পুষ্করের সহ পাশা খেলে রাজা নল।
একে একে রাজ্য ধন হারিল সকল।।
বসন ভূষণ আর রত্ন অলঙ্কার।
সকল হারিল রাজা, কিছু নাহি আর।।
হাসিয়া পুষ্কর তবে বলিল বচন।
দেখিব কি আছে আর, শীঘ্র কর পণ।।
অবশেষে তব কিছু নাহি দেখি আর।
রাণী দময়ন্তী পণ করহ এবার।।
এত শুনি নল ক্রোধে আরক্তিম নেত্র।
পুষ্করের বাক্য যেন পৃষ্ঠে মারে বেত্র।।
তবে রাজা বস্ত্র রত্ন যা ছিল শরীরে।
বাহির করিয়া সব দিলেন পুষ্করে।।
একবস্ত্র পরিধানে বাহির হইল।
অন্তঃপুরে থাকি সব বৈদর্ভী শুনিল।।
অঙ্গের ভূষণ যত ফেলিল খুলিয়া।
চলিল রাজার সহ একবস্ত্রা হৈয়া।।
আজ্ঞা দিল পুষ্কর আপন অনুচরে।
এই কথা জ্ঞাত কর নগরে নগরে।।
নল নৃপেরে যে জন দিবেক আশ্রয়।
সবংমে সংহার আমি করিব তাহায়।।
আজ্ঞামাত্র রাজ্যে রাজ্যে জানাইল চর।
রাজাজ্ঞা শুনিয়া সবে হৃদে পায় ডর।।
তিন দিন নল নৃপ নগরে রহিল।
দণ্ড ভয়ে কেহ তাঁরে আশ্রয় না দিল।।
কেহ না জ্ঞিজ্ঞাসে, কেহ না যায় নিকটে।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় নল গেল নদীতটে।।
তিন রাত্রি দিনান্তরে করি জলপান।
তারপর বনমধ্যে করিল প্রয়াণ।।
পাছু পাছু দময়ন্তী করিল গমন।
অরণ্যের মধ্যে প্রবেশিল দুই জন।।
বহুদিন ক্ষুধা তৃষ্ণা শরীর পীড়িত।
বনমধ্যে স্বর্ণপক্ষী দেখে আচম্বিত।।
পক্ষী দেখি আনন্দেতে ভাবিল রাজন।
মাংস ভক্ষি পক্ষ বেচি পাব বহুধন।।
ধরিবার উপায় চিন্তিলেন মনে মন।
পক্ষীর উপর ফেলে পিন্ধন বসন।।
বস্ত্র লয়ে উড়িল মায়াবী বিহঙ্গম।
আকাশে উড়িয়া বলে, আর মতিভ্রম।।
সর্ব্বনাশ কৈনু অক্ষে ভ্রষ্ট করি জ্ঞান।
আমি কলি দ্বাপর বলিয়া এবে জান।।
আমা সবা এড়ি ভৈমী বরিল তোমারে।
তাহার উচিত ফল দিলাম তোমারে।।
এত শুনি নরপতি ভৈমী প্রতি বলে।
যতেক কহিল পক্ষী শ্রবণে শুনিলে।।
অক্ষে যেই হারাইল, সেই বস্ত্র নিল।
নিশ্চয় আমার প্রিয়ে জ্ঞান হত হৈল।।
এখন যে বলি শুন তাহার কারণে।
এই যে যাইতে পথ দেখহ দক্ষিণে।।
অবন্তী-নগরে লোক যায় এই পথে।
এই যে দেখহ পথ কোশল যাইতে।।
এই পথে যাই প্রিয়ে বিদর্ভ নগর।
শুনিয়া হৈল ভৈমী কম্পিত অন্তর।।
রোদন করিয়া ভৈমী কহে রাজা প্রতি।
তব বাক্য শুনি মোর স্থির নহে মতি।।
রাজ্যনাশ বনবাস বিবস্ত্র হইলে।
মহা দুঃখার্ণবেতে নিমর্জ্জিত হইলে।।
সব পাসরিবে আমি থাকিলে সংহতি।
আমারে ত্যজিতে কেন চাহ নরপতি।।
ভার্য্যার বিহনে রাজা নাহি সুখলেশ।
আমারে ত্যজিলে বনে পাবে বহু ক্লেশ।।
নল বলে, সত্য তুমি যতেক কহিলে।
ভার্য্যা সম মিত্র আর নাহি ক্ষিতিতলে।।
ত্যজিবারে পারি আমি আপন জীবন।
তোমা ত্যাগ না করিব আমি কদাচন।।
ভৈমী বলে, মোরে যদি ত্যাগ না করিবে।
বিদর্ভের পথ কেন দেখাইয়া দিবে।।
এই হেতু, শঙ্কা মম হতেছে রাজন।
তোমা ছাড়ি গেলে মোর নিশ্চয় মরণ।।
এক বাক্য বলি রাজা, যদি লয় মনে।
বিদর্ভ নগরে চল যাই দুই জনে।।
তোমারে দেখিলে পিতা হবে হরষিত।
দেবতুল্য তোমারে পূজিবে নিত্য নিত্য।।
নল বলে, নহে দেবি যাবার সময়।
এ বেশে কুটুম্বগৃহে উচিত না হয়।।
আপনি জানহ তুমি স্বয়ম্বর কালে।
তব পিতৃগৃহে গেনু চতুরঙ্গ দলে।।
এখন এ বেশে গেলে হাসিবেক লোক।
বৈরীর হইবে হর্ষ, সুহৃদের শোক।।
পরম বন্ধুর গৃহে যায় যদি দীন।
মহাগুণী হইলেও হয় মানহীন।।
অনাহারে থাকি তপ করিব কাননে।
দুঃখী হয়ে বন্ধুগৃহে, না যাব কখনে।।
তবে পুনঃ পুনঃ ভৈমী যতেক কহিল।
না শুনিল সে নল সঙ্কল্প না টালিল।।
যেই বস্ত্র ছিল ভৈমী করিয়া পিন্ধন।
সেই বস্তই পিন্ধন কৈল দুই জন।।
ছাড়িয়া যাবেন স্বামী ভয় করি মনে।
এক বস্ত্র বৈদর্ভী পরিল সে কারণে।।
বেগেতে চলিতে নারে, যায় ধীরে ধীরে।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ভ্রমে দুর্ব্বল শরীরে।।
দিব্য এক স্থান রাজা হেরিল কাননে।
শ্রান্ত হইয়া তথা শুইল দুই জনে।।
বাহু বন্ধনে ভৈমী ধরি রহে রাজারে।
পাছে স্বামী যায় ছাড়ি, সভয় অন্তরে।।
একে সুকুমারী, বহুদিন নিরাহারা।
শোবামাত্র দময়ন্তী হৈল জ্ঞানহারা।।
দুঃখে সন্তাপিত নল, নিদ্রা নাহি যায়।
মনে বিচারিল, যে বৈদর্ভী নিদ্রা যায়।।
এ ঘোর অরণ্যে ভৈমী সঙ্গে যদি থাকে।
মম দুঃখ দেখি, নিত্য মজিবেক শোকে।।
আমারে না দেখি কোন পথিক সংহতি।
ক্রমে ক্রমে যাইবেক পিতার বসতি।।
এ দুঃখ সমুদ্র হৈতে হইবে মোচন।
আমিহ একক হৈলে যাব যথা মন।।
একাকী রাখিয়া যাব, ঘোর বনস্থল।
সেই ভয় নাহি, কেহ করিবে না বল।।
তপস্বিনী পতিব্রতা, ভকতি আমাতে।
এরে কে করিবে বল নাহি ত্রিজগতে।।
কলিতে আচ্ছন্ন রাজা, হত নিজ জ্ঞান।
দময়ন্তী ত্যজিবারে করে অনুমান।।
এক বস্ত্র আচ্ছাদন দোঁহাকার গায়।
মনে চিন্তে কি করিব ইহার উপায়।।
পাছে জাগে দময়ন্তী চিন্তিত রাজন।
ভাবিত হইল বড় কি করি এখন।।
কেমনে ত্যজিব আমি এক বস্ত্র পরা।
শরীরে আছিল কলি দুষ্ট খরতরা।।
জানিয়া রাজার মন হৈল খড়্গরূপ।
সম্মূখে হেরিয়া খড়্গ হরষিত ভূপ।।
অস্ত্র লয়ে অর্দ্ধবাস ছেদন করিল।
মায়াতে মোহিত রাজা আকুল হইল।।
ধীরে ধীরে তথা হৈতে গমন করিল।
কতদূর হতে তবে বাহুড়ি আইল।।
দেখিল বৈদভী নিদ্রা যায় অচেতন।
ব্যাকুল হইয়া রাজা করয়ে ক্রন্দন।।
সিংহ ব্যাঘ্র লক্ষ লক্ষ এ ঘোর কাননে।
কি গতি হইবে প্রিয়া আমার বিহনে।।
হে সূর্য্য পবন চন্দ্র বনের দেবতা।
তোমা সবে রক্ষা কর আমার বনিতা।।
এত বলি নরপতি গমন করিল।
পুনঃ কতদূর হৈতে ফিরিয়া আইল।।
কলিতে আচ্ছন্ন রাজা দুই দিক মন।
ভার্য্যা স্নেহ ছাড়িতে না পারে কদাচন।।
দময়ন্তী দুঃখে দুঃখী কহিছে অন্তরে।
অনাথা করিয়া প্রিয়ে যাই যে তোমারে।।
পুনরপি বিধি যদি করায় ঘটন।
দেখিব তোমারে নহে শেষ দরশন।।
এত চিন্তি নরপতি আকুল হৃদয়।
পাছে দময়ন্তী জাগে পুনঃ হৈল ভয়।।
অতিবেগে চলিয়া যাইল সেইক্ষণ।
প্রবেশ করিল গিয়া নির্জ্জন কানন।।