৪৮তম অধ্যায়
শ্বেত-কৌরব-দ্বন্দ্বযুদ্ধ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! এইরূপে মহাধনুৰ্দ্ধর শ্বেত শল্যরথের প্রতি সমুপস্থিত হইলে পাণ্ডব ও কৌরবগণ, বিশেষতঃ শান্তুনুতনয় ভীষ্ম করিয়াছিলেন, সবিস্তার কীর্ত্তন কর।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! সহস্ৰ সহস্ৰ ক্ষত্ৰিয়শ্রেষ্ঠ মহারথীগণ সেনাপতি শ্বেতকে অগ্রসর করিয়া আপনার পুত্ৰকে বলবিক্রম প্রদর্শন করিতে লাগিলেন। তাঁহারা আত্মত্ৰাণাৰ্থ শিখণ্ডীকে অগ্ৰে লইয়া ভীষ্মকে নিধন করিবার মানসে তাঁহার হেমভূষিত রথসন্নিধানে সমুপস্থিত হইলেন। হে রাজন! ঐ সময়ে আপনাদিগের ও শত্রুপক্ষের সৈন্যগণ পরস্পর ঘোরতর সংগ্রাম করিয়া বহুসংখ্যক লোক সংহার করিল; আমি উহা বলিতেছি, শ্রবণ করুন।
“মহাবীর শান্তনুতনয় শরাঘাতে বীরগণের মস্তকচ্ছেদন ও রথোপস্থসকল [রথস্থ দ্রব্যসমূহ] শূন্য করিতে লাগিলেন। ঐ সূৰ্য্যসদৃশ প্রতাপশালী মহাবীর অনবরত শরবর্ষণদ্বারা সূৰ্য্যকে সমাচ্ছাদিত করিলেন। রবি যেমন সমুদিত হইয়া তমোরাশি বিনাশ করেন, তদ্রূপ শান্তনুতনয় সমরমধ্যে অসংখ্য বীরপুরুষকে সংহার করিতে লাগিলেন; ঐ মহাবীরকর্ত্তৃক নিক্ষিপ্ত ক্ষত্রিয়ান্তক সহস্ৰ সহস্ৰ সায়ক মহাবেগে গমনপূর্ব্বক মহাবলপরাক্রান্ত যোদ্ধৃগণের শিরচ্ছেছদন করিতে লাগিল। বলবিক্রমশালী রথিগণ তীক্ষ্মশরে ছিন্নমস্তক হইয়া রোমাঞ্চিতকলেবরে রথমধ্যে নিপতিত রহিলেন। রথ রথের উপর ও অশ্ব অশ্বের উপর নিপতিত হইল। কোন কোন অশ্ব পৃষ্ঠে লম্বমান রণনিহত স্বীয় আরোহীকে বহন করিয়া ইতস্ততঃ ভ্ৰমণ করিতে লাগিল। খড়্গ-তূণীরধারী বদ্ধপরিকর [দৃঢ়সঙ্কল্প] শত শত বীরগণ ছিন্নকবচ ও নিহত হইয়া ধরাতলে বীরশয্যায় শয়ন করিলেন। দ্বন্দ্বযুদ্ধকুশল বীরগণ পরস্পরের প্রতি ধাবমান হইয়া ভূতলে পতিত, পুনরুত্থিত ও দ্বন্দ্বযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন এবং পরস্পর পীড়িত হইয়া রণস্থলে বিলুণ্ঠন করিতে লাগিলেন। মত্তগজ নিপাতিত হইল, শত শত রথীগণ শত্রুপক্ষীয় রথীদিগকে মর্দ্দন করিতে করিতে প্ৰাণত্যাগ করিল। কেহ কেহ শরাঘাতে নিহত হইয়া রথোপরি নিপতিত হইল। সারথি নিহত হইবামাত্র উচ্চ রথসমুদয় নিপতিত হইতে লাগিল।
“হে মহারাজ। ঐ সময় ধূলিপটল মহাবেগে সমুত্থিত হওয়াতে সংগ্রামনিরস্ত [যুদ্ধনিবৃত্ত] ব্যক্তিগণ কেবল শরাসনধ্বনি শ্রবণ করিতে লাগিল। তাহারা শত্রুর গাত্ৰ স্পর্শ করিয়াও তাঁহাকে শত্রু বলিয়া বুঝিতে পারিল না। সৈন্যগণ সুসজ্জিত হইয়া পরস্পরের প্রতি আক্রমণ করিতে লাগিল। ঐ তুমুল সংগ্রামে কৰ্ণবিদারী পটহধ্বনি সমুত্থিত হওয়াতে বীরগণের বাণশব্দ এবং কোন বীর পৌরুষ প্রকাশ করিতেছেন, তাঁহার নামও শ্রবণগোচর হইল না। ঐ সময় পিতা স্বীয় পুত্রকে চিনিতে না পারিয়া পরস্পর যুদ্ধ করিতে লাগিল। ঋজুগামি বাণসমূহদ্বারা রথচক্ৰ ও যুগভগ্ন, ভারবাহী অশ্ব নিহত ও যোদ্ধা সারথিসমভিব্যাহারে রথ হইতে নিপতিত হইতে লাগিল। যোদ্ধগণ ভগ্নধূর [যাহার রথের ধুরা ভগ্ন হইয়াছে এইরূপ], ভিন্নচক্র রথমধ্যে দেখিল যে, স্বীয় বান্ধবগণ কেহ ছিন্নমস্তক, কেহ বা মর্ম্মাহত হইয়া প্ৰাণত্যাগ করিয়াছে। ফলতঃ মহাবলপরাক্রান্ত মহাবীর শান্তনুতনয় শক্ৰ সংহার করিতে আরম্ভ করিলে বিপক্ষপক্ষের প্রায় কেহই অনাহত রহিল না।
শ্বেত-কৌরবের তুমুল যুদ্ধ
“মহাবীর শ্বেতও কৌরবপক্ষীয় সহস্ৰ সহস্র রাজপুত্রকে সংহার করিতে লাগিলেন। তিনি শরনিকর নিক্ষেপপূর্ব্বক রথিগণের মস্তক, অঙ্গদভূষিত বাহু, ধনু, ক্ষুদ্র ও বিশাল রথ, রথচক্ৰ ও পাতাকাসমুদয় ছেদন করিলেন। সহস্ৰ সহস্র হস্তী, অশ্ব ও মানবগণ তাঁহার শরাঘাতে প্রাণত্যাগপূর্ব্বক ধরাতলশায়ী হইল। হে মহারাজ। আমরা সেই সময় শ্বেতের ভয়ে নিতান্ত ভীত হইয়া রথপরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করলিাম। সমরার্থ সুসজ্জিত কৌরবগণ শ্বেতের শরপাত হইতে বিমুক্ত হইয়া শান্তনুতনয়ের নিকট অবস্থান করিতে লাগিলেন। সেই ভয়ঙ্কর লোমহর্ষণ সংগ্রামসময়ে একমাত্র ভীষ্ম মেরুপর্ব্বতের ন্যায় অচলভাবে রহিলেন। যেমন মরীচিমালী ভাস্কর গ্ৰীষ্মকালে স্বীয় কিরণজালদ্বারা রস আকর্ষণ করেন, তদ্রূপ মহাবীর শান্তনুতনয় শরনিকরদ্ধারা অরাতিকুলের প্রাণ গ্রহণ করিতে লাগিলেন। ভগবান চক্ৰপাণি যেমন অসুরগণকে নিহত করিয়া থাকেন, তদ্রূপ ভীষ্ম বাণবর্ষণপূর্ব্বক শত্ৰুগণকে শমনসদনে প্রেরণ করিতে আরম্ভ করিলেন। অরাতিগণ ভীষ্মের শরে নিতান্ত কাতর হইয়া শ্বেতকে পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিতে লাগিল। দুৰ্য্যোধন প্রিয়চিকীর্ষু মহাবলপরাক্রান্ত শান্তনুতনয় জীবিতাশা ও ভয় এককালে পরিত্যাগপূর্ব্বক পাণ্ডবসৈন্যগণকে সংহার করিতে লাগিলেন।
শ্বেতসহ ভীষ্মের ভীষণ সমর
“মহাবীর ভীষ্ম সেনাপতি শ্বেতকে কৌরবসৈন্য নিধন করিতে দেখিয়া এইরূপে পাণ্ডবসৈন্য সংহার করিয়া মহাবেগে তাঁহার সমীপে ধাবমান হইলেন। মহাবীর শ্বেত ভীষ্মের উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। ভীষ্ম তাঁহার প্রতি বহুসংখ্যক শর সন্ধান করিলেন; তাঁহারা উভয়েই বৃষভদ্বয়ের ন্যায়, মত্ত মাতঙ্গদ্বয়ের ন্যায়, ক্রুদ্ধ বাঘ্রদ্বয়ের ন্যায় গভীর গর্জ্জন করিয়া পরস্পরের প্রতি ধাবমান হইলেন এবং পরস্পর বিধাভিলাষী হইয়া অস্ত্ৰদ্বারা অস্ত্রনিবারণপূর্ব্বক ঘোরতর সংগ্ৰাম করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! মহাবল্লাপরাক্রান্ত শ্বেত যদি পাণ্ডবগণকে রক্ষা না করিতেন, তাহা হইলে অসামান্য বলবীর্যসম্পন্ন মহাবীর ভীষ্ম একদিনেই তাঁহাদিগকে নিঃশেষিত করিতে পারিতেন।
“হে মহারাজ! বহুক্ষণ এইরূপে সেই বীরদ্বয়ের সংগ্রাম হইলে, পরিশেষে মহাবীর শ্বেত ভীষ্মকে সমরে পরাঙ্মুখ করিলেন। তদ্দর্শনে পাণ্ডবগণের আহ্লাদ ও দুৰ্য্যোধনের বিষাদের আর পরিসীমা রহিল না। মহাবীর দুৰ্য্যোধন তৎক্ষণাৎ ক্রোধান্বিতচিত্তে বহুসংখ্যক ভূপতি ও সৈন্যগণে পরিবৃত হইয়া পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিলেন। বায়ুবেগ যেমন বৃক্ষগণকে বিনষ্ট করে, তদ্রূপ মহাবীর শ্বেত ভীষ্মকে পরিত্যাগপূর্ব্বক দুৰ্য্যোধনের সৈন্যসমুদয় সংহার করিতে লাগিলেন। তিনি এইরূপে অতি অল্পকালের মধ্যে দুৰ্য্যোধনের সৈন্যগণকে বিদ্রাবিত করিয়া ক্ৰোধকম্পিত্যকলেবরে পুনরায় ভীষ্মসন্নিধানে সমুপস্থিত হইলেন। তখন বৃত্র ও বাসবের ন্যায় সেই বীরপুরুষদ্বয় পরস্পর বিধাভিলাষী হইয়া পরস্পরের প্রতি শরনিক্ষেপপূর্ব্বক ঘোরতর সংগ্ৰাম করিতে লাগিলেন। মহাবীর শ্বেত ভীষ্মের উপর সাতবাণ নিক্ষেপ করিলেন; মত্তহস্তী যেমন মত্তহস্তীকে আক্রমণ করে, তদ্রূপ পরাক্রমশালী ভীষ্ম বলপূর্ব্বক শ্বেতকে আক্রমণ করিয়া অভিভূত করিলেন। তখন মহাবীর শ্বেত পুনরায় ভীষ্মকে প্রহার করিতে লাগিলেন। মহাঁবিল পরাক্রান্ত ভীষ্ম শ্বেতের উপর দশবাণ নিক্ষেপ করিলেন। বলবান শ্বেত ভীষ্মের শার সহ্য করিয়া পর্ব্বতের ন্যায় অকম্পিত রহিলেন এবং ভীষ্মের উপর সন্নতপর্ব্ব পঞ্চবিংশতি সায়ক নিক্ষেপ করিলেন; তদর্শনে সমুদয় লোক চমৎকৃত হইল। পরে মহাবীর শ্বেত সহাস্যবদনে সৃক্কণী লেহন করিতে করিতে দশবাণ নিক্ষেপপূর্ব্বক ভীষ্মের শরাসন দশধা খণ্ডন করিলেন। তদনন্তর লোমযুক্ত একবাণ পরিত্যাগ করিয়া ভীষ্মের তালকেতুর অগ্রভাগ ছেদন করিলেন। আপনার পুত্ৰগণ মহাবীর ভীষ্মের কেতু নিপতিত দেখিয়া তাঁহাকে শ্বেতের বশীভূত ও নিহত বলিয়া স্থির করিলেন এবং পাণ্ডবগণ হৃষ্টচিত্তে শঙ্খনাদ করিতে লাগিলেন।
শ্বেতসমরে দুৰ্য্যোধনের ভীষ্ম-সাহায্য
“তখন দুৰ্য্যোধন ক্ৰোধপরতন্ত্র হইয়া ভীষ্মের রক্ষার্থ আপনার সৈন্যগণকে প্রেরণ করিলেন; সৈন্যগণ অতি যত্নসহকারে ভীষ্মকে রক্ষা করিতে লাগিল। সমরোৎসাহী দুৰ্য্যোধন তাহাদের উৎসাহ বৰ্দ্ধনাৰ্থ কহিতে লাগিলেন, “হে বীরগণ! শ্বেত অবশ্য বিনষ্ট হইবে; শান্তনুতনয় ভীষ্ম মহাবলপরাক্রান্ত, তাঁহার কিছুমাত্র শঙ্কা নাই।” মহারথগণ দুৰ্য্যোধনের এইরূপ উত্তেজনাবাক্যে প্রোৎসাহিত হইয়া সত্বর চতুরঙ্গিণী সেনা লইয়া ভীষ্মকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। মহাবীর বাহ্লীক, কৃতবর্ম্মা, কৃপাচাৰ্য্য, শল্য, জরাসন্ধতনয়, বিকৰ্ণ, চিত্ৰসেন ও বিবিংশতি ইঁহারা সত্বরে চতুর্দ্দিক হইতে শ্বেতের উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত শ্বেত স্বীয় হস্তলাঘবপ্রদর্শনপূর্ব্বক নিশিত সায়কসমুদয়দ্বারা সেই ক্রোধান্বিত বীরগণকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। কেশরী যেমন কুঞ্জারগণকে নিবারণ করে, তদ্রূপ মহাবীর শ্বেত ক্ৰমে সেই সমুদয় বীরগণকে পরাঙ্মুখ করিয়া বহুসংখ্যক শরবর্ষণপূর্ব্বক ভীষ্মের শরাসন ছেদন করিলেন। তখন শান্তনুনন্দন অন্য এক ধনুগ্রহণপূর্ব্বক শ্বেতের উপর কঙ্কপক্ষযুক্ত শরসমুদয় নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তদর্শনে সেনাপতি শ্বেত ক্ৰোধপরতন্ত্র হইয়া সর্ব্বলোকসমক্ষে প্রভূত সায়কদ্বারা ভীষ্মকে বিদ্ধ করিলেন। মহারাজ দুৰ্য্যোধন এইরূপে সর্ব্ববীরপ্রধান ভীষ্মকে শ্বেতকর্ত্তৃক নিরাকৃত দেখিয়া নিতান্ত ব্যথিত হইলেন এবং ঐ সময় কৌরবপক্ষীয় বহুতর সৈন্যও বিনষ্ট হইতে লাগিল। তখন মহাবীর ভীষ্মকে শ্বেতের শরে ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ অবলোকন করিয়া সকলেই তাঁহাকে শ্বেতের বশীভূত ও তৎকর্ত্তৃক নিহত বলিয়া বোধ করিতে লাগিলেন।
“তখন মহাবীর শান্তনুনন্দন ভীষ্ম স্বীয় ধ্বজ উন্মথিত ও সৈন্যগণকে নিরাকৃত দেখিয়া একান্ত ক্রোধান্বিতচিত্তে শ্বেতের উপর বহুসংখ্যক শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। রথিকুলশ্রেষ্ঠ মহাবীর শ্বেত ভীষ্মের সেই সমুদয় বাণ নিবারণ করিয়া ভল্লদ্বারা পুনরায় তাহার বাণসমুদয় ছেদন করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ভীষ্ম তদর্শনে ক্ৰোধে অধীর হইয়া অন্য এক শরাসনগ্রহণপূর্ব্বক তাহাতে সুতীক্ষ্ণ সাতভল্লযোজনপূর্ব্বক চারিটি দ্বারা শ্বেতের চারি অশ্ব, দুইটি দ্বারা ধ্বজ ও একটি দ্বারা সারথির মস্তক ছেদন করিলেন। তখন মহারথ শ্বেত সেই অশ্বশূন্য রথ হইতে লম্মফপ্রদানপূর্ব্বক ভূতলে অবতীর্ণ হইয়া একান্ত ক্ৰোধপরবশ ও নিতান্ত ব্যাকুল হইলেন। মহাবীর ভীষ্ম রথিশ্রেষ্ঠ শ্বেতকে বিরত দেখিয়া নিশিতশারদ্বারা তাহাকে তাড়ন করিতে লাগিলেন। শ্বেত ভীষ্মের চাপচ্যুত শরনিকরে তাড়িত হইয়া স্বীয় রথে শরাসন সংস্থাপনপূর্ব্বক কালদণ্ডসদৃশ মহাভয়ঙ্কর কাঞ্চনবিনির্ম্মিত শক্তি গ্রহণ করিয়া ভীষ্মকে কহিলেন, “হে পুরুষোত্তম শান্তনুতনয়! ক্ষণকাল অবস্থানপূর্ব্বক আমার পরাক্রম অবলোকন কর।” হে মহারাজ! পাণ্ডবগণের হিতার্থী ও আপনার অহিতচিকীর্ষু [অমঙ্গলাভিলাষী] মহাবীর শ্বেত এই বলিয়া ভীষ্মের প্রতি সেই শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। আপনার পুত্ৰগণ সেই নির্ম্মাকনির্ম্মুক্ত ভীষণ ভুজঙ্গসদৃশ শ্বেত-নিক্ষিপ্ত শক্তি সন্দর্শন করিয়া হাহাকার করিতে লাগিলেন। শক্তি নভস্তল হইতে নিপতিত মহোল্কার ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া অন্তরীক্ষে গমন করিতে লাগিল। শান্তনুতনয় তদর্শনে একান্ত সংভ্রান্ত হইয়া আটবাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক সেই উৎকৃষ্ট হেমনির্ম্মিত শক্তি নয়খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তদর্শনে আপনার পুত্ৰগণের সমুদয় সৈন্য উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিতে আরম্ভ করিল।
“কালোপহতচিত্ত [কালপ্রেরিত—আসন্নমৃত্যু] বিরাটতনয় শ্বেত শক্তি ব্যর্থ হইল দেখিয়া নিতান্ত ক্ৰোধান্বিত হইয়া ইতিকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইলেন। তিনি একান্ত ক্ৰোধান্ধ হইয়া ভীষ্মকে সংহার করিবার মানসে গদাগ্রহণ করিলেন এবং ক্ৰোধসংরক্তলোচনে দ্বিতীয় যমের ন্যায় ধাবমান হইলেন। প্রতাপশালী ভীষ্ম সেই গদার বেগ অনিবাৰ্য্য জানিতে পারিয়া আত্মরক্ষার্থ সহসা রথ হইতে ভূতলে অবতীর্ণ হইলেন। মহাবীর শ্বেত নিতান্ত ক্ৰোধপরতন্ত্র হইয়া সেই মহাগদা বিঘূর্ণনপূর্ব্বক ভীষ্মের রথোপরি নিক্ষেপ করিলে সেই ভীষণ গদাঘাতে ভীষ্মের রথ, ধ্বজ, সারথি, অশ্ব ও যুগন্ধর চুর্ণীকৃত হইল।
“এদিকে শল্যপ্রভৃতি রথিগণ রথিশ্রেষ্ঠ শ্বেতকে বিরথ দেখিয়া তাহার সমীপে গমন করিলেন। তখন মহাবীর ভীষ্ম অন্য এক রথে আরোহণপূর্ব্বক শরাসন কম্পিত করিয়া মহারথ শ্বেতের সমীপে শনৈঃ শনৈঃ গমন করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে স্বীয় হিতকারী এই দৈববাণী তাহার কর্ণগোচর হইল, “হে মহাবাহো ভীষ্ম! শীঘ্ৰ যত্ন কর, ভগবান বিশ্বযোনি শ্বেতের এই নিধনকাল নির্দ্দিষ্ট করিয়াছেন।” শান্তনুতনয় দেবদূতের এই বাক্যশ্রবণে নিতান্ত হৃষ্টচিত্ত হইয়া শ্বেতবধে কৃতনিশ্চয় হইলেন।
“মহাবীর সাত্যকি, ভীমসেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন, কৈকেয়গণ, ধৃষ্টকেতু ও অভিমন্যু প্রভৃতি মহারথসমুদয় রথিশ্রেষ্ঠ শ্বেতকে সমরাঙ্গনে পাদচারে সঞ্চরণ করিতে দেখিয়া সকলে একত্ৰ হইয়া তাহার সমীপে গমন করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীষ্ম উক্ত মহারথগণকে আগমন করিতে দেখিয়া দ্রোণ, শল্য ও কৃপের সাহায্যে তাঁহাদিগকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর শ্বেত পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণকে সন্নিরুদ্ধ দেখিয়া খড়্গ আকর্ষণপূর্ব্বক ভীষ্মের শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর ভীষ্ম দেবদূতের বাক্যে শ্বেতবধে প্রোৎসাহিত [অতিশয় উৎসাহান্বিত] হইয়াছিলেন; সুতরাং শ্বেতকর্ত্তৃক নিবারিত হইয়াও সত্বরে সেই ছিন্নধনু পরিত্যাগপূর্ব্বক অন্য ধনু গ্রহণ ও ক্ষণকালমধ্যে তাহাতে জ্যা-রোপণ করিয়া ভীমসেন প্রভৃতি মহারথগণকর্ত্তৃক সেনাপতিপদে অভিষিক্ত মহাবীর শ্বেতের প্রতি ধাবমান হইলেন; প্রতাপশালী ভীমসেন ভীষ্মকে আগমন করিতে দেখিয়া তাঁহার উপর ষষ্টিশর নিক্ষেপ করিলেন।
বিরাটতনয় শ্বেতের পতন
“তখন মহাবীর শান্তনুতনয় ঘোরতর শরনিকর নিক্ষেপপূর্ব্বক অভিমন্যুকে ও তিনশরদ্বারা অন্যান্য মহারথগণকে নিবারিত করিয়া সাত্যকির প্রতি একশত, ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি বিংশতি ও কৈকেয়ের প্রতি পাঁচবাণ নিক্ষেপ করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত দেবব্রত ভীষ্ম এইরূপে শরনিকর দ্বারা সেই মহারথগণকে নিবারিত করিয়া শ্বেতের প্রতি ধাবমান হইলেন এবং সাক্ষাৎ কালান্তক যমোপম এক ভীষণ সায়ক তূণীর হইতে নিষ্কাশিত করিয়া শ্বেতের প্রতি সন্ধান করিলেন। দেব, নাগ, গন্ধর্ব্ব, পিশাচ ও রাক্ষসগণ সেই ব্ৰহ্মাস্ত্ৰ-সুসঙ্গত লোকযুক্ত শর নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। অস্তাচলগমনোন্মুখ ভাস্করসদৃশ প্রভাশালী সেই ভীষ্মনিক্ষিপ্ত শর মহাবীর শ্বেতের কবচ ভেদপূর্ব্বক প্ৰাণ লইয়া বহির্গত ও মহাশনির ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া ধরণীতলে প্রবিষ্ট হইল। মহাবীর শ্বেত ভীষ্মকর্ত্তৃক এইরূপে নিহত হইয়া গিরিশৃঙ্গের ন্যায় নিপতিত হইলেন। তদর্শনে পাণ্ডবগণ ও তৎপক্ষ ক্ষত্ৰিয়সমুদয় শোক করিতে লাগিলেন এবং কৌরবগণ পরম পরিতুষ্ট হইলেন দুঃশাসন শ্বেতকে নিহত হইতে দেখিয়া বাদিত্রসহকারে চতুর্দ্দিকে নৃত্য করিতে লাগিলেন।
“হে মহারাজ! এইরূপে সেই মহাবলপরাক্রান্ত বীরবরাগ্রগণ্য বিরাটতনয় শ্বেত সংগ্রামে ভীষ্মশরে নিহত হইলে ধনুৰ্দ্ধর শিখণ্ডীপ্ৰভৃতি মহারথীগণ কম্পিত হইতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় ও কৃষ্ণ সেনাপতি নিহত হইল দেখিয়া সৈন্যগণকে বিশ্রাম করিতে আদেশ করিলেন। উভয়পক্ষীয় সেনাগণ যুদ্ধে ক্ষান্ত হইয়া মুহুর্ম্মুহুঃ গর্জ্জন করিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিল। পার্থিবগণ বিমনাঃ হইয়া দ্বৈরথযুদ্ধে শ্বেতকে নিহত দেখিয়া চিন্তা করিতে করিতে শিবিরে প্রবেশ করিলেন।”