৪৯ম অধ্যায়
ক্ষত্রিয়নাশপ্রসঙ্গে পরশুরাম-জন্মবৃত্তান্ত
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ। তখন মহাত্মা বাসুদেব পৃথিবী যেরূপে নিঃক্ষত্রিয়া ও যেরূপে পুনরায় ক্ষত্রিয়-পরিপূর্ণ হইয়াছিল, তদ্বৃত্তান্ত বর্ণন করিতে আরম্ভ করিয়া কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আমি মহর্ষিগণের নিকট ভার্গবের জন্ম, বিক্রম ও প্রভাবের বিষয় যেরূপ শ্রবণ করিয়াছি, ঐ মহাবীর যেরূপে কোটি কোটি ক্ষত্রিয় নিপাতিত করিয়াছিলেন এবং যেরূপে রাজবংশে পুনরায় ক্ষত্রিয়গণ উদ্ভূত ও নিহত হইয়াছেন, তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। মহাত্মা জহ্নুর পুত্র অজ, অজের পুত্র বলাকাশ্ব, বলাকাশ্বের পুত্র কুশিক। কুশিক ইন্দ্রকে পুত্ৰত্বে লাভ করিবার মানসে কঠোর তপানুষ্ঠান করাতে দেবরাজ সুপ্রসন্ন হইয়া স্বয়ং তাঁহার ঔরসে জন্মগ্রহণপূর্ব্বক গাধি নামে বিখ্যাত হয়েন। মহারাজ গাধির সত্যবতীনামে এক রূপবতী কন্যা জন্মে। কুশিকতনয় সেই কন্যাটিকে ভৃগুনন্দন ঋচীকের হস্তে প্রদান করিয়াছিলেন। ভগবান্ ঋচীক স্বীয় প্রিয়তমার পবিত্রতাগুণে প্রীত হইয়া তাঁহার ও তাঁহার পিতা মহারাজ গাধির পুত্রলাভের নিমিত্ত দুইটি পৃথক পৃথক চরু প্ৰস্তুত করিয়া সত্যবতীকে আহ্বানপূর্ব্বক কহিলেন,প্রিয়ে! তোমার মাতাকে এই প্রথম চরুটি ভোজন করিতে কহিও এবং তুমি স্বয়ং এই দ্বিতীয় চরুটি ভোজন করিও। তোমার মাতা এই প্রথম চরু ভোজন করিলে নিশ্চয়ই এক ক্ষত্রিয়নিসূদন বীরপুত্র প্রসব করিবেন এবং তুমি এই দ্বিতীয় চরুটি ভোজন করিলে এক শান্তস্বভাব ধৈর্য্যশালী তপোনিরত পুত্রের মুখাবলোকনে সমর্থ হইবে, সন্দেহ নাই। ভগবান্ ঋচীক ভাৰ্য্যাকে এই কথা কহিয়া তপঃসাধনার্থ অরণ্যে প্রস্থান করিলেন।
“ইত্যবসরে মহারাজ গাধি তীর্থযাত্রাপ্রসঙ্গে সস্ত্রীক হইয়া ভগবান্ ঋচীকের আশ্রমে সমুপস্থিত হইলেন। সত্যবতী পিতামাতার দর্শনে নিতান্ত পুলকিত ও ব্যস্তসমস্ত হইয়া চরুদ্বয় গ্রহণপূর্ব্বক জননীর নিকট গমন করিয়া মহর্ষি ঋচীকের বাক্য আনুপূর্ব্বিক কীৰ্ত্তন করিলেন। তখন গাধিমহিষী পরমাহ্লাদে সেই চরুদ্বয় গ্রহণপূৰ্ব্বক অজ্ঞানতাপ্রযুক্ত আপনার চরু কন্যাকে প্রদান ও কন্যার চরু স্বয়ং ভোজন করিলেন। এইরূপে সত্যবতী ভ্রমক্রমে মাতার চরু ভোজন করাতে তাঁহার গর্ভ ক্রমে ক্রমে নিতান্ত ঘোরদর্শন হইয়া উঠিল। মহাত্মা ঋচীক ভাৰ্য্যার গর্ভের ভীষণাকার দর্শন করিয়া তাঁহাকে কহিলেন, ‘প্রিয়ে! তোমার জননী তোমাকে তোমার চরু প্রদান না করিয়া তাঁহার চরু ভোজন করাইয়াছেন এবং স্বয়ং তোমার চরু ভক্ষণ করিয়াছেন; অতএব নিশ্চয়ই তোমার পুত্র অতি ক্রূরকর্ম্মা ও ক্রোধপরায়ণ এবং তোমার ভ্রাতা তপোনিরত ও ব্রহ্মাতেজঃসম্পন্ন হইবে। আমি তোমার চরুতে ব্ৰহ্মতেজ ও তোমার মাতার চরুতে ক্ষাত্ৰতেজ সমাহিত করিয়াছিলাম। অতএব তোমার জননীর পুত্র ব্রাহ্মণ ও তোমার পুত্র ক্ষত্রিয় হইবে, সন্দেহ নাই।
‘ভগবান ঋচীক এই কথা কহিলে পতিপরায়ণা সত্যবতী কম্পান্বিতকলেবরে ভর্তার চরণে নিপতিত হইয়া কহিলেন, ভগবন্! আমার পুত্র ক্ষত্রিয়ধর্ম্মাবলম্বী হইবে, এরূপ বাক্য প্রয়োগ করা আপনার কর্ত্তব্য নহে।” তখন ঋচীক কহিলেন, ‘প্রিয়ে! আমি ত’ তোমার ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মাক্রান্ত পুত্র হইবে মনে করিয়া চরু প্রস্তুত করি নাই; অতএব এ বিষয়ে আমার অপরাধ কি? তুমি কেবল চরুভোজন-দোষেই অতি ক্রূরকর্ম্মা পুত্র প্রসব করিবে।’ সত্যবতী কহিলেন, মহর্ষে! আপনি ইচ্ছা করিলে পুত্রের কথা দূরে থাকুক, সমুদয় লোকের সৃষ্টি করিতে পারেন। অতএব অনুগ্রহ করিয়া আমাকে এক শান্ত প্রকৃতি ধীর পুত্র প্রদান করুন।’ ঋচীক কহিলেন, ‘প্রিয়ে! মন্ত্রোচ্চারণপূর্ব্বক বহ্নিস্থাপন করিয়া চরু প্রস্তুত করিবার সময়ের কথা দূরে থাকুক, আমি পরিহাসচ্ছলেও কখন মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করি নাই। বিশেষতঃ তোমার পিতার বংশে ব্রাহ্মণ উৎপত্তি হইবে, তাহা আমি পূৰ্বেই অবগত হইয়াছি।’ তখন সত্যবতী কহিলেন, নাথ! যদি নিতান্তই আপনার বাক্য অন্যথা না হয়, তবে উহার প্রভাবে আমার পৌত্র যেন ক্ষত্রিয়ধর্ম্মাবলম্বী হইয়া জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু আপনাকে অনুগ্রহ করিয়া আমাকে শান্তগুণাবলম্বী পুত্র প্রদান করিতেই হইবে।’ মহাত্মা ঋচীক প্রিয়তমার নির্ব্বন্ধাতিশয় দর্শনে কথঞ্চিৎ সম্মত হইয়া কহিলেন, ‘প্রিয়ে! আমার মতে পুত্র ও পৌত্রে কিছুমাত্র প্রভেদ নাই। যাহা হউক, তুমি যাহা কহিলে, তাহার অন্যথা করিব না। তোমার মনোরথ সফল হউক।
“অনন্তর পতিপরায়ণা সত্যবতী যথাসময়ে তপানুষ্ঠাননিরত শান্তস্বভাব জমদগ্নিকে প্রসব করিলেন। কুশিকনন্দন মহারাজ গাধিরও বিশ্বামিত্র নামে তপানুষ্ঠানপরায়ণ পুত্ৰ সমুৎপন্ন হইল। কিয়দ্দিন পরে ঋচীকপুত্র মহাত্মা জমদগ্নির ঔরসে দীপ্ত পাবকতুল্য ধনুর্ব্বিদ্যাপারদর্শী ক্ষত্রিয়নিহন্তা পরশুরাম জন্মগ্রহণ করিলেন। ঐ মহাবীর গন্ধমাদনপৰ্ব্বতে দেবদেব মহাদেবকে পরিতুষ্ট করিয়া প্রভূত অস্ত্র ও জ্বলিতানলতুল্য অকুণ্ঠিতধার[অমোঘ ধার—যে ধারের তীক্ষ্ণ কখন লুপ্ত হয় না] পরশু[কুঠার] প্রাপ্ত হইয়া ইহলোকে অদ্বিতীয় বীর হইয়া উঠিলেন।
কার্ত্তবীর্য্যাৰ্জ্জুনের প্রতি বশিষ্ঠশাপ
“ইত্যবসরে হৈহয়াধিপ মহাবলপরাক্রান্ত কার্ত্তবীৰ্য্য অর্জ্জুন দত্তাত্রেয়ের প্রসাদে সহস্র বাহু লাভ করিয়া স্বীয় বাহুবল ও অস্ত্রবলে অখণ্ড ভূমণ্ডলে একাধিপত্য সংস্থাপনপূর্ব্বক অশ্বমেধযজ্ঞে ব্রাহ্মণগণকে সমুদয় পৃথিবী প্রদান করিলেন। ঐ সময় ভগবান হুতাশন ক্ষুধার্ত্ত হইয়া অৰ্জ্জুনের নিকট দাহ্যবস্তু প্রার্থনা করিলে তিনি তাঁহাকে বিবিধ গ্রাম, নগর প্রভৃতি প্রদান করিতে সম্মত হইলেন। তখন তাঁহার বাণাগ্রসম্ভূত হুতাশন প্রজ্বলিত হইয়া শৈল ও পাদপসমূহ ভস্মসাৎ করিতে করিতে বায়ুবেগবশতঃ মহর্ষি বশিষ্ঠের রমণীয় পবিত্র আশ্রমে প্রাদুর্ভূত হইয়া উহা দগ্ধ করিয়া ফেলিল। মহাত্মা বশিষ্ঠ তদ্দর্শনে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া কাৰ্ত্তবীৰ্য্যকে এই অভিশাপ প্রদান করিলেন, ‘হে দুরাত্মন্! তুমি জ্ঞাতসারে আমার এই তপোবন দগ্ধ করিলে, অতএব এই পাপে জমদগ্নির পুত্র পরশুরাম তোমার সমুদয় বাহু ছেদন করিয়া ফেলিবেন। মহাত্মা অৰ্জ্জুন মহাবলপরাক্রান্ত, শান্তগুণাবলম্বী, দাতা, শরণাগত প্রতিপালক ও ব্রাহ্মণের হিতকারী ছিলেন; সুতরাং বশিষ্ঠকর্ত্তৃক এইরূপ শাপগ্রস্ত হইয়াও তৎকালে কিছুমাত্র চিন্তাযুক্ত হইলেন না। কার্ত্তবীর্য্যের পুত্রগণ নিতান্ত গর্ব্বিত ও নৃশংস ছিল। তাহারা সেই অভিশাপশ্রবণে ক্রুদ্ধ হইয়া পিতার অজ্ঞাতসারে জমদগ্নির ধেনুবৎস অপহরণ করিল। বৎস অপহৃত হওয়াতে পরশুরাম যৎপরোনাস্তি রোষাবিষ্ট ও কার্ত্তবীর্য্যের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া তাঁহার সহস্র বাহু ছেদনপূর্ব্বক তাঁহার অন্তঃপুর হইতে সেই বৎসটি স্বীয় আশ্রমে প্রত্যানীত করিলেন।
পরশুরাম কর্ত্তৃক পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয়করণ
“কিয়দ্দিন পরে একদা মহাত্মা পরশুরাম সমিৎকুশাদি আহরণ করিবার নিমিত্ত আশ্রম হইতে বহির্গত হইলে নিৰ্ব্বোধ কাৰ্ত্তবীৰ্য্যতনয়গণ জমদগ্নির আশ্রমে সমুপস্থিত হইয়া ভল্লদ্বারা তাঁহার মস্তকচ্ছেদন করিয়া ফেলিল। পরশুরাম সমিৎকুশাদি আহরণপূর্ব্বক আশ্রমে প্রত্যাগত হইয়া পিতৃবধদর্শনে নিতান্ত কোপান্বিত হইলেন এবং পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয়া করিতে প্রতিজ্ঞা করিয়া শস্ত্র গ্রহণপুৰ্ব্বক ক্রমে ক্রমে কাৰ্ত্তবীর্য্যের পুত্র, পৌত্র ও অন্যান্য ক্ষত্রিয়দিগকে সমূলে উম্মূলিত করিলেন। হৈহয়গণের শোণিতধারায় পৃথিবী কর্দ্দময় হইল। এইরূপে মহাবীর পরশুরাম পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করিয়া করুণার্দ্র চিত্তে বনপ্রস্থান করিলেন। সহস্র বৎসর অতীত হইলে ক্রোধপরায়ণ ভগবান্ জামদগ্ন সেই বনমধ্যে ব্রাহ্মণসমাজে নিতান্ত নিন্দিত হইলেন। একদা মহর্ষি বিশ্বামিত্রের পৌত্র পরাবসু সৰ্ব্বসমক্ষে তাঁহাকে নিন্দা করিয়া কহিলেন, “রাম! রাজা যযাতির দেবলোক হইতে পতননিবন্ধন যে যজ্ঞানুষ্ঠান হইয়াছিল, সেই যজ্ঞে প্রতর্দ্দন প্রভৃতি অসংখ্য ভূপতি আগমন করিয়াছিলেন; তাঁহারা কি ক্ষত্রিয় নহেন? তুমি পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয়া করিবে বলিয়া যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলে, তাহা পরিপূর্ণ করিতে পার নাই। এক্ষণে জনসমাজে কেবল বৃথা আত্মশ্লাঘা করিতেছ। নিশ্চয়ই তুমি মহাবীর ক্ষত্রিয়গণের ভয়ে একান্ত ভীত হইয়া পৰ্ব্বতে পলায়ন করিয়া রহিয়াছ। যাহা হউক, এক্ষণে পৃথিবী পুনরায় অসংখ্য ক্ষত্রিয়ে পরিপূর্ণ হইয়াছে।
“কোপনস্বভাব জমদগ্নিনন্দন পরাবসুর মুখে এইরূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া পুনরায় শস্ত্র গ্রহণ করিলেন। পূর্বে তিনি যে সকল ক্ষত্রিয়দিগকে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, তাঁহারা এক্ষণে মহাপরাক্রান্ত ও অভ্যুদয়সম্পন্ন হইয়া পৃথিবী শাসন করিতেছিলেন। তিনি তদ্দর্শনে ক্রোধান্বিত হইয়া তাঁহাদিগকে এবং তাঁহাদের অল্পবয়স্ক বালকদিগকে অবিলম্বে সংহার করিয়া ফেলিলেন। কিয়দ্দিন পরে গর্ভস্থ ক্ষত্রিয়সন্তানগণ প্রসূত হইতে লাগিল। উহারা জন্মগ্রহণ করিবামাত্র জমদগ্নিতনয় উহাদিগকেও বিনষ্ট করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় কতকগুলি ক্ষত্রিয়পত্নী স্ব স্ব পুত্রদিগকে পরম যত্নসহকারে পরশুরামের হস্ত হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন।
“মহাবীর জমদগ্নিনন্দন এইরূপে পৃথিবীতে একবিংশতিবার নিঃক্ষত্রিয়া করিয়া পরিশেষে অশ্বমেধযজ্ঞানুষ্ঠানপূর্ব্বক মহর্ষি কশ্যপকে সমুদয় পৃথিবী দক্ষিণা দান করিলেন। তখন কশ্যপ হতাবশিষ্ট ক্ষত্রিয়গণের রক্ষাবিধানার্থ স্রূক্ ও প্রগ্রহ[যজ্ঞীয় রজ্জু-ঋগবেদীয় হোমে কুশ রজ্জু ধারণ করিতে হয়]সম্পন্ন হস্ত দ্বারা দিঙ্ নির্দেশপূৰ্ব্বক রামকে কহিলেন, “হে মহাত্মন্! এক্ষণে তুমি দক্ষিণসাগরের কূলে গমন কর। আজ হইতে সমুদয় পৃথিবী আমার উপকূলে অধিকৃত হইল। অতএব আর ইহাতে বাস করা তোমার কর্ত্তব্য নহে।” জমদগ্নিতনয় কশ্যপকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া অবিলম্বে সাগরের কূলে গমন করিলেন। রাম তথায় উপস্থিত হইবামাত্র সমুদ্র তাঁহার বাসের নিমিত্ত শূর্পারক নামক স্থান প্রস্তুত করিয়া দিলেন। জনদগ্নিতনয় সেই সমুদ্রদত্ত স্থানে বাস করিতে লাগিলেন। এ দিকে মহর্ষি কশ্যপও বসুন্ধরা প্রতিগ্ৰহ করিয়া উহাতে ব্রাহ্মণগণকে সংস্থাপনপূর্ব্বক বনে প্রবেশ করিলেন।
পরশুরামভয়ে গোপনে ক্ষত্রিয় শিশুরক্ষা
“এইরূপে পৃথিবী ক্ষত্রিয়শূন্য ও অরাজক হইলে শূদ্র ও বৈশ্যগণ স্বেচ্ছানুসারে ব্রাহ্মণপত্নীতে গমন করিতে লাগিল, বলবানেরা দুর্ব্বল ব্যক্তিদিগকে নিতান্ত নিপীড়িত করিতে আরম্ভ করিল এবং ধনে আর কাহারও অধিকার রহিল না। পৃথিবী দুরাত্মাদিগের দৌরাত্মে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া অবিলম্বে রসাতলে গমন করিতে লাগিলেন। মনস্বী কশ্যপ পৃথিবীকে ভীতমনে রসাতলে ধাবমান দেখিয়া ঊরুদ্বারা অবরোধ করিলেন। তৎকালে কশ্যপের ঊরুদ্বারা অবরুদ্ধ হওয়াতে পৃথিবীর নাম ঊর্ব্বী হইয়াছে। অনন্তর অবনী কশ্যপকে প্রসন্ন করিয়া স্বীয় রক্ষাবিধানাথ তাঁহার নিকট এক ভূপতি প্রার্থনাপূৰ্ব্বক কহিলেন, ভগবন্! আমি হৈহয়বংশীয় অনেক ক্ষত্রিয়রমণীর গর্ভে ক্ষত্রিয়সন্তানসমুদয় রক্ষা করিয়াছি, এক্ষণে তাঁহারাই আমাকে রক্ষা করুন। কৌরবগণের জ্ঞাতি বিদূরথের পুত্র বর্ত্তমান রহিয়াছেন। তিনি ঋক্ষবান্ পর্ব্বতে ভল্লুকদিগের প্রযত্নে রক্ষিত হইয়াছেন। অলৌকিক তেজস্বী মহর্ষি পরাশর অনুকম্পাপরবশ হইয়া সৌদাসপুত্রকে রক্ষা করিয়া শূদ্রের ন্যায় স্বয়ং ঐ বালকের কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিয়াছেন। ঐ বালকের নাম সৰ্ব্বকৰ্ম্মা। প্রতৰ্দ্দনের পুত্র মহাবলপরাক্রান্ত বৎস বিদ্যমান আছেন, তিনি গোষ্ঠে বৎসকুলকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়াছিলেন। মহারাজ শিবির পুত্র গোসমুদয়ের প্রযত্নে রক্ষিত হইয়াছেন। উঁহার নাম গোপতি। দধিবাহনের পৌত্র দিবারথের পুত্র মহর্ষি গৌতমকর্ত্তৃক ভাগীরথীতীরে রক্ষিত হইয়াছেন। প্রভূতসম্পদশালী বৃহদ্রথ গৃধ্রকূটে গোলাঙ্গুলকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়াছেন। আর মহাসাগর মরুত্তবংশীয় দেবরাজসদৃশ বলবিক্রমসম্পন্ন বহুসংখ্যক ক্ষত্রিয় কুমারের রক্ষা করিয়াছেন। ঐ সমস্ত রাজকুমার এক্ষণে স্থপতি[অট্টালিকাদির নির্ম্মাণকারী-রাজমিস্ত্রী] ও সুবর্ণকারজাতি আশ্রয় করিয়া অবস্থান করিতেছেন। যদি ইঁহারা, আমার রক্ষাভার গ্রহণ করেন, তাহা হইলে আমি সুস্থির হইয়া থাকিব। ইঁহাদিগের পিতৃপিতামহগণ আমারই নিমিত্ত রণস্থলে পরশুরামকৰ্তৃক নিহত হইয়াছেন। সুতরাং তাঁহাদিগের ঋণজাল হইতে মুক্তিলাভ করা আমার কর্ত্তব্য হইতেছে। বিশেষতঃ অধার্ম্মিক রাজা আমাকে যে শাসন করিবে, তাহা আমি কিছুতেই সহ্য করিতে পারিব না। অতএব হে তপোধন! এক্ষণে যাহাতে আমার রক্ষা হয়, আপনি তাহার উপায় বিধান করুন।
“তখন মহর্ষি কশ্যপ পৃথিবীকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া তাঁহার নির্দ্দেশানুসারে সেই সমস্ত ক্ষত্রিয়কুমার ও তাঁহাদিগের পুত্র-পৌত্র প্রভৃতিকে আনয়নপূৰ্ব্বক রাজ্যে অভিষেক করিলেন। ধৰ্ম্মরাজ“ আপনি আমাকে ইতিপূর্বে যে পুরাবৃত্ত জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, এই তাহা আনুপূৰ্ব্বিক কীৰ্ত্তন করিলাম।”
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! যদুপ্রবীর কৃষ্ণ রাজা যুধিষ্ঠিরকে এই কথা কহিতে কহিতে দিবাকরের ন্যায় দিঙ্মণ্ডল উদ্ভাসিত করিয়া মহাবেগে রথারোহণে গমন করিতে লাগিলেন।