আঙ্গিক ও ভাষা (ব্রাহ্মণ)
ব্ৰাহ্মণগুলি সংস্কৃতে গদ্যসাহিত্যের প্রথম নিদর্শন; গদ্য অংশযুক্ত কৃষ্ণ যজুর্বেদের বিষয়বস্তুর প্রত্যক্ষ ও অবিচ্ছিন্ন ধারার অন্তর্গত বলেই ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যকে গণ্য করা চলে। গান বা আবৃত্তির যোগ্য স্তবকের মতো গদ্যসাহিত্যের কোনো সৃজনশীল প্রেরণার দাবি ছিল না। তবুও তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য পূরণ করত; গদ্য ব্যাখ্যা ও অর্থবাদের দ্বারা যজ্ঞানুষ্ঠানকে এই ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যই বোধগম্য ও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল। ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের বিষয়বস্তুর নিগূঢ় বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ নির্দেশ সূচনা ও ব্যাখ্যা এর গদ্যভঙ্গির চরিত্র নির্ধারণ করেছিল। মৌখিক রচনারূপে এই গদ্যের কিছু কিছু বিশেষ সমস্যা ছিল, কেননা এই বিপুল সাহিত্যকে কণ্ঠস্থ করে সম্পূর্ণভাবে স্মৃতিতেই ধারণ করতে হত, অথচ ছন্দের সাহায্য ছাড়া এই বিপুল সাহিত্যসম্ভারকে স্মৃতিতে সংরক্ষণ করা অত্যন্ত দুরূহ ছিল।
ব্ৰাহ্মণসাহিত্য তিনভাবে এই সমস্যার সমাধান করেছিল। প্রথমত, এর রচনাশৈলীর মৌল লক্ষণ হ’ল বাকসংযম বা সংক্ষিপ্ততা এবং যথাযথতা; প্রায় কোথাও কোনো একটিও অপ্রয়োজনীয় শব্দ ও বাক্যবন্ধ পাওয়া যায় না এবং সেই সঙ্গে সমাস ও সংকুচিত বাক্যাংশের প্রয়োগ এবং খণ্ডবাক্যকে শব্দে পরিণত করার প্রবণতার ফলে গ্রন্থের আয়তন বহুলাংশে হ্রাসপ্রাপ্ত হত। দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই গদ্য ছন্দোবদ্ধ হওয়াতে ছন্দের দ্বারা কণ্ঠস্থ রাখার সুবিধা হত। তৃতীয়ত, রচনাশৈলী সংহিতার মতোই সাংকেতিক সূত্র জাতীয়। এই সব সূত্র চরিত্রগতভাবে ভিন্ন; তাদের বৈশিষ্ট্য হ’ল বাক্য ও বাক্যাংশের পুনরাবৃত্তি, সুপরিনির্দিষ্ট বিশেষণ, নিশ্চিত অবস্থানে শব্দের পুনরাবৃত্তি ইত্যাদি। মুহুর্মুহু পুনরাবৃত্তির ফলে গদ্য শৈলী অতিরিক্ত মাত্রায় ক্লান্তিকর ও একঘেয়ে হয়ে পড়েছে; একই ধরনের খণ্ডবাক্য ও শব্দবন্ধের পৌনঃপৌনিক প্রয়োগ প্রায় অন্তহীনভাবে প্ৰযুক্ত হওয়ায় রচনাশৈলী প্রচণ্ডভাবে ভারপ্রস্তু। অন্যদিকে বিষয়বস্তু তার অন্তর্নিহিত যজ্ঞকেন্দ্ৰিক প্রকৃতির ফলেই অনাকর্ষণীয়। এই একঘেয়েমি এত স্পষ্টভাবে অভিব্যক্ত যে কেবলমাত্র বিষয়বস্তুর অসামান্য ঐতিহাসিক মূল্যের জন্যেই ব্রাহ্মণসাহিত্য আজও বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় নি। কখনো কখনো একই উপসর্গ বা প্ৰত্যয় বিভিন্ন শব্দে প্ৰযুক্ত হয়েছে, এগুলি একই সঙ্গে স্মৃতি-সহায়ক ও শ্রোতা ও বক্তার কল্পনায় ঐন্দ্ৰজালিক শক্তির উদ্বোধিক। আবার শতপথ ব্ৰাহ্মণ ও তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে দুটি সম্পূর্ণ স্তবকে ‘গ্রহ’ শব্দ ভিন্ন দুটি অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। মূলত যে-শব্দটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার সঙ্গেই সম্পূক্ত ছিল, তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে এখানে অনুষ্ঠানবহির্ভূত একটি ভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে। স্পষ্টতই এই প্রবণতা অনুষ্ঠানকেন্দ্ৰিক অতীন্দ্ৰিয়বাদ ও প্রতীকায়নের মধ্যে দিয়ে আরণ্যকের ভিত্তিভূমি নির্মাণ করেছিল। আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যে উর্ধগামী বা নিম্নগামী সুর প্রবাহে বিন্যস্ত বাক্যাংশ ও খণ্ডবাক্যের বিন্যাস কিংবা পরিমাণগত সমতারক্ষা প্রকৃতপক্ষে শ্বাসাঘাত বা পুনরাবৃত্তির মতোই স্মৃতিসহায়ক। কোনো শব্দ বা শব্দবন্ধের পুনরাবৃত্তির দ্বারা আমরা সূত্রের মধ্যে স্বরপ্রবাহের ধারণা-সৃষ্টির জন্য ব্যবহৃত একটি কৌশলের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করি। সংহিতায় নিহিত নিয়মিত ছন্দের পরিগঠনে যে অভাব তা অব্যবহিত পরবর্তী উত্তরসূরীরূপে ব্ৰাহ্মণের আঙ্গিকেও দেখা যায়–কিঞ্চিৎ পরিমাণে তারই ক্ষতিপূরণের চেষ্টা ঐ উপাদানগুলির একত্ৰ সন্নিবেশে লক্ষণীয়।
কাল্পনিক ব্যুৎপত্তি রচনার বিশেষ প্রবণতা ব্ৰাহ্মণসাহিত্যে রয়েছে। ব্যুৎপত্তির প্রতি এই আগ্রহ স্পষ্টতই আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনে ব্যক্ত, যেহেতু যজ্ঞানুষ্ঠানই ব্ৰাহ্মণের প্রাথমিক লক্ষ্যস্থল। তাই “উদগীথকে দেবতাদের সঙ্গে সম্পর্কিত করার উদ্দেশ্যে জৈমিনীয় উপনিষদ ব্রাহ্মণে শব্দটির তিনটি অংশের ব্যুৎপত্তি নিম্নোক্তভাবে প্ৰদৰ্শিত হয়েছে : উদ = আদিত্য, গী = অগ্নি এবং থ = চন্দ্ৰ। কোনো সন্দেহ নেই যে, এজাতীয় সম্পর্ক কল্পনার যৌক্তিকতা প্রমাণের উপযোগী রচনা কোথাও নেই। কখনো কখনো এধরনের ব্যুৎপত্তিকে সমর্থন করার জন্যে কিছু কিছু দেবকাহিনী উদ্ভাবিত হয়েছে; সেসব বর্তমানে আমাদের কাচ্ছে হাস্যকর বলে প্ৰতিভাত হলেও তৎকালীন জনসাধারণের কাছে এসবই বিভিন্ন ব্যুৎপত্তিকে গ্ৰহণযোগ্য করে তুলত। ফলে যজ্ঞানুষ্ঠানের অনুপুঙ্খাগুলি জনমানসে দৃঢ়প্ৰতিষ্ঠা লাভ করত। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে প্ৰজাপতির বিস্ফোরিত (শো ধাতু বিস্ফার অর্থে) চোখ থেকে ‘অশ্বে’র উৎপত্তি, বা ‘অঙ্গ’ ও ‘রস’ থেকে অঙ্গিরস বা অঙ্গিরার নিরুক্তি প্রদত্ত হয়েছে। অনুরূপভাবে শতপথ ব্রাহ্মণে অঙ্গের থেকে অঙ্গিরসের ব্যুৎপত্তি কথিত হয়েছে, তাই ব্ৰাহ্মণসাহিত্যপ্রদত্ত নিরুক্তিগুলি পরস্পর বিসদৃশ, যদিও প্রবহমান বিপুল সাধারণ উৎস থেকেই পুরোহিতরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই নির্বাচনের উপাদান সংগ্ৰহ করতেন। কখনো কখনো বর্ণনীয় বিষয়ের আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনের ওপর নির্ভর করে বিকল্প ব্যুৎপত্তি উপস্থাপিত হত। কখনো বা অনুষ্ঠানের সঙ্গে পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত প্রচলিত বিশ্বাসগুলিকে সমর্থন করার জন্যে নানাবিধ ব্যুৎপত্তি প্রবর্তিত হত। গোপথ ব্ৰাহ্মণে ‘পুত্র’ শব্দের নিরুক্তি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, যে পুল্লাম নরক থেকে ত্ৰাণ করে সে-ই পুত্র। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পুত্রসন্তানই যেহেতু সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করত, তাই পুত্রলাভের পুণ্য সামাজিক মূল্যবোধেরই ইঙ্গিত বহন করে–সেই সঙ্গে পুন্নামক নরকের আবিষ্কারও এই মূল্যবোধেরই স্বীকৃতি। আবার, ‘উপবাস’ শব্দের ব্যুৎপত্তিতে যে পবিত্রতার দ্যোতনা রয়েছে, তাতে মনে হয়, এটা তখন প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। কেননা, উপবাসের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্য সম্ভবত প্রাক্তন পশুপালক সমাজে নূতন প্রবর্তিত হয়েছিল, যখন যজ্ঞানুষ্ঠান আর এ জাতীয় আত্মনিগ্ৰহ দাবি করতে পারত না। তেমনি ‘উপনিষদ’ শব্দটি ‘নিষদ’ বা আনুষ্ঠানিক দীক্ষা থেকে নিম্পন্ন করা হয়েছে। স্পষ্টতই এটা হ’ল উদীয়মান ভাবনাত্মক যজ্ঞবিরোধী ঔপনিষদীয় প্রবণতার অনুষ্ঠান-সর্বস্ব ব্রাহ্মাণ্য ঐতিহ্যের সমন্বয়ের নিদর্শন। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ তাৎপৰ্যপূর্ণভাবে ইন্দ্র সম্পর্কে ত্ৰিধাতুশরণম্য বিশেষণটি প্রয়োগ করেছে-এই শব্দে স্পষ্টতই বৌদ্ধ শব্দবন্ধের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে; ত্ৰিধাতু এবং ‘শরণ’ বৌদ্ধ সাহিত্যে, দর্শনে কেন্দ্রীয় এবং বহুব্যবহৃত ।
ব্ৰাহ্মণের রচয়িতারা উপলব্ধি করেছিলেন যে, এই জাতীয় ব্যুৎপত্তি নিতান্ত কাল্পনিক; তাই এ’ধরনের প্রয়াসের যৌক্তিকতা প্রদর্শনের জন্য তারা বহুস্থানে লিখেছিলেন ‘রহস্যই দেবতাদের প্রিয়, অতিস্পষ্টকে তারা অবজ্ঞা করে থাকেন।’ [ ‘পরোক্ষপ্রিয়া বৈ দেবাঃ, প্রত্যক্ষদ্বিষঃ ]। সমগ্ৰ পৃথিবীতে প্রাচীন পুরোহিত সম্প্রদায়গুলির মধ্যে যে দুর্জেয়িতা বা রহস্যসৃষ্টির প্রবণতা, রয়েছে। এ যেন তারই অভিব্যক্তি; কেননা পুরোহিতরা অনুভব করেছিলেন যে এ ধরনের অতীন্দ্ৰিয়বাদী প্রবণতার পেছনে দেবকাহিনী, প্রত্নকথা নির্মাণের যে প্রয়াস সক্রিয়, তা’ মূলত অবচেতনাপ্রসূত বলেই স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। পুরোহিততান্ত্রিক সমাজের প্ৰধান শ্রেণীর স্বাৰ্থ সংরক্ষণ কয়রি প্রচেষ্টা এতে অভিব্যক্ত হয়েছে। ব্ৰাহ্মণে প্রতিফলিত ব্যাকরণ ‘পাণিনি পূর্ববতী’ যুগের ইঙ্গিত বহন করে; বহুশব্দেই বিভক্তি তখনও নির্দিষ্ট নয়। ক্রিয়াপদ থেকে দূরে বিচ্ছিন্নভাবে উপসর্গ প্রয়োগের প্রবণতা সাধারণভাবে বিরলতর হয়ে গেলেও কখনো কখনো সংহিতা যুগের প্রাচীন অভ্যাস আমরা পুনরাবৃত্ত হতে দেখি। পাণিনির নিয়মবহির্ভূত প্রয়োগ ছাড়াও ইতিমধ্যে আত্মনেপদী ও পরস্মৈপদী ক্রিয়াপদের ব্যবহারে তাৎপৰ্যগত স্পষ্ট পার্থক্য অভিব্যক্তি হয়েছে। ব্ৰাহ্মণের শব্দভাণ্ডারে আর্যদের কালানুক্রমিক ও ভৌগোলিক অগ্ৰগতি প্রতিফলিত হয়েছে। অনার্য উৎস-জাত বহু অপরিচিত বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদকে সম্পূর্ণ অপরিশীলিত ও সামান্য পরিশীলিত অবস্থায় ভারতীয় আর্যভাষা আত্মসাৎ করেছে। পাণিনির সমসাময়িক গোপথ ব্ৰাহ্মণের পূর্বভাগে সর্বপ্রথম অব্যয়ের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এখানে তির্যক রচনাশৈলীর জন্য সংলাপগুলি অধিকতর প্রত্যক্ষ ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ব্ৰাহ্মণের রচনাশৈলীতে যে চমৎকার অব্যবহিত প্ৰত্যক্ষতা, শক্তিমত্তা, সংক্ষিপ্ততা ও সংকোচনশীলতা অভিব্যক্ত হয়েছে, তা ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের পূর্বে বা পরে আর কখনো এমন যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয় নি, যেহেতু অনুরূপ রচনাশৈলীযুক্ত সূত্ৰ-সাহিত্যের কোনো সাহিত্যগুণ নেই, কিন্তু কাব্য সৌন্দৰ্যযুক্ত বহু স্তবক ব্ৰাহ্মণসাহিত্যে পাওয়া যায়।
ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে প্রায়ই ধ্বনি সংকোচনের প্রয়োজনে প্রয়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সন্ধি ব্যবহৃত হয়েছে। শ্রুতিসাহিত্য স্মৃতি সহায়ক হওয়ার জন্যেই সন্ধির ফলে প্রায়ই ধবনিগত কর্কশতা অনিবাৰ্যভাবে দেখা দিয়েছে। প্ৰাচীনতর। শব্দ একদিকে যেমন ক্রমশ লুপ্ত হয়ে এসেছে, তেমনিই বেশ কিছু নতুন শব্দও আবির্ভূত হয়েছে। ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যে প্রাচীনতর নাটক ও শিলালিপিগুলিতে সাহিত্যিক গদ্যের আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত কয়েক শতাব্দী ব্যাপী রচনায় ব্রাহ্মণের ব্যাকরণবিধিই অনুসৃত হয়েছিল। সবগুলি ব্ৰাহ্মণেই আমরা শব্দের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের প্রতি অভিনব উৎসাহ অভিব্যক্ত হতে দেখি। বিজয়ী আর্যজাতি যে নিজেদের ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে সগর্ব ও সচেতন, তার বহু নিদর্শন এ সাহিত্যে পাওয়া যায়। অবশ্য দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে আৰ্যদের বসতি বিস্তারের পর্যায়ে বৈদিক ভাষায় অনার্য উৎসজাত ধবনিতাত্ত্বিক প্রভাবও প্রতিফলিত হয়েছে।
ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে এমন কিছু প্ৰহেলিকার সন্ধান পাওয়া যায় যাদের আনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্য আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অস্পষ্ট। পদ্যে নিবদ্ধ ও সাধারণভাবে অনুষ্টুপ ছন্দে প্রথিত, এই প্ৰহেলিকাগুলিকে ‘আজিজ্ঞাসেন্যা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। অথর্ববেদের প্রহেলিকাগুলি প্রতিরোধ, অতিবাদ ও অহনয়া নামে পরিচিত। বিভিন্ন ব্ৰাহ্মণে সার্বভৌম সত্য সম্পর্কে বেশ কিছু শ্লোক রয়েছে যা সাধারণভাবে অনুইপ ছন্দে প্রথিত। প্রাচীনতম ব্রাহ্মণগুলির অন্যতম ঐতরেয় ব্রাহ্মণে যে প্রচুরসংখ্যক শ্লোক রয়েছে সেগুলিও বিশেষভাবে তাৎপৰ্যপূৰ্ণ; সম্ভবত সংহিতার অব্যবহিত পরবর্তী উত্তরসূরীরূপে এদের গণ্য করা চলে। প্রাচীন মানুষের সঞ্চিত জ্ঞানের প্রতিফলন হওয়া ছাড়াও এগুলির মধ্যে আমরা বহু প্ৰাচীন উপকথার সন্ধান পাই। অন্যান্য ব্রাহ্মণে এ ধরনের শ্লোককে ইন্দো-ইরাণীয় যুগের ঐতিহ্য অনুযায়ী ‘গাথা’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে; অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুষ্টুপ ছন্দে এবং কখনো ত্ৰিষ্টুপ ছন্দোও প্রথিত গাথাগুলির বহুস্থানেই প্ৰকৃত কাব্যিক সৌন্দর্য ও প্রাচীন লোকায়ত উপলব্ধির সজীব অভিব্যক্তি ঘটেছে। তবে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, এ ধরনের রচনায় আলংকারিক রচনাশৈলীর আভাস থাকলেও তা সর্বত্র কাব্যিক গুণের পরিচায়ক নয়, যেহেতু ব্ৰাহ্মণের অভীষ্ট হ’ল ঋজুতা, স্পষ্টতা, সংক্ষিপ্ততা ও দ্রুত অর্থবোধ। প্ৰত্যক্ষভাবে যজ্ঞানুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় চিত্রকল্পের প্রয়োগেও নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে। উপমা ও রূপক প্রযুক্ত হলেও যজ্ঞানুষ্ঠানের অনুপুঙ্খকে যথাযথ ও দৃঢ়ভাবে উপস্থাপিত করাই এর একমাত্র লক্ষ্য। অর্থাৎ কোথাও কোথাও রচয়িতার সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার পরিচয় থাকা সত্ত্বেও সাধারণভাবে কোনো গভীর উপলব্ধি বা প্রাকৃত কাব্যিক অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটে নি।
বৈদিক জনসাধারণের শিল্প সম্পর্কিত ভাবনার প্রথম প্ৰকাশ ঘটেছে ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণের একটি বাক্যে–“আত্মসংস্কৃতির্বােব শিল্পানি” (৬ : ৫ : ৬ : ২৭) এই গ্রন্থে শিল্পকে বাস্তবের অনুকরণ বলা হয়েছে। (৩ : ২ : ১ : ৫ ) শতপথ ব্ৰাহ্মণ অনুযায়ী ঋষিই কবি (১ : ৪ : ২ : ৮)।