হইল নৃপতি পরে জরাযুত অঙ্গ।
রাজ্য ত্যজি গেল বনে মুনিগণ-সঙ্গ।।
কঠিন তপস্যা রাজা করে নিরন্তর।
ফল-মূলাহার করে বনের ভিতর।।
অতিথির পূজা রাজা করয়ে তথায়।
হেনমতে সহস্র বৎসর তথা যায়।।
উঞ্ছবৃত্তি-ব্রত করি বঞ্চে বহুক্লেশে।
ফল-মূল আহার ত্যজিল অবশেষে।।
জলপান ত্যজিয়া করিল বাতাহার।
তপস্যায় হৈল রাজা অস্থি-র্চ্ম্ম-সার।।
হেনমতে গেল দুই সহস্র বৎসর।
পঞ্চাগ্নি করিল বৎসরেক নৃপবর।।
যোগবলে শরীর ত্যজিল মহারাজ।
দিব্য রথে চড়ি গেল ইন্দ্রের সমাজ।।
তথা হৈতে ব্রহ্মলোকে গিয়া নরপতি।
দশলক্ষ বর্ষ ব্রহ্মলোকে করে স্থিতি।।
ব্রহ্মলোক হৈতে রাজা আসে ইন্দ্রস্থানে।
কপটে জিজ্ঞাসে ইন্দ্র তার বিদ্যমানে।।
জরায় পীড়িত তুমি ছিলে গুণাধার।
জরা নিল পুরু তব কনিষ্ঠ কুমার।।
কোন্ নীতি শিখাইলে তারে মহারাজ।
কেন বা ছাড়িয়া এলে ব্রহ্মার সমাজ।।
রাজা বলে, শুন শিখাইলাম যে তারে।
রাজনীতি বিধিমত শাস্ত্র-অনুসারে।।
রাজছত্র দিয়া আমি কহিনু নন্দনে।
পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ কথা, শুন একমনে।।
ক্রোধী নাহি হয় যেই ক্রোধ করাইলে।
গালি দিলে যেই জন কিছু নাহি বলে।।
পর দুঃখে দুঃখী যেই, পর উপকারী।
মধুর কোমল বাক্য বলে মৃদু করি।।
মর্ম্মপীড়া পরেরে না দেয় কোন কালে।
কাপট্য-কুবৃত্তি-হীন, সদা সত্য বলে।।
আপনার ক্লেশে করে পরে পরিত্রাণ।
পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ নাহি তাহার সমান।।
এ সব লোকের বাক্য শুনিয়া শ্রবণে।
পুত্রবৎ করিয়া পালিবে প্রজাগণে।।
দানের দারিদ্র্য দুঃখ বিনাশিবে ধনে।
বিপ্রগণে তুষিবে বিপুল শ্রদ্ধাদানে।।
উৎসব করিয়া বন্ধু-গণেরে তুষিবে।
চোর দস্যু দুষ্ট লোক রাজ্যে না রাখিবে।।
দয়া করি পালিবে অনাথ বৃদ্ধ-জনে।
অবহেলা না করিবে অতিথি সেবনে।।
অবশেষে পুত্র করে দিয়া রাজ্যভার।
তপস্যা করিবে করি ফল-মূলাহার।।
ইন্দ্র বলে, রাজা তুমি পরম পণ্ডিত।
তোমার যতেক কর্ম্ম না হয় বর্ণিত।।
ইন্দ্রলোক ব্রহ্মলোক ভ্রম নিজ সুখে।
তোমার সদৃশ নাহি দেখি তিনলোকে।।
কি পুণ্য করিলে তুমি জন্মিয়া সংসারে।
কহ নৃপবর, ইচ্ছা আছে শুনিবারে।।
রাজা বলে, বৃষ্টিধারা গণিবারে পারি।
আমার পুণ্যের কথা কহিবারে নারি।।
স্বর্গমর্ত্ত্য পাতালে না দেখি হেন জন।
আমার সহিত তার করি যে গণন।।
শুনিয়া হাসিয়া বলে ইন্দ্র দেবরাজ।
আপনা প্রশংসি নিন্দ দেবের সমাজ।।
এই পাপে ক্ষীণপুণ্য হইলে যযাতি।
তোমারে না শোভে আর স্বর্গের বসতি।।
স্বর্গ হৈতে চ্যুত হও, বলে পুরন্দর।
বিস্মিত হইয়া তবে বলে নৃপবর।।
কহিলাম বাক্য আমি, আর না নেউটে।
ভুঞ্জিব আপন কর্ম্ম আছে যে ললাটে।।
এক নিবেদন মোর তোমার গোচরে।
কৃপা করি দেবরাজ আজ্ঞা কর মোরে।।
পুণ্যবান লোক যত আছে যেই পথে।
সেই পথে পড়ি আজ্ঞা কর শচীপতে।।
ইন্দ্র বলে, রাজা তব বুদ্ধি নাহি ঘটে।
নিজগুণে পুনঃ স্বর্গে আসিবে নিকটে।।
এতেক বলিতে তবে পড়িল রাজন।
আকাশ হইতে যেন খসিল তপন।।
হেনকালে শূন্যে অষ্টকাদি চারি জন।
ডাক দিয়া বলে রহ, পড়ে কোন্ জন।।
পুণ্যবান্ আজ্ঞা কভু না হয় খণ্ডন।
শূন্যেতে হইল স্থিত যযাতি রাজন।।
অষ্টক বলিল তুমি, কোন্ মহাজন।
কোন্ নাম ধর তুমি, কাহার নন্দন।।
সূর্য্য অগ্নি-চন্দ্র-তেজ দেখি যে তোমার।
স্বর্গ হৈতে পড়, কেন না বুঝি বিচার।।
রাজা বলে, নাম আমি ধরি যে যযাতি।
পুরুর জনক আমি, নহুষ-সন্ততি।।
পুণ্যবান্ জনেরে করিলাম অমান্য।
সেই হেতু ইহলাম আমার ক্ষীণপুণ্য।।
ধনহীনে পৃথিবীতে বন্ধুগণ ত্যজে।
পুণ্যহীনে স্বর্গ ত্যজে দেবের সমাজে।।
অষ্টক বলিল, তুমি আছিলা কোথায়।
কি কারণে চ্যুত হইলে, কহিবে আমায়।।
রাজা বলে মর্ত্তেতে ছিলাম মহারাজা।
পৃথিবীর লক্ষ রাজা সবে কৈল পূজা।।
পুত্রে রাজ্য দিয়া পুনঃ গেলাম কাননে।
তপ আচরিলাম যে পরম যতনে।।
শরীর ত্যজিয়া স্বর্গে করিনু গমন।
স্বর্গভোগ করিলাম, না যায় কথন।।
সহস্র বৎসর তথা স্বর্গভোগ করি।
তথা হৈতে গেলাম যে ইন্দ্রের নগরী।।
ইন্দ্রের অমরাবতী নাহি পাঠান্তর।
নানাভোগ করিলাম সহস্র বৎসর।।
তথা হৈতে ব্রহ্মলোকে হৈল মোর গতি।
দশ লক্ষ বর্ষ যে হইল তথা স্থিতি।।
নন্দনাদি বন তথা, কি কব সে কথা।
অপ্সরীর সহ ক্রীড়া করিলাম তথা।।
কামরূপী হইয়া বেড়াই যথা তথা।
দেখি ইন্দ্র জিজ্ঞাসিল মোর পুণ্যকথা।।
ইন্দ্রে কহিলাম আপনার পুণ্যচয়।
তথা হইতে সে কারণে পড়ি মহাশয়।।
অষ্টক বলিল, কহ শুনি মহামতি।
স্বর্গ হৈতে পড়িলে হইবে কোন্ গতি।।
রাজা বলে, ক্ষীণপুণ্য হয় যেই জন।
ভৌম-নরকের মধ্যে পড়ে সেইজন।।
রজোবীর্য্যযুত হয়ে পুনঃ দেহ ধরে।
দ্বিপদ চৌপদ হয় কর্ম্ম-অনুসারে।।
পশু কীট পতঙ্গ বিবিধ জন্ম পায়।
গৃধ্র-শিবা-গণ তারে পুনঃপুনঃ খায়।।
পুনঃ পুনঃ জন্ম হয় পুনঃ পুনঃ মরে।
নিজ কর্ম্মে গতাগতি খণ্ডিবারে নারে।।
অষ্টক কহিল, তবে কহ সবাকারে।
এ ঘোর নিরয়ে নরে তরি কি প্রকারে।।
রাজা বলে, তপ-শান্তি-দয়া-দান-ফলে।
এ সব স্বর্গের ভোগ হয় অবহেলে।।
যজ্ঞ-হোম-ব্রত করে অতিথি সেবন।
গুরু-দ্বিজ-সেবা করে দেব আরাধন।।
দৈবাধীন সুখ দুঃখে সদা সমজ্ঞান।
তবে ত নরক হৈতে পায় পরিত্রাণ।।
অষ্টক বলিল, তুমি বড় পুণ্যবান্।
হেথায় নাহিক কেহ তোমার সমান।।
চিরদিন হেথায় থাকহ মহাশয়।
নিশ্চিন্ত হইয়া থাক নাহি ইন্দ্র-ভয়।।
রাজা বলে, ক্ষীণপুণ্য রহিতে না পারি।
স্বর্গেতে রহিতে আর নহি অধিকারী।।
শুনিয়া অষ্টক শিবি বসু প্রতর্দ্দন।
রাজারে ডাকিয়া তথা বলে চারি জন।।
আমা সবাকার পুণ্য যতেক আছয়।
সেই পুণ্যে হেথা তুমি রহ মহাশয়।।
রাজা বলে, পরদ্রব্য না করি গ্রহণ।
কৃপণের বৃত্তি এই শুন মহাজন।।
শিবি রাজা বলে, তুমি তৃণগাছি দিয়া।
আমা সবাকার পুণ্য লহ ত কিনিয়া।।
রাজা বলে, যাহা কহ বালকের ভাষ।
তৃণ দিয়া লব পুণ্য, লোকে উপহাস।।
এত শুনি বলে অষ্টকাদি চারিজন।
নিশ্চয় হেথায় যদি না রহ রাজন্।।
তোমার সহিত তবে যাব চারি জন।
যথায় নৃপতি তুমি করিবে গমন।।
এতেক বচন যদি তাহারা বলিল।
দিব্যমূর্ত্তি পঞ্চ-রথ সেখানে আইল।।
পঞ্চরথে চড়িয়া চলিল পঞ্চ জন।
ইন্দ্রের অমরাবতী করিল গমন।।
বৈশম্পায়ন বলে, শুন জনমেজয়।
সেই চারি জন তাঁর কন্যার তনয়।।
কন্যার পুত্রের পুণ্যে তরিল যযাতি।
পুনরপি স্বর্গে রাজা করিল বসতি।।
যযাতি-চরিত্র কথা অমৃত-আধার।
শ্রবণে মধুর নাহি সমান ইহার।।
শ্রদ্ধাযুক্ত হৈয়া ইহা যে করে শ্রবণ।
ধন-ধর্ম্ম-যশ লভে ব্যাসের বচন।।
হৃদয়ে নির্ম্মল জ্ঞান হয় তো উদিত।
পাঁচালী প্রবন্ধে কাশীদাস বিরচিত।।