৪৮তম অধ্যায়
ভীষ্মকর্ত্তৃক অর্জ্জুনপ্রভাব বর্ণন-নরনারায়ণ উপাখ্যান
অনন্তর শান্তুনুনন্দন ভষ্মি দুর্য্যোধনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে দুৰ্য্যোধন!! একদা বৃহস্পতি, শুক্ৰ, ইন্দ্র, অগ্নি, সপ্তঋষি এবং বায়ু, বসু, আদিত্য, সাধ্য ও অন্সরাগণ এবং বিশ্বাবসু গন্ধৰ্ব ব্ৰহ্মার নিকটে গমন ও তাঁহাকে নমস্কারপূর্ব্বক চতুর্দ্দিকে উপবেশন করিলেন। এমন সময়ে পূর্ব্বদৈব [আদি অবতার] নর ও নারায়ণ তথায় আবির্ভূত হইয়া যেন স্বীয় তেজোদ্বারা তাঁহাদিগের তেজ ও মন অভিভূত করিয়া তাঁহাদিগকে অতিক্রমপূর্ব্বক গমন করিলেন। তখন বৃহস্পতি ব্ৰহ্মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে পিতামহ! আপনাকে উপাসনা না করিয়া গমন করিলেন, ইহারা দুইজন কে?” ব্ৰহ্মা কহিলেন, ‘সুরাচাৰ্য্য! এই যে দুই মহাবল তপস্বী ভূলোক ও দ্যুলোক উদ্ভাসিত করিয়া আমাকে অতিক্রমপূর্ব্বক গমন করিলেন, ইঁহারা নর ও নারায়ণ; ভূলোক হইতে ব্ৰহ্মলোকে আগমন করিয়াছেন। ইঁহারা তপস্যাপ্রভাবে মহাবলপরাক্রান্ত হইয়াছেন। ইঁহারাই ধৰ্মদ্বারা লোকসকল আনন্দিত করিয়া থাকেন। দেব ও গন্ধর্ব্বগণ ইঁহাদিগকে পূজা করিয়া থাকেন এবং ইঁহারাই অসুরবধের নিমিত্ত দ্বিধাভূত হইয়াছেন।”
“দেবগণ তখন অসুরগণের সহিত যুদ্ধনিবন্ধন ভীত হইয়াছিলেন, এই নিমিত্ত যে স্থানে নর ও নারায়ণ তপস্যা করিতেছেন, ইন্দ্ৰপ্ৰভৃতি দেবগণ তথায় উপস্থিত হইয়া তাহাদিগের নিকট বর প্রার্থনা করিলেন। তখন তাঁহারা তাঁহাদিগকে কহিলেন, “হে দেবগণ! তোমরা বর গ্রহণ কর।” ইন্দ্ৰ কহিলেন, “হে নরনারায়ণ! আপনারা আমাদিগের সাহায্য করুন।” তাঁহারা কহিলেন, “হে ইন্দ্ৰ! তুমি যেরূপ ইচ্ছা করিতেছ, আমরা সেইরূপই করিব।’ অনন্তর পুরুন্দর তাঁহাদিগের সাহায্যে দৈত্য ও দানবকে পরাজিত করিলেন। পরন্তপ নরও পুরন্দরের শত্রু শতসহস্ৰ পৌলোম ও কালঞ্জকদিগকে সংগ্রামে সংহার করিয়াছিলেন। জম্ভাসুর তাঁহাকে গ্ৰাস করিতে উদ্যত হইলে তিনি তখন ভ্রমণশীল রথ উপবিষ্ট হইয়া ভল্লাস্ত্রে তাহার মস্তকচ্ছেদন করিয়াছিলেন। তিনিই সমুদ্রপারে ষষ্টিসহস্র নিবাতকবচকে পরাজিত করিয়া হিরণ্যপুর উৎসাদিত করিয়াছিলেন। সেই মহাবাহু ইন্দ্ৰাদি দেবগণকে পরাভূত করিয়া হুতাশনের তর্পণ করিয়াছিলেন। এইরূপ নারায়ণও ভূরি ভুরি শত্ৰুগণকে সংহার করিয়াছেন। দেখ, সেই দুই মহাবীর নরলোকে অবতীর্ণ হইয়াছেন।
“আমি বেদবিৎ নারদমুনির নিকট শ্রবণ করিয়াছি, মহারাথ অর্জ্জুন সেই পূর্ব্বদেব নর ও ভগবান বাসুদেব পূর্ব্বদেব নারায়ণ। একমাত্র আত্মা নর ও নারায়ণরাপে দ্বিধাকৃত হইয়াছেন। ইন্দ্রাদি দেবগণ, অসুরগণ অথবা মানবগণ ইহাদিগকে পরাজয় করিতে কদাচি সমর্থ হয় না। ইহার কর্ম্মদ্বারা অক্ষয় ধ্রুবলোকসমূহ লাভ করিয়াছেন। যেসকল স্থানে তুমুল সংগ্রাম সমুপস্থিত হয়, ইহারা সেই সকল স্থানে জন্মগ্রহণ করিয়া থাকেন। যুদ্ধই ইহাদিগের কর্ত্তব্য কর্ম্ম।
সমরপরিণাম প্রসঙ্গে কর্ণের আক্রোশ
‘হে দুৰ্য্যোধন!! যখন তুমি শঙ্খচক্ৰগদাহস্ত কেশব ও গাণ্ডীবসনাথ শস্ত্রপাণি মহাত্মা অর্জ্জুনকে একরথে অবলোকন করিবে, তখন তোমাকে আমার বাক্য স্মরণ করিতে হইবে। ফলতঃ যদি আমার বাক্য রক্ষা না কর, তাহা হইলে কুরুকুলের সংহারাদশা উপস্থিত হইবে, তাহার সন্দেহ নাই। কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকর্ত্তৃক বহুবীর বিনষ্ট হইয়াছে, ইহা শ্রবণ করিয়াও যদি তুমি আমার বাক্য গ্ৰহণ না কর, তাহা হইলে তোমার বুদ্ধি নিশ্চয়ই ধর্ম্মাৰ্থ হইতে পরিভ্রষ্ট হইয়াছে। সমুদয় কৌরব তোমার মতেরই অনুসরণ করিয়া থাকেন; কিন্তু তুমি একাকী পরশুরামকর্ত্তৃক অভিশপ্ত, হীনজাতি, সূতপুত্ৰ কৰ্ণ, সুবলনন্দন শকুনি ও ক্ষুদ্রাশয় পাপাত্মা দুঃশাসন—এই তিনজনের মতের অনুবর্ত্তী হও।”
কৰ্ণ কহিলেন, “হে পিতামহ! আপনি আমাকে যাহা কহিলেন, তাহা পুনরায় কহিবেন না। আমি ক্ষত্রিধর্ম্ম আশ্রয় করিয়াছি বটে, কিন্তু স্বধর্ম্ম হইতে পরিভ্রষ্ট হই নাই। আমাতে আর কি দুৰ্বত্ততা আছে যে, আপনি আমাকে তিরস্কার করিতেছেন? ধার্ত্তরাষ্ট্রেরা জানেন, আমি কখন কিঞ্চিম্মাত্ৰ পাপানুষ্ঠান করি নাই। আমি কদাপি দুৰ্য্যোধনের সহিত কিছুমাত্র অহিত্যচরণ করি নাই। আমি সংগ্রামে সমুদয় পাণ্ডবকেই সংহার করিব। পাণ্ডবগণ পূর্ব্বে বিরোধী ছিল, এক্ষণে সাধু হইয়াছে বলিয়াই কি তাঁহাদিগের সহিত পুনরায় সন্ধি হইতে পারে? সে যাহা হউক, এক্ষণে দুৰ্য্যোধন রাজ্যাভিষিক্ত হইয়াছেন। অতএব আমি তাঁহার ও রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সর্ব্বপ্রকার প্রিয়কাৰ্য্য সাধন করিব; তাহাতে সন্দেহ নাই।”
বৈর-পরিত্যাগে ভীষ্ম-দ্রোণের উপদেশ
ভীষ্ম কর্ণের বাক্য-শ্রবণে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, হে রাজন! কর্ণ পাণ্ডবগণকে সংহার করিব বলিয়া সর্ব্বদা আত্মশ্লাঘা করিয়া থাকেন; কিন্তু মহাত্মা পাণ্ডবদিগের যেরূপ ক্ষমতা, ইহাতে তাহার ষোড়ষ ভাগের একভাগও নাই। তুমি নিশ্চয় জানিবে যে, তোমার দুরাত্মা পুত্ৰগণের যে দুর্নীতি উপস্থিত হইবে, উহা দুৰ্মতি সূতপুত্র কর্ণের কর্ম্ম। তোমার পুত্ৰ মুন্দবুদ্ধি দুর্য্যোধন ইহাকে আশ্রয় করিয়াই দেবপুত্র মহাবীর পাণ্ডবগণকে অবমানিত করিয়াছে। পূর্ব্বে সেই পাণ্ডবগণ যে সকল দুষ্কর কর্ম্ম করিয়াছেন, কর্ণ কি তাদৃশ কোন কর্ম্ম সাধন করিয়াছেন? যখন ধনঞ্জয় বিরাটনগরে কর্ণের প্ৰিয়তম ভ্রাতাকে আক্রমণপূর্ব্বক বিনষ্ট করিয়াছিলেন, তখন ইনি কি করিয়াছিলেন? যখন ধনঞ্জয় সমস্ত কৌরবগণকে আক্রমণপূর্ব্বক অচেতন করিয়া তাহাদিগের বস্ত্রহরণ করিয়াছিলেন, তখন কি ইনি সেখানে ছিলেন না? এখন ইনি বৃষের ন্যায় আস্ফালন করিতেছেন, কিন্তু ঘোষযাত্রার সময়ে গন্ধর্ব্বগণ যখন তোমার পুত্রকে হরণ করিয়াছিল, তখন এই সূতপুত্র কোথায় ছিলেন? দেখ, সেই সময় মহাত্মা ভীমসেন, ধনঞ্জয়, নকুল ও সহদেব তথায় গমন করিয়া গন্ধর্ব্বগণকে পরাজিত করিয়াছিলেন। হে রাজন! তোমার কল্যাণ হউক, ধর্ম্মার্থভ্রংশকর আত্মশ্লাঘানিরত ব্যক্তিরা এই প্রকার ভুরি ভুরি মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করিয়া থাকে।”
মহানুভব দ্রোণাচাৰ্য্য ভীষ্মের বাক্য শ্রবণ করিয়া সেই রাজমণ্ডলীমধ্যে সম্মানপূর্ব্বক ধৃতরাষ্ট্রকে কহিতে আরম্ভ করিলেন, “মহারাজ! ভারতশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম যাহা কহিতেছেন, তাহাই করুন; অর্থলিপ্সুদিগের বাক্যানুসারে কাৰ্য্য করা সর্ব্বতোভাবে অকর্ত্তব্য। যুদ্ধের পূর্ব্বে পাণ্ডবগণের সহিত মিলিত হওয়াই উচিত; কেন না, সঞ্জয় ধনঞ্জয়ের যেসকল কথা কহিয়াছে, আমি তৎসমুদয় অবগত আছি; ধনঞ্জয় যাহা কহিয়াছেন, তাহা অবশ্যই করিবেন; তাহার সমকক্ষ ধনুৰ্দ্ধর ত্ৰিভুবনে নাই।”
রাজা ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম ও দ্রোণাচাৰ্য্যের তাদৃশ অর্থসম্পন্ন বাক্যে অনাদর প্রদর্শন করিয়া সঞ্জয়কে পাণ্ডবদিগের কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। রাজা ধৃতরাষ্ট্র যখন ভীষ্ম ও দ্রোণাচাৰ্য্যের সহিত সম্ভাষণে পরাঙ্মুখ হইলেন, কৌরবগণ তখনই জীবিতাশা পরিত্যাগ করিলেন।