৪৬তম অধ্যায়
অভিমন্যুরণে দুর্য্যোধনতনয় লক্ষ্মণ বধ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! তুমি অনেক ব্যক্তির সহিত একের তুমুল সংগ্রাম ও জয়লাভ কীৰ্ত্তন করিতেছ। এক্ষণে তাহার বিক্রম বিশ্বাসের অযোগ্য ও নিতান্ত অদ্ভুতের ন্যায় বোধ হইতেছে; কিন্তু যাঁহাদিগের ধর্ম্মই আশ্রয়, তাঁহাদের এইরূপ বিক্রম অদ্ভুত বলিয়া প্রতীয়মান হয় না। যাহা হউক, এক্ষণে এক শত রাজপুত্র নিহত ও দুর্য্যোধন বিমুখ হইলে আমার পক্ষ বীরগণ অভিমন্যুর সহিত কিরূপ আচরণ করিলেন।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আপনার পক্ষ বীরগণের মুখমণ্ডল শুষ্ক, নয়নযুগল চঞ্চল, গাত্র কন্টকিত ও অনবরত স্বেদজল নির্গত হইতে লাগিল। তখন তাঁহারা বিজয় লাভে নিতান্ত উৎসাহশূন্য হইয়া পলায়নে কৃতসংকল্প হইলেন এবং নিহত ভ্রাতা, পিতা, পুত্র, সুহৃৎ, সম্বন্ধী ও বান্ধবগণকে পরিত্যাগ করিয়া হস্তী ও অশ্বদিগকে ত্বরান্বিত করিয়া গমন করিতে লাগিলেন।
অনন্তর দ্রোণাচার্য্য, অশ্বত্থামা, কৃপ, দুর্য্যোধন, কর্ণ, কৃতবর্ম্মা ও সৌবল তাঁহাদিগকে ছিন্ন ভিন্ন দেখিয়া ক্রোধভরে অভিমন্যুর প্রতি ধাবমান হইলেন। তিনি তাঁহাদিগকে বিমুখ প্রায় করিলে সুখভোগ প্রবৃদ্ধ, বালকতা ও দর্পবশতঃ নির্ভয়, মহাতেজা লক্ষ্মণ একাকী অভিমন্যুর প্রতি ধাবমান হইলেন। পুত্রবৎসল রাজা দুৰ্য্যোধন লক্ষ্মণের অনুগমন করিলেন এবং অন্যান্য মহারথগণ দুর্য্যোধনের অনুসরণ করিতে লাগিলেন। যেমন বারিধারা পর্ব্বতোপরি বারিধারা বর্ষণ করে, তদ্রূপ তাঁহারা অভিমন্যুর উপর শরবর্ষণ করিতে প্রবৃত্ত হইলে অভিমন্যু সমীরণের অদ্ভুদ মন্থনের ন্যায় তাঁহাদিগকে প্রমথিত করিতে লাগিলেন। অনন্তর যেমন মত্ত মাতঙ্গ অন্য মত্ত মাতঙ্গকে প্রাপ্ত হইয়া থাকে, তদ্রূপ অভিমন্যু পিতৃসমীপবর্তী, উদ্যতকাৰ্ম্মুক, নিতান্ত দুর্দ্ধর্ষ, কুবেরপুত্রসদৃশ, প্রিয়দর্শন মহাবীর লক্ষ্মণকে প্রাপ্ত হইলেন। লক্ষ্মণ নিশিত শরনিকরে অভিমন্যুর বক্ষস্থল ও বাহু দ্বয়ে প্রহার করিলে অভিমন্যু দণ্ডাহত ভুজঙ্গের ন্যায় অতিশয় ক্রোধাবিষ্ট হইয়া আপনার পৌত্র লক্ষ্মণকে কহিলেন, হে লক্ষ্মণ! তোমারে পরলোক গমন করিতে হইবে; এই সময় সুন্দর রূপে ইহলোক সন্দর্শন কর; আমি তোমার বান্ধবগণ সমক্ষেই তোমাকে যমালয়ে প্রেরণ করির। এই বলিয়া তিনি নির্ম্মোকমুক্ত উরগসদৃশ এক ভল্ল নিক্ষেপ করিলেন। উহা নিক্ষিপ্ত হইবামাত্র লক্ষ্মণের নাসাবংশ সুশোভিত, ভ্রূযুগলোপেত, কেশকসাপ ও কুণ্ডলসমলঙ্কৃত মস্তক ছেদন করিল।
ক্রাথপুত্র বধ – কৌরব পলায়ন
সকলে লক্ষ্মণকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া হাহাকার করিতে লাগিল; রাজা দুৰ্য্যোধন উচ্চস্বরে ক্ষত্রিয়গণকে কহিতে লাগিলেন, হে ক্ষত্রিয়গণ! তোমরা অভিমন্যু সংহার কর। অনন্তর দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, কৃতবর্ম্মা ও হার্দ্দিক্য এই ছয় জন রথী অভিমন্যুকে বেষ্টন করিলেন। অভিমন্যু নিশিত শরনিকরে তাঁহাদিগকে বিদ্ধ ও পরাঙ্মুখ করিয়া মহাবেগে সিন্ধুরাজ জয়দ্রথের সৈন্য মধ্যে নিপতিত হইলেন। কলিঙ্গ ও নিষাদগণ এবং মহাবল পরাক্রান্ত ক্রাথপুত্র গজসৈন্য দ্বারা তাঁহার পথ রোধ করিলেন। তখন উভয় পক্ষে ঘোরতর যুদ্ধ হইতে লাগিল। অনন্তর মহাবীর অভিমন্যু দুর্দ্ধর্ষ করিবল ছিন্ন ভিন্ন করিতে লাগিলেন; বোধ হইল যেন, সমীরণ নভোমণ্ডলে জলদজাল ছিন্ন ভিন্ন করিতেছে। পরে ক্রাথপুত্র শরনিকরে অভিমন্যুরে নিবারণ করিলে দ্ৰোণ প্রভৃতি রথী সকল পুনরায় আগমন করিয়া দিব্যাস্ত্র জাল বিস্তার পূর্ব্বক অভিমন্যুর প্রতি ধাবমান হইলেন। অভিমন্যু শরজালে তাঁহাদিগকে নিবারণ করিয়া ক্ৰাথপুত্রকে পীড়িত করিতে লাগিলেন এবং অসংখ্য শরে তাহার ছত্র ও ধ্বজ ছিন্ন এবং সারথি ও অশ্বগণকে বিনষ্ট করিয়া পরিশেষে কুল, শীল, শ্রুত, বীৰ্য্য, কীর্ত্তি ও অস্ত্রবলসম্পন্ন ক্ৰাথপুত্রকে নিহত করিলেন। তদ্দর্শনে অন্যান্য বীরগণ সমরে পরাঙ্মুখপ্রায় হইলেন।