৪৫তম অধ্যায়
অর্জ্জুনের কামকলাশিক্ষার্থ ইন্দ্রের উর্ব্বশী নিয়োগ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, অর্জ্জুনের মন উর্ব্বশীতে আসক্ত হইয়াছে বিবেচনা করিয়া দেবরাজ ইন্দ্ৰ প্ৰথমতঃ চিত্ৰসেনকে নির্জ্জনে আহ্বান করিয়া কহিলেন, “হে গন্ধর্ব্বরাজ! অদ্য তুমি অন্সরোবরা উর্ব্বশীর নিকট গমন কর এবং সে এখানে আসিয়া যেন ফাল্গুনির মনোরথ সফল করে, ইহাও আদেশ করিবে। তুমি যেমন আমার নিয়োগতন্ত্র হইয়া সৎকারপূর্ব্বক পার্থকে অস্ত্ৰ-শিক্ষা প্ৰদান করিয়াছ, তদ্রূপ তাহাকে রমণীজনের হাবভাবাদি-পরিচয়ে সুনিপুণ করিয়া দাও।” গন্ধর্ব্বরাজ ইন্দ্রের আজ্ঞা পাইবামাত্ৰ ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া উর্ব্বশীর নিকট গমনপূর্ব্বক তাহাকে নেত্রগোচর করিয়া পরমপ্রীত হইলেন এবং স্বাগতপ্রশ্নপূর্ব্বক তৎকর্ত্তৃক পূজিত ও সুখাসীন হইয়া সহাস্যবদনে কহিলেন, “হে নিবিড়নিতস্বিনি! ত্ৰিদশাধিপতি যে নিমিত্ত আমাকে তোমার নিকট প্রেরণ করিয়াছেন, বোধ হয়, তুমি তাহা বুঝিয়া থাকিবে। যিনি নৈসৰ্গিক গুণসমূহদ্বারা দেবলোক ও মনুষ্যলোকে মহতী খ্যাতিলাভ করিয়াছেন; যিনি অনুপম রূপলাবণ্য, মহীয়সী, সুশীলতা, অবিচলিত ব্ৰতানুষ্ঠান, অসাধারণ ইন্দ্ৰিয়সংযম, অলোকসামান্য বলবীৰ্য্য, মহতী তেজস্বিতা, বীতমৎসরতা ও ক্ষমাগুণে সর্ব্বত্র সুবিখ্যাত হইয়াছেন; যিনি বেদ, বেদাঙ্গ ও উপনিষদ অধ্যয়ন করিয়া কৃতবিদ্য হইয়াছেন; যিনি অকৃত্রিম ভক্তিসহকারে গুরুজনের শুশ্রূষা করিয়া থাকেন; যাঁহার অষ্টগুণাত্মিক মেধা স্বাভাবিকী; যিনি ব্রহ্মচৰ্য্য, অনালস্য, পিতৃ-মাতৃকুল-তৰ্পণ ও অভিজ্ঞতাদ্বারা ত্ৰিদিবরক্ষক ইন্দ্রের ন্যায় সকলের রক্ষণাবেক্ষণ করিয়া থাকেন; যিনি কদাপি আত্মশ্লাঘা করেন না; যিনি লোকের সম্মানরক্ষায় অগ্রগণ্য, অতিসূক্ষ্ম অৰ্থসকল স্থূলার্থের ন্যায় যিনি অনায়াসে বুঝিতে পারেন এবং বিবিধ অন্নপানদ্বারা সুহৃদ্বর্গের ভরণপোষণ করিয়া থাকেন; যিনি সত্যবাদী, সদ্বক্তা, স্থিরপ্রতিজ্ঞ, সকলের পূজিত, শরণাগত প্রতিপালক, প্রিয়দর্শন এবং অভিলষণীয় গুণসমূহে মহেন্দ্র ও রুদ্রের সদৃশ, সেই মহাবীর অর্জ্জুন যেন আজি স্বৰ্গফললাভে বঞ্চিত না হয়েন। হে কল্যাণি! অদ্য ধনঞ্জয় ইন্দ্ৰকর্ত্তৃক অনুজ্ঞাত হইয়া যাহাতে তোমার চরণলাভ করিতে পারেন, তাহার উপায়বিধান করা তোমার সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য। ফলতঃ অৰ্জ্জুন তোমার প্রতি সাতিশয় অনুরক্ত হইয়াছেন।”
সর্ব্বলোকলালামভূতা উর্ব্বশী গন্ধর্ব্বরাজকর্ত্তৃক এইরূপে অভিহিত হইয়া যথোচিত সম্মান প্ৰদৰ্শন ও তদ্বাক্যের বহুমাননাপূর্ব্বক প্রীতিপ্ৰফুল্লমনে সহাস্যবদনে কহিতে লাগিল, “মহাশয়! আপনি অর্জ্জুনের যে-সকল গুণ কীর্ত্তন করিলেন, তৎসমুদয়ই সত্য; আমি লোকমুখে অর্জ্জুনের গুণানুবাদ শ্রবণ করিয়া বিষম কমশরে ব্যথিত হইয়াছি; অতএব বরণ করিব কি, আমি গুণশ্রবণমাত্রে অগ্ৰেই মনে মনে তাহাকে বরণ করিয়াছি। অধুনা সুরনাথের আদেশে, আপনার প্রার্থনায় এবং ফাল্গুনির গুণদামে আকৃষ্ট হইয়া সাতিশয় অধৈৰ্য্য হইয়াছি; আপনি-এক্ষণে স্বেচ্ছাক্রমে স্বস্থানে প্রস্থান করুন, আমি অর্জ্জুনের নিকট গমন করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই।”