ষট্চত্বারিংশ অধ্যায়
জরৎকারুর বংশরক্ষায় প্রতিজ্ঞা
পিতৃগণ কহিলেন, “বৎস! আমাদিগের সৌভাগ্যবলে তুমি যদৃচ্ছাক্রমে এই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছ, এক্ষণে জিজ্ঞাসা করি, তুমি কি নিমিত্ত দারপরিগ্রহ কর নাই?” জরৎকারু কহিলেন, “হে পিতৃগণ! আমার মনে সর্ব্বদাই এই ভাব উদিত হয় যে, আমি ঊর্দ্ধ্বরেতা হইয়া ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বনপূর্ব্বক দেহত্যাগ করিব, কদাচ দারপরিগ্রহ করিব না। এক্ষণে আপনাদিগকে এই মহাগর্ত্তমধ্যে পক্ষীর ন্যায় লম্বমান দেখিয়া আমার ব্রহ্মচর্য্যের বাসনা অপনীত হইল। আমি আপনাদের হিতসাধনার্থে অচিরাৎ বিবাহ করিব, কিন্তু তদ্বিষয়ে এই এক প্রতিজ্ঞা রহিল যে, যদি আমি আমার সনাম্নী কন্যা ভিক্ষাস্বরূপ প্রাপ্ত হই এবং তাহাকে ভরণপোষণ করিতে না হয়, তাহা হইলেই তাহার পাণিগ্রহণ করিব, প্রকারান্তর হইলে তদ্বিষয়ে প্রবৃত্ত হইব না। আমার সেই পত্নীর গর্ভে যে পুৎত্র জন্মিবে, সেই আপনাদিগকে উদ্ধার করিবে। হে পিতামহগণ! তখন আপনারা অক্ষয় স্বর্গলাভ করিয়া পরম সুখে কালযাপন করিতে পারিবেন।”
উগ্রশ্রবাঃ শৌনককে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, হে ভৃগুবংশাবতংস! মহর্ষি জরৎকারু এইরূপে পিতৃগণকে আশ্বাসিত করিয়া সমস্ত মহীমণ্ডল ভ্রমণ করিতে লাগিলেন; কিন্তু তিনি বৃদ্ধ বলিয়া কেহই তাঁহাকে কন্যাপ্রদানে উদ্যত হইল না। যখন তিনি পিতৃগণের আদেশানুসারে বিবাহ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াও তৎসম্পাদনে কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না, তখন দুঃখার্ত্তমনে অরণ্যানী প্রবেশ পূর্ব্বক উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। পরিশেষে পিতৃলোক-হিতৈষী-মহাপ্রাজ্ঞ জরৎকারু এই বলিয়া ক্রমে ক্রমে তিনবার কন্যা ভিক্ষা করিলেন, “এ স্থানে যে কোন স্থাবর বা অস্থাবর বস্তু বর্ত্তমান আছ অথবা যাহারা অন্তর্হিত [অদৃষ্ট-অগোচর] আছ, সকলে আমার বাক্য শ্রবণ কর। আমি যাযাবরবংশে সমুদ্ভত। আমার নাম জরৎকারু। জন্মাবধি এতাবৎকাল পর্য্যন্ত কেবল ব্রহ্মচর্য্যানুষ্ঠান দ্বারা কালযাপন করিয়াছি। সম্প্রতি আমার পিতৃগণ বংশলোপভয়ে আমাকে পাণিগ্রহণ করিতে আদেশ দিয়াছেন। আমি অত্যন্ত দরিদ্র হইয়াও পিতৃগণের আজ্ঞাক্রমে দারপরিগ্রহাভিলাষে [বিবাহিত পত্নী পাইবার আশায়] নিখিল ধরণীমণ্ডল পরিভ্রমণ করিলাম, কিন্তু কুত্রাপি কন্যালাভ হইল না। অতএব এক্ষণে আমি যাঁহাদের নিকট কন্যা প্রার্থনা করিতেছি, তাঁহাদের মধ্যে যদি কোন ব্যক্তির মৎসনাম্নী [আমারতুল্যা নামের] দুহিতা থাকে, আর যদি আমাকে সেই কন্যা ভিক্ষাস্বরূপ সম্প্রদান করেন এবং তাহাকে যদি ভরণপোষণ করিতে না হয়, তবে আনয়ন করুন, আমি তাহার পাণিগ্রহণ করিব।”
অনন্তর যে সকল সর্প জরৎকারুর দারপরিগ্রহাভিলাষের অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিল, তাহারা সত্বর যাইয়া বাসুকিকে সংবাদ দিল। নাগরাজ বাসুকি তাহাদের মুখে এই বাক্য শ্রবণ করিবামাত্র সাতিশয় সন্তোষপ্রকাশপূর্ব্বক স্বীয় ভগিনীকে বিচিত্র বসন ভূষণে বিভূষিত করিয়া জরৎকারু সন্নিধানে লইয়া গেলেন এবং তাঁহাকে ভিক্ষা-স্বরূপ সেই কন্যা প্রদান করিলেন; কিন্তু মুনিবর কন্যার নাম ও ভরণ-পোষণ-বিষয়ে সন্দিহান হইয়া নাগরাজ বাসুকিকে তাঁহার নাম জিজ্ঞাসা করিলেন এবং কহিলেন, “আমি ইঁহার ভরণপোষণ করিতে পারিব না।” এইরূপে মহর্ষি জরৎকারু মুমুক্ষু হইয়াও দারপরিগ্রহার্থ দ্বিমনা [সংশয়িত চিত্ত- ইতস্ততঃ ভাব] হইয়াছিলেন।