একোনপঞ্চাশত্তম অধ্যায়
পরীক্ষিতের নিধনবৃত্তান্ত
শৌনক কহিলেন, রাজা জনমেজয় পিতার স্বর্গারোহণবৃত্তান্ত মন্ত্রিগণকে যেরূপে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, হে সূতনন্দন! তুমি এক্ষণে তাহা সবিস্তারে কীর্ত্তন কর। উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, হে দ্বিজেন! রাজা জনমেজয় যে প্রকারে মন্ত্রীদিগের পিতার নিধন বার্ত্তা জিজ্ঞাসা করেন এবং তাঁহার যেরূপে সেই বৃত্তান্ত বর্ণন করেন, তাহা কহিতেছি, শ্রবণ করুন। একদা রাজা জনমেজয় স্বীয় মন্ত্রীদিগকে কহিলেন, “হে অমাত্যগণ! তোমরা আমার পিতার নিধনবৃত্তান্ত সমুদয় জান, এক্ষণে আমি তোমাদিগের নিকট তাহা আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিয়া যথোচিত প্রতিবিধান-চেষ্টা করিব।” ধার্ম্মিক ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন অমাত্যগণ মহারাজ জনমেজয় কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া কহিলেন, “রাজন্! আপনার পিতা মহাত্মা পরীক্ষিতের যেরূপ চরিত্র ও তিনি যে প্রকারে লোকান্তরে গমন করিয়াছেন, তাহা কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। ধর্ম্মাত্মা প্রবলপরাক্রান্ত রাজা পরীক্ষিৎ মূর্ত্তিমান ধর্ম্মের ন্যায় প্রজাপালনপূর্ব্বক ভগবতী ভূতধাত্রীকে রক্ষা করিতেন। তদীয় অধিকার কালে ব্রাহ্মণ, ক্ষৎত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চারিবর্ণ স্ব স্ব ধর্ম্মে অনুরক্ত ছিলেন। তিনি কাহারও দ্বেষ্টা ছিলেন না এবং তাঁহার প্রতিও কেহ বিদ্বেষ করিত না। তিনি প্রজাপতির ন্যায় সর্ব্বভূতে সমদর্শী ছিলেন এবং বিধবা, বিকলাঙ্গ, অনাথ, দীন, দরিদ্রদিগকে ভরণপোষণ করিতেন। তদীয় কলেবর দ্বিতীয় শশধরের ন্যায় লোকের প্রিয়দর্শন ছিল। মহারাজ পরীক্ষিৎ শারদ্বত হইতে ধনুর্ব্বেদ শিক্ষা করেন ও ভূতভাবনা ভগবান্ বাসুদেবের অতি প্রিয়পাত্র ছিলেন। প্রজাগণ সকলেই তাঁহার প্রতি সবিশেষ অনুরক্ত ছিল। কুরুকুল পরিক্ষীণ হইলে আপনার পিতা অভিমন্যুর ঔরসে উত্তরার গর্ভে উৎপন্ন হয়েন; এই নিমিত্ত তাঁহার নাম পরীক্ষিৎ হইয়াছিল। তিনি রাজধর্ম্মে সুনিপুণ, নীতিশাস্ত্রে পারদর্শী, জিতেন্দ্রিয়, মেধাবী এবং ষড়বর্গ-বিজেতা [কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ. মদ ও মাৎসর্য্য-এই ষড়্রিপুজয়ী] ছিলেন। রাজাধিরাজ পরীক্ষিৎ ষষ্টিবর্ষ বয়ঃক্রম পর্য্যন্ত প্রজাপালন করিয়া সংসারলীলা সংবরণ করেন। তদীয় নিধনকালে সকলেই শোকাভিভূত হইয়াছিলেন। তৎপরে আপনি কুলক্রমাগত এই রাজ্যতন্ত্র ধর্ম্মতঃ লাভ করিয়াছেন এবং অতি শৈশবাবস্থাতেই রাজ্যে অভিষিক্ত হইয়া সহস্র বৎসর প্রজাবর্গ শাসন করিয়াছেন।”
জনমেজয় কহিলেন, “মদীয় পূর্ব্বপুরুষদিগের বিচিত্র চরিত্র পর্য্যালোচনা করিয়া দেখিলে বোধ হয়, এই বংশে এমন কোন রাজা ছিলেন না যে, তিনি প্রজাবর্গের প্রিয়কার্য্য-সম্পাদন না করিতেন। অতএব আমার পিতা তথাবিধ রাজা হইয়াও কি প্রকারে বিনাশপ্রাপ্ত হইলেন, তাহা যথাযথরূপে বর্ণনা কর, আমি শ্রবণ করিতে বাসনা করি।” রাজার প্রিয়হিতাভিলাষী মন্ত্রিগণ তদীয় আদেশক্রমে পরীক্ষিতের নিধনবৃত্তান্ত যথাবৎ বর্ণন করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহারা কহিলেন, “মহারাজ! আপনার পিতা পাণ্ডু রাজার ন্যায় অসাধারণ ধনুর্দ্ধর ও মৃগয়াতৎপর ছিলেন। একদা তিনি আমাদিগের প্রতি সমস্ত সাম্রজ্যের ভারার্পণ করিয়া মৃগয়ার্থ অরণ্যানী প্রবেশপূর্ব্বক শাণিত বাণ দ্বারা একটি মৃগকে বিদ্ধ করিয়াছিলেন; বিদ্ধ করিয়া অস্ত্র-শস্ত্র সহিত অতি সত্বরপদে তাহার অনুসরণে প্রবৃত্ত হইলেন; কিন্তু পলায়িত বাণবিদ্ধ মৃগের কিছুই অনুসন্ধান করিতে পারিলেন না। তৎকালে তিনি ষষ্টিবর্ষ বয়স্ক ও অতি দুর্ব্বল হইয়াছিলেন, এই নিমিত্ত অতি অল্পকালের মধ্যে একান্ত ক্লান্ত ও ক্ষুৎপিপাসায় নিতান্ত আক্রান্ত হইলেন। পরে ইতস্ততঃ পর্য্যটন করিতে করিতে অরণ্যমধ্যে এক মুনিকে দেখিতে পাইলেন। ঐ মুনি মৌনব্রতাবলম্বনপূর্ব্বক একতানমনে ধ্যান করিতেছিলেন। রাজা তাঁহার নিকট প্রত্যুত্তর করিলেন না। রাজা ক্ষুধার্ত্ত ও পিপাসার্ত্ত ছিলেন, সুতরাং তিনি মুনিকে উত্তরদানে পরাঙ্মুখ দেখিয়া তৎক্ষণাৎ ক্রোধাবিষ্ট হইলেন এবং তাঁহাকে প্রতিবোধিত না করিয়া রোষাবেশ প্রকাশপূর্ব্বক ধরাতল হইতে ধনুষ্কোটি [ধনুকের অগ্রভাগ] দ্বারা এক মৃতসর্প উদ্ধৃত করিয়া সেই শুদ্ধচিত্ত মুনিবরের স্কন্ধদেশে নিক্ষেপ করিলেন। তথাপি তিনি কিছুই না বলিয়া অক্ষুব্ধচিত্তে স্কন্ধে মৃতসর্পধারণ পূর্ব্বক পূর্ব্ববৎ অবস্থিত রহিলেন।”