৪৬ম অধ্যায়
ধ্যানস্থ কৃষ্ণদর্শনে যুধিষ্ঠিরের কারণজিজ্ঞাসা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, তখন ধৰ্ম্মরাজ কেশবকে একান্ত মৌনভাবাপন্ন দেখিয়া কহিলেন, “হে অমিতপরাক্রম! তুমি কি নিমিত্ত এতাদৃশ বিস্ময়কর ধ্যানে নিমগ্ন হইয়াছ? এক্ষণে ত্রিজগতের মঙ্গল ত’? তুমি জাগরিত, স্বপ্নাবস্থা বা সুষুপ্তিপ্রাপ্ত নই; কাষ্ঠ, কুড্য[দেওয়াল] ও পাষাণের ন্যায় নিতান্ত নিশ্চল হইয়াছ। তোমাকে এরূপ অবস্থায় অবস্থিত দেখিয়া আমার মন নিতান্ত বিচলিত হইতেছে। তুমি শরীরস্থিত পঞ্চবায়ুকে সংযত ও ইন্দ্রিয়গ্রামকে মনে সন্নিবেশিত করিয়াছ। তোমার বাক্য ও মন বুদ্ধিতে এবং শব্দাদি গুণসমুদয় উপযুক্ত স্থানে সন্নিবেশিত হইয়াছে। তোমার রোমসকল কম্পিত হইতেছে না; মন ও বুদ্ধি এককালে স্থির হইয়া রহিয়াছে এবং তুমি নিৰ্ব্বাতপ্রদেশস্থিত [বায়ুহীন স্থানস্থিত] দীপের ন্যায় নিতান্ত নিশ্চল হইয়াছ। তোমার এরূপ অবস্থার কারণ কি? যদি উহা শ্রবণ করিতে আমার কোন বাধা না থাকে, তাহা হইলে ঐ বিষয় প্রকাশ করিয়া আমার সংশয়চ্ছেদন কর। হে কৃষ্ণ! তুমিই কৰ্ত্তা, তুমিই সংহর্তা, তুমিই ক্ষয়, তুমিই অক্ষয়। তোমার আদি বা অন্ত নাই। অতএব তুমিই আদিপুরুষ। এক্ষণে আমি প্রণত হইয়া ভক্তিভাবে প্রার্থনা করিতেছি, তুমি এই ধ্যানের যথার্থ তত্ত্ব কীৰ্ত্তন করিয়া আমাকে চরিতার্থ কর।”
কৃষ্ণকর্ত্তৃক ভীষ্মের শরণাগতি প্রকাশ
তখন ভগবান্ হৃষীকেশ যুধিষ্ঠিরের বাক্যশ্রবণে মন, বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়গ্রামকে স্ব স্ব স্থানে সংস্থাপনপূর্ব্বক ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! কুরুপিতামহ ভীষ্ম নিৰ্ব্বাণোন্মুখ[নির্ব্বাপিতপ্রায়] হুতাশনের ন্যায় শরশয্যায় শয়ন করিয়া আমাকে চিন্তা করিতেছেন, এই নিমিত্তই আমি তদগতচিত্ত হইয়াছি। দেবরাজ ইন্দ্রও যাঁহার অশনিনিস্বন-সদৃশ জ্যানির্ঘোষ সহ্য করিতে সমর্থ হয়েন নাই, যিনি স্বীয় বাহুবলে সমস্ত রাজমণ্ডল পরাজিত করিয়া স্বয়ংবরস্থল হইতে তিনটি কন্যা আনয়ন করিয়াছিলেন, মহাবীর পরশুরাম এয়োবিংশতি রাত্রি যুদ্ধ করিয়াও যাঁহাকে পরাস্ত করিতে সমর্থ হয়েন নাই, ভগবতী ভাগীরথী যাঁহাকে স্বীয় গর্ভে ধারণ করিয়াছিলেন, ভগবান বশিষ্ঠদেব যাঁহার উপদেষ্টা, যিনি পরশুরামের প্রিয়শিষ্য ও সমস্ত বিদ্যার আধার, ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান যাঁহার প্রত্যক্ষ রহিয়াছে, সেই মহাত্মা বুদ্ধিদ্বারা ইন্দ্রিয়গ্রাম ও মন সংযত করিয়া আমার শরণাগত হইয়াছেন। তন্নিমিত্ত আমি তাঁহাতেই মনঃসংযোগ করিয়া রহিয়াছিলাম।
“হে ধৰ্ম্মরাজ। সেই পুরুষশ্রেষ্ঠ মহাবীর শান্তনুতনয় স্বীয় কৰ্ম্মফলে স্বর্গে গমন করিলে এই পৃথিবী শশাঙ্কশূন্য শৰ্ব্বরীর ন্যায় শোভাবিহীন হইবে; অতএব আপনি সেই ভীষণপরাক্রম ভীষ্মের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া ধৰ্ম্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চতুৰ্ব্বিধ বিদ্যা, যজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপ, চারি আশ্রমের ধর্ম্ম ও রাজধৰ্ম্ম প্রভৃতি সমুদয় বিষয় তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করুন। সেই কৌরবধুরন্ধর ভীষ্ম পরলোকগমন করিলে জ্ঞানসমুদয় এককালে ভূমণ্ডল হইতে তিরোহিত হইবে। এই নিমিত্তই আপনাদের তথায় গমন করিয়া জ্ঞানযোগ অভ্যাস করিতে অনুরোধ করিতেছি।”
কৃষ্ণসহ যুধিষ্ঠিরের ভীষ্মসাক্ষাৎকারোদ্যোগ
তখন ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির বাসুদেবের সেই হিতকর বাক্যশ্রবণ করিয়া বাম্পগদগদস্বরে কহিলেন, “জনার্দ্দন! তুমি ভীষ্মের যেরূপ প্রভাব কীৰ্ত্তন করিলে, তদ্বিষয়ে আমার অণুমাত্র সন্দেহ নাই। আমি অনেক ব্রাহ্মণের মুখে ভীষ্মের প্রভাব ও মহানুভবতার কথা শ্রবণ করিয়াছি। তুমি ত্রিলোকের কর্ত্তা, অতএব তোমার বাক্যে কিছুমাত্র সন্দেহ হইবার নহে। যাহা হউক, যদি আমার প্রতি তোমার অনুগ্রহ হইয়া থাকে, তবে তুমি আমাদিগকে সমভিব্যাহারে লইয়া তথায় গমন কর। ভগবান্ ভাস্কর অস্তাচলচূড়া অবলম্বন করিলেই ভীষ্মদেব দেবলোকে গমন করিবেন; অতএব এ সময় অবিলম্বে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎকার করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। তুমি আদিদেব ও ব্রহ্ম; অতএব তোমার দর্শনলাভ হইলে শান্তনুতনয় কৃতার্থ হইবেন, সন্দেহ নাই।”
তখন ভগবান্ বাসুদেব ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া সাত্যকিকে কহিলেন, “যুযুধান! অবিলম্বে আমার রথযোজনা করিতে আদেশ কর।” মহাত্মা সাত্যকি কৃষ্ণের বাক্যশ্রবণে তৎক্ষণাৎ তথা হইতে নির্গত হইয়া দারুককে রথযোজন করিতে আজ্ঞা করিলেন। কৃষ্ণসারথি দারুক সাত্যকির বাক্যশ্রবণমাত্র মরকত, চন্দ্রকান্ত ও সূৰ্য্যকান্ত-মণি-খচিত, নবোদিত সূর্য্যের ন্যায় প্রভাসম্পন্ন, শৈব্য, সুগ্রীব প্রভৃতি মনোমারুতগামী অতি উৎকৃষ্ট অশ্ব-সংযুক্ত, সুবর্ণমণ্ডিতচক্রবিশিষ্ট, গড়্গধ্বজ রথ সুসজ্জিত করিয়া কৃষ্ণের নিকট গমনপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিল, “মহাশয়! রথ প্রস্তুত হইয়াছে।”