৪৭ম অধ্যায়
ভীষ্মের তনুত্যাগবার্ত্তা—ঋষিগণ সমাগম
জনমেজয় কহিলেন, হে তপোধন। শরশয্যায় শয়ান কুরুপিতামহ ভীষ্ম কোন্ যোগ অবলম্বন করিয়া কিরূপে তনুত্যাগ করিলেন?
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! আমি মহাত্মা ভীষ্মের কলেবর-পরিত্যাগের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, অবহিত হইয়া শ্রবণ করুন। দিবাকরের উত্তরায়ণ আরম্ভ হইলেই মহাত্মা ভীষ্ম অবহিত হইয়া দেহত্যাগের অভিলাষ করিলেন। ঐ সময় তাঁহার শরনিচিত কলেবর কিরণজালে পরিশোভিত দিবাকরের ন্যায় সুশোভিত হইতে লাগিল। বেদবিৎ ব্যাস, সুরর্ষি নারদ, দেবস্থান, বাৎস্য, অশ্মক, সুমন্তু, জৈমিনি, পৈল, শাণ্ডিল্য, দেবরাত, মৈত্রেয়, অসিত, বশিষ্ঠ, কৌশিক, হারীত, লোমশ, আত্রেয়, বৃহস্পতি, শুক্র, চ্যবন, সনৎকুমার, কপিল, বাল্মীকি, তুম্বুরু, কুরু, মৌদ্গল্য, ভৃগুনন্দন রাম, তৃণবিন্দু, পিপ্পলাদ, বায়ুসংবৰ্ত্ত, পুলক, কচ, কাশ্যপ, পুলস্ত্য, ক্রতু, দক্ষ, পরাশর, মরীচি, অঙ্গিরাঃ, কাশ্যপ, গৌতম, গালব, ধৌম্য, বিভাণ্ড, মাণ্ডব্য, কৃষ্ণানুভৌতিক, উলূক, মার্কণ্ডেয়, ভাস্করি, পূরণ, কৃষ্ণ, পরমধার্ম্মিক সূত ও অন্যান্য শ্রদ্ধাবান্ জিতেন্দ্রিয় ও শান্তিগুণোপেত মহর্ষিগণ তাঁহাকে পরিবেষ্টন করাতে তিনি গ্রহগণসমাকীর্ণ চন্দ্রের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন।
শরশয্যা-শয়ান ভীষ্মের কৃষ্ণস্তব
অনন্তর মহাত্মা শান্তনুতনয় শরশয্যায় শয়ান থাকিয়াই কায়মনোবাক্যে কৃষ্ণকে ধ্যান করিয়া অতি গম্ভীরস্বরে কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহার স্তব করিতে লাগিলেন, “হে পুরুষোত্তম! আমি তোমাকে আরাধনা করিবার নিমিত্ত সংক্ষেপে ও সবিস্তারে যেসমস্ত কথা কহিব, তদ্দ্বারা তুমি প্রীত ও প্রসন্ন হও। তুমি দোষহীন ও নির্দ্দোষতার আস্পদ, তুমি পরমহংস ও ঈশ্বর। এক্ষণে আমি তনুত্যাগ করিয়া যেন তোমাকে প্রাপ্ত হই। তুমি অনাদি, অনন্ত ও পরব্রহ্মস্বরূপ, দেবতা ও ঋষিগণ তোমাকে বিদিত হইতে সমর্থ নহেন। কেবল ভগবান্ ধাতাই তোমার তত্ত্ব অবগত আছেন এবং তাহা হইতেই কোন কোন মহর্ষি, সিদ্ধ, দেবতা, দেবর্ষি ও মহোরগ তোমার তত্ত্ব কথঞ্চিৎ নির্ণয় করিয়াছেন। তুমি পরম ও অব্যয়। দেব, দানব, গন্ধৰ্ব্ব, যক্ষ, রাক্ষস ও পন্নগগণ তুমি কে এবং কোথা হইতে উৎপন্ন হইয়াছ, তাহার কিছুই জ্ঞাত নহেন। সূত্রগ্রথিত মণিসমূহের ন্যায় কাৰ্য্যকারণসম্বন্ধ সমস্ত বিশ্ব ও ভূতসমুদয় তোমাতেই অবস্থান করিতেছে। তুমি নিত্য ও বিশ্বকর্ম্মা। লোকে তোমাকে সহস্রশিরাঃ, সহস্রবদন, সহস্রচক্ষুঃ, সহস্রচরণ, সহস্রবাহু, সহস্ৰমুকুটসম্পন্ন নারায়ণ বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকে। তুমি সূক্ষ্ম হইতেও সূক্ষ্ম, স্থূল হইতেও স্থূল, গুরু হইতেও গুরু এবং শ্রেষ্ঠ হইতেও শ্রেষ্ঠ। মন্ত্র, মন্ত্রাৰ্থ-প্রকাশক ব্রাহ্মণবাক্য, নিষৎ[কৰ্ম্মকাণ্ডাত্মক বেদবাক্য], উপনিষৎ[জ্ঞানাত্মক বেদবাক্য] ও সামবেদ তোমার মহিমা কীর্ত্তন করিয়া থাকেন। তুমি সত্যস্বরূপ ও সত্যকৰ্ম্মা; তুমি বাসুদেব, সঙ্কৰ্ষণ, প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধনামে চারি দেহ ধারণ করিতেছ। তুমি একমাত্র বুদ্ধিতে অভিব্যক্ত। তুমি ভক্তদিগের রক্ষিতা। লোকে তোমার পরমগুহ্য দিব্যনাম উল্লেখপূর্ব্বক অর্চ্চনা করিয়া থাকে। তোমার প্রীতিসম্পাদনের নিমিত্ত নিত্য তপানুষ্ঠান করিলে উহা কদাচ ক্ষয় হয় না। তুমি সর্বাত্মা, সৰ্ব্ববিৎ, সৰ্ব্ব, সর্ব্বজ্ঞ ও সর্ব্বভাবন। অরণিকাষ্ঠ [যে কাঠের পরস্পর ঘর্ষণে অগ্নি বহির্গত হয়—শমী প্রভৃতি] যেমন বহ্নিরক্ষার্থ সৃষ্ট হইয়াছে, তদ্রূপ তুমিও ভূতস্থল বেদের রক্ষাবিধানার্থ দেবকীর গর্ভে বসুদেব হইতে উৎপন্ন হইয়াছ। তুমি নিষ্পাপ ও সর্ব্বেশ্বর। মনুষ্য অভেদজ্ঞানসম্পন্ন হইয়া হৃদয়াকাশে তোমাকে নিরীক্ষণপূর্ব্বক মোক্ষলাভে অধিকারী হয়। তুমি বায়ু, ইন্দ্র, সূৰ্য্য ও তেজকে অতিক্রম করিয়াছ। তুমি বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়ের অগোচর। এক্ষণে আমি তোমার শরণাপন্ন হইলাম। তুমি পুরাণপুরুষ, যুগ্মপ্রারম্ভে ব্ৰহ্ম ও ক্ষয়কালে সঙ্কর্ষণনামে নির্দিষ্ট হইয়া থাক। তুমি পরমারাধ্য, অতএব আমি তোমার উপাসনা করি। তুমি একমাত্র হইয়াও বহু অংশে প্রাদুর্ভূত হইয়াছ। তুমি সর্ব্বাভিলাষসম্পাদক; তোমারই একান্ত ভক্ত ক্রিয়াবান লোকেরা তোমার অর্চ্চনা করিয়া থাকেন। তুমি জগতের ভাণ্ডারস্বরূপ। জগতের সমস্ত ব্যক্তি তোমাতেই অবস্থান করিতেছে। নীরমধ্যে হংস ও সারস প্রভৃতি জলচর পক্ষিগণের ন্যায় জীবগণ সতত তোমাতেই বিহার করিতেছে। তুমি সত্যস্বরূপ, অদ্বিতীয়, অক্ষয়, ব্রহ্ম এবং সৎ ও অসতের অতীত; তোমার আদি, মধ্য ও অন্ত নাই। দেবতা ও মহর্ষিগণ তোমাকে অবগত হইতে সমর্থ নহেন। সুর, অসুর, গন্ধৰ্ব্ব, সিদ্ধ, ঋষি ও উরগগণ প্রযতমনে প্রতিনিয়ত তোমার অর্চ্চনা করিয়া থাকেন। তুমি দুঃখনাশের উৎকৃষ্ট ঔষধ। তুমি স্বয়ম্ভু, সনাতন, অদৃশ্য ও অজ্ঞেয়। তুমি বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় পদার্থের অধিপতি। তুমি পরমপদ, হিরণ্যবর্ণ ও দৈত্যনাশক। তুমি একমাত্র হইয়াও দ্বাদশ-অংশে আবির্ভূত হইয়াছ। তুমি সূৰ্য্যস্বরূপ, তোমাকে নমস্কার। যিনি শুক্লপক্ষে দেবগণকে ও কৃষ্ণপক্ষে পিতৃগণকে অমৃতদ্বারা পরিতৃপ্ত করেন, তুমি সেই চন্দ্ররূপী, তোমাকে নমস্কার। যিনি নিবিড়তর[অত্যন্ত ঘন] অজ্ঞানান্ধকারের পরপারবৰ্ত্তী, যাঁহাকে অবগত হইলে মৃত্যুভয় থাকে না, সেই জ্ঞেয়াত্মাকে নমস্কার। অতি বিস্তীর্ণ সামবেদে যাঁহাকে বৃহৎ বলিয়া কীৰ্ত্তন করে, অগ্নিসন্নিধানে ও যজ্ঞস্থলে যাঁহার মহিমা কীৰ্ত্তিত হয়, ব্রাহ্মণগণ যাঁহাকে সতত ধ্যান করিয়া থাকেন, সেই বেদস্বরূপকে নমস্কার। ঋক ও যজুর্ব্বেদ যাঁহার তেজ, যিনি পঞ্চহবিঃ ও সপ্ততন্তু বলিয়া অভিহিত হয়েন, সেই যজ্ঞস্বরূপকে নমস্কার। যিনি সপ্তদশ অক্ষরে আহুত হইয়া থাকেন, সেই হোমস্বরূপকে নমস্কার। যে বেদপুরুষের নাম যজুঃ, ছন্দঃসকল যাঁহার গাত্র, ঋক্, যজুঃ ও সামবেদপ্রবর্ত্তিত তিন যজ্ঞ যাঁহার তিন মস্তক এবং রথন্তর যাঁহার প্রীতিবাক্য, সেই স্তোত্রস্বরূপকে নমস্কার। যিনি সহস্রবৎসরসাধ্য যজ্ঞে আবির্ভূত হইয়াছিলেন, যিনি বিশ্বস্রষ্টাদিগেরও শ্রেষ্ঠ, সেই হিরন্ময়পক্ষসম্পন্ন হংসস্বরূপকে নমস্কার। সুপ তিঙন্ত পদ[প্রকৃতি-প্রত্যয়সাধ্য সংস্কৃত শব্দ]সমুদয় যাঁহার অঙ্গ, সন্ধি[দুই বা ততোধিক পদের একত্র মিলন] যাঁহার পৰ্ব্ব, স্বর ও ব্যঞ্জন যাঁহার ভূষণ, সেই দিব্যঅক্ষর বাক্যস্বরূপকে নমস্কার। যিনি যজ্ঞাঙ্গভূত বরাহমূৰ্ত্তি পরিগ্রহ করিয়া ত্রিলোকের হিতসাধনার্থ পৃথিবী উদ্ধার করিয়াছিলেন, সেই বীৰ্য্যস্বরূপকে নমস্কার। যিনি যোগ অবলম্বনপূৰ্ব্বক অনন্তের সহস্র-ফণাবিরচিত পর্য্যঙ্কে শয়ন করিয়াছিলেন, সেই নিদ্ৰাস্বরূপকে নমস্কার। যিনি বশীভূত-ইন্দ্রিয়বর্গ, মোক্ষেপায় ও বেদোক্ত উপায়দ্বারা সাধুগণের যোগধৰ্ম্ম বিস্তার করিয়াছেন, সেই সত্যস্বরূপকে নমস্কার। ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম্মাবলম্বী ভিন্ন ভিন্ন ধৰ্ম্মফলাভিলাষী মহাত্মারা ভিন্ন ভিন্ন ধৰ্ম্ম অবলম্বনপূৰ্ব্বক যাঁহাকে অর্চ্চনা করিয়া থাকেন, সেই ধৰ্মাত্মাকে নমস্কার। যাঁহার অঙ্গ প্রত্যঙ্গসমুদয় কামময়, যিনি সকল প্রাণীকে কামমদে উন্মত্ত করিয়া থাকেন, সেই কামাত্মাকে নমস্কার। মহর্ষিগণ যে দেহস্থিত অব্যক্ত পুরুষের অনুসন্ধান করিয়া থাকেন, যে ক্ষেত্রজ্ঞ [প্রকৃতির অধীশ্বর] পুরুষ সতত বুদ্ধিতে বিরাজমান আছেন, সেই ক্ষেত্রস্বরূপকে নমস্কার। যিনি নিত্যস্বরূপ, যিনি ষোড়শগুণে [চক্ষুঃ প্রভৃতি একাদশ ইন্দ্রিয় ও ক্ষিতি প্রভৃতি পঞ্চভূতে] পরিবৃত হইয়া জাগ্রৎ, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি এই তিন অবস্থায় অবস্থিত আছেন, সাংখ্যে যাঁহাকে সপ্তদশ বলিয়া কীৰ্ত্তন করে, সেই সাংখ্যাত্মাকে নমস্কার। শান্ত প্রকৃতি, ইন্দ্রিয়দমনশীল মনুষ্যেরা নিদ্রা ও শ্বাসপ্রশ্বাস পরাজয়পূর্ব্বক যোগে মনোনিবেশ করিয়া যাঁহাকে জ্যোতিঃস্বরূপে নিরীক্ষণ করিয়া থাকেন, সেই যোগাত্মাকে নমস্কার। শান্তপ্রকৃতি মোক্ষার্থী সন্ন্যাসীরা পাপপুণ্য ক্ষয় হইলে যাঁহাকে প্রাপ্ত হইয়া থাকেন, সেই মোক্ষস্বরূপকে নমস্কার। যিনি যুগসহস্রের পর প্রদীপ্ত মার্ত্তণ্ডরূপ ধারণ করিয়া সমস্ত ভূতের বিনাশসাধন করেন, সেই ঘোরস্বরূপকে নমস্কার। যিনি সমস্ত ভূত বিনষ্ট ও সমুদয় জগৎ একার্ণবময়[জলময় একমাত্র সমুদ্রে পরিণত] করিয়া একাকী বালকবেশে শয়ন করিয়া থাকেন, সেই মায়াস্বরূপকে নমস্কার। যিনি স্বয়ম্ভুর নাভি হইতে সমুদ্ভূত হইয়াছেন, যাঁহাতে সমুদয় জগৎ প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে, সেই পদ্মস্বরূপকে নমস্কার। সে সহস্ৰমস্তকসম্পন্ন নিরুপম পুরুষ এককালে সমুদয় কামনা অতিক্রম করিয়াছেন, সেই যোগনিদ্ৰাস্বরূপকে নমস্কার। যাঁহার কেশপাশে জলজাল, অঙ্গ সন্ধিতে নদী এবং জঠর মধ্যে চারি সমুদ্র বিরাজমান রহিয়াছে, সেই জলস্বরূপকে নমস্কার। যাঁহা হইতে সমুদয় পদার্থ সমুৎপন্ন এবং যাঁহাতে সমুদয় লীন হয়, সেই কারণস্বরূপকে নমস্কার। যিনি রাত্রিতে শয়ান এবং দিবাভাগে উপবিষ্ট হইয়া ইষ্টানিষ্টসমুদয় বিষয় সন্দর্শন করিতেছেন, সেই দর্শকস্বরূপকে নমস্কার। যিনি সমস্ত কাৰ্য্যে অবিচলিত ও ধৰ্ম্মকাৰ্য্যের নিমিত্ত উদ্যত হইয়া থাকেন, সেই কাৰ্য্যস্বরূপকে নমস্কার। যিনি ক্ষত্রিয়ের অধর্ম্মাচরণ দর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া একবিংশতিবার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয়া করিয়াছেন, সেই ক্রুরতাস্বরূপকে নমস্কার। যিনি বায়ু[প্রাণ, অপান সমান উদান, ব্যান]রূপে শরীরমধ্যে পাঁচভাগে বিভক্ত হইয়া প্রাণীগণকে সচেষ্ট করিতেছেন, সেই পবনস্বরূপকে নমস্কার। যিনি যুগে যুগে অবতীর্ণ হইয়া মাস, ঋতু, অয়ন ও বৎসরব্যাপী যোগে আসক্ত হয়েন, যিনি সৃষ্টি ও প্রলয়ের কৰ্ত্তা, সেই কালস্বরূপকে নমস্কার। যাঁহার মুখ হইতে ব্রাহ্মণ, বাহু হইতে ক্ষত্রিয়, উদর হইতে বৈশ্য এবং পাদ হইতে শূদ্র উৎপন্ন হইয়াছে, সেই সৰ্ব্ববর্ণস্বরূপকে নমস্কার। অগ্নি যাঁহার আস্যদেশ, স্বর্গ মস্তক, আকাশমণ্ডল নাভি, ভূমণ্ডল চরণদ্বয়, সূৰ্য্যমণ্ডল চক্ষু ও দিঙ্মণ্ডল[সমস্ত দিক] যাঁহার কর্ণ, সেই লোকস্বরূপকে নমস্কার। যিনি কাল ও যজ্ঞ হইতে শ্রেষ্ঠ, যিনি শ্রেষ্ঠ হইতেও শ্রেষ্ঠ, যিনি এই বিশ্বসংসারের আদি কারণ এবং যাঁহার আদি কেহই নাই, সেই বিশ্বস্বরূপকে নমস্কার। যিনি রাগদ্বেষাদিদ্বারা শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়গ্রামকে রক্ষা করিতেছেন, সেই রক্ষিতাকে নমস্কার। যিনি অন্ন, পান ও ইন্ধন[কাষ্ঠ]রূপী, যিনি লোকের বল ও জীবনের বর্দ্ধনকর্ত্তা এবং যিনি এই প্রাণীগণকে ধারণ করিতেছেন, সেই প্রাণস্বরূপকে নমস্কার। যিনি প্রাণধারণের নিমিত্ত চতুৰ্ব্বিধ অন্ন ভোজন এবং প্রাণীগণের অন্তরে প্রবিষ্ট হইয়া অন্নাদি পাক করিতেছেন, সেই পাকস্বরূপকে নমস্কার। যিনি পিঙ্গলনেত্র, পিঙ্গলকেশর নরসিংহরূপ ধারণপূর্ব্বক নখ ও দশনদ্বারা দানবেন্দ্র হিরণ্যকশিপুকে সংহার করিয়াছেন, সেই দৃপ্ত[ক্রুদ্ধ]স্বরূপকে নমস্কার। দেবতা,গন্ধৰ্ব্ব, দৈত্য ও দানবগণ যাঁহার যথার্থ তত্ত্ব অবগত হইতে অসমর্থ, সেই সূক্ষ্মস্বরূপকে নমস্কার। যিনি রসাতলগত হইয়া অনন্তরূপে জগৎ-সংসার ধারণ করিতেছেন, সেই বীৰ্য্যস্বরূপকে নমস্কার। যিনি এই সংসার-পরিরক্ষণার্থ প্রাণীগণকে স্নেহপাশে বদ্ধ করিয়া মুগ্ধ করিতেছেন, সেই মোহস্বরূপকে নমস্কার। যিনি আত্মজ্ঞানের যথার্থ তত্ত্ব অবগত হইয়াছেন এবং যাঁহার মহিমা কেবল আত্মজ্ঞানপ্রভাবেই অবগত হওয়া যায়, সেই জ্ঞানস্বরূপকে নমস্কার। যাঁহার দেহ অপ্রমেয় এবং যাঁহার পরিমাণের ইয়ত্তা নাই, সেই জ্ঞাননেত্রসম্পন্ন দিব্যস্বরূপকে নমস্কার। যে লম্বোদর পুরুষ জটা, দণ্ড ও কমণ্ডলু ধারণ করিয়া থাকেন, সেই ব্ৰহ্মস্বরূপকে নমস্কার। যাঁহার সর্বাঙ্গ ভস্মদিগ্ধ[ছাইমাখা], যিনি নিরন্তর ত্রিশূল ধারণ করিয়া থাকেন, সেই ত্রিদশের ত্রিলোচন, উলিঙ্গ ও রুদ্রস্বরূপকে নমস্কার। যাঁহার ললাটে অর্ধচন্দ্র, হস্তে শূল ও পিনাক, সেই নাগযজ্ঞোপবীতধারী[সাপের পৈতা-পরা] উগ্রস্বরূপকে নমস্কার। যিনি সৰ্ব্বভূতের আত্মা, সৰ্ব্বভূতের সৃষ্টি ও সংহারকর্তা এবং ক্রোধ, দ্রোহ ও মোহপরিশূন্য, সেই শান্তস্বরূপকে নমস্কার। যাঁহাতে এই চরাচর বিশ্ব লীন রহিয়াছে। এবং যাঁহা হইতে ইহা সম্ভূত হইয়াছে, সেই সৰ্ব্বময় সর্ব্বস্বরূপকে নমস্কার। হে বিশ্বকৰ্ম্মন্! হে বিশ্বাত্মন্! তুমি পঞ্চভূতকে অতিক্রমপুৰ্ব্বক নিত্য নির্ম্মুক্ত হইয়াছ, তুমি ত্রিলোকমধ্যে সৰ্ব্বত্র বিদ্যমান রহিয়াছ, তুমি ধৰ্ম্মময় এবং প্রাণীগণের সৃষ্টিসংহারকর্তা। আমি ভূতাদি[অতীত, বর্ত্তমান ও ভবিষ্যৎ] কালয়ে তোমার অবস্থিতি অবলোকনে সমর্থ নহি, কেবল তত্ত্বজ্ঞানদ্বারা তোমার সনাতন মূর্ত্তি নিরীক্ষণ করিতেছি। তোমার মস্তকদ্বারা স্বর্গ ও পদযুগলদ্বারা মৰ্ত্ত ব্যাপ্ত রহিয়াছে। তুমি ত্রিবিক্রম সনাতনপুরুষ। দিক্সকল তোমার বাহু, সূৰ্য্য তোমার চক্ষু এবং শুক্র ও প্রজাপতি তোমার বলস্বরূপ। তুমি বায়ুর সপ্তমার্গ রোধ করিয়া রহিয়াছ। তুমি অতসীপুষ্পসদৃশ কৃষ্ণবর্ণ ও পীতবস্ত্রধারী। তোমাকে যে নমস্কার করে, তাহার কিছুমাত্র ভয় থাকে না। অতএব আমি ভক্তিভাবে তোমাকে নমস্কার করিতেছি।
“কৃষ্ণকে একটিমাত্র প্রণাম করিলে অশ্বমেধযজ্ঞানুষ্ঠানের অধিক ফললাভ হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি দশ অশ্বমেধের অনুষ্ঠান করে, তাহার পুনরায় জন্ম হয়, কিন্তু যে একবার কৃষ্ণকে প্রণাম করে, তাহাকে আর ভূমণ্ডলে জন্মগ্রহণ করিতে হয় না। যাহারা কৃষ্ণব্রতপরায়ণ এবং যাহারা রাত্রিকালেও উত্থিত হইয়া কৃষ্ণকে স্মরণ করে, তাহারা বহ্নিমধ্যে মন্ত্রপূত ঘৃতের ন্যায় কৃষ্ণের শরীরে প্রবেশ করিতে পারে। হে কৃষ্ণ! তুমি নরকয়নিবারক এবং সংসারসাগর পার হইবার নৌকাস্বরূপ। তুমি ব্ৰহ্মণ্যদেব এবং গো, ব্রাহ্মণ ও জগতের হিতকারী; তোমাকে নমস্কার। হরি’- এই দুইটি অক্ষর জীবন-বনভ্রমণের পাথেয়, সংসারশৃঙ্খলচ্ছেদনের উপায় এবং শোকদুঃখের অন্তকস্বরূপ। সত্য বিষ্ণুময়, জগৎ বিষ্ণুময় এবং সমস্ত বস্তুই বিষ্ণুময়; অতএব সেই বিষ্ণুর প্রসাদে আমার পাপসকল বিনষ্ট হউক। হে পদ্মপলাশলোচন! এক্ষণে এই নরাধম অভিলষিত গতি প্রাপ্ত হইবার নিমিত্ত ভক্তিসহকারে তোমার শরণাপন্ন হইয়াছে, তুমি ইহার শুভানুধ্যান কর। তুমি বিদ্যা ও তপস্যার উৎপত্তিস্থান এবং স্বয়ম্ভূ, এক্ষণে আমার এই বাক্যে প্রীত ও প্রসন্ন হও। বেদ, তপস্যা ও বিশ্বসংসার সকলই নারায়ণাত্মক। হেনারায়ণ! তুমি সর্ব্বদা সকল বস্তুতেই বিরাজমান আছ।”
মহাত্মা ভীষ্ম এইরূপে তদ্গতচিত্তে কৃষ্ণকে স্তব করিয়া প্রণাম করিলেন। তখন ভগবান বাসুদেব যোগবলে ভীষ্মের ভক্তিভাব অবগত হইয়া তাঁহাকে ত্রিলোকদর্শনজ্ঞান প্রদান করিলেন। অনন্তর সেই ব্রহ্মবাদী ব্রাহ্মণেরা বাষ্পগদগদকণ্ঠে পুরুষোত্তম নারায়ণের স্তব করিয়া বারংবার ভীষ্মের প্রশংসা করিতে লাগিলেন। ঐ সময় পরমপুলকিত বাসুদেব সাত্যকির সহিত, ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ধনঞ্জয়ের সহিত এবং ভীমসেন নকুল ও সহদেবের সহিত রথে আরোহণপূর্ব্বক চক্রের ঘর্ঘর-ঘোষে বসুন্ধরা কম্পিত করিয়া ভীষ্মদর্শনার্থ ধাবমান হইলেন। মহাবীর কৃপ, যুযুৎসু ও সঞ্জয় ইঁহারাও প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড রথে আরোহণপূর্ব্বক ভীষ্মসমীপে গমন করিতে লাগিলেন। মহাত্মা মধুসূদন গমনকালে পথিমধ্যে ব্রাহ্মণগণের মুখে আপনার স্তুতিবাদ শ্রবণ করিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন এবং মহাত্মা ভীষ্মকে কৃতাঞ্জলিপুটে প্রণত দেখিয়া হৃষ্টমনে তাঁহাকে অভিনন্দন করিতে লাগিলেন।