৪৯তম অধ্যায়
ভীষ্মদ্রোণবাক্যে ধৃতরাষ্ট্রের উপেক্ষা-সঞ্জয় প্রদত্ত সংবাদ শ্রবণে উৎসাহ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমাদিগের প্রীতির নিমিত্ত ভুরি ভুরি সেনা সমাগত হইয়াছে শ্রবণ করিয়া রাজা যুধিষ্ঠির কি কহিলেন? তিনি যুদ্ধের নিমিত্ত কিরূপ উদ্যোগ করিতেছেন? কাহারই বা অনুমতিলাভের নিমিত্ত তাঁহার মুখ নিরীক্ষণ করিয়া আছেন? কোন ব্যক্তিরাই বা কপটাচারকোপিত ধৰ্মরাজকে যুদ্ধ হইতে নিবারিত ও ক্ষান্ত করিতেছে?”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আপনার কল্যাণ হউক। পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ রাজা যুধিষ্ঠিরের অনুমতি প্রতীক্ষা করিতেছেন এবং তাঁহার শাসনের অনুগামী হইয়া চলিতেছেন। তিনি আগমন করিলে তাঁহাদিগের রথসমূহ পৃথক পৃথক হইয়া তাঁহার অভিনন্দন করে। বিশেষতঃ পঞ্চিলিগণ। সেই দীপ্ততেজাঃ যুধিষ্ঠিরকে গগনোদিত সূৰ্য্যমণ্ডলের ন্যায়, তেজোরাশির ন্যায় পূজা করিয়া থাকেন। অন্যের কথা কি কহিব, পাঞ্চাল, কেকয় ও মৎস্যদেশের গোপাল ও মেষপাল পর্য্যন্ত তাহার অভিনন্দন করে। ব্রাহ্মণী, রাজপুত্রী ও বৈশ্যকুমারীও যুধিষ্ঠিরকে বদ্ধপরিকর নিরীক্ষণ করিবার নিমিত্ত ক্রীড়া করিতে করিতে তাহার সমীপে আগমন করিয়া থাকে।”
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! পাণ্ডবগণ কাহার সাহায্যে আমাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সজ্জীভূত হইয়াছেন?”
পাণ্ডবাবলম্মরণে সঞ্জয়ের মূৰ্ছা-মূৰ্ছাপগমে পুনর্ব্বার বিবৃতি
রাজা ধৃতরাষ্ট্র এই কথা জিজ্ঞাসা করিবামাত্ৰ সঞ্জয় দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক মুহুর্ত্তকাল চিন্তা করিয়া অকস্মাৎ মূৰ্ছাপন্ন হইলেন। তখন বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে কহিলেন, “মহারাজ! সঞ্জয় মূর্চ্ছিত হইয়া ধরাতলে পতিত হইয়াছেন; ইহার মুখ হইতে একটি কথাও নিঃসৃত হইতেছে না।”
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “বিদুর! সঞ্জয় মহারথ পাণ্ডবগণের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিল, তাহারা ইহার মনকে নিতান্ত উত্তেজিত করিয়াছে, সন্দেহ নাই।”
অনন্তর সঞ্জয় চেতনালাভপূর্ব্বক আশ্বস্ত হইয়া ধৃতরাষ্ট্রকে কহিলেন, “মহারাজ! আমি মহারথ কুন্তীপুত্ৰদিগকে বিরাটগৃহনিরোধ নিবন্ধন অতিমাত্ৰ কৃশ অবলোকন করিলাম। সে যাহা হউক, এক্ষণে তাঁহারা যাহাদিগের সাহায্যে আপনাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সজ্জীভূত হইয়াছেন, শ্রবণ করুন। পাণ্ডবগণ মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্নের সাহায্যে আপনাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সজ্জীভূত হইয়াছেন। যিনি রোষ, ভয়, লোভ, অর্থ বা কোন প্রকার হেতুবাদে কদাপি সত্য পরিত্যাগ করেন না, যিনি স্বয়ং ধর্মের প্রমাণস্বরূপ, পাণ্ডবগণ সেই ধার্মিকশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের সাহায্যে আপনাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সজ্জীভূত হইয়াছেন। বাহুবলে যাহার সমকক্ষ পৃথিবীতে নাই, যে ধনুৰ্দ্ধর সমুদয় মহীপালকে সজ্জীভূত এবং কাশী, বঙ্গ, মগধ ও কলিঙ্গদেশীয়দিগকে পরাজিত করিয়াছেন, পাণ্ডবগণ সেই ভীমসেনের সাহায্যে আপনাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সজ্জীভূত হইয়াছেন। পাণ্ডবচতুষ্টয় যাহার বাহুবলে সহসা জতুগৃহ ও নরভিক্ষক হিড়িম্ব হইতে রক্ষিত হইয়াছিলেন, যিনি পাণ্ডবগণের প্রধান অবলম্বন, যিনি সিন্ধুরাজের হস্ত হইতে যজ্ঞসেনীকে পরিত্ৰাণ করিয়া পাণ্ডবগণের পক্ষে বিপদসাগরের দ্বীপস্বরূপ হইয়াছিলেন, পাণ্ডবগণ সেই বৃকোদরের সাহায্যে আপনাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সজ্জীভূত হইয়াছেন। যিনি দ্রৌপদীর প্রীতিসম্পাদনের নিমিত্ত অতি দুৰ্গম গন্ধমাদনপর্ব্বতে গমন করিয়া ক্রোধবশনামে রাক্ষসগণকে সংহার করিয়াছেন, যাহার বাহুবল অযুত নাগবলের সমান, পাণ্ডবগণ সেই ভীমসেনের সাহায্যে আপনাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সজ্জীভূত হইয়াছেন।
“যিনি হুতাশনের সন্তোষার্থ কৃষ্ণের সাহায্যে ও আপন বিক্রমে যুদ্ধে পুরন্দরকে পরাজয় করিয়াছেন, যিনি সাক্ষাৎ শূলপাণি দেবদেব মহাদেবকে যুদ্ধে গ্ৰীত করিয়া সকল লোকপালকে বশীভূত করিয়াছেন, পাণ্ডবগণ সেই ধনুৰ্দ্ধর ধনঞ্জয়ের সাহায্যে আপনাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সজ্জীভূত হইয়াছেন।
“যিনি ম্লেচ্ছকুলসঙ্কুল প্রতীচীদিক বশীভূত করিয়াছেন, পাণ্ডবগণ সেই চিত্ৰযোধী সৌম্যমূর্ত্তি মহাধনুৰ্দ্ধর বীরবর নকুলের সাহায্যে আপনাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সজ্জীভূত হইয়াছেন।
“যিনি কাশী, অঙ্গ, মগধ ও কলিঙ্গদেশীয়দিগকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়াছেন, পৃথিবীতে অশ্বত্থামা, ধৃষ্টকেতু, রুক্মী ও প্ৰদ্যুম্ন, এই বীরচন্তুষ্টয় বলবীৰ্য্যে যাহার সমকক্ষ, পাণ্ডবগণ সেই সহদেবের সাহায্যে আপনাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সজ্জীভূত হইয়াছেন। মহারাজ! সেই যবীয়ান [পাণ্ডবগণের সর্ব্বকনিষ্ঠ] নববীর, জননীর আনন্দবৰ্দ্ধন সহদেবের সহিত আপনাদের যুদ্ধঘটনা কেবল বিনাশের কারণ।
“পূর্ব্বে যে সাধ্বী কাশিরাজকন্যা প্রাণত্যাগ করিয়াও ভীষ্মকে বধ করিবার অভিলাষে ঘোরতর তপস্যা করিয়া পাঞ্চালরাজের কন্যা হইয়াছিলেন, যিনি আবার যক্ষের অনুগ্রহ পুরুষবিগ্রহ পরিগ্রহ করিয়াছেন, যিনি স্ত্রীপুরুষ উভয়েরই গুণাগুণ অবগত আছেন এবং যিনি কলিঙ্গদিগকে আক্রমণ করিয়াছিলেন, পাণ্ডবগণ সেই যুদ্ধদুর্ম্মদ শিখণ্ডীর সাহায্যে আপনাদের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সজ্জীভূত হইয়াছেন। কেকায়েরা পঞ্চভ্রাতা মহাধনুৰ্দ্ধর, বর্মিতাঙ্গ [বর্ম্মাবৃত] ও শৌৰ্য্যশালী, পাণ্ডবগণ তাঁহাদিগের সাহায্যে আপনাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সজ্জীভূত হইয়াছেন। যিনি দীর্ঘবাহু, লঘুহস্ত [বাণবর্ষণে ক্ষিপ্তহস্ত], ধৈৰ্য্যশালী ও অমোঘবিক্রম, সেই বৃষ্ণিবীর যুযুধানের সহিত আপনাদিগের যুদ্ধঘটনা হইবে। যিনি সমুচিত সময়ে মহাত্মা পাণ্ডবগণকে রক্ষা করিয়াছিলেন, সেই বিরাটরাজের সহিত আপনাদিগের সমাগম হইবে। যে কাশীশ্বর পাণ্ডবগণের যোদ্ধৃপদে নিযুক্ত হইয়াছেন, তাহারা সেই মহারথ কাশীপতির সাহায্যে আপনাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সজ্জীভূত হইয়াছেন। পাণ্ডবগণ আশীবিষের ন্যায় বিষম্পর্শ ও সমরে দুৰ্জয় দ্রুপদশিশুদিগের সাহায্যে আপনাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সজ্জীভূত হইয়াছেন। যিনি বীরত্বে বাসুদেবের তুল্য ও ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহে যুধিষ্ঠিরের সমান, পাণ্ডবগণ সেই অভিমনুর সাহায্যে আপনাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সজ্জীভূত হইয়াছেন। যিনি চেদিরাজ্যের অধীশ্বর, বীরত্বে অপ্রতিম ও সমরে দুঃসহ, পাণ্ডবগণ সেই মহাযশাঃ শিশুপালনন্দন ধৃষ্টকেতুর সাহায্যে আপনাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সজ্জীভূত হইয়াছেন। যিনি অক্ষৌহিণীপরিবৃত হইয়া পাণ্ডবগণের সহিত মিলিত হইয়াছেন; যিনি দেবগণের আশ্রয় সহস্ৰলোচনের ন্যায় পাণ্ডবগণের সহায়, পাণ্ডবগণ সেই বাসুদেবের সাহায্যে আপনাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সজ্জীভূত হইয়াছেন এবং তাঁহারা চেদিপতির ভ্রাতা শরভ ও করকর্ষের সাহায্যে আপনাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সজ্জীভূত হইয়াছেন।
“অদ্বিতীয় রথী জরাসন্ধানন্দন সহদেব ও জয়ৎসেন যুদ্ধার্থী হইয়া অবস্থিত আছেন। মহাবলপরিবৃত মহাবল দ্রুপদ পাণ্ডবগণকে আত্মপ্রদানপূর্ব্বক যুদ্ধার্থী হইয়া আছেন। রাজা যুধিষ্ঠির এই সকল প্রাচ্য পাশ্চাত্ত্য প্রভৃতি শত শত ভূপতিকে আশ্রয় করিয়া যুদ্ধোন্মুখ হইয়া আছেন।”