৪৭তম অধ্যায়
দূতকর্ত্তৃক অর্জ্জুন কথিত ভাবী দুৰ্য্যোধনদুর্ঘটনা প্রকাশ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! অদীনসত্ত্ব যোদ্ধৃগণের নেতা; দুরাত্মাগণের সংহর্ত্তা, মহাত্মা ধনঞ্জয় কি কহিয়াছেন? আমি রাজ, গণসমক্ষে তাহাই জিজ্ঞাসা করিতেছি।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! যুদ্ধার্থী নিভীক অর্জ্জুন যুধিষ্ঠিরের অনুমতি অনুসারে কেশবের সম্মুখে আমাকে কহিয়াছেন যে, “হে সঞ্জয়! যে দুৰ্ভাষী, দুরাত্মা, অতিমূঢ়, আসন্নমৃত্যু সূতপুত্র আমার সহিত যুদ্ধার্থী হইয়াছেন এবং যে সকল রাজা পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত আনীত হইয়াছেন, তাঁহাদিগের ও সমস্ত কুরুগণের সমক্ষে দুৰ্য্যোধন ও তাঁহার অমাত্যগণকে কহিবে যে, লোহিতলোচন [(উৎকর্ষ পক্ষে) রক্তাভ নেত্ৰ; (ক্রোধ পক্ষে)। আরক্ত চক্ষু] গাণ্ডীবধন্বা যুদ্ধোন্মুখ ধনঞ্জয় সুরসমাজমধ্যবর্ত্তী বজ্রহস্ত সহস্রালোচনের ন্যায় পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণের সমক্ষে কহিয়াছেন যে, যদি দুৰ্য্যোধন রাজা যুধিষ্ঠিরের রাজ্য পরিত্যাগ না করেন, তাহা হইলে স্পষ্টই বোধ হইতেছে, ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের অভুক্ত পূর্ব্বকৰ্মজনিত পাতক অবশ্যই বর্ত্তমান আছে; এই নিমিত্তই ভমিসেন, অর্জ্জুন, নকুল, সহদেব, বাসুদেব, সাত্যকি, ধৃতশস্ত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখন্তীর সহিত তাঁহাদিগের যুদ্ধঘটনা হইবে এবং যে যুধিষ্ঠির অবলীলাক্রমে স্বৰ্গমর্ত্য ভস্মসাৎ করিতে পারেন, তিনিও সেই যুদ্ধে সম্মুখীন হইবেন। যদি দুৰ্য্যোধন ইহাদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে স্বীকার করেন, তাহা হইলে পাণ্ডবগণের সকল প্রয়োজনই সম্পন্ন হয়। কিন্তু তাহা যেন না করেন; আর যদি ইচ্ছা হয়, যুদ্ধ করুন।
“ধর্ম্মচারী রাজা যুধিষ্ঠির অরণ্যে প্রব্রাজিত হইয়া যে দুঃসহ দুঃখশয্যায় শয়ন করিয়াছিলেন, দুৰ্য্যোধন তদপেক্ষা অধিকতর দুঃখদায়ক অস্তিমশয্যায় শয়ন করিয়া প্ৰাণ পরিত্যাগ করুক। অন্যায়াচারপরায়ণ দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন হ্রী, জ্ঞান, তপস্যা, দম, শৌৰ্য্য, ধন ও বলদ্বারা কদাচ পাণ্ডবগণকে পরাভব করিতে সমর্থ হয় নাই; কিন্তু আমাদিগের রাজা যুধিষ্ঠির সরলতা, তপশ্চৰ্য্যা, দম, শৌৰ্য্য, ধন ও বলসম্পন্ন এবং প্ৰণিপাতপরায়ণ হইয়াও কেবল সত্যের অনুরোধে দুঃশহ ক্লেশ সহ্য করিয়া আছেন। যখন ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির উদভ্ৰান্তচেতাঃ হইয়া কুরুগণের প্রতি চিরসঞ্চিত ভয়ানক ক্ৰোধ প্রকাশ করিবেন এবং যেমন প্রজ্জ্বলিত হুতাশন কক্ষ দাহ করে, সেইরূপ যখন তিনি ক্ৰোধপ্ৰদীপ্ত হইয়া ধার্ত্তরাষ্ট্রের সেনাগণকে দগ্ধ করিবেন, তখন তদ্দর্শনে দুৰ্য্যোধনকে অনুতাপ করিতে হইবে।
“যখন তিনি দেখিবেন, যমোপম ভীমসেন বর্ম্মাবৃতশরীরে গদাহস্তে রথারোহণপূর্ব্বক ভীমবেশে সেনাগণের সম্মুখীন হইয়া রোষবিষ উদগার করিতেছেন এবং বীর ও সেনাগণকে সংহার করিতেছেন, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ ও আমাদিগের বাক্য স্মরণ করিতে হইবে। যখন দেখিবেন, ভীমসেন গিরিশৃঙ্গ সদৃশ মাতঙ্গদল নিপতিত করিয়াছেন, তাহাদের কুম্ভসমূহ বিদীর্ণ হইয়াছে এবং তাহা হইতে রুধিরধারা বিনিঃসৃত হইতেছে, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। যখন ভীমরূপ ভীমসেন গোসমূহ প্রবিষ্ট মহাসিংহের ন্যায় ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের সমীপবর্ত্তী হইয়া তাহাদিগকে সংহার করিবেন, তখন তাহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। যখন ভয়শূন্য, কৃতাস্ত্ৰ, শৌর্য্যশালী ভীমসেন একমাত্র রথে গদাদ্বারা রথ ও পদাতিসমূহ সংহার করিবেন, শৈক্যদ্বারা বেগে মাতঙ্গগণকে নিগৃহীত করিবেন এবং পরশুছিন্ন অরণ্যের ন্যায় ধার্ত্তরাষ্ট্রের সৈন্যগণকে উচ্ছিন্ন করিবেন, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। যখন দেখিবেন, ভীমসেন শস্ত্ৰাগ্নিদ্বারা ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে তৃণবহুল গ্রামের ন্যায় দগ্ধ করিয়াছেন, সেনাগণকে বিদ্যুৎঅগ্নিদগ্ধ সুপক্ক শস্যরাশির ন্যায় অগ্নিসাৎ করিয়াছেন এবং প্ৰগলভ যোদ্ধৃগণকে ভয়ার্ত্ত, পরাঙ্মুখ ও সুদূরপরাহত করিয়াছেন, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে।
“যখন চিত্ৰযোধী নকুল দক্ষিণ তূণীর হইতে শতাধিক শর নিক্ষেপ করিয়া রথিগণকে ব্যথিত করিবেন, তখন দুৰ্য্যোধনকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। যখন সুখোচিত নকুল বনমধ্যে দীর্ঘকাল দুঃখশয্যায় শয়ন নিবন্ধন রোষাপরবশ হইয়া আশীবিষের ন্যায় ক্রোধহলাহল বমন করিবেন, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। রাজা যুধিষ্ঠির যেসকল রাজাকে যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত আদেশ করিয়াছেন, যাঁহারা তাঁহাকে আত্মপ্রদান করিয়াছেন, যখন সেই সকল রাজা শুভ্র রথসমূহে আরোহণ করিয়া সৈন্যগণকে আক্রমণ করিবেন, তখন দুৰ্য্যোধনকে অনুতাপ করিতে হইবে। যখন তিনি দেখিবেন, যুবার ন্যায় শৌৰ্য্যশালী কৃতাস্ত্ৰ পঞ্চশিশু [শ্রুতকীর্ত্তি আদি দ্ৰৌপদীর পঞ্চপুত্র] জীবিতাশা পরিত্যাগ করিয়া কৌরবগণকে আক্রমণ করিতেছে, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে।
“যখন সহদেব ধৃতাস্ত্ৰ হইয়া দান্ত [সংযত-সুশিক্ষিত] তুরঙ্গমযুক্ত নিঃশব্দচক্ৰ সুবৰ্ণতারাসনাথ রথে আরোহণপূর্ব্বক শরসমূহে নৃপতিগণের শিরচ্ছেদ করিতে আরম্ভ করিবেন, তখন কৃতাস্ত্র রথিগণকে মহাভয়ে সমরে পরাঙ্মুখ হইয়া চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিতে দেখিয়া তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। লজ্জাশীল, নিপুণ, সত্যবাদী, মহাবল, সর্ব্বধর্ম্মসম্পন্ন, ক্ষিপ্রকারী ও তরস্বী সহদেব দুৰ্য্যোধনকে আক্রমণপূর্ব্বক সৈন্যগণকে সংহার করিবেন, তাহার সন্দেহ নাই।
“যখন দুৰ্য্যোধন দেখিবেন, শরশোভিত, সৌন্দর্য্যশালী, সমরকুশল দ্ৰৌপদেয়গণ ঘোর বিষ আশীবিষের ন্যায় আগমন করিতেছেন, তখন তাহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। যখন পরবীরঘাতী কৃতাস্ত্ৰ কৃষ্ণসম অভিমন্যু বারিধারাবর্ষী ধারাধরের ন্যায় অরাতিগণের প্রতি শরধারা বর্ষণ করিবেন, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। যখন দেখিবেন, যুবার ন্যায় শৌৰ্য্যশালী, ইন্দ্রপ্রতিম, কৃতাস্ত্ৰ, বালক সৌভদ্র শত্রুসেনার মৃত্যুস্বরূপ হইয়া আগমন করিতেছেন, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। যখন ক্ষিপ্রকারী রণবিশারদ সিংহাসমান শৌৰ্য্যশালী যুবা প্রভদ্রকগণ সসৈন্য ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে আক্রমণ করিবে, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। যখন মহারথ বিরাট ও দ্রুপদ পৃথক পৃথক সেনাসমভিব্যাহারে সসৈন্য ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিবেন, তখন তাঁহাকে, যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। “যখন অস্ত্রবিদ্যাবিশারদ দ্রুপদমহীপতি রথারোহণপূর্ব্বক রোশাবেশে শরসমূহে যুবাদিগের সমস্ত মস্তকছেদন করিবেন, তখন দুৰ্য্যোধনকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। যখন সপুত্র বিরাটরাজ মৎস্যগণসমভিব্যাহারে শত্রুসেনার অভ্যন্তরে প্রবেশ করিবেন, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। যখন দুৰ্য্যোধন সম্মুখে আৰ্য্যসদৃশ বিরাটপুত্র উত্তরকে রথারূঢ় ও বদ্ধপরিকর অবলোকন করিবেন, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। যখন তনুত্রসনাথ [বৰ্মদ্বারা আবৃত] শিখণ্ডী দিব্য তুরঙ্গযোজিত রথদ্বারা রথসমূহ অবমৰ্দন ও সমুদয় রথিগণকে অন্বেষণপূর্ব্বক ভীষ্মকে আক্রমণ করিবে, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। আমি সত্য কহিতেছি, কুরুসত্তম ভীষ্ম শিখণ্ডীর হস্তে নিহত হইলে আরাতিগণ অবশ্যই আমাদিগকে বিনষ্ট করিবে। যখন দেখিবেন, ধীমান দ্রোণ যাহাকে গুহ্য অস্ত্র প্রদান করিয়াছিলেন, সেই ধৃষ্টদ্যুম্ন সৃঞ্জয়সৈন্যমধ্যে শোভা পাইতেছেন, তখন তাঁহাকে পরিতাপ করিতে হইবে। যখন সেই অপ্রনেয়শৌৰ্য্যশালী ধৃষ্টদ্যুম্ন সেনা-প্রতিপদে অভিষিক্ত হইয়া দ্রোণাচাৰ্য্যের সমক্ষেই শরনিকরে ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে ব্যথিত করিবেন, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। মনীষী, ধীমান্, লক্ষ্মীবান্, বলবান্, মনস্বী, সোমকুলতিলক বাসুদেব যাঁহাদিগের প্রধাননেতা, আরাতিগণ কোনকালেই তাঁহাদিগকে পরাভব করিতে সমর্থ হইবে না। দুৰ্য্যোধনকে ইহাও বলিবে যে, আমরা যখন অদ্বিতীয় যোদ্ধা, মহারথ, বীতভয়, বিপুলায়ুধধারী সাত্যকিকে বরণ করিয়াছি তখন তিনি যেন রাজ্যের আশা পরিত্যাগ করেন। যখন সেই শিনিরাজ সত্যকি আমার বাক্যানুসারে বর্ষণশীল জলধরের ন্যায় শরজালে প্রধান যোদ্ধাদিগকে আচ্ছাদিত করিবেন, তখন তাহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। যেমন গোসকল সিংহের গন্ধ আত্মাণ করিয়া ইতস্ততঃ পলায়ন করে, সেইরূপ দীর্ঘবাহু দৃঢ়ধন্বা মহাত্মা সাত্যকি যুদ্ধের নিমিত্ত অধ্যবসায়ারূঢ় হইলে শত্ৰুগণ সংগ্রাম হইতে ইতস্ততঃ পলায়ন করিবে। সূৰ্য্যের ন্যায় দীপ্তিমান সেই সাত্যকি এরূপ অস্ত্রবিদ্যায় নিপুণ ও ক্ষিপ্ৰহস্ত যে, তিনি অনায়াসে পর্ব্বতশ্রেণী বিদীর্ণ ও সর্ব্বলোককে বিনষ্ট করিতে পারেন। বৃষ্ণিসিংহ বাসুদেবের অস্ত্রযোগ যে প্রকার বিস্ময়কর, রমণীয় ও সুশিক্ষিত এবং যাদৃশ অস্ত্ৰযোগ প্রশস্ত বলিয়া নির্দ্দিষ্ট আছে, সাত্যকি তৎসমুদয় গুণেই অলঙ্কৃত হইয়াছেন। যখন অকৃতাত্মা মন্দবুদ্ধি দুৰ্য্যোধন সেই সাত্যকিকে হিরন্ময় ও শ্বেততুরঙ্গ চতুষ্টয়যোজিত মাধবরথে অবলোকন করিবেন, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত পরিতাপ করিতে হইবে।
“যখন তিনি দেখিবেন, কেশব আমার সুবর্ণসদৃশ মণিপ্রভাবসমুজ্জ্বল শ্বেতাশ্বযুক্ত বানরকেতু রথে আরোহণ করিয়াছেন, তখন তাঁহাকে পরিতাপ করিতে হইবে। যখন মহারণে আমার গাণ্ডীবাশরাসনের বজ্রনির্ঘোষসদৃশ কঠোরতর মৌর্বীশব্দ দুৰ্মতি দুৰ্য্যোধনের শ্রবণবিবরে প্রবেশ করিবে, তখন তাঁহাকে পরিতাপ করিতে হইবে। যখন তিনি দেখিবেন, তাহার সৈন্যগণ বাণবর্ষণজনিত অন্ধকারসমাচ্ছন্ন সমরমুখে গোসমূহের ন্যায় ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইতেছে এবং যেমন বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ মেঘ হইতে বির্নিমুক্ত হয়, তদ্রূপ ভীমরূপ, সহস্ৰঘ্ন, অস্থিচ্ছেদী ও মৰ্মভেদী নিশিতফলক শরসমূহ গাণ্ডীবের জ্যামুখ হইতে বিনির্গত হইয়া তুরঙ্গ, মাতঙ্গ ও বস্মিতাঙ্গ [বর্ম্মাবৃত] যোদ্ধাদিগকে কবলিত করিতেছে, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। যখন তিনি দেখিবেন, পরপ্ৰযুক্ত শরসমূহ আমার শরজালে প্রতিহত ও তিৰ্য্যগভাবে বিদ্ধ হইয়া ছিন্নভিন্ন হইতেছে, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। যেমন দ্বিজগণ তরুশিখর হইতে ফলচয়ন করেন, সেইরূপ যখন আমার বির্নিমুক্ত শরসমূহ যুবাদিগকে উত্তমাঙ্গ [মস্তক] অবচয়ন [আহরণ, কর্ত্তন, ছেদন, অধঃপতন] করিবে, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। যখন তিনি দেখিবেন, তাঁহার প্রসিদ্ধ যোদ্ধাগণ শরাঘাতে নিহত হইয়া, রথ, হস্তী ও অশ্ব হইতে রণক্ষেত্রে পতিত হইয়াছে, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। যখন তিনি দেখিবেন, অস্ত্ৰাঘাত প্রাপ্ত হওয়া দূরে থাকুক, ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ উহা দৰ্শনমাত্রেই যুদ্ধের সহিত জীবন পরিত্যাগ করিতেছে, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। যখন আমি বিবৃতবদন কালস্বরূপ প্রজ্বলিত ও অবিচ্ছিন্ন শরপরম্পরায় পদাতি, রথ ও শত্ৰুগণকে পরাহত করিব, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত পরিতাপ করিতে হইবে। যখন তিনি দেখিবেন, ইতস্ততসঞ্চারী রথবেগে নিবিড় ধূলিপটল সমুত্থিত ও গাণ্ডীবাস্ত্ৰে তাঁহার সৈন্যসকল ছিন্নভিন্ন হইতেছে, তখন তাঁহাকে অনুতাপ করিতে হইবে। যখন তিনি দেখিবেন, তাঁহার সৈন্যগণের মধ্যে কেহ বা পলায়ন করিতেছে, কাহার বা কলেবর বিচ্ছিন্ন, কেহ বা সংজ্ঞা শুন্য হইয়াছে, কোথাও বা অশ্ব, মাতঙ্গ, বীরেন্দ্র ও নরেন্দ্ৰগণ নিহত হইয়া পতিত রহিয়াছে, কাহারও বা বাহন শ্রমার্ত্ত, কেহ তৃষ্ণার্ত্ত, কেহ বা ভয়ার্ত্ত হইয়াছে, কেহ আর্ত্তস্বরে চীৎকারপূর্ব্বক প্ৰাণপরিত্যাগ করিতেছে, কেহ বা গতজীবিত হইয়া রণস্থলে পতিত রহিয়াছে, কাহার কেশ, অস্থি ও কপাল ইতস্ততঃ বিকীর্ণ হইয়াছে, রণভূমি যেন বাজপেয়[বহু পশুদ্বারা হুয়মান যজ্ঞ-যে যজ্ঞে অসংখ্য পশু আহুতি দেওয়া হয়; তদ্রূপ মৃতদেহে রণভূমি আকীর্ণ হইবে]যজ্ঞভূমি হইয়া উঠিয়াছে, তখন তাঁহাকে অনুতাপ করিতে হইবে। যখন তিনি আমার রথে গাণ্ডীব, বাসুদেব, দিব্যপাঞ্চজন্য শঙ্খ, তুরঙ্গসমূহ, অক্ষয় তূণীরদ্বয় এবং দেবদত্ত শঙ্খ ও আমাকে দৃষ্টিগোচর করিবেন, তখন তাঁহাকে যুদ্ধের নিমিত্ত অনুতাপ করিতে হইবে। যেমন যুগান্তকালীন হুতাশন দস্যুগণকে উন্মুলিত করিয়া যুগান্তর প্রবর্ত্তিত করে, তদ্রূপ আমি যখন কৌরবগণকে দগ্ধ করিয়া যুগান্তর উপস্থিত করিব, তখন তাঁহাকে ও তাঁহার পুত্ৰগণকে অনুতাপ করিতে হইবে। যখন কোপনস্বভাব অল্পচেতাঃ দুৰ্য্যোধন, ঐশ্বৰ্য্যভ্রষ্ট ও হৃতাদর্প হইয়া সৈন্যগণ এবং ভ্রাতাদিগের সহিত আহত ও কম্পিত্যকলেবর হইবেন, তখন তাঁহাকে অনুতাপ করিতে হইবে।
“একদা এক ব্ৰাহ্মণ আমার পৌর্ব্বাহ্নিক জপক্রিয়া ও তাঁহার সন্ধ্যাবন্দনাদি পরিসমাপ্ত হইলে মধুরবাক্যে কহিলেন, “হে সব্যসাচিন! দেবরাজ উচ্চৈঃশ্রবায় আরোহণ ও বজ্র হস্তে করিয়া শত্ৰুগণকে সংহারপূর্ব্বক তোমার সম্মুখে গমন করুন; আর কৃষ্ণই বা সুগ্ৰীব হয়যোজিত রথে তোমার পশ্চাৎ রক্ষা করুন; শত্ৰুগণের সহিত সংগ্রাম করা তোমার অনায়াসসাধ্য নহে।” আমি কহিলাম, হে ব্ৰহ্মন! বাসুদেব বজ্রধর অপেক্ষাও অধিক সাহায্য করিবেন, আমি দাস্যুগণকে বধ করিবার নিমিত্তই কৃষ্ণকে লাভ করিয়াছি; বোধহয়, দেবতারাই এই ঘটনা করিয়াছেন। তেজস্বী শৌর্য্যশালী বাসুদেবকে পরাজয় করিবার অভিলাষ আর বাহুদ্বারা অপ্ৰমেয়-সলিলশালী মহাসাগর উত্তীর্ণ হইবার অভিলাষ, উভয়েই সমান। যে ব্যক্তি অতিমাত্র বৃহৎ শ্বেতপর্ব্বত ভগ্ন করিবার অভিলাষে চপেটাঘাত করে, তাহারই পাণিতল বিশীর্ণ হইয়া যায়; কিন্তু পর্ব্বতের কিছুমাত্ৰ হানি হয় না। সমরে পুরষোত্তম কেশবকে পরাজয় করিবার অভিলাষ করা আর হস্তদ্বারা প্ৰজ্বলিত হুতাশন নির্ব্বাণ করা ও চন্দ্র-সূৰ্য্যের গতিরোধ করা এবং সহসা সুরগণের সুধা অপহরণ করা, সকলই সমান। যিনি সমরে ভোজরাজদিগকে সহসা উৎসাদিত করিয়া মহাত্মা রোক্সিণেয়ের জননী যশস্বিনী রুক্মিনীয় পাণিপীড়ন করিয়াছেন, যিনি সহসা গান্ধারগণকে প্রমথিত ও নগ্নজিতের পুত্ৰগণকে পরাজিত করিয়া সুরলোকলালামভূত সুদৰ্শন রাজাকে বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়াছিলেন, যিনি কপটদ্বারা পাণ্ড্যরাজকে নিহত এবং কলিঙ্গদিগকে রণক্ষেত্রে বিমন্দিত করিয়াছেন, যৎকর্ত্তৃক বারাণসী নগরী দগ্ধ হইয়া বহু বর্ষ অনাথা হইয়াছিল, যিনি অন্যের অজেয় নিষাদরাজ একলব্যকে সমরে আহ্বান করিয়া অনায়াসে নিহত করিয়াছেন, যিনি বলদেবের সাহায্যে বৃষ্ণি ও অন্ধকদিগের সমক্ষে দুৰ্দান্ত কংসকে ধ্বংস করিয়া উগ্রসেনকে রাজ্য প্রদান করিয়াছেন, যিনি আকাশচর মায়াধর নির্ভীক শাম্বরাজ সৌভের সহিত যুদ্ধ করিয়া সৌভদ্ধারে হস্তদ্বারা শতয়ী ধারণ করিয়াছেন, কোন ব্যক্তি তাঁহার সামর্থ সহ্য করিতে সমর্থ্য হয়?
“অতি দুৰ্গম প্ৰাগজ্যোতিষনগরনিবাসী মহাবলপরাক্রান্ত ভূমিপুত্র নরকাসুর অদিতির মণিময় কুণ্ডলদ্বয় অপহরণ করিয়াছিল; দেবগণ অমর হইয়াও তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিতে সমর্থ হয়েন নাই; অনন্তর কেশবের প্রকৃতি, বিক্রম, বল ও অনিবাৰ্য্য অস্ত্ৰসকল সন্দর্শন করিয়া তাঁহাকেই দস্যুবধে নিয়োগ করিয়াছিলেন। কাৰ্য্যসাধনসমর্থ বাসুদেব ঐ দুষ্কর কর্ম্ম সম্পন্ন করিবার নিমিত্ত অঙ্গীকার করিলেন; পরে ষট্সহস্ৰ অসুর, মুর ও ওঘ রাক্ষসকে বিনষ্ট ও লৌহময় পাশসকল ছিন্ন করিয়া নগরমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। তথায় মহাবল নরক-দৈত্যের সহিত যুদ্ধঘটনা হইলে দৈত্যরাজ বাতমথিত কর্ণিকার-কুসুমের ন্যায় প্ৰাণ পরিত্যাগ করিয়া ধরাশায়ী হইল। অমিত প্রভাব বাসুদেব এইরূপে ভৌম নরক ও মুরকে সংহারপূর্ব্বক শ্ৰী ও কীর্ত্তিসকল হইয়া মণিময় কুণ্ডলদ্বয় গ্রহণপূর্ব্বক প্রত্যাবৃত্ত হইলেন। তখন দেবগণ ইহার ভয়ানক রণকৃত্য নিরীক্ষণ করিয়া ইহাকে এই বর প্রদান করিলেন যে, “হে কেশব! অদ্যাবধি যুদ্ধসময়ে তোমার শ্রান্তিবোধ হইবে না; তোমার গতি সর্ব্বত্র অব্যাহত হইবে এবং শত্ৰুপ্ৰহিত শস্ত্ৰসকল তোমার গাত্রে বিদ্ধ হইবে না।” ভগবান বসুদেবতনয় এইরূপ বর লাভ করিয়া কৃতাৰ্থ হইলেন।
“ ‘এবংবিধ মহাবলসম্পন্ন অপ্রমেয়বীৰ্য্য বাসুদেব সর্ব্বদাই গুণসম্পদ বিদ্যমান আছে। দুৰ্য্যোধন কি এই অনন্তবীৰ্য্য অনন্তদেবকে পরাজিত করিতে অভিলাষ করে? সেই দুরাত্মা ইঁহাকে সংহার করিতে নিরন্তর যত্ন করিতেছে; কিন্তু ইনি কেবল আমাদিগের মুখাপেক্ষায় তাহা সহ্য করিয়া আছেন। যে ব্যক্তি কৃষ্ণের ও আমার পরস্পর কলহ উৎপাদন করিতে অভিলাষ করে, সে ব্যক্তি যুদ্ধে গমন করিলে জানিতে পরিবে যে, কৃষ্ণের প্রতি পাণ্ডবগণের মমতা অপহরণ করিতে সমর্থ হয় নাই।
“আমি রাজ্যলাভার্থ ভীষ্ম, দ্রোণ, অশ্বত্থামা ও অদ্বিতীয় যোদ্ধা কৃপাচাৰ্য্যকে নমস্কারপূর্ব্বক রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইব। আমি দেখিতেছি যে, যে পাপবুদ্ধি পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ করিবে, তাহাকে কালের হস্তে নিহত হইতে হইবে। নৃশংস ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ যে রাজপুত্রদিগকে কপটদ্যুতে পরাজিত করিয়া দ্বাদশ বৎসর অরণ্যে ও একবর্ষ অজ্ঞাতবাসে নির্ব্বাসিত করিয়াছিল, বলিতে পারি না তাহারা জীবিত থাকিতে কি নিমিত্ত ঐ দুরাত্মারা পদস্থ হইয়া সুখস্বচ্ছন্দে পরমানন্দে কাল যাপন করিবে? যদি তাহারা ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণের সাহায্যে যুদ্ধে আমাদিগকে পরাজিত করে, তাহা হইলে ধর্ম্ম অপেক্ষা অধর্ম্মাচরণই গরীয়ান এবং সাধুকর্মের অনুষ্ঠান কেবল পণ্ডশ্রম, তাহাতে সন্দেহ নাই। যদি পুরুষ কর্ম্মসূত্রে গ্রথিত না হয় ও আমরা কৌরবগণের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ না হই, তাহা হইলে দুৰ্য্যোধনের জয়লাভ হইতে পারে। যদি আমাদিগকে রাজ্য হইতে নিঃসারিত করা এবং এক্ষণে রাজ্য প্ৰদান না করার ফল অবশ্যম্ভাবী হয়, তাহা হইলে আমি অবশ্যই বাসুদেবের সাহায্যে দুৰ্য্যোধনকে সমূলে নির্ম্মূল করিব। উক্ত উভয়বিধ কর্মের ফলাফল আলোচনা করিয়া অবধারণ করিয়াছি যে, দুৰ্য্যোধনের পরাভূত হওয়াই শ্ৰেয়ঃ।
“আমি কুরুগণের সমক্ষে কহিতেছি যে, যুদ্ধক্ষেত্রে ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগের কেহই জীবিত থাকিবে না; অন্য স্থানে গমন করিলে তাহাদিগের প্রাণরক্ষা হইতে পারে। আমি কর্ণ ও ধার্ত্তরাষ্ট্রকে বিনষ্ট করিয়া সমগ্ৰ কৌরবরাজ্য জয় করিব। তোমাদিগের যাহা কর্ত্তব্য থাকে কর; এই সময় স্ব স্ব প্ৰেয়সীসমাগমসুখসম্ভোগ করিয়া তৃপ্তিলাভ কর। আমাদিগের নিকট যে সকল বৃদ্ধ, বহুশাস্ত্ৰজ্ঞ, শীলকুলসম্পন্ন, বর্ষজ্ঞ [বৎসরের ফলাফলে অভিজ্ঞ] জ্যোতির্ষিক এবং নক্ষত্ৰযোগের নিশ্চয়জ্ঞ ব্ৰাহ্মণ আছেন তাহারা এবং নানাবিধ দৈবরহস্য ভাবী ঘটনার অর্থপ্রকাশক, শৈবগমপ্রসিদ্ধ [তন্ত্রবিনির্ণীত] মৃগচক্রসকল ও মুহূর্ত্তসমুদয় কৌরবগণের ক্ষয় ও পাণ্ডবগণের জয় নিবেদন করিতেছে। আমাদিগের অজ্ঞাতশত্রু শত্রুগণের নিগ্রহবিষয়ে যেমন স্থিরসিদ্ধান্ত করিয়াছেন, সর্ব্বদর্শী জনাৰ্দনও সেইরূপ কৃতনিশ্চয় হইয়াছেন। আমিও স্বয়ং অপ্ৰমাদ, বুদ্ধি ও যোগপ্রভাববতী দৃষ্টিতে সেইরূপ ভবিষ্যৎ ঘটনা অবলোকন করিয়া অবগত হইতেছি যে, যুদ্ধকালে ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে অবশ্যই প্ৰাণত্যাগ করিতে হইবে। আমার গাণ্ডীবাশরাসন স্পর্শ করি নাই, তথাপি ইহা স্ফীত হইতেছে, অনাহত মৌর্বী কম্পিত হইতেছে, আমার শরসমুদয় তৃণমুখ হইতে বহির্গত হইবার নিমিত্ত মুহুর্মুহুঃ উৎসুক হইতেছে; আমার নির্ম্মল খড়্গ নির্মোকমুক্ত বিষধরের ন্যায় কোষ হইতে বিনিঃসৃত হইতেছে। ধ্বজ হইতে এই নিদারুণ বাক্য উচ্চারিত হইতেছে যে, “হে কিরীটি! তোমার রথ কত দিনে সংযোজিত হইবে?” রাত্রি হইলে গোমায়ুগণ চিৎকার করিতে থাকে ও বায়সগণ অন্তরীক্ষ হইতে নিপতিত হয় এবং মৃগ, শৃগাল, দাত্যুহ [ডাকপাখী], কাক, গৃধ্র, বক, তরক্ষু ও সুবর্ণপত্ৰগণ [স্বর্ণপক্ষযুক্ত শুকপক্ষী] শ্বেতাশ্বসংযুক্ত রথ অবলোকন করিয়া পশ্চাতে পতিত হয়। আমি একাকী শরজালবর্ষণ করিয়া সমুদয় যোদ্ধাকে শমনসদনে প্রেরণ করিব। যেমন প্রজ্বলিত হুতাশন নিদাঘসময়ে অরণ্যকে নিঃশেষিত করিয়া পরিশেষে স্বয়ং নির্ব্বাণপ্ৰাপ্ত হয়, সেইরূপ আমি তাহাদিগের বিধার্থ সুসজ্জিত হইয়া অস্ত্রপ্রয়োগের পৃথক পৃথক উপায় অবলম্বনপূর্ব্বক বেগশালী স্থূনাকৰ্ণ পাশুপত [সাড়ে তিন হাত লম্বা লৌহময় গ্ৰন্থিবহুল অস্ত্ৰ], ব্রাহ্ম ও ইন্দ্ৰদত্ত অস্ত্রে সমস্ত প্ৰজা নিঃশেষিত করিয়া শান্তি লাভ করিবে। হে সঞ্জয়! তাঁহাদিগকে আমার এই স্থির সঙ্কল্প অবগত করিব। দেখ, দুৰ্য্যোধনের কি ভ্রান্তি! ইন্দ্ৰপ্ৰভৃতি দেবগণের সাহায্য লাভ করিয়াও যাহাদিগকে পরাজয় করা সাধ্য নয়, সহসা তাহাদিগের সহিত কলহ করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছে। সে যাহা হউক, এক্ষণে এই প্রার্থনা যে, বৃদ্ধ পিতামহ, কৃপ, দ্রোণ, অশ্বত্থামা ও ধীমান বিদুর যে প্রকার কহিয়াছেন, তাহাই হউক, কৌরবগণও চিরজীবন লাভ করুন।’ ”