও চোখ কানা হতে পারে না?

কাকাবাবু বললেন, রূপকথা নামটা কিন্তু অলিকে খুব মানিয়েছে। আচ্ছা অলি, তুমি আর কী কী দূরের জিনিস দেখেছ? যেমন তুমি জোজোকে একটা অন্ধকার ঘরে দেখতে পেলে?

অলি বলল, আমি মাঝে-মাঝে এরকম দেখি। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করে। সবাই ভাবে, বানিয়ে বানিয়ে বলছি।

কাকাবাবু বললেন, দু-একটা তো মিলেও যায়!

অসীম দত্ত বললেন, তুমি যদি কারও হাত দেখে দশটা কথা বলে, তা হলে একটা-দুটো মিলে যেতেই পারে!

কাকাবাবু বললেন, অলি, তোমার পিসিমণি আসবার মতন, তুমি আর কী বলেছ, যা মিলে গেছে?

অলি বলল, একদিন আমি ছাদের ঘরে বসে বই পড়ছি, হঠাৎ খুব জোর একটা শব্দ শুনলাম। মনে হল, একটা মোটরসাইকেল খুব জোর ছুটে যাচ্ছে। খুব কাছে। রাস্তায় উঁকি দিয়ে দেখলাম, সেখানে কোনও মোটরসাইকেল নেই। কেমন যেন ভয়-ভয় করল। তারপরই দেখতে পেলাম ছোটকাকাকে। তার মুখ দিয়ে ভলকে-ভলকে রক্ত বেরোচ্ছে।

থেমে গিয়ে, বাবার দিকে তাকিয়ে অলি আড়ষ্টভাবে বলল, একথাটা তোমাদের বলিনি। আমার এমন ভয় করছিল!

অসীম দত্ত দারুণ অবাক হয়ে বললেন, তুই সত্যি এরকম দেখেছিলি? জানো রাজা, আমার ছোটভাই থাকে পটনায়। সে মোটরসাইকেল অ্যাকসিডেন্ট করেছিল। খুব জোর প্রাণে বেঁচে গেছে। কয়েকটা পাঁজরা ভেঙে গিয়েছিল, আর চারখানা দাঁত! আমরা খবর পেয়েছিলাম দুদিন পরে। অলি তা আগে থেকে কী করে জানবে? অলি, তুই আগে বলিসনি, এখন বানাচ্ছিস না তো?

কাকাবাবু বললেন, না, ও বানাচ্ছে না। ওর মুখ দেখেই বোঝা যায়!

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুমি তো জোজোকে কখনও দ্যাখোনি। তাকে চেনো। তুমি কী করে বুঝলে, অন্ধকার ঘরে জোজোকে বেঁধে রাখা হয়েছে?

অলি আমতা-আমতা করে বলল, জোজোকে চিনি না…তোমরা যখন জোজোর কথা বলছিলে, তখন হঠাৎ দেখলাম…তোমারই বয়েসী একটা ছেলে, হাত বাঁধা, মুখ বাঁধা…

অসীম দত্ত মাথা নেড়ে বললেন, এটা মিলবে না। আমার ধারণা, আজ বিকেলের মধ্যেই ছেলেটার খোঁজ পাওয়া যাবে।

গাড়িটা কাকদ্বীপ বাজার পেরিয়ে যেতেই সন্তু চেঁচিয়ে বলে উঠল, আরে! তাঁবুটা কোথায়?

সত্যিই মাঠের মধ্যে কাল বিরাট সার্কাসের তাঁবু ছিল, মাইকে অনবরত ঘোষণা হচ্ছিল, গান বাজছিল, এখন সব চুপচাপ, তাঁবুটাও নেই।

তবে, কয়েকটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, জিনিসপত্র তোলা হচ্ছে। ভারী ভারী বাক্স বয়ে আনছে কিছু লোক। একটা খাঁচায় দুটো বাঘ, আর একটা খাঁচায় একটা বাঘ। হাতিটা দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। অত বড় হাতিকে কি ট্রাকে ভোলা যাবে?

সবাই গাড়ি থেকে নেমে সেদিকে এগিয়ে গেল। কাকাবাবু একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, সার্কাস বন্ধ হয়ে গেল?

লোকটি বলল, হ্যাঁ, এর পর বজবজে হবে।

কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, কাল আমরা দেখে গেলাম, তখন তো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা কিছু শুনিনি। আজ আবার দেখব বলে বন্ধুদের নিয়ে এসেছি।

লোকটি বলল, কাল আদ্ধেকও টিকিট বিক্রি হয়নি। এরকম লোকসান দিয়ে চালানো যায় না।

অসীম দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ম্যানেজার?

লোকটি আঙুল দিয়ে একদিকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, ম্যানেজারবাবু ওইখানে বসে আছেন।

সেখানে একটা একতলা বাড়ি। তার বারান্দায় টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে আছে একজন, আর কয়েকজন ভিড় করে আছে তার সামনে।

কাছে গিয়ে দেখা গেল, কালকের সেই সোনালি কোট পরা লোকটিই ম্যানেজার। কিন্তু এখন তাকে চেনা খুব শক্ত। কাল তার মাথায় ছিল কুচকুচে কালো বাবরি চুল, গায়ে সোনালি কোট, আর সাদা প্যান্ট পরা। আজ তার মাথায় আধখানা টাক, বাকি চুল কাঁচা-পাকা, অর্থাৎ কাল পরচুলা পরে ছিল। পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি, বেশ ভুড়িওয়ালা চেহারা। ম্যানেজার কিছু লোককে হিসেব করে টাকা-পয়সা মিটিয়ে দিচ্ছে।

কাকাবাবু সামনে এসে বললেন, নমস্কার ম্যানেজারবাবু। সার্কাস বন্ধ করে দিলেন?

ম্যানেজার বলল, হ্যাঁ! এবার বজবজ যাব।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কালই যে শেষ খেলা, তা তো একবারও ঘোষণা করলেন না? আমরা ভেবেছিলাম, আজকে আর একবার দেখব। বিশেষ করে ওই মানুষ অদৃশ্য করার খেলাটা…

ম্যানেজার বলল, আহা, ওইজন্যই তো বন্ধ করে দিতে হল এখানে। ও খেলাটা আর দেখানো যাবে না। ম্যাজিশিয়ান মিস্টার এক্স কাল রাত্তিরেই কাজ ছেড়ে দিয়েছে। কত করে বোঝালাম, একশো টাকা বেশি দেব বললাম, তাও থাকতে চাইল না।

এবার কাকাবাবুর ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি ম্যানেজারের চোখে চোখ রেখে বললেন, মিস্টার এক্স কাজ ছেড়ে দিয়েছেন? কেন, আপনার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে?

ম্যানেজার বলল, না, না, ঝগড়া হবে কেন? হঠাৎ বলল, আর খেলা দেখাবে না।

উনি আপনার সার্কাসে কতদিন আছেন?

ও তো আমার স্টাফ নয়। এখানে তাঁবু ফেলার পর নিজে থেকেই এসে বলেছিল, ওই খেলাটা দেখাবে। আমার মনে হল, ওটা একটা অ্যাট্রাকশান হবে। তা ও খেলাটা লোকে নিচ্ছিল খুব। এরকম তো হয়, যত লোক খেলা দেখায়, সবাই সার্কাসের স্টাফ নয়। কিছু কিছু লোকাল আর্টিস্টও নিতে হয়।

যে লোকটা দু হাতে দুটো লাঠি নিয়ে খেলা দেখাল, সেও তো লোকাল।

মিস্টার এক্স-এর আসল নাম কী?

তাও তো আমি জানি না। সে একটা ন্যাড়া-মাথা অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়ে এসেছিল, তাকেও আমরা ন্যাড়া-ন্যাড়া বলেই ডেকেছি।

মিস্টার এক্স কতদিন ওই খেলা দেখিয়েছেন?

দশদিন।

এই দশদিনে যত লোককে অদৃশ্য করা হয়েছিল, তাদের ফেরত পাওয়া গেছে?

ম্যানেজার এবার কাকাবাবুর বগলের কাচদুটোর দিকে তাকিয়ে চিনতে পারল। দু হাত ছড়িয়ে বলল, আপনি কাল একটা ছেলের খোঁজ নিতে এসেছিলেন না? আপনি তো বড় তাজ্জব কথা বললেন মশাই। মানুষ কি সত্যি-সত্যি অদৃশ্য হতে পারে নাকি? ও তো ভেলকিবাজি। আলোর কারসাজি। অডিয়েন্সের ভেতর থেকে যদি কেউ আসে, সে খেলা শেষ হওয়ার একটু বাদে নিজের সিটে ফিরে যায়।

কাকাবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, কিন্তু আমাদের সঙ্গে যে ছেলেটি ছিল, সে ফিরে আসেনি।

অসীম দত্ত তাঁর বডিগার্ডকে বললেন, সুলেমান, এখানকার থানায় চলে যাও। বড়বাবুকে আমার নাম করে ডেকে আনো। এক্ষুনি আসতে বলবে।

তারপর তিনি ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনিই কি এই সার্কাসের মালিক? আপনার নাম কী?

ম্যানেজার বলল, না, সার, আমি ম্যানেজার। তবে মালিকের সঙ্গে কিছুটা শেয়ার আছে। মালিক থাকেন কানপুরে। আমার নাম জহুরুল আলম। সার্কাসের লাইনের লোকেরা আমাকে জহরভাই বলে চেনে।

অসীম দত্ত বললেন, আপনার আজ বজবজ যাওয়া হবে না। জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিন, আপনাকে এখানে থাকতে হবে।

জহুরুল আলম একগাল হেসে বলল, তাই নাকি? আমি বজবজ যেতে পারব না? কে আমায় আটকাবে?

অসীম দত্ত বললেন, থানা থেকে বড়বাবু আসছেন। তিনি আপনাকে থানায় নিয়ে যাবেন!

জহুরুল আলম এবার হাসি থামিয়ে অবজ্ঞার সুরে বলল, বললেই হল? ওরকম পুলিশ আমার ঢের দেখা আছে! কেন আমায় আটকাবে, আমি কী দোষ করেছি?

অসীম দত্ত বললেন, কাল থেকে আপনারা একটা ছেলেকে গাপ করে রেখেছেন। তাকে ফেরত না পেলে আপনাকে ছাড়া হবে না!

জহুরুল আলম বলল, গাপ করে রেখেছি? খামোক একটা ছেলেকে ধরে রাখতে যাব কেন? সে ছোঁড়া নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে কোথাও লুকিয়ে আছে, তার জন্য আমার দোষ হল? তা ছাড়া মিস্টার এক্স খেলা দেখিয়েছে, তাকে জিজ্ঞেস করুন গিয়ে।

অসীম দত্ত বললেন, আপনিই তো বললেন, মিস্টার এক্স কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। আপনি সত্যি কথা বলছেন কিনা, তা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।

এই সময় হঠাৎ একটা বিকট চিৎকার শোনা গেল। যেখানে ট্রাকগুলোতে জিনিসপত্র তোলা হচ্ছিল, সেখানকার লোকগুলো প্রাণ ভয়ে দৌড়চ্ছে। দু-একজন চেঁচিয়ে বলল, বাঘ! বাঘ!

জহুরুল আলমের মুখোনা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে বলল, সর্বনাশ! নিশ্চয়ই একটা বাঘের খাঁচার দরজা খুলে গেছে!

এই কথা বলেই সে টেবিলটা উলটে দিয়ে দৌড় মারল।

অসীম দত্ত পকেট থেকে রিভলভার বার করলেন। কাকাবাবু বললেন, এ কী করছ, তুমি কি রিভলভার দিয়ে বাঘ মারবে নাকি? সে-চেষ্টাও কোরো না। তুমি গুলি চালালে বাঘ নির্ঘাত তোমার দিকেই তেড়ে আসবে, ওই গুলিতে ওর কিছু ক্ষতি হবে না।

লোকেরা দৌড়চ্ছে, বাঘটাকে এখনও দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু একবার ডাক শোনা গেল।

এই ছোট বাড়িটার দুটো ঘরের দরজাই তালাবন্ধ। ভেতরে আশ্রয় নেওয়া যাবে না, ভোলা বারান্দা। কাকাবাবু বললেন, সবাই দৌড়ে গিয়ে গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ো। গাড়ির মধ্যে থাকলে বাঘ কিছু ক্ষতি করতে পারবে না।

অন্যরা দৌড়তে পারে। একমাত্র কাকাবাবুরই দৌড়বার ক্ষমতা নেই। সন্তুও অন্যদের সঙ্গে গাড়ি পর্যন্ত দৌড়ে গেল, তারপর কাকাবাবুর কথা মনে পড়ায় আবার ফিরে এল।

কাকাবাবু তাকে ধমক দিয়ে বললেন, তুই ফিরে এলি কেন? শিগগির যা, গাড়িতে ঢুকে পড়। আমার কিছু হবে না।

অসীম দত্তকে বারণ করলেও কাকাবাবু নিজের রিভলভারটা হাতে নিলেন। তারপর ক্রাচে ভর দিয়ে যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি এগোতে লাগলেন গাড়ির দিকে।

অন্য লোকেরা এর মধ্যে কোথায় হাওয়া হয়ে গেছে। মাঠে আর কেউ নেই। এবার দেখা গেল বাঘটাকে। বেরিয়ে এল একটা ট্রাকের আড়াল থেকে। কাকাবাবুর দিকেই সে ছুটে আসছে।

কাকাবাবু গাড়ির কাছাকাছি প্রায় পৌঁছে গেছেন। অলি হিস্টিরিয়া রোগীর মতন চিৎকার করছে, কাকাবাবু, কাকাবাবু, বাঘ! এসে পড়ল, এসে পড়ল।

কাকাবাবু বাঘটার দিকে চোখ রেখে পেছোতে লাগলেন। গাড়ির দরজা খুলে অসীম দত্ত ঝট করে কাকাবাবুকে টেনে নিলেন ভেতরে। সব কাচ তুলে দেওয়া হল। ড্রাইভারকে বলা হল, স্টার্ট দাও, স্টার্ট দাও!

ড্রাইভার পরিতোষ এমনই ভয় পেয়ে গেছে যে, থরথর করে কাঁপছে। গাড়ির চাবিটা খসে পড়ে গেছে নীচে, সে খুঁজেই পাচ্ছে না।

বাঘটা চলে এল গাড়ির একেবারে কাছে। বেশ বড় বাঘ। কাল সার্কাসের খেলার সময় সবকটা বাঘকেই মনে হচ্ছিল বুড়ো আর ক্লান্ত, এখন তা মনে হচ্ছে না। চোখ দুটো দারুণ হিংস্র, গরগর আওয়াজ করছে।

বাঘটা দুই থাবা তুলে গাড়ির জানলার কাছে মুখটা ঠেকাল।

অলি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কাচ ভেঙে ফেলতে পারে না?

অসীম দত্ত বললেন, চুপ, কথা বলিস না।

সন্তু ভাবছে, কোন খাঁচার দরজাটা খুলে গেছে? যেটাতে দুটো বাঘ ছিল, না একটা?

বাঘটা ওদের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছে, কে জানে!

একটা-একটা মুহূর্ত কাটছে, যেন এক-এক ঘণ্টা। বাঘটা কটমট করে তাকিয়ে আছে তো তাকিয়েই আছে।

অসীম দত্ত নিচু হয়ে চাবিটা খুঁজে পেয়ে ড্রাইভারকে বললেন, শিগগির চালাও!

এঞ্জিন স্টার্ট দেওয়ার শব্দ হতেই বাঘটা এক লাফে গাড়ির ছাদের ওপর উঠে গেল! ধড়াম করে একটা শব্দ হল!

এবার কী হবে? বাঘটাকে নিয়েই গাড়িটা চলবে? ড্রাইভার হতভম্ব মুখে অসীম দত্তর দিকে তাকাল।

কাকাবাবু হাত বাড়িয়ে খুব জোরে হর্ন বাজিয়ে দিলেন।

তাতে কাজ হল। হঠাৎ অত জোর শব্দ শুনে বাঘটা গাড়ির ওপর থেকে লাফিয়ে নেমে গেল মাঠে।

গাড়িটা চলতে শুরু করতেই বাঘটা তেড়ে এল সেদিকে।

অলি তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপছে। যেন এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে।

এরই মধ্যে কাকাবাবু হেসে উঠে বললেন, আহা রে, বাঘটার বোধ হয় খুব খিদে পেয়েছে। এত মুখের গেরাস ফসকে গেল!

অসীম দত্ত চেঁচিয়ে উঠলেন, জোরে চালাও, খুব জোরে!

মাঠটা এবড়োখেবড়ো, মাঝে-মাঝে বড় বড় গর্ত, গাড়ি জোরে চালানো যায়, সেটা অনবরত লাফাচ্ছে।

বাঘটা কিন্তু বেশিদূর এল না। কোথা থেকে একটা বন্দুকের গুলির শব্দ হল!

গাড়িটা পাকা রাস্তায় উঠে আসতেই অসীম দত্ত অস্থিরভাবে বললেন, ডান দিকে যাও, ডান দিকে, থানায়, থানায়!

এর মধ্যেই বাঘ বেরোবার খবর রটে গেছে। সব দোকানপাটের ঝাঁপ বন্ধ, রাস্তায় একটাও লোক নেই। কিছু বাড়ির ছাদে লোকেরা ভিড় করে আছে। সেইরকমই একটা বাড়ির ছাদ থেকে বন্দুক চালাচ্ছে একজন। কিন্তু সেখান থেকে অতদূরে বাঘটার গায়ে গুলি লাগানো অসম্ভব।

থানার সামনেও অন্য কোনও লোক নেই, শুধু তিনজন কনস্টেবল রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তাদের চোখ-মুখে ভয়ের ছাপ। অসীম দত্তর বডিগার্ডও দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের পেছনে। থানার ওসি একটা জিপগাড়িতে বসে স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু সেটা কিছুতেই স্টার্ট নিচ্ছে না।

এই গাড়িটা পৌঁছতেই ও সি নেমে এসে অসীম দত্তকে স্যালুট দিয়ে বললেন, সার, আমি এক্ষুনি যাচ্ছিলাম, জিপটা গোলমাল করছে। আপনাদের কোনও বিপদ হয়নি তো?

অসীম দত্ত গাড়ি থেকে নেমে এসে বললেন, বাঘ বেরিয়েছে, এখন কী করবেন? পুলিশ কি বাঘ ধরতে পারে? বাঘ মারাও তো নিষেধ!

ও সি বললেন, এমন আইন হয়েছে, বাঘ ইচ্ছে করলেই মানুষ মারতে পারবে। কিন্তু আমরা বাঘ মারতে পারব না।

কাকাবাবু হালকা গলায় বললেন, বাঘটা যদি নিজেই এই থানায় উপস্থিত হয়, তখন আপনারা কী করবেন? আপনাদের কী বাঘ বন্দি করে রাখার ব্যবস্থা আছে?

অসীম দত্ত বললেন, তুমি এখন রসিকতা করছ, রাজা? উফ, যা গেল না। বাঘটা যখন গাড়ির জানলার কাছে থাবা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল, এই শীতকালেও আমার গা থেকে ঘাম বেরিয়ে গেছে! সবাই নেমে এসো, থানার ভেতরে গিয়ে বসা যাক!

ওসি বললেন, বাঘ ধরার দায়িত্ব টাইগার প্রজেক্ট আর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের।

অসীম দত্ত বললেন, ডায়মন্ড হারবারে ওদের অফিসে ফোন করুন!

ওসি বললেন, খবর পাওয়ামাত্র আমি ফোন করেছিলাম। লাইন পাওয়া যাচ্ছে না। বোধ হয় ওদের টেলিফোন খারাপ!

অসীম দত্ত বিরক্তির ভঙ্গি করে বললেন, ঠিক দরকারের সময় ফোন খারাপ হয়! সব সার্কাসের দলের সঙ্গেই বাঘের একজন ট্রেনার থাকে। সে চাবুক নিয়ে শপাং-শপাং করে, বাঘেরা তাকে ভয় পায়। সে-লোকটা গেল কোথায়?

কাকাবাবু বললেন, এখন কে তাকে খুঁজতে যাবে?

সবাই মিলে থানার ভেতরে এসে বসা হল। তারপর মাঝে মাঝেই খবর আসতে লাগল নানা রকম। কেউ বলল, বাঘটা নদীর ধারে গেছে, কেউ বলল, বাঘটা একটা বাড়ির গোয়াল ঘরে ঢুকে পড়েছে, কেউ বলল, এর মধ্যেই। তিনটে মানুষ মেরেছে, কেউ বলল, একই সময় দুজায়গায় দুটো বাঘ দেখা গেছে, কেউ বলল, হাতিটাও ছাড়া পেয়ে গিয়ে বাড়িঘর ভাঙছে।

কোনটা যে সত্যি আর কোনটা মিথ্যে, তা বোঝার উপায় নেই।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। দুপুরে সেরকম কিছু খাওয়া জোটেনি, সব হোটেল বন্ধ। থানার কাছে একটা ছোট চায়ের দোকান, সেটা খোলানো হল প্রায় জোর করে। বন্দুক নিয়ে পাহারায় রইল তিনজন সেপাই। সে দোকানে কয়েকটা ডিম আর বিস্কুট ছাড়া কিছুই নেই। সেই ডিমসিদ্ধ আর বিস্কুট দিয়ে চা খেয়ে খিদে মেটানো হল কিছুটা।

কাকাবাবু বললেন, আচ্ছা অসীম, আজ তোমার বিরিয়ানি খাওয়ার কথা ছিল, তার বদলে এ তো কিছুই না!

অসীম দত্ত বললেন, বাঘের পেটে গিয়ে যে কিমা হইনি, এই যথেষ্ট!

এর পর সন্ধে হয়ে গেলে বিপদের আশঙ্কা আরও বাড়বে। অন্ধকারে অতর্কিতে বাঘ যে কখন কোথায় হানা দেবে, তা টেরও পাওয়া যাবে না।

ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লঞ্চ এসে পৌঁছল বিকেল সাড়ে চারটের সময়। তাদের সঙ্গে ঘুমপাড়ানি গুলি আছে। ওই গুলি খেয়ে বাঘ ঘুমিয়ে পড়লে তারপর তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাওয়া হবে। এখন বাঘটা কোথায় আছে, তা খুঁজে বার করা দরকার।

ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকেরা লঞ্চ থেকে নেমে প্রথমে থানায় এল। তারপর তারা অসীম দত্তর গাড়িটা ধার নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

এরা এসে পড়ায় সাধারণ মানুষের সাহস হঠাৎ বেড়ে গেছে। সেই গাড়ির পেছনে শত-শত লোক শাবল, লাঠি নিয়ে ছুটছে। এত লোকের চাচামেচিতে ভয় পেয়ে বাঘটা কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকলে, তাকে খুঁজে পাওয়া শক্ত হবে।

কাকাবাবু একটা ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে আছেন। বাঘ ধরা না পড়া পর্যন্ত বেরোনোই যাবে না। এখন কিছুই করার নেই।

ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকরা বেরিয়ে যাওয়ার পর কাকাবাবু নিজের পিঠের এক জায়গায় হাত দিয়ে বললেন, ঘুমপাড়ানো গুলি! একবার একজন আমার ওপর ওই গুলি চালিয়ে ছিল। এখনও দাগ আছে। তোর মনে আছে সন্তু?

সন্তু বলল, বাঃ, মনে থাকবে না! তারপর আমরা ত্রিপুরায় গেলাম।

কাকাবাবু বললেন, কী ঘুম ঘুমিয়েছি সেবার! বেঁচে গেছি খুব জোর! আচ্ছা সন্তু, বল তো, এই বাঘের খাঁচার দরজাটা হঠাৎ খুলে গেছে, না কেউ ইচ্ছে করে খুলে দিয়েছে?

ঘরের অন্য কোণে একটা চেয়ারে বসে আছেন অসীম দত্ত। তিনি বললেন, সে কী! কেউ ইচ্ছে করে খুলে দেবে কেন? এরকম একটা সাঙ্ঘাতিক কাজ করে তার কী লাভ?

কাকাবাবু বললেন, একটা লাভ তো বুঝতেই পারা যাচ্ছে। আমরা জোজোর খোঁজখবর নিতে এসেছিলাম, সেটা বন্ধ করে দিল। যদি সত্যি-সত্যি কেউ জোর করে জোজোকে ধরে রেখে থাকে, সেও এই তালে সরে পড়ার সুযোগ পেল! এখন সবাই বাঘ নিয়ে ব্যস্ত। জোজোর কথা কেউ ভাবছে না।