৪৫তম অধ্যায়
অভিমন্যু কর্ত্তৃক শল্যপুত্র রুক্মরথ বিনাশ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে রাজন! যেমন প্রলয়কাল উপস্থিত হইলে কৃতান্ত সমস্ত ভূতের প্রাণ সংহার করিয়া থাকেন, তদ্রূপ সুররাজ সমবিক্রম অভিমন্যু বীরগণকে বিনষ্ট করিতে লাগিলেন এবং সৈন্য সকল আলোড়িত করিয়া অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিলেন। পরে যেমন সমুদ্ধত শার্দ্দল মৃগকে গ্রহণ করে, তদ্রূপ তিনি সৈন্য মধ্যে প্রবেশ করিয়া সত্যশ্রবাকে গ্রহণ করিলেন; অনন্তর তাঁহাকে আকর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলে মহারথগণ বিবিধ অস্ত্র গ্রহণ পূর্ব্বক সত্বরে অভিমন্যুর প্রতি ধাবমান
হইলেন এবং আমিই সর্ব্বাগ্রে, আমিই সর্ব্বাগ্রে এই বলিয়া স্পর্ধা পূর্ব্বক অভিমন্যু বিনাশের অভিলাষে গমন করিতে লাগিলেন। যেমন সাগর মধ্যে তিমি ক্ষুদ্র মৎস্যদিগকে গ্রাস করিয়া থাকে, তদ্রূপ অভিমন্যু ধাবমান ক্ষত্রিয় সৈন্যগণকে সংহার করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। যেমন নদী সকল সমুদ্র হইতে প্রতিনিবৃত্ত হয় না, তদ্রূপ সমরে অপরাঙ্মুখ অভিমন্যুর সন্নিহিত সৈন্যগণ আর প্রতিনিবৃত্ত হইল না। তখন কৌরব সেনা মহাগ্ৰাহ গৃহীতের ন্যায়, বায়ুবেগ ক্ষুভিত ঘূর্ণায়মান সাগরস্থিত নৌকার ন্যায় নিতান্ত ভয়বিহবল হইয়া কম্পিত হইতে লাগিল।
অনন্তর মহাবল পরাক্রান্ত নির্ভীক মদ্রেশ্বরতনয় রুক্মরথ, সন্ত্রস্ত সৈন্যদিগকে আশ্বস্ত করিয়া কহিলেন, হে সৈন্যগণ! তোমরা ভীত হইও না; আমি জীবিত থাকিতে অভিমন্যু কি করিবে? আমি উহাকে জীবন্ত গ্রহণ করিব, তাহার সন্দেহ নাই। তিনি এই বলিয়া সুসজ্জিত রথে আরোহণ পূর্ব্বক অভিমন্যুর প্রতি ধাবমান হইলেন এবং তিন বাণে তাঁহার বক্ষ স্থল, তিন বাণে দক্ষিণ বাহু ও তিন বাণে বাম বাহু বিদ্ধ করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। অভিমন্যু তৎক্ষণাৎ তাঁহার শরাসন, বাহু যুগল এবং সুন্দর নয়ন ও সুন্দর ভ্রুসুশোভিত মস্তক ছেদন করিয়া ক্ষিতিতলে নিপাতিত করিলেন। যুদ্ধদুৰ্ম্মদ শল্যতনয় রুক্মরথের প্রিয়বয়স্য সুবর্ণখচিত ধ্বজশালী রাজকুমারগণ তাঁহাকে বিনষ্ট দেখিয়া তালপ্রমাণ কার্ম্মুক আকর্ষণ ও শর-বর্ষণপূর্ব্বক অভিমন্যুকে চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিলেন। শিক্ষাবলসম্পন্ন তরুণবয়স্ক একান্ত অমর্ষণস্বভাব বীরগণ শরনিকরে অভিমন্যুকে সমাচ্ছন্ন করিয়াছেন দেখিয়া দুর্য্যোধন সাতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন এবং অভিমন্যু শমনসদনে গমন করিয়াছেন বোধ করিলেন। রাজকুমারগণ নানা লক্ষ্মণ লাঞ্ছিত সুবর্ণপুঙ্খ শরজালে নিমেষমধ্যে অভিমন্যুকে দৃষ্টিপথের অতীত করিলেন। আমরা রথ, ধ্বজদণ্ড, তাঁহার সারথি ও তাঁহারে শলভসমাচ্ছন্নের ন্যায় নিরীক্ষণ করিতে লাগিলাম। তখন অভিমন্যু তোদনদণ্ডপীড়িত মাতঙ্গের ন্যায় গাঢ়বিদ্ধ ও নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া গান্ধর্ব্ব অস্ত্র গ্রহণ করিয়া মায়াজাল বিস্তার করিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন তপোনুষ্ঠান পূর্ব্বক তুম্বুরুপ্রমুখ গন্ধৰ্ব্ব হইতে ঐ অস্ত্র প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। উহা পরিত্যাগ করিবামাত্র বিপক্ষেরা বিমোহিত হইল। অভিমন্যু ক্ষিপ্র হস্তে গান্ধৰ্ব্ব অস্ত্র পরিত্যাগ পূর্ব্বক অলাতচক্রের ন্যায় কখন এক, কখন শত, কখন বা সহস্র প্রকার নিরীক্ষিত হইতে লাগিলেন। পরে তিনি রথ চালন ও অস্ত্র মায়া দ্বারা মহীপালগণকে বিমোহিত করিয়া তাঁহাদের কলেবর শতধা খণ্ড খণ্ড করিলেন। জীবগণের জীবন নিশিত শরনিকরে নির্গত হইয়া পরলোকে গমন করিল এবং দেহ পৃথিবীতে নিপতিত রহিল। অনন্তর অভিমন্যু নিশিত ভল্লে কতকগুলি রাজপুত্রের কাৰ্ম্মুক, অশ্ব, সারথি, ধ্বজ, অঙ্গদ সমলঙ্কৃত বাহু ও মস্তক সকল ছেদন করিলেন। যেমন পঞ্চবর্ষীয়, ফলসম্পন্ন, আম্র কানন ভগ্ন হইয়া পতিত হয়, তদ্রূপ এক শত রাজপুত্র অভিমন্যু শরে নিহত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন। তখন ক্রুদ্ধ আশীবিষ সঙ্কাশ, সুখোচিত, রাজকুমারগণকে এক মাত্র অভিমন্যু কর্ত্তৃক নিহত নিরীক্ষণ করিয়া মহারাজ দুর্য্যোধনের অন্তঃকরণে ভয় সঞ্চার হইল এবং তাঁহাকে রথী, কুঞ্জর, অশ্ব ও পদাতি সকল বিমর্দ্দিত করিতে দেখিয়া রোষাবিষ্ট চিত্তে সত্বরে তাঁহার সন্নিধানে গমন করিলেন। উভয়ের অসম্পূর্ণ সংগ্রাম ক্ষণকালের নিমিত্ত তুমুল হইয়া উঠিল। অনন্তর রাজা দুৰ্য্যোধন শরজালে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া সমরে পরাঙ্মুখ হইলেন।”