৪৭তম অধ্যায়
ইন্দ্ৰসভাগত লোমশ ঋষির সহিত পার্থের পরিচয়
বৈশম্পায়ন কহিলেন, কোন সময়ে মহর্ষি লোমশ ভ্ৰমণ করিতে করিতে ইন্দ্রদর্শনাভিলাষে তদীয় আলয়ে উপস্থিত হইলেন। মহামুনি তথায় আগমন ও দেবরাজকে নমস্কার করিয়া দেখিলেন, পাণ্ডুনন্দন ধনঞ্জয় বাসবের অৰ্দ্ধাবসানে উপবিষ্ট হইয়া রহিয়াছেন। অনন্তর মহর্ষিগণ-পূজিত দ্বিজরাজ লোমশ দেবরাজের অনুমতিক্রমে বিষ্টরাসনে আসীন হইয়া মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন যে, কৌন্তেয় ক্ষত্ৰিয় হইয়া কি প্রকারে ইন্দ্রাসন প্রাপ্ত হইয়াছেন? এমন কি পুণ্যকর্ম্ম বা এমন কোন লোক জয় করিয়াছেন যে, তন্নিমিত্ত দেবপূজিত স্থান প্রাপ্ত হইলেন?
শচীনাথ লোমশ মুনির মনোগত ভাব অবগত হইয়া সহাস্যবদনে কহিলেন, “ব্রহ্মর্ষে! আপনি যাহা জানিতে ইচ্ছা করিয়াছেন, তাহা শ্রবণ করুন। এই কৌন্তেয় কেবল মানব নহে, উঁহাতে দেবত্বও আছে আমার ঔরসে কুন্তীর গর্ভে ইঁহার জন্ম হইয়াছে। এখানে কোন কারণবশতঃ অস্ত্ৰপ্ৰাপ্তির নিমিত্ত আসিয়াছেন। কি আশ্চৰ্য্য! আপনি এই পুরাতন ঋষিকে জানেন না! হৃষীকেশ ও ধনঞ্জয় এই দুই পুরাতন ঋষি ত্ৰিলোকে নরনারায়ণ বলিয়া বিখ্যাত; ইহারা কাৰ্য্যবশতঃ পুণ্যস্থান পৃথিবীতে অবতীর্ণ হইয়াছেন। মহাত্মা দেব ও ঋষিগণ যাহা দৰ্শন করিতে অসমর্থ ও সিদ্ধচারণসেবিত গঙ্গা যে স্থান হইতে প্রবাহিত হইয়াছেন, সেই বিখ্যাত বন্দরী-নামক আশ্রমপদ বিষ্ণু ও এই জিষ্ণুর নিবাসস্থান। এই দুই মহাবীৰ্য্য আমার নিয়োগানুসারে পৃথিবীতে জন্মপরিগ্রহ করিয়াছেন; ইহারা ভূমির ভারাবতরণ করিবেন। নিবাতকবচ-নামে কতকগুলি মহাবল পরাক্রান্ত পাতালপুরবাসী দানবেরা বরলাভে প্ৰদীপ্ত ও বিমোহিত হইয়া আমাদের অপ্ৰিয়াচরণে প্ৰবৃত্ত ও প্রাণ-সংহারের নিমিত্তও উদ্যত হইয়াছে; আমাদিগকে কোনক্রমেই গণনা করে না। দেবগণ তাহাদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে সমর্থ নহেন। অতএব যিনি পৃথিবীতে কপিল-নামে অবতীর্ণ হইয়া রসাতল-খননে প্রবৃত্ত সগরসন্তানগণকে দর্শনমাত্রে ধ্বংস করিয়াছেন, সেই মধুসূদন মহাযুদ্ধে অর্জ্জুনের সহিত মিলিত হইয়া আমাদিগের মহৎকাৰ্য্য সম্পন্ন করিবেন, সন্দেহ নাই। তিনি যেমন পূর্ব্বে মহাহ্রদে পন্নগগণের প্রাণনাশ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ দৃষ্টিপাতমাত্রেই নিবাতকবচ ও তাহাদিগের অনুচরগণকে বিনষ্ট করিতে পারেন; কিন্তু অতি সামান্য কাৰ্য্যের নিমিত্ত তাঁহাকে উদ্ধুদ্ধ করা কোনক্রমেই উচিত নহে; কেন না, সেই তেজোরাশি প্রবুদ্ধ হইলে এই জগৎ ভস্মীভূত হইবে, সন্দেহ নাই। অতএব দনুজদলন্দালনক্ষম ধনঞ্জয়ই তাহাদিগকে নিহত করিয়া পুনরায় মর্ত্যলোকে গমন করিবেন।
লোমশ মুনিমুখে পাণ্ডবগণের নিকট অর্জ্জনবার্ত্তাপ্রেরণ
“আপনি আমার অনুরোধে একবার গমন করুন; রাজা যুধিষ্ঠির কম্যাকবনে অবস্থিতি করিতেছেন; আপনি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া কহিবেন যে, তিনি যেন অর্জ্জুনের নিমিত্ত কোনক্রমেই উৎকণ্ঠাকুল না হয়েন; অর্জ্জুন অস্ত্রসংগ্রহবিষয়ে কৃতকাৰ্য্য হইয়া শীঘ্রই ফিরিয়া আসিবেন; কেন না, বাহুবীৰ্য্যের সংশোধন ও অস্ত্রসংগ্রহ ব্যতিরেকে ভীষ্ম, দ্রোণ প্রভৃতিকে সংগ্রামে পরাজয় করা অতি দুরূহ ব্যাপার। মহাবাহু ধনঞ্জয় সংগহীতাস্ত্র এবং দিব্য নৃত্য, বাদ্য ও সঙ্গীত-বিদ্যায় পারদর্শী হইয়াছেন। তিনি ভ্রাতৃগণ-সমভিব্যাহারে পবিত্ৰ তীৰ্থসকল দর্শন ও তথায় অবগাহনপূর্ব্বক বিগত পাপ ও গতসন্তাপ হইয়া সুখে রাজ্যভোগ করুন। হে দ্বিজরাজ! আপনি তীৰ্থপৰ্যটনকালে তপোবলে গিরিদুর্গ ও বিষম প্রদেশবাসী ভীষণ রাক্ষসগণ হইতে তাঁহাকে রক্ষা করিবেন।”
পবিত্ৰাত্মা অৰ্জ্জুনও মহেন্দ্রের বাক্যাবসানে লোমশ মুনিকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে মহামুনে! আপনি ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করিবেন এবং যাহাতে তাঁহার তীৰ্থপৰ্যটন ও দানাদি ধর্ম্মক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তদ্বিষয়েও যত্নবান হইবেন।”
মহাতপাঃ লোমশ তাহাদিগের বাক্য অঙ্গীকার করিয়া কাম্যককাননোদ্দেশ্যে মহীতলে হমন করিয়া দেখিলেন, রাজা যুধিষ্ঠির তাপসগণ ও তদীয় ভ্রাতৃবৃন্দকর্ত্তৃক চতুর্দ্দিকে পরিবেষ্টিত হইয়া তথায় বাস করিতেছেন।