০৪. অনুষ্ঠান চৰ্যা
যজুর্বেদে বর্ণিত যজ্ঞাগুলির মধ্যে অশ্বমেধ, অগ্নিচয়ন ও সোমযাগ সবচেয়ে দীর্ঘকাল ব্যাপী যজ্ঞ। লক্ষণীয় যে, সম্পাদনার প্রক্রিয়ার যে বিবরণ যজুর্বেদে পাই তা রচনার দিক থেকে কতকটা শিথিল। অশ্বমেধের বিবৃতিতে অন্তত দু’বার ছেদ পড়েছে। একটানা বিবৃতির পরিবর্তে কখনও আপ্রীসূক্ত, কখনও বা ‘অশ্ব’শব্দের প্রত্নপৌরাণিক ব্যাখ্যা, কখনও বা সোমযাগ, কখনও বা যজ্ঞের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা প্রভৃতি যথেচ্ছ যজ্ঞ প্রক্রিয়ার বিবরণের মধ্যেই সন্নিবিষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে বিচিত্র অর্থযুক্ত বহুবিধ মন্ত্রের বর্ণনা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও আপ্তি, পর্যাপ্তি, অভূ, অনুভু, অপাব্য, যব্যহােম, সন্ততিহােম, প্ৰসুক্তিহােম, অন্নহােম, শারীরহােম ইত্যাদি।
স্পষ্টতই যজুর্বেদে যে প্রবণতাকে আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাই, তা হল যজ্ঞকে ক্রমশ জটিলতর, ব্যাপকতর, অধ্যাত্ম-ব্যঞ্জনাযুক্ত ও গূঢ়াৰ্থবহ করে তোলার প্রবণতা। অশ্বমেধের সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ : কোনও ক্ষমতাশালী স্থানীয় গোষ্ঠীপতি ধীরে ধীরে রাজার পদবীতে সার্বভৌম সম্রাটের পর্যায়ে উন্নীত হয়ে তবেই অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করতেন। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যজমানের, রাজ্যটির দুর্বলতর প্রতিবেশী এবং শত্ৰুগণের ওপরে আধিপত্য আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পেত। মূল যজ্ঞের বর্ণনা যে বারবারই অগ্নিচয়ন ও সোমযাগের মতো সুস্পষ্ট ব্রাহ্মণ্য-ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দ্বারা বিঘ্নিত হয়েছে, এতেই পুরোহিত শ্রেণীর বিশেষ গুরুত্ব অভিব্যক্তি। অশ্বের বিভিন্ন প্রতিশব্দের মধ্যে সম্ভবত বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত বিচিত্রে ধরনের, অনুষ্ঠানগুলির সমন্বয় প্রচেষ্টা আভাসিত হয়েছে। অনু্রূপভাবে সংখ্যার, আঙ্গিকের ও বর্ণের রহস্যময় ব্যাখ্যার দ্বারা বিভিন্ন দেশের প্রচলিত নিগূঢ় প্রক্রিয়ার প্রতীকগুলিকে যজ্ঞের দ্বারা ব্যাখ্যা করে যজ্ঞকে গূঢ় ব্যঞ্জনা দেওয়ার চেষ্টা স্পষ্টতই প্ৰতীয়মান। এই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের উর্বরতাচর্যা ও আঞ্চলিক উৎসব এবং প্ৰহেলিকপূর্ণ গূঢ় বিদ্যার সংযোগে অশ্বমেধ যজ্ঞ সর্বতোভাবে মূল বিশ্ব-প্রক্রিয়ার গ্ৰন্থিল প্রতীকী অভিব্যক্তি অর্জন করতে চেয়েছে। অগ্নিচয়ন অনুষ্ঠানে প্রচুর প্রত্নপৌরাণিক উপাদান রয়েছে, যার অধিকাংশই দুরধিগম্য, গূঢ়ার্থবহ ও অধ্যাত্ম ব্যঞ্জনাময়–সংস্কৃতির অপরিশীলিত আদিমতর কোনও অধ্যায়ের স্মৃতি তার মধ্যে নিহিত। বস্তুত, এই অনুষ্ঠানে আদিমতম ও নবীনতম এবং এ উভয়ের অস্তবতী নানা পর্যায়ের কৃষ্টি ও চিন্তার বিচিত্ৰ সহাবস্থান ঘটেছে। মনে হয়, ভারতভূমিতে নবাগত আৰ্যজাতির প্রতীকী প্রতিষ্ঠা যজ্ঞের বিভিন্ন অনুপুঙ্খের মধ্য দিয়ে স্বীকৃতি অর্জন করতে প্ৰয়াসী হয়েছিল। বহুস্তরে বিন্যস্ত, দীর্ঘকালব্যাপী জটিল যজ্ঞপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে আর্যদের কঠোর ও দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম অভিব্যক্তি। অগ্নিচয়নে বেদী নির্মাণকালে ইটের জটিল বিন্যাসের মধ্যে নিবেশিত তিনটি মৌলিক প্রতীক–পদ্মপত্র, ভেক ও স্বর্ণনির্মিত মানব-মুর্তি–সম্ভবত ভারতবর্ষের স্থল ও জলভূমির উপর আর্যদের প্রভুত্বেরই দ্যোতক। কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর পক্ষে সর্বাধিক প্রয়োজনীয় বস্তু যে বৃষ্টিপাত, তার প্রতীক যেমন পদ্মপত্র ও ভেক, তেমনি স্বর্ণমানব একদিক দিয়ে সূর্য ও অন্যদিক দিয়ে কর্ষণরত মানুষের প্রতীক। আমরা জানি যে, সোনার তৈরি একটি থালা সূর্যাস্তের পর যজ্ঞীয় জলকলসের উপরে ঢাকা থাকত ; এটি সূর্যের প্রতীকরূপে পরিগণিত হত। অর্থাৎ মূলত স্বর্ণ উর্বরতাচৰ্যারই একটি মৌলিক প্রতীক।
দ্বাদশ-বর্ষব্যাপী যে সোমযাগ, সত্ৰ, তা স্পষ্টতই অত্যন্ত শুরুত্বপূৰ্ণ ; তৈত্তিরীয়সংহিতায় অশ্বমেধ যজ্ঞের অংশ হওয়া ছাড়াও ষষ্ট ও অষ্টম কাণ্ডে এই যজ্ঞটিই প্ৰধান বিষয়বস্তু। সোমের প্রকৃত পরিচয় নিয়ে যদিও বিতর্ক রয়েছে, তবু এটা অন্তত স্পষ্ট যে, সোমরসের উত্তেজক গুণের জন্য সোমযাগ একাহ যজ্ঞ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে কালের ব্যাপ্তিতে বাড়তে বাড়তে (দ্বাদশাহ, বর্ষব্যাপী গবাময়ন সত্র) শেষ পর্যন্ত দ্বাদশবর্ষব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী অনুষ্ঠান সত্রে পরিণত হয়েছিল। দীর্ঘকালব্যাপী সোমপানের অভ্যাস মত্ততা ও আতিশয্য আনে। সোম যখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছিল তখন শেষপর্যন্ত মূল সোমের পরিবর্তে ভিন্ন জাতীয় বিকল্প নানা উদ্ভিজ্জ ব্যবহারের নির্দেশ অনিবাৰ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু এইসব উদ্ভিজের যেহেতু কোনও মাদকতা ছিল না, তাই বহু অনুপুঙ্খাযুক্ত সোমযাগের অনুষ্ঠান ক্রমে নিষ্প্রভ হয়ে, ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারিয়ে ধীরে ধীরে বাহুল্যে পর্যবসিত হয়ে গেল। সোমকে যেহেতু বারবার ‘রাজা’ ও ‘অতিথি’ বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে, এতে মনে হয় যে, অবচেতনায় বহিরাগত আৰ্যদের শাসকররূপে প্রতিষ্ঠা লাভই এই অভিধাগুলির মধ্যে নিহিত ছিল। সঙ্গীত ও নৃত্যমুখর আনন্দ উৎসবে বহু দেবতার প্রতি নানাভাবে পানীয় নিবেদন বিজয়োৎসবের চিত্রকে সম্পূর্ণতা দিয়েছে। সোম সম্ভবত অনার্য জনগোষ্ঠী দ্বারা অতিযত্নে সুরক্ষিত ছিল ; আৰ্যরা যে প্ৰবঞ্চনার দ্বারা তা সংগ্ৰহ করতেন তার ইঙ্গিত রয়েছে একটি বিশেষ প্ৰত্নকথায়–গন্ধৰ্বদের দ্বারা সুরক্ষিত সোমকে বিষ্ণু, চাতুর্যের দ্বারা সংগ্ৰহ করেছিলেন।
রুদ্রকে সোমযাগের অংশভাগী করা হয় নি, কারণ তার কল্পনার সঙ্গে স্বভাবত ভয় ও অমঙ্গলের নানা অনুষঙ্গ সম্পৃক্ত ছিল। ঋগ্বেদের প্রধান দেবতা অগ্নি এই যজ্ঞের বিশেষ প্রকৃতির জন্যই অপেক্ষাকৃত স্বল্প শুরুত্বের অধিকারী। পরবর্তী সাহিত্যে অশ্বীরা সোমরসের অংশ লাভে বঞ্চিত হলেও এখানে তিনটি সবনেই তাঁদেরকে প্ৰাপ্য হব্যের সোমরসে অংশ দেওয়া হয়েছে। প্ৰাতঃসবনটিই সম্ভবত আদি ও মৌলিক অনুষ্ঠান, যেহেতু ঋগ্বেদ-সংহিতার প্রাচীনতম পৰ্যায় থেকেই তার অস্তিত্ব রয়েছে। মাধ্যদিন সবন প্রায় সম্পূর্ণতই ইন্দ্র ও মরুদগণের উদ্দেশে নিবেদিত। তৃতীয় সবন স্পষ্টতই পরবর্তীকালে সংযোজিত-সবিতা, আদিত্যগণ, বিশ্বেদেবাঃ ও অগ্নি তার অংশভাক। প্ৰাতঃকালে সোম সংগৃহীত হত, প্ৰাতঃসবন ও মাধ্যন্দিন সবন পর্যন্ত উদ্ভিজটি সতেজ থাকত এবং স্বভাবতই সন্ধ্যায় শুকিয়ে উঠত। তাই, তখন সেই শুকনো সোমকে জলে ভিজিয়ে ফুলিয়ে আপ্যায়ন করা (অর্থাৎ পীন করে তোলা) হত, যাতে তার থেকে রস নিষ্কাশন করা যায়। লক্ষণীয়, এ সবনের নাম কাল দিয়ে নির্ণীত নয়, পরবর্তী সংযোজন, তাই একে শুধু তৃতীয়-সবনই বলা হয়েছে। সোমযাগকে সর্বব্যাপী করার উদ্দেশ্যে তৃতীয় সবনে অপ্রধান দেবতাগণও উল্লিখিত হয়েছেন ; এমনকি, দেবায়িত পিতৃগণকেও তার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর্যদের ধর্মীয় জীবনে পিতৃ উপাসনা যে অন্যতম প্রধান দিক ছিল, তার প্রমাণ রয়েছে পিণ্ডপিতৃযজ্ঞ অনুষ্ঠানে।
অন্যান্য যজ্ঞানুষ্ঠানের মধ্যে দর্শপূর্ণমাস, রাজসূয়, সৌত্রামনী ও পশুযাগ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। দর্শপুর্ণমাস যজ্ঞ নিশ্চয়ই অনেক প্রাচীন কালেই পরিকল্পিত হয়েছিল–আৰ্যরা যখন যাযাবর পশুপালক জীবনে সময়-স্মারক রূপে আকাশ পর্যবেক্ষণ করে পূর্ণিমা ও অমাবস্যাকে অর্থাৎ কৃষ্ণ ও শুক্লপক্ষের চূড়ান্ত পরিণতির তিথি দুটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন, সেই সময়কার স্মৃতি এই অনুষ্ঠান দুটিতে প্রচ্ছন্ন রয়েছে। তাছাড়া, আৰ্থতিতে দুগ্ধজাত দ্রব্যের ব্যবহার পশুপালক জীবনেরই ইঙ্গিত বহন করে। পরবর্তী পর্যায়ে পরিকলিত চতুর্মাস্য যজ্ঞে চারটি ঋতুর উপযোগী আহুতি প্ৰদান করা হত–বৈশ্বদেব, বরুশপ্রঘাস, সামমেধ ও শুনাসীর। কৃষিজীবী আৰ্যদের জীবনযাত্রার সঙ্গে চাতুর্মাস্য যাগের এই অংশটি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। নিৰ্ব্বতি, রুদ্র, করুন ও ত্র্যম্বকের প্রতি নিবেদিত কিছু কিছু প্ৰতিষেধক ও প্ৰায়শ্চিত্তমূলক অনুষ্ঠান আৰ্যদের তৎকালীন জীবনধারার সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ, যেহেতু শস্য ও পাতালের অধিষ্ঠাতা দেবতাদের অশুভ ক্ষমতা সম্বন্ধে ভীতিই তাদের উদ্দেশে অৰ্ঘ্য নিবেদনের মূল প্রেরণা। লক্ষণীয় যে, এই সব আহুতি রয়েছে যজ্ঞের সূচনায় অর্থাৎ নেতিবাচক ভয়ংকর শক্তিগুলিকে কোনরকমে প্রশমিত করে তবেই যজ্ঞ ইতিবাচক ও কল্যাণপ্ৰসূ হয়ে উঠতে পারে। পরবর্তীকালে সংযোজিত এ ধরনের আরও কিছু স্তোত্রে বিভিন্ন গৌণ দেবতা এবং রাক্ষস, অনুমতি, রাকা, সিনীবালী ও কুকুকে সন্তুষ্ট করার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। রাজার প্রকৃত অভিষেক-বিষয়ক অনুষ্ঠান শুরু হয় একাদশ রত্নী অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, রাজন্য, মহিষী, পরিবৃক্তি, সেনানী, সূত, গ্রামণী, ক্ষত্তা, সংগ্ৰহীতা, ভাগদুঘ ও অক্ষাবাপ-এর গৃহে একাদশ রত্ন হাব্য নিবেদনের সঙ্গে সঙ্গে। এই সমস্ত ব্যক্তি যেহেতু রাজকীয় ক্ষমতার স্তম্ভ-স্বরূপ যজ্ঞে তাই আনুষ্ঠানিকভাবে এদের গুরুত্ব স্বীকার করা হত। পরবর্তী দেবাসু নামক বিভাবে বৃহস্পতির মতো নবীন দেবতার প্রাধান্য থাকায় সহজেই অনুমান করা যায় যে, অভিষেক-অনুষ্ঠানটি পরবর্তীকালেই পরিকল্পিত হয়েছিল, যখন গোষ্ঠী ও কৌমগুলি ছোট ছোট সামন্তরাজার অধীনে সংগঠিত হয়ে রাজ্যের সৃষ্টি করছিল। তাছাড়া, কোনও সুপ্রতিষ্ঠিত জনগোষ্ঠীর পক্ষেই শুধু রাজকীয় ক্ষমতার প্রতি এইরূপ সম্মান প্ৰদৰ্শন করা স্বাভাবিক। সমাজে তখন অন্তত বৃত্তিগত জাতিভেদ প্ৰথা যে সুস্পষ্ট চরিত্র পেয়ে গেছে, তারও নিদর্শন আমরা পাই। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজন্য ও ব্রাহ্মণদের মধ্যে শ্রেণীস্বাৰ্থজনিত দ্বন্দ্বের আভাসও পাওয়া যায়। অভিষেকের প্রয়োজনে যে সমস্ত স্থান থেকে পবিত্ৰ জল আহরণের উল্লেখ রয়েছে, তা আর্যদের প্রাথমিক বসতিগুলির ভৌগোলিক অবস্থানের নিদর্শন। রাজার একাধিপত্যসূচক যে সমস্ত অনুষ্ঠান অভিষেকের অঙ্গ ছিল, তা তৎকালীন ভারতবর্ষের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের স্বল্পালোকিত দিকের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রাজাকে অত্যন্ত তাৎপৰ্যপূর্ণভাবে সর্বসমক্ষে অতিজাগতিক ও নৈতিক গুণযুক্ত দেবতাকাপে বর্ণনা করা হত ; বিভিন্ন দেবতার সঙ্গে তাকে একাত্ম করে তোলার সঙ্গে সঙ্গে ব্ৰাহ্মণ পুরোহিতের সঙ্গেও তাঁর তুলনা করা হত। অভিষেকের অন্তিম পর্যায়ে বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশে বিশেষভাবে নিবেদিত দশপেয় অনুষ্ঠানে দশজন ব্রাহ্মণ একই পাত্র থেকে যুগপৎ সুরাপানের মাধ্যমে সদ্য অভিষিক্ত নূতন রাজা ও রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপন করতেন। সম্ভবত, আরও পরবর্তীযুগে উদ্ভাসিত প্ৰবৰ্গ যাগের অনুষ্ঠানে সূৰ্যদেবের শক্তি বৃদ্ধির জন্য অশ্বীদের উদ্দেশে ‘মহাবীর’ নামক উত্তপ্ত রক্তবর্ণ পাত্রে দুগ্ধ অর্পণ করা হত।
অশ্বমেধ যজ্ঞে বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত কৌম ও জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস ও আচার ব্যবহার একত্রে সমন্বিত হয়েছিল–তবে রাজনৈতিক বিজয়লাভের প্রতীকী ঘোষণাই এর যজ্ঞের উদ্দেশ্য। বিবিধ প্রকারের ঐন্দ্রজালিক অনুষ্ঠান, গূঢ়ার্থবহ অক্ষক্রীড়া, প্রকৃত অতীত ইতিহাস থেকে সামূহিক অবচেতনায় সংকলিত লুণ্ঠন-অভিযানের কাহিনীগুলিকে কেন্দ্র করে প্রত্নকথা নির্মাণ ও গোষ্ঠীগতভাবে আনুষ্ঠানিক মদ্যপান–এই সমস্ত আদিপর্বে সম্ভবত অনুষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল না। খুব সম্ভব, প্ৰাথমিক পর্যায়ে মূল অনুষ্ঠানটি সংক্ষিপ্ত ও সরল থাকলেও ঐতিহাসিক কারণে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর বিচিত্র আধ্যাত্মিক প্রয়োজন মেটাবার জন্য বহুবিধ প্রতীকী অনুষ্ঠানিকলাপের সমন্বয়ে তা শেষ পর্যন্ত জটিল ও বিচিত্র আকার ধারণ করে।
বাজপেয় যজ্ঞের বিভিন্ন অনুপুঙ্খগুলি বিশ্লেষণ করে আমাদের মনে হয় যে, মূলত সোমযোগেরই সামান্য একটু ভিন্ন অভিব্যক্তির সঙ্গে বিভিন্ন জনপ্রিয় উৎসব ও অনুষ্ঠান সংমিশ্রিত হয়ে আলোচ্য অনুষ্ঠানটিকে গড়ে তুলেছিল। শরৎকালে অনুষ্ঠিত এই যজ্ঞটির বিভিন্ন পানিপাত্রের বিশেষ গুরুত্ব লক্ষণীয় ; এদের কেন্দ্ৰবিন্দুতে রয়েছে ‘ঐন্দ্ৰি’ বা ‘বাজপেয়’ নামক পান-পাত্রে। স্পষ্টতই ইন্দ্র এখানে প্রধানতম দেবতা এবং যজ্ঞের নামকরণেও সেই ইঙ্গিত। বর্ষা শেষের পৃথিবীতে শরৎকালেই রাজারা বিজয় অভিযানে বেরোতেন। এই বিজয়কামী রাজাদের আদি প্রতিভূ ইন্দ্ৰ, যিনি ক্ষত্রিয়াশক্তির প্ৰতীক ; সোম এবং সুরাপানে যিনি অভ্যস্ত। তাই, বাজ (শক্তি) পানের জন্য নির্দিষ্ট এই শারদ যজ্ঞে ইন্দ্র ও তার সহযোগী মরুদগণ অনুরূপ গৌরবের অধিকারী। এই যজ্ঞে প্ৰজাপতির উপস্থিতি কিছু কিছু অংশের তুলনামূলক নবীনতাই প্রমাণ করে। প্ৰজাপতি এখানে রাজার রক্ষা ও শাসকশক্তির প্রতিভূ। মাধ্যন্দিন-সবনে ইন্দ্রের অবিসংবাদিত প্রাধান্য এবং সামগ্রিকভাবে বাজপেয় যজ্ঞে ইন্দ্রের শ্রেষ্ঠত্ব এই ইঙ্গিতই বহন করে যে, প্ৰধানত এটি ক্ষত্রিীয়দের যজ্ঞ। বস্তুত, পরবর্তীকালের রাজারাও এই শরৎকালেই ক্ষত্রিয় শ্রেণীভুক্ত সামরিক অভিযানের উদ্যোগ করতেন। বাজপ্রসবীয় বা শক্তিপ্রদ আহুতিদান এবং যজ্ঞের সমাপ্তিতে উত্তেজিত বা বিজয়প্রশস্তি গানের সঙ্গে আহুতিদান এই প্রসঙ্গে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এই যজ্ঞের বিভিন্ন অনুপুঙ্খের মধ্যে ঊর্বরতা ও সৌর উপাসনার অবশেষ অনেক পণ্ডিত লক্ষ্য করেছেন।
সৌত্রামণী নামক যজ্ঞেও সুরা নিবেদিত হয় ; সেখানে আহুতি মূলত দুই ধরনের–স্বতন্ত্র অনুষ্ঠান হিসাবে তাকে ‘কৌকিলী’ বলে অভিহিত করা হয়েছে, আবার গৌণ অনুষ্ঠানরূপে তা সুরাসক্ত ব্যক্তির জন্য পরিকল্পিত। এই যজ্ঞে ইন্দ্রের উদ্দেশে বৃষ, সরস্বতীর উদ্দেশে মেঘ, অশ্বীদের উদ্দেশে ছাগ এবং অগ্নির উদ্দেশেও বৃষ বলিদান করা হত। রাজার প্রাধান্য ও আধিপত্যের প্রতীকী ঘোষণারূপে এ অনুষ্ঠানের নির্দিষ্ট কিছু অনুপুঙ্খ পরিকল্পিত হয়েছিল।
বাজসনেয়ী সংহিতার তেত্ৰিশ অধ্যায়ে আলোচিত পুরুষমেধ যজ্ঞটি পরবর্তীকালে সংকলিত হলেও বহু প্ৰাচীনকালে তার উৎস সন্ধান করা যেতে পারে, যখন পরাজিত শত্রুকে বধ করা হত। কারণ খাদ্য উৎপাদনের সেই স্তরে অর্থাৎ শিকারের পর্যায়ে জীবন্ত শত্ৰু সমস্যার সৃষ্টি করত, তার জন্য খাদ্য যোগানো উৎপাদনের সেই স্তরে অন্যায় অপচয় ব’লে বিবেচিত হ’ত। নিহত শত্রুর মৃতদেহ বিজেতা কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে ভক্ষিত হওয়ার পিছনে এই বিশ্বাস সক্রিয় ছিল যে, শক্রর শক্তি এভাবেই আত্মীকরণ করা সম্ভব। পরবর্তীকালে অবশ্য পরাজিত শক্রকে পশুপালন বা কৃষিকাজে নিযুক্ত করে অর্থনৈতিক উৎপাদনের অঙ্গীভূত করা হ’ত। শক্রকে বধ ও ভক্ষণ করার প্রাচীন রীতি লাভজনক নয় বলেই তা ক্ৰমে পরিত্যক্ত হয়েছিল। তবে তার স্মৃতি সামূহিক নির্জ্ঞানে গ্রথিত ছিল ; বাস্তব জীবনে পরাজিত শক্রকে যেহেতু আর তখন হত্যা করা হত না, তাই পুরুষমেধ যজ্ঞ তখন বিশুদ্ধ প্ৰতীকী অনুষ্ঠানেই পর্যবসিত হ’ল। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের অন্তর্গত বিখ্যাত পুরুষসূক্তের সঙ্গে এর সম্পর্ক প্রকৃতই তাৎপর্যপূর্ণ। অতিজাগতিক স্তরে ঈশ্বরের প্রতিভূ ‘পুরুষের আনুষ্ঠানিকভাবে বলিদান ও আহুতি প্রদানের প্রক্রিয়া বিশ্বসৃষ্টির মৌল কারণরূপে এ সুক্তে বৰ্ণিত। প্রতীকী প্রত্নকথার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন বৃত্তিধারী শ্রেণীকে এই সূক্তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যান্য দেবকল্পনাতেও একটি মহাজাগতিক শক্তির প্রতিভুরূপে কল্পিত আদিমতম দেবতার বলিদান বা আত্মবলিদানের দ্বারাই বিশ্বসৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল, এমন কল্পনা মাঝেমাঝেই পাওয়া যায়। এটি একান্তভাবে বেদেরই বৈশিষ্ট্য নয়।
সর্বমেধ নামক কল্পনাসমৃদ্ধ অনুষ্ঠানটিকে শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এ অনুষ্ঠানের শেষে যজমান তাত্ত্বিকভাবে তার সমস্ত কিছুই দক্ষিণারূপে প্রার্থীদের অর্পণ করেন। এই ভাবনার সার্বিক বাস্তবায়ীত বিমূর্ত কল্পনা থেকেই আধ্যাত্মিক প্ৰতীকায়নের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আনুষ্ঠানিক কর্মের দার্শনিক ব্যাখ্যা প্রদত্ত হতে থাকে ও যজ্ঞের অন্তনিহিত মূল আদর্শরূপে আত্মদানের প্রশংসা প্রাধান্য পায়। অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে, সর্বমেধ যজ্ঞ বর্ণনার মধ্যেই আসন্ন অধ্যাত্মবাদী যজ্ঞ-ব্যাখ্যার ধারক ‘ব্রাহ্মণ’ ও ‘আরণ্যক অংশের প্রাথমিক সূচনা হয়েছিল। বৈদিক সমাজ তখন প্রকৃত যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রাথমিক অর্থাৎ ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পূক্ত পৰ্যায় থেকে ক্রমশ সরে গিয়ে সংহিতার শেষে অধ্যায়ে অভিব্যক্তি ঈশোপনিষদের আধ্যাত্মিক প্ৰতীকায়িত অবস্থানে উপনীত হচ্ছিল। এতে স্পষ্টতই সর্বমেধের মৌল আদর্শ অর্থাৎ সর্বব্যাপী পরমাত্মার প্রকাশ স্বীকৃত হয়েছে।
সরলতম ও সংক্ষিপ্ততম অনুষ্ঠান অগ্নিহােত্রে অবশ্য প্রতীকী দিক দিয়ে মহত্মম যজ্ঞ-ভাবনারই এক অভিব্যক্তি নিহিত আছে, যেহেতু তা প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরাজিত সাধারণ বিশ্বাস অর্থাৎ বিশ্বজগতে সূর্যদেবের অপরিহার্যতা ও শ্রেষ্ঠতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে।