৪৬তম অধ্যায়
অভিসারিকা উর্ব্বশীর অর্জ্জুন-অভিগমন
উর্ব্বশী গন্ধর্ব্বরাজকে বিদায় করিয়া পার্থসমাগমলালসার বশীভূত হইয়া স্নানাদি ক্রিয়া সমাপন করিল। অনন্তর গন্ধ, মাল্য ও রমণীয় বেশভূষা সমাধান করিলে ধনঞ্জয়ের মোহিনীমূর্ত্তি তাহার স্মৃতিপথে আবির্ভূত হইয়া তাহাকে রতিরমণের বাণগোচর করিল। তখন উর্ব্বশী মন্মথশরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া দিব্যোস্তরণসংক্রাস্তীর্ণ বিস্তীর্ণ শয্যাতলে শয়নপূর্ব্বক অনন্যমনে হৃদয়সঙ্কলিত প্ৰাণবল্লভের প্রতিমূর্ত্তি-সম্ভোগ দ্বারা আত্মাকে চরিতার্থ করিতে লাগিল। ক্রমে ক্রমে প্রগাঢ় প্রদোষকাল উপস্থিত; চন্দ্ৰমা সমুদিত হইল। তখন সেই পৃথুনিতম্বিনী স্বীয় নিবাস হইতে বহির্গত হইয়া পার্থভবনাভিমুখে গমন করিতে লাগিল। সেই লাবণ্যবতী ললনার সুকোমল কুঞ্চিত, কুসুমগুচ্ছশোভিত, সুদীর্ঘ কেশপাশ, ভ্রূবিক্ষেপ, আলাপমাধুৰ্য্য ও মৌম্যাকৃতি অনির্ব্বচনীয় সুষমা সম্পাদন করিয়াছিল। তাহার বদন-সুধাকর সন্দর্শনে শশধরও লজ্জিত হইলেন। সেই সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী দিব্য-চন্দনচর্চিত, বিলোল-হারাবলিললিত, পীনোন্নত পয়োধরযুগল বিকম্পিত হওয়াতে পদে পদে নমিতাঙ্গী হইয়া গমন করিতে লাগিল। তাহার ত্ৰিবলীদামমনোহর কটিদেশের কি অনির্ব্বচনীয় শোভা! তাহার গিরিবরবিত্তীর্ণ রাজতরশনা [রূপার কাঞ্চীদা]-রঞ্জিত নিতম্ব যেন মন্মথের আবাসস্থান; সূক্ষ্ম বসনাবৃত অনিন্দনীয় তদীয় জঘন নিরীক্ষণে ঋষিগণেরও চিত্তবিকার জন্মে; কিঙ্কিণীকিণলাঞ্ছিত পাদদ্বয় কুর্ম্মপৃষ্ঠের ন্যায় উন্নত; গৃঢ়গ্ৰন্থি অঙ্গুলিসকল তাম্রবর্ণ ও আয়ততল। একে ত’ সেই সুরসুন্দরী সহজেই মদনোন্মত্তা, তাহাতে আবার পরিমিত সুরাপানে প্ৰফুল্লচিত্ত হইয়া বিবিধ বিলাসবিভ্রমসহকারে বাক্পথাতীত প্রিয়দর্শনা হইয়া উঠিল। সিদ্ধ, চারণ ও মনোহর গন্ধর্ব্বগণ-সমভিব্যাহারিণী অর্জ্জুনভবনাভিসারিণী সেই বিলাসিনী বহুবিধ আশ্চৰ্য্য ও মনোহর দ্রব্যপূর্ণ সুরলোকেও সকলের পরমদর্শনীয় হইল। সেই সুরকামিনী মেঘবৰ্ণ অতিসূক্ষ্ম উত্তরীয় বসন ধারণ করাতে যেন অভ্রাবৃত কৃশ চন্দ্ৰলেখার ন্যায় বিরাজিত হইতে লাগিল।
অনন্তর শুচিস্মিতা উর্ব্বশী দ্রুত পদসঞ্চারে ক্ষণকালমধ্যে অর্জ্জুন-নিকেতনে উপনীত হইবামাত্র দ্বারপালেরা সসম্ভ্রমে পার্থসন্নিধানে গিয়া তাহার বৃত্তান্ত নিবেদন করিল। অৰ্জ্জুন তাহাকে গৃহপ্ৰবেশ করাইতে অনুমতি প্ৰদান করিয়া স্বয়ং শঙ্কিতচিত্তে তৎক্ষণাৎ তাহার প্রত্যুদগমন করিলেন। পার্থ উর্ব্বশীকে নয়নগোচর করিবামাত্র লজ্জাবনতবদনে তাহাকে অভিবাদনপূর্ব্বক গুরুর ন্যায় সৎকার করিয়া কহিলেন, “হে অন্সরঃপ্রবরে! প্ৰণাম; আপনার ভৃত্য উপস্থিত; কি নিমিত্ত শুভাগমন হইয়াছে, আজ্ঞা করুন।” উর্ব্বশী অর্জ্জুনবাক্য-শ্রবণে হতজ্ঞান হইয়া তাঁহাকে চিত্ৰসেন গন্ধর্ব্বের বাক্য আদ্যোপান্ত সমস্ত শ্রবণ করাইলেন।
“হে মানুজশ্রেষ্ঠ! গন্ধর্ব্বরাজ চিত্ৰসেন আমাকে যে কথা কহিয়াছেন ও যে নিমিত্ত আমি এখানে আগমন করিয়াছি, তৎসমুদয় আপনাকে নিবেদন করিতেছি, শ্রবণ করুন। আপনার আগমনাবধি মহেন্দ্রের উপস্থানসূচক পরামমনোরম বর্ত্তমান মহোৎসবে সুরলোক উৎসবময় হইলে চতুর্দ্দিক হইতে রুদ্র, আদিত্য, অশ্বিনীকুমার ও বসুগণ সমাগত হইলেন। সিদ্ধ, চারণ, যক্ষ, মহোরগ, মহর্ষি, রাজর্ষিগণ, উজ্জ্বলকায় কৃশানু, ভানু ও শশধর সেই উৎসব সন্দর্শনে সমুপস্থিত হইয়া স্বস্ব মৰ্য্যাদানুসারে আসন পরিগ্রহ করিলে গন্ধর্ব্বেরা বীণাবাদনপূর্ব্বক তানলয়বিশুদ্ধ স্বরসংযোগে সুমধুর সঙ্গীত আরম্ভ করিল ও প্রধান প্রধান অন্সরাসকল নৃত্য করিতে লাগিল। তখন আপনি অনিমেষলোচনে কেবল আমার প্রতিই দৃষ্টিপাত করিয়াছিলেন। উৎসবদর্শনার্থ সমাগত দেবতা, অন্সরা ও অন্যান্য জনগণ আপনার পিতাকর্ত্তৃক অনুজ্ঞাত হইয়া স্বস্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন। দেবরাজ এইরূপে সকলকেই বিদায় করিয়া গন্ধর্ব্বরাজ চিত্ৰসেনকে আমার নিকট প্রেরণ করিলেন। গন্ধর্ব্বরাজ চিত্ৰসেন ত্বদীয় পিতার আদেশক্রমে মদ্ন্তিকে উপস্থিত হইয়া কহিলেন, ‘হে বরবর্ণিনি! আমি দেবরাজকর্ত্তৃক প্রেরিত হইয়া তোমার নিকট আসিয়াছি, তুমি মহাবলপরাক্রান্ত উদারস্বভাব পার্থকে পতিত্বে বরণ কর; তাহা হইলে সুরপতি ও আমার সাতিশয় প্রিয়কাৰ্য্য সম্পাদন করা হইবে এবং ত্বদীয় আত্মাও পরিতৃপ্ত হইয়া সুখসম্ভোগ করিবে।” হে কমললোচন! আমি দেবরাজ ও গন্ধর্ব্বরাজের আজ্ঞা শ্রবণানন্তর আপনার শুশ্রূষা করিবার নিমিত্ত এখানে আসিয়াছি এবং আপনার গুণদামে আকৃষ্ট হইয়া বিষমশর অনঙ্গের বশবর্ত্তিনী হইয়াছি। হে অরিন্দম! আপনি আমার পতি হইবেন, ইহা আমার চিরাভিলষিত মনোরথ।”
অর্জ্জুনের উর্ব্বশী উপেক্ষা
অর্জ্জুন উর্ব্বশীর এইরূপ বাক্য-শ্রবণে সাতিশয় লজ্জিত হইয়া কৰ্ণে করার্পণপূর্ব্বক কহিলেন, “হে ভাবিনি! আপনি যে বিষয়ের নিমিত্ত অনুরোধ করিতেছেন, উহা আমার নিতান্ত অশ্রাব্য; আপনি আমার গুরুপত্নীতুল্য। যেমন মহাভাগা কুন্তী ও ইন্দ্ৰাণী আমার পূজনীয়, আপনিও আমার পক্ষে সেইরূপ, সন্দেহ নাই। হে শুভে! যে নিমিত্ত আমি অনিমেষনয়নে আপনাকে নিরীক্ষণ করিয়াছিলাম, তাহার কারণ শ্রবণ করুন। আপনাকে পৌরববংশের জননী মনে করিয়া উৎফুল্ললোচনে আমি আপনার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াছিলাম; তাহাতে আমার অসন্দভিসন্ধি বিবেচনা করা কোনক্রমেই আপনার উচিত নহে। হে কল্যাণি! আপনা হইতেই পৌরবংশের উদ্ভব, অতএব আপনি আমার পরম গুরু।
উর্ব্বশী কহিলেন, “হে দেবরাজনন্দন! আমরা সামান্য নারী; আমাকে গুরু সম্বোধন করা আপনার অনুচিত। পুরুবংশীয় পুত্ৰপৌত্রেরা তপোবলে স্বৰ্গপ্রাপ্ত হইয়া আমাদিগের সহিত ক্রীড়া কৌতুকে কালযাপন করেন; কিন্তু তদ্ব্যতিক্রমাচরণে কদাচ তাঁহাদিগের প্রবৃত্তি জন্মে না; অতএব আপনি প্রসন্ন হউন; আমাকে প্রত্যাখ্যান করা আপনার উচিত হয় না। আমি মদনবাণে আহত হইয়া আপনার প্রতি সাতিশয় অনুরক্ত হইয়াছি; এক্ষণে আপনি আমাকে ভজনা করিয়া আমার মন ও প্রাণ রক্ষা করুন।”
অর্জ্জুন কহিলেন, “হে বরারোহে! আমি সত্য কহিতেছি, শ্রবণ করুন এবং দিগবিদিক ও দিকপালেরাও শ্রবণ করুন। কুন্তী, মাদ্রী ও শচীর ন্যায় আপনিও আমার পরম গুরু। হে অনঘে! আমি নতশিরাঃ হইয়া আপনার চরণে প্ৰণিপাত করিতেছি, আপনি আমার মাতৃবৎ পূজনীয় ও আমি আপনার পুত্ৰবৎ রক্ষণীয়; অতএব এক্ষণে আপনি স্বস্থানে প্ৰস্থান করুন।”
উর্ব্বশীশাপে অর্জ্জুনের ক্লীবত্ব
উর্ব্বশী ধনঞ্জয়ের উক্তপ্রকার বাক্য-শ্রবণে ক্রোধাবিষ্ট, ভ্রূকুটিকুটিলানন ও বেপমান হইয়া তাঁহাকে শাপ প্রদান করিল, “হে পাৰ্থ! আমি অনঙ্গবাণে পীড়িত হইয়া তোমার পিতার আজ্ঞাক্ৰমে অভিসারিকবৃত্তি [কান্তর্থিনী হইয়া সঙ্কেতস্থানে গমনকারিণী নারী] অবলম্বনপূর্ব্বক স্বয়ং গৃহাগত হইয়াছি, তথাপি তুমি আমাকে প্রত্যাখ্যান করিলে, অতএব তোমাকে মানহীন ও ক্লীবনামে বিখ্যাত হইয়া স্ত্রীগণমধ্যে নৃত্য করিয়া ষণ্ডের ন্যায় কালব্যাপন করিতে হইবে।” উর্ব্বশী অর্জ্জুনকে উক্তপ্রকার অভিসম্পাত করিয়া রোষে স্ফুরতাধর হইয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক আপন গৃহে প্রত্যাগমন করিল।
অনন্তর অর্জ্জুন সত্বর চিত্ৰসেনের নিকট উপস্থিত হইয়া উর্ব্বশীসংক্রান্ত আদ্যোপান্ত রজনীবৃত্তান্ত-সকল অবিকল নিবেদন করিলেন এবং তিনি যে অভিশপ্ত হইয়াছেন, তাহাও জানাইলেন। চিত্ৰসেন তৎসমুদয় বৃত্তান্ত ইন্দ্রের নিকট কীর্ত্তন করিয়া দেবরাজ নির্জ্জন প্রদেশে তনয়কে আনয়ন করাইয়া সহাস্যবদনে মধুরবাক্যদ্বারা তাহাকে সান্ত্বনা করিয়া কহিলেন, “হে তাত! তোমাকে গর্ভে ধারণ করিয়া অদ্য পৃথা সৎপুত্রা হইলেন। তুমি ধৈৰ্য্যগুণে ঋষিগণকেও পরাভব করিয়াছ। উর্ব্বশীপ্রদত্ত শাপও তোমার পক্ষে শ্রেয়স্কর ও অর্থসাধক হইবে, সন্দেহ নাই। হে অনঘ! ত্ৰয়োদশবর্ষে যখন তোমরা ভূমণ্ডলে অজ্ঞাতবাসে কালযাপন করিবে, তখন তুমি ক্লীবরূপে নর্ত্তকবেশে বিহার করিয়া সেই অবশিষ্ট একবৎসর অনায়াসে যাপন করিয়া পরিশেষে আপন পুরুষত্ব প্রাপ্ত হইবে।” অর্জ্জুন দেবরাজের এবংবিধ বাক্য-শ্রবণে সাতিশয় আহ্লাদিত হইয়া শাপচিন্তা পরিত্যাগপূর্ব্বক চিত্ৰসেনের সহিত স্বৰ্গভবনে পরম পরিতুষ্টমনে কালব্যাপন করিতে লাগিলেন।
মহারাজ! যাহারা অবহিত হইয়া প্রতিদিন এই আশ্চৰ্য্য পরমপবিত্র ফাগ্লুনিচরিত্র শ্রবণ করেন, তাহাদিগের মন কদাপি পাপকাৰ্য্যে লিপ্ত হয় না এবং সেই পুণ্যশীল মানবেরা মদ, দম্ভ, রাগ ও দোষশূন্য হইয়া চরমে পরমফল স্বৰ্গবাস লাভ করিয়া সুখস্বচ্ছন্দে কালব্যাপন করিতে পারেন।