অতল জলের আহ্বান
নেডের চীৎকার শুনে জাহাজের সব লোক তার দিকে ছুটে গেলো। এবার কিন্তু সিন্ধুদানব আর কারো অগোচর রইলো না। দেখতে পেলুম জাহাজ থেকে বেশ খানিকটা দূরে সমুদ্রের জল আলো হয়ে উঠেছে; জলের উপর ভেসে উঠেছে সেই রহস্যময় দানবটির প্রকাণ্ড পিঠ, আর তার গা থেকেই এই উজ্জ্বল চোখ-ধাঁধানো আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। কিন্তু তখন আর ভালো করে ধীরে-সুস্থে তাকে অবলোকন করার অবস্থা ছিল না; কারণ সচমকে আমরা দারুণ আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ্য করলুম, দানবটা প্রচণ্ড বেগে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে।
জাহাজের মধ্যে যে-সমস্বর শোরগোল উঠলো, তাতে আমার সভয় চীৎকার ঢাকা পড়ে গেলো। কিন্তু তারই ভিতর অবিচল রইলেন শুধু ক্যাপ্টেন ফ্যারাশুট। তার নির্দেশমতো বোকরে অর্ধবৃত্তাকার পথে ঘুরে গিয়ে আব্রাহাম লিঙ্কন ধাবমান দানবটির কাছ থেকে সরে যেতে লাগলো। কিন্তু দ্বিগুণ বেগে আমাদের দিকে ধেয়ে আসতে লাগলো সমুদ্রের সেই প্রজ্বলন্ত বিভীষিকা। কিন্তু তারপরেই–আবার আশ্চর্য!-হঠাৎ এক জায়গায় সে থমকে দাঁড়িয়ে গেল, তারপর আস্তে জাহাজটার চারপাশ একবার প্রদক্ষিণ করে নিলো–যেন কোনো শিকারী জন্তু চড়াও হবার আগে তার শিকারের ক্ষমতা ও সাধ্য আন্দাজ করে নিতে চাচ্ছে। কলের জাহাজ যেমন যাওয়ার সময় পেছনে লম্বা ও কুণ্ডলিত ধোয়ার রেখা রেখে যায়, ঠিক তেমনি পুঞ্জীভূত আলোকিত কুয়াশার রেখা একে গেলো জলের মধ্যে, তারপর অবিশ্বাস্য গতিতে তার পরিক্রমা সম্পূর্ণ করে জানোয়ারটা আচম্বিতে জাহাজ লক্ষ্য করে উল্কার মতো ধেয়ে এলো।
শামাল। শামাল। রব উঠলো জাহাজে। কিন্তু জাহাজের একেবারে মুখোমুখি এসেই আচমকা সেই তীব্র আলোর চ্ছটা মিলিয়ে গেলো। পরক্ষণেই জাহাজের অন্যধারে দেখা গেলো সেই প্রজ্বলন্ত বিভীষিকা। রাতের অন্ধকারে আমরা ঠাহরই করতে পারলুম না জানোয়ারটা ড়ুব দিয়ে ওধারে গেলো, না জাহাজটিকে নিছকই প্রদক্ষিণ করে গেলো।
অ্যাব্রাহাম লিঙ্কন তখন ঝপাঝপ আলো নিভিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অবাক হয়ে ক্যাপ্টেন ফ্যারাটকে জিগেস কললুম, ব্যাপার কী?
রাতের অন্ধকারে ওই অদ্ভুত জানোরারটার সঙ্গে লড়াই করে তো আর আমার জাহাজ আর লোকজনের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারি না, ক্যাপ্টেন বললেন, কাল দিনের বেলায় দেখবো সমুদ্রের ওই শক্ত কত শক্তি ধরে।
সে রাতে কারো চোখেই একফোঁটা ঘুম নামলো না। উত্তেজনায় ও আতঙ্কে সবাই কেমন টান-টান হয়ে আছে—তীর ছোড়ার আগে ধনুকের ছিলা যেমন টান হয়ে যায়। সবাই রুদ্ধশ্বাসে জানোয়ারটার গতিবিধি লক্ষ্য করার চেষ্টা করছে, কিন্তু মাঝরাত্রে হঠাৎ সেই সিন্ধুদানব যেন কোন অতলে মিলিয়ে গেলো। যেন দপ করে কোনো অতিকায় জোনাকি নিভে গেলো অকস্মাৎ। কিন্তু শেষরাতের দিকে আবার সেই বিচিত্র আলো দেখা গেলো সামনে। সেই সঙ্গে শোনা গেলো জলে ল্যাজ আছড়ানোর আক্রোশ ফেঁাস-ফেঁাস নিশেস ছাড়ার ভয়ংকর ও অলক্ষুণে আওয়াজ।
আক্রমণ শুরু হলো প্রাতঃকালে। সকাল হতে না হতেই হারপুন বাগিয়ে নেড তার নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর পুরোদমে ইঞ্জিন চালিয়ে দেয়া হলো।
জ্বলন্ত লাল বলের মতো তখন সূর্য উঠছে দিগন্তে, আর জানোয়ারটার সেই উগ্র আলো যেন নিভে গেছে মন্ত্রবলে। মাইল দু-এক দূরে ঢেউয়ের উপরে তার অতিকায় কালো শরীর ভেসে আছে। তিমিমাছের মতো স্তম্ভের আকারে জলের ধারা সে ছুঁড়ে দিচ্ছে প্রায় চল্লিশ ফুট উঠে গেছে সেই জলস্তম্ভ। আমাদের জাহাজ ক্যাপ্টেনের নির্দেশ অনুযায়ী পুরোদমে জন্তুটির দিকে ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্য, দিগন্ত যেমন করে পিছিয়ে যায়, মরীচিকা যেমন করে সরে যেতে থাকে, তেমনিভাবে জন্তুটিও কেবল পিছিয়ে যাচ্ছে তখন দূরত্বটা আর কিছুতেই কমছেনা।
ক্যাপ্টেন ফ্যারাশুট আরো জোরে জাহাজ চালাতে নির্দেশ দিলেন, ইঞ্জিনের প্রচণ্ড নির্ঘোষ উঠলো সবকিছুকে ছাপিয়ে; কোনো-এক অতিকায় হৃৎপিণ্ডের মতো আস্ত জাহাজটা যেন ধ্বক-ধ্বক করে বেজে উঠছে, থরোথরো কেঁপে উঠছে আস্ত পাটাতনটি। কিন্তু দূরত্বটা সমান রেখে ঠিক ততখানি বেগেই জানোয়ারটা দূরে চলে যাচ্ছে–যেন কোনো মজার খেলায় সে মেতে উঠেছে।
দূরত্ব যখন একটুও নাকমে একই থেকে গেলো আগের মতো, ক্যাপ্টেন তখন কামান দাগার আদেশ দিলেন।
কামানের নির্ঘোষ মেলাবার আগেই দেখা গেলো জন্তুটির মসৃণ কঠিন চামড়ার উপর গোলাটা পিছলে গিয়ে সমুদ্রের জলে ঠিকরে পড়লো।
এই পশ্চাদ্ধাবন চললে সারাদিন ধরে। শেষকালে বেলা পড়ে এলো ধীরে ধীরে, ড়ুবে গেলো সূর্য, নেমে এলো অন্ধকার; আর সেই অন্ধকারে অদ্ভুত এই জন্তটারও আর-কোনো হদিশ পাওয়া গেলো না। কিন্তু রাত যখন এগারোটা, হঠাৎ মাইল তিনেক দূরে গত রাত্রির মতোই সমুদ্রের বুকে আবার জ্বলে উঠলো সেই চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল আলো-তাছাড়া আর কোনো সাড়াশব্দ নেই তার। সারা দিনের পরিশ্রমে তাহলে কি অবসন্ন দানবটি ঘুমিয়ে পড়েছে?
অন্তত ক্যাপ্টেন ফ্যারাগুটের তা-ই ধারণা হলো। সুবর্ণ সুযোগ মনে করে সন্তর্পণে জাহাজটিকে তার দিকে নিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন তিনি। ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে নিঃশব্দে অ্যাব্রাহাম লিঙ্কন সেই প্রজ্বলন্ত কালো দানবটির দিকে এগিয়ে গেলো।
আর মাত্র বিশ ফুট দুরে পড়ে আছে দানবটা, নিঃসাড়, কালো ও উজ্জ্বল। নেড ল্যাণ্ড আর একটুও দেরি না করে প্রচণ্ড বেগে তার হারপুন ছুড়লে জন্তুটির দিকে। ঠক! একটা চাপা শব্দ উঠলোহারপুনটা দানবটার গায়ে আছড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে।
অমনি, নিমেষের মধ্যে, সেই উজ্জ্বলপ্রবল আলো নিভে গেলো। প্রচণ্ড দুটি জলের ধারা এসে পড়লো জাহাজের উপর, যেন কোনো সিন্ধু-ঐরাবত তার ওড় দিয়ে জল ছুঁড়ে মারছে। প্রচণ্ড জােড়ে মুহূর্তে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো। মাস্তুল ভেঙে পড়লো মুহূর্তে, ছিঁড়ে গেলো দড়ি-দড়া, নাবিকরা আছড়ে পড়লো এ ওর গায়ে। প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি অনুভব করলুম আমি, তারপরেই রেলিঙের উপর দিয়ে সমুদ্রে ছিটকে পড়লুম।
এত জোরে ছিটকে পড়েছিলুম যে তলিয়ে গিয়েছিলুম প্রথমটায়! কিন্তু সাঁতার জানা ছিলো বলে ভেসে উঠতে পারলুম। সাঁতার দিতে দিতে তাকিয়ে দেখি পুবদিকে ধীরে ধীরে অ্যাব্রাহাম লিঙ্কন-এর আবছা ছায়া মিলিয়ে যাচ্ছে।
খ্যাপার মত চীৎকার করতে লাগলুম আমি কিন্তু জাহাজের কেউ আমার সেই চীৎকার শুনতে পেলো বলে মনে হলো না। প্রাণপণে হাত-পা চালিয়ে সাঁতার কেটে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতে লাগলুম কেবল; কিন্তু সেটাও মস্ত ভুল হলো—তার ফলে অল্পেতেই ভয়ানক ক্লান্ত লাগলো নিজেকে; নিশেস বন্ধ হয়ে আসছে ক্রমশ; বুঝতে পারছি যে ড়ুবে যাচ্ছি কিন্তু কিছুই করার নেই; ভিজে ভারি পোশাকে হাত-পা যেন লোহার মতো ভারি হয়ে উঠেছে।
কয়েক ডোক নোজল খেয়ে যখন তলিয়ে গেছি, তখন শক্ত মুঠোয় আমার জামার কলার চেপে ধরে যে আমাকে টেনে তুললো, সে আমার অনুগত ভূত্য কোনসাইল।
কোনসাইল! তুমি! অনেক চেষ্টা করে এই দুটি কৃতজ্ঞ ও বিস্মিত কথাই আমি উচ্চারণ করতে পারলুম।
হ্যাঁ, মঁসিয়, আমি। আপনি জলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও আপনার পিছনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।
কিন্তু আব্রাহাম লিঙ্কন? আমাদের জাহাজ? সে যে চলে গেলো-
কিছুই করার নেই তাদের, মঁসিয়। জন্তুটার দারুণ কামড়ে জাহাজের হাল আর চাকা খণ্ড-খণ্ড হয়ে গেছে। কাজেই অথৈ জলে নিরুপায়ভাবে নিয়ন্ত্রণবিহীন ভেসে-যাত্মা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার নেই। জলে পড়ার আগেই নাবিকদের চাচামেচিতে এই খবরটা জানতে পেরেছিলাম বলেই আমি আর খামকা ওদের ডাক দিই নি।
তাহলে উপায়? বুদ্ধিভ্রংশের মতো অসহায়ভাবে কোনসাইলকে আমি জিগেস করলুম।
আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে, ছুরি বার করে আমার পোশাক কেটে কোনসাইল আমাকে ভারমুক্ত করে দিলে। তারপর নিজের পোশাকও অমনিভাবে ছুরি দিয়ে কেটে সে বিসর্জন দিলে। অতঃপর শুরু হলো পালা করে একজনের সাঁতার কাটা আর অন্য জনের ভাসমান দেহকে ঠেলে-নিয়ে-যাওয়া। অকুল সমুদ্রের মধ্যে এ-ভাবে সাঁতার দিয়ে লাভই বা কী? কতক্ষণ আর এভাবে জলের উপর ভেসে থাকতে পারবো? কিন্তু একেবারে হাল না ছেড়ে দিয়ে কিছু-একটা করা ঢের ভালো-এই কথা মনে রেখে আমরা পালাবদল করে সাঁতার দিতে লাগলুম।
কিন্তু তাও আর কতক্ষণইবা সম্ভব? অল্পক্ষণের মধ্যেই এমনি অবসাদে ভরে গেলুম যে দেহের শেষ শক্তিবিন্দুটুকু পর্যন্ত হারিয়ে গেলো। হাত-পা সব অবশ, দৃষ্টি আচ্ছন্ন, মাথার ভিতর তাঙ্খিম-মামি করছে, বোধহয় উদ্ধারের আর কোনো সম্ভাবনাই নেই—এমন সময়ে হঠাৎ একটা কঠিন জিনিশের গায়ে ধাক্কা খেলুম। আর অমনি কে যেন সবল হাতে আমাকে আঁকড়ে ধরে জলের উপর থেকে তুলে নিলে। তারপর আর-কিছু মনে নেই।
চেতনা ফিরে আসতেই দেখি দুটি উদ্বিগ্ন মুখ আমার উপর ঝুকে আছে-নেড ল্যাণ্ড আর কোনসাইল। তৎক্ষণাৎ ধড়মড় করে উঠে বসবার চেষ্টা করলুম। নেড ল্যাণ্ড! তুমি?
হ্যাঁ, প্রফেসর আরোনা, আমি। পুরস্কারের টাকার মায়াটা কিছুতেই ছাড়তে পারলুম না, তাই এবার একেবারে জানোয়ারটার পিঠেই চেপে বসেছি। অত জোরে হারপুন ছোড়া সত্বেও নেড ল্যাণ্ডের হারপুন কেন ঠং করে লেগে ঠিকরে গিয়েছিল, তা এবার বুঝতে পারছি, প্রফেসর। কোনো হারপুন কি আর ইস্পাতের বর্ম ভেদ করতে পারে?
তার মানে?
তার মানে অত্যন্ত সরল, প্রফেসর। আপনি যার উপর বসে আছেন, সেটা যে আসলে অতিকঠিন একটি ধাতুনির্মিত খোল, তা আপনি হাত বুলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন। আর যার পিছনে আমরা সর্বকর্ম ছেড়ে তেড়ে গিয়েছিলাম, সেটা আসলে তিমি নয়, তিমিজিলও নয়, অথবা অতিকায় ও অজ্ঞাত কোনো সিন্ধুদানও নয়, সেটা আসলে একটি–
ড়ুবোজাহাজ! বিমূঢ় আমি কলের পুতুলের মতো তার মুখে কথা জুগিয়ে দিলুম।
ঠিক তাই।
ততক্ষণে আস্তে পুবদিকে লাল ছোপ দিচ্ছে; গোল একটা আগুনের চাকার মতো টকটকে সূর্য উঠে আসছে সমুদ্রের জল থেকে। হঠাৎ এমন সময়ে পায়ের তলার বিশাল ভাসমান বস্তুটা নড়ে উঠলো। তারপরেই সেটা ড়ুবতে শুরু করলো আস্তে-আস্তে।
আমরা সবাই আতঙ্কে লাফিয়ে উঠলুম। খ্যাপার মতো ড়ুবোজাহাজটার গায়ে পদাঘাত করতে করতে নেড ল্যাণ্ড প্রচণ্ড ও নিরর্থক চীৎকার শুরু করে দিলে।
হয়তো নেডের ওই চীৎকার একেবারেই নিরর্থক ছিলো না। কারণ আচমকা সেই বিচিত্র ড়ুবোজাহাজটি নিশ্চল হয়ে গেলো, তারপর ঢাকনি খুলে ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একটি লোক। কী-এক দুর্বোধ ভাষায় চেঁচিয়ে উঠেই সে আবার ভিতরে ঢুকে গেলো। তারপরেই পরপর উঠে এলো আটজন মুখোশ-পরা পুরুষ মূর্তি; আমরা কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের টেনে হিচড়ে সেই ড়ুবোজাহাজের ভিতরে নিয়ে গেলো তারা।