জন্মেজয় জিজ্ঞাসিল যুড়ি দুই কর।
অনন্তর কি হইল কহ মুনিবর।।
মুনি বলে, অবধান কর নৃপমণি।
কচের বিরহে দুঃখে রহে দেবযানী।।
তবে কত দিনে পরে বৃষপর্ব্ব-পুরে।
কন্যাগণ মিলি গেল স্নান করিবারে।।
শর্ম্মিষ্ঠা নামেতে বৃষপর্ব্বার কুমারী।
স্নানেতে চলিল দাসীগণ সঙ্গে করি।।
শুক্রকন্যা দেবযানী চলিল সংহতি।
একত্রে চলিল সবে স্নানেতে যুবতী।।
চৈত্ররথ-নামে বলে আছে সরোবর।
জলক্রীড়া করে সবে তাহার ভিতর।।
নিজ নিজ বস্ত্র সব রাখি তার কূলে।
উন্মত্তা হইয়া সবে ক্রীড়া করে জলে।।
হেনকাল খরতর বহিল পবন।
একত্র করিল যত সবার বসন।।
জলক্রীড়া করিয়া উঠিল কন্যাগণ।
চিনিয়া পরিল সবে আপন বসন।।
শর্ম্মিষ্ঠা দৈত্যের কন্যা উঠি শীঘ্রগতি।
শুক্রজার বস্ত্র পরে হইয়া বিস্মৃতি।।
দেবযানী বলে তোর এত অহঙ্কার।
শূদ্রা হৈয়া বস্ত্র তুই পরিস আমার।।
দেবযানী-বাক্য শুনি শর্ম্মিষ্ঠা কুপিল।
দেবযানী প্রতি চাহি ক্রোধেতে বলিল।।
তোমায় আমায় দেখ অনেক অন্তর।
মোর অন্ন খাইয়া রক্ষা কর কলেবর।।
মোর বাপে তোর বাপ সদা স্তুতি করে।
মোরে হেন বাক্য বল কেন্ অহঙ্কারে।।
অল্প হেন করি তোরে করি যে গণনা।
মোর সঙ্গে দ্বন্দ্ব কর না চিন আপনা।।
বলিতে বলিতে ক্রোধ অধিক বাড়িল।
বলে ধরি কূপে দেবযানীরে ফেলিল।।
তাহারে ফেলিয়া কূপে গেল নিজাগার।
মরিল কি বাঁচিল সে, না দেখিল আর।।
দৈবের নির্ব্বন্ধ কেবা খণ্ডিবারে পারে।
সেই বনে গেল রাজা মৃগ মারিবারে।।
মৃগয়াতে পটু বড় নহুষ-নন্দন।
সসৈন্যে যযাতি রাজা গেল সেই বন।।
তৃষ্ণায় পীড়িত হৈল যযাতি রাজন।
জল অন্বেষণে ভ্রমে সব সৈন্যগণ।।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে দেখে কূপের ভিতর।
পড়িয়াছে কন্যা এক পরম-সুন্দর।।
আস্তে-ব্যস্তে লোক গিয়া জানায় রাজারে।
শুনিয়া নৃপতি তবে এল তথাকারে।।
অতি পুরাতন কূপ আচ্ছন্ন তৃণেতে।
পড়িয়াছে চন্দ্রের সমান কন্যা তাতে।।
রাজা বলে, কন্যা কহ নিজ বিবরণ।
কূপে পড়িয়াছ তুমি কিসের কারণ।।
দ্বিতীয় চন্দ্রের প্রায় ত্রৈলোক্য-মোহিনী।
কি নাম ধরহ তুমি, কাহার নন্দিনী।।
রাজার বচন শুনি বলে দেবযানী।
দেবযানী নাম মোর শুক্রের নন্দিনী।।
আমার বৃত্তান্ত রাজা কহিব পশ্চাতে।
আগে নরপতি মোরে তোল কূপ হৈতে।।
কুলীন পণ্ডিত তুমি দেখি মহাজন।
মহাতেজোবন্ত দেখি রাজার লক্ষণ।।
করে ধরি তোল মোরে না কর বিচার।
বিষম প্রমাদ হৈতে করহ উদ্ধার।।
এত শুনি নৃপতি বলিল আরবার।
তোমার বচন চিত্তে না লয় আমার।।
ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠ শুক্র, তুমি কন্যা তাঁর।
দ্বিতীয় দেখি যে তব যৌবন-সঞ্চার।।
সে কারণে তোমারে ছুঁইতে না যুয়ায়।
কন্যা বলে দোষ রাজা নাহিক তাহায়।।
অন্ধকূপে পড়িয়াছি, মোর প্রাণ যায়।
ত্বরিতে উদ্ধার কর, প্রাণ রাখ তায়।।
এত শুনি নরপতি কন্যার বচনে।
কন্যার দক্ষিণ হস্ত ধরি ততক্ষণে।।
সাবধানে নরপতি উপরে তুলিল।
কন্যা উদ্ধারিয়া রাজা নিজ দেশে গেল।।
হেনকালে ঘূর্ণিকা নামেতে সহচরী।
সম্মুখে দেখিল তারে শুক্রের কুমারী।।
কান্দিয়া কহিল যত দুঃখ আপনার।
পিতারে জানাহ গিয়া মোর সমাচার।।
পুনঃ নগরেতে নাহি করিব গমন।
কোন্ লাজে লোক মাঝে দেখাব বদন।।
চলি যাহ ঘূর্ণিকা গো, কহ পিতৃস্থান।
তাঁহাকে কহিও আমি ত্যজিব পরাণ।।
ত্বরিতে জানাও গিয়া শুক্রে মহামতি।
এত শুনি ঘূর্ণিকা চলিল শীঘ্রগতি।।
শুক্র-স্থানে ঘূর্ণিকা বলিছে সবিনয়।
দেবযানীর বৃত্তান্ত শুন মহাশয়।।
শর্ম্মিষ্ঠা সহিত গেল স্নান করিবারে।
বলেতে শর্ম্মিষ্ঠা কূপে ফেলাইল তাঁরে।।
এত শুনি শুক্র হৈল বিরস-বদন।
দেবযানী দেখিবারে করিল গমন।।
দেখে শুক্র, দেবযানী বনের ভিতরে।
হেঁট মুখে বসি আছে, চক্ষে জল ঝরে।।
বস্ত্র দিয়া দৈত্য-গুরু, মুছায় বদন।
জিজ্ঞাসিল বার্ত্তা কিবা কহ বিবরণ।।
কোন কালে তুমি সে করিয়াছিলে পাপ।
তাহার কারণে তুমি পেলে এত তাপ।।
পাপ নাহি জানি গো যাবত মম জ্ঞান।
কহি যত বিবরণ, কর অবধান।।
বৃষপর্ব্ব-কন্যা মোরে বলেতে ধরিয়া।
ঘরে গেল আমারে সে কূপে ফেলাইয়া।।
শূদ্রী হৈয়া মোর বস্ত্র করিল পিন্ধন।
কতেক কহিব যে করিল পিন্ধন।
কতেক কহিব যে কহিল কুবচন।।
মোর বাপে স্তুতি শুক্র করে অনুব্রতে।
কুটুম্ব সহিত খাও মোর ধন হৈতে।।
পুনঃ পুনঃ কহিলেক যাহা আসে মুখে।
তার বাক্য বজ্র হেন বাজিয়াছে বুকে।।
শুক্র বলে, দেবযানী ত্যজ মনস্তাপ।
ক্রোধে লোক ভ্রষ্ট হয়, ক্রোধে হয় পাপ।।
অক্রোধের সম পুণ্য নাহিক সংসারে।
সর্ব্বধর্ম্মে ধার্ম্মিক যে ক্রোধকে সম্বরে।।
শতেক বৎসর তপ করে যেই জন।
অক্রোধ-সহিত সম নহে কদাচন।।
দেবযানী বলে, পিতা আমি সব জানি।
লাঞ্ছিত করিলা মোরে দৈত্যের নন্দিনী।।
দর্প দংশনে যেন বিষে অঙ্গ দগ্ধয়।
কাষ্ঠে কাষ্ঠে ঘর্ষণে যেমন অগ্নি হয়।।
ততোধিক পিতা মম দহে কলেবর।
না হয় নিবৃত্ত সদা দহিছে অন্তর।।
কন্যার বচন শুনি ভৃগুর নন্দন।
বৃষপর্ব্ব-দৈত্য-স্থানে করিল গমন।।
বৃষপর্ব্বে চাহি শুক্র বলিল বিশেষ।
অন্যত্র যাইব ত্যজি তোমার এ দেশ।।
পাপী দুরাচার যেই হিংসা করে লোকে।
পুণ্যবান্ জন তার নিকটে না থাকে।।
জানিয়া শুনিয়া পাপ করে যেই জন।
অনুরূপ দুঃখ পায়, না যায় খণ্ডন।।
তারে না ফলিলে তার পুত্র-পৌত্রে ফলে।
ব্যর্থ নাহি হয়, কভু বিধি বেদে বলে।।
ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠ বৃহস্পতির নন্দন।
পুনঃ পুনঃ তুই তারে করিলি নিধন।।
মম কন্যা দেবযানী, তোর কন্যা তারে।
নিক্ষেপিল বধিবারে কূপের মাঝারে।।
নারীবধ ব্রহ্মবধ কৈলে বারে-বার।
সহজে অসুর তুই, দুষ্ট দুরাচার।।
থাকিলে পাপীর কাছে নিত্য পাপ বাড়ে।
সে কারণে সাধুজন পাপিসঙ্গ ছাড়ে।।
এত বলি ভৃঙ্গ-সুত চলিল সত্বর।
বাধা দিয়া পায়ে ধরি কহে দৈত্যেশ্বর।।
অধম পাপিষ্ঠ আমি বড় দুরাচার।
আপনার গুণে প্রভু কর প্রতিকার।।
জাতি ধন রাজ্য প্রাণ কুটুম্বাদি করি।
এ সব আমার দ্রব্যে তুমি অধিকারী।।
নিশ্চয় গোসাঞি যদি ছাড়ি যাবে মোরে।
গোষ্ঠীর সহিত আমি পশিব সাগরে।।
শুক্র বলে, তুমি গিয়া প্রবেশ সাগরে।
শরীর ত্যজহ কিম্বা যাও দেশান্তরে।।
প্রাণের সদৃশ হয় আমার কুমারী।
তাহার অপ্রিয় আমি করিবারে নারি।।
প্রবোধ করিতে যদি পার দেবযানী।
তবে ক্ষান্ত হই আমি, শুন দৈত্যমণি।।
এত শুনি দৈত্যরাজ বিনয় করিয়া।
কহে দেবযানীর অগ্রেতে দাঁড়াইয়া।।
হইল কুকর্ম্ম মোর ক্ষম অপরাধ।
সদয় হইয়া মোরে দেহ ত প্রসাদ।।
দেবযানী বলে, রাজা বুঝহ অন্তরে।
তবে সে প্রসন্ন আমি হইব তোমারে।।
শর্ম্মিষ্ঠা তোমার কন্যা বড়ই দুর্ভাষী।
সহচরী সহ মোর করি দেহ দাসী।।
এত শুনি দৈত্যরাজ হৈল অঙ্গীকার।
এখনি আনিয়া অগ্রে দিব গো তোমার।।
এত বলি ধাত্রী পাঠাইল অন্তঃপুরে।
শর্ম্মিষ্ঠারে বার্ত্তা ধাত্রী কহিল সত্বরে।।
ক্রোধ করি যায় শুক্র নগর ত্যজিয়া।
সে কারণে রাজা মোরে দিল পাঠাইয়া।।
না মানে প্রবোধ কারো ভৃগুর নন্দন।
কেবল তাঁহার ক্রোধ তোমার কারণ।।
অতএব শীঘ্র তুমি যাহ তথাকারে।
তোমাকে লইতে রাজা পাঠাইল মোরে।।
কন্যা বলে, যাহে হৈবে জ্ঞাতির কুশল।
প্রবোধিয়া শুক্রাচার্য্যে করিব নিশ্চল।।
এত বলি যার কন্যা ধাত্রীর সংহতি।
যথায় আছেন পিতা দৈত্য-অধিপতি।।
সহস্রেক দাসী সঙ্গে চড়ি চতুর্দ্দোলে।
পিতার সম্মুখে গিয়া দাণ্ডাইল তলে।।
বৃষপর্ব্ব বলে, কন্যা দৈবের লিখনে।
দেবযানী কাছে তুমি থাক দাসীপণে।।
শর্ম্মিষ্ঠা বলেন, পিতা যে আজ্ঞা তোমার।
হইলাম দাসী আমি কর্ম্মে আপনার।।
এত শুনি উত্তর করিল দেবযানী।
কিমতে হইবা দাসী তুমি ঠাকুরাণী।।
তোর বাপে মোর বাপ সদা স্তুতি করে।
তোর অন্নেতে যে বাড়িয়াছি কলেবরে।।
হেন জন তুমি দাসী হেইবে কেমনে।
শুনিয়া উত্তর কন্যা দিল ততক্ষণে।।
জ্ঞাতির কুশল আর পিতার বচন।
দুই ধর্ম্ম রাখিতে করিনু দাসীপণ।।
ইহাতে আমার লজ্জা তিলেক নহিবে।
তথাচ রাজার কন্যা সবাই বলিবে।।
পরে শুক্র দেবযানী গেল নিজ ঘর।
সঙ্গেতে শর্ম্মিষ্ঠা গেল সহ পরিচর।।
আদিপর্ব্বে হয় দেবযানীর আখ্যান।
কাশীদাস বলে সব অমৃত-সমান।।