৪৪তম অধ্যায়
ত্যাজাগ্রাহ্যবিষয়ক বিধি
“হে মহারাজ! শোক, ক্ৰোধ, সন্তাপ, লোভ, কাম, মান, নিদ্রাপরায়ণতা, ঈৰ্ষা, মোহ, বিধিৎসা, কৃপা, অসূয়া ও জুগুপ্সা—এই দ্বাদশটি মহাদোষ ও প্রাণনাশক। এইসকল দোষ প্রত্যেক মনুষ্যকে আশ্রয় করিয়া থাকে; মূঢ়মুব্ধি মনুষ্য ইহাদ্বারা আক্রান্ত হইয়া পাপকর্মের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়। স্পৃহারান, উগ্ৰস্বভাব, পুরুষবাক, বহুভাষী, ক্রোধাপরবশ ও আত্মশ্লাঘানিরত-এই ছয়জন নৃশংস; ইহারা অর্থলাভ করিয়া অন্যের অবমাননা করিয়া থাকে। যে ব্যক্তি স্ত্রীসংসর্গ পুরুষাৰ্থ বোধ করিয়া দুর্ব্যবস্থিত হয়, যে ব্যক্তি অতি মানী, যে ব্যক্তি কৃপণ, যে ব্যক্তি হীনবীৰ্য্য, যে ব্যক্তি আত্মপ্রশংসানিরত, যে ব্যক্তি বনিতাদ্বেষী এবং যে ব্যক্তি দান করিয়া আত্মশ্লাঘা করে– এই সাতজনাপাপশীল ও নৃশংস। ধর্ম্ম, সত্য, তপঃ, দম, আমাৎসৰ্য্য, লজ্জা, তিতিক্ষা, অনসূয়া, দান, শাস্ত্র, ধৈৰ্য্য ও ক্ষমা—এই দ্বাদশটি ব্রাহ্মণের মহাব্ৰত বলিয়া অভিহিত হয়। যিনি এই দ্বাদশটি ব্রত পালন করেন, তিনি এই পৃথিবী শাসন করিতে সমর্থ হয়েন। যিনি এই দ্বাদশটি ব্রতের তিন, দুই অথবা একটিমাত্র ব্রত সাধন করেন, সামান্য ধনে তাঁহার আর আদর থাকে না। ত্যাগ, দম ও অপ্রমাদে মুক্তি অবস্থান করিতেছে। এই তিনটি মনীষী ব্ৰাহ্মণগণের নিতান্ত শ্রেয়স্কর।
“ব্রাহ্মণের প্রকৃত বা আরোপিত দোষ কীর্ত্তন করা সাতিশয় অপ্রশস্ত; তদ্বিষয়ে প্রবৃত্ত হইলে অবশ্যই নিরয়গামী হইতে হয়। পরদারপরায়ণতা, ধর্মের বিঘ্নাচরণ, গুণে দোষারোপ, মিথ্যাবাক্য, কাম, ক্ৰোধ, পরদোষকীর্ত্তন, মদ্যাদির বশবর্ত্তিতা, ক্রুরতা, অর্থহানি, বিবাদ, মাৎসৰ্য্য, প্রাণীপীড়ন, ঈৰ্ষা, অহঙ্কারদ্যোতক হর্ষ, প্রতিবাদ, অজ্ঞানতা ও নিরন্তর পরানিষ্টচিন্তা এই অষ্টাদশ মদদোষ; ইহা নিতান্ত নিন্দিত; অতএব প্রাজ্ঞব্যক্তি পরমযত্নসহকারে এইসকল দোষ পরিত্যাগ করিবেন। সৌহৃদ্যে ছয়টি গুণ বিদ্যমান আছে;-প্রিয় উপস্থিত হইলে হর্ষ ও অপ্রিয় উপস্থিত হইলে দুঃখের উদ্রেক; কোন ব্যক্তি শুদ্ধভাবসম্পন্ন দাতার নিকট আচাৰ্য্য, পুত্র, কলাত্র ও বিভবাদি প্রার্থনা করিলে তৎক্ষণাৎ তাহা প্ৰদান করা; যাহাকে সর্ব্বস্ব প্রদান করিবে, আমি এ ব্যক্তির উপকার করিয়াছি মনে করিয়া তাঁহার আবাসে কদাচ বাস না করা; সৎকর্ম্মজিত অর্থ উপভোগ এবং মিত্রের হিতসাধনাৰ্থ আপনার মঙ্গলজনক কাৰ্য্যেরও ব্যাঘাত করা।
“যিনি এইরূপ গুণবান, দ্রব্যবান [ধনবান-বিত্তশালী], দাতা ও সত্ত্বগুণসম্পন্ন হয়েন, তিনি শব্দাদি পঞ্চবিষয় [রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস, স্পর্শ], হইতে পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে নিবৃত্ত করিয়া থাকেন; ইহাই সম্পূর্ণ তপঃ, ইহাতেই সদগতিলাভ হয়। ধৈৰ্য্যচ্যুত ব্যক্তিরা ‘দিব্য সুখসম্ভোগ করিব’, এই সঙ্কল্পে সমাহিত তপঃপ্রভাবে উত্তম গতিপ্রাপ্ত হইয়া থাকে। সত্যের অবধারণপ্রযুক্ত সঙ্কল্প হইতে যজ্ঞ প্রবর্ত্তিত হয়। কেহ মনঃ, কেহ বাক্য, কেহ বা কর্ম্মদ্বারা যজ্ঞানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়েন। কিন্তু পরমাত্মা সত্যসঙ্কল্প পুরুষের উপরও আধিপত্য করিয়া থাকেন।
“হে মহারাজ! এক্ষণে ব্ৰাহ্মণের কতকগুলি বিশেষ ধর্ম্ম কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। ব্রাহ্মণেরা অধ্যাপনায় নিযুক্ত থাকিবেন, ইহা তাঁহাদিগের একান্ত যশস্কর; কবিগণ ইহা ভিন্ন অন্য অশাস্ত্র বাক্যকে বিকার বলিয়া থাকেন। সমুদয় বিষয়ই যোগের অধীন; যাঁহারা ঐ যোগ সম্যক জ্ঞাত হইয়াছেন, তাঁহারা অনায়াসে মুক্তিলাভ করেন। উত্তমরূপ অনুষ্ঠিত কর্ম্মপ্রভাবে ব্ৰহ্মলাভ হয় না। অবিদ্বান পুরুষ যাগ ও হোমাত্মক কৰ্মদ্বারা মোক্ষলাভ করিতে পারে না এবং অন্তকালে আনন্দলাভ করিতেও সমর্থ হয় না। তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বনপূর্ব্বক ব্রহ্মোপাসনা করিবে; মন [বিধয়াসক্ত মন] দ্বারা তাঁহার অনুসন্ধান করা অবিধেয়। ব্রাহ্মণগণ স্তুতিবাদে প্রীতি ও নিন্দায় ক্ৰোধ পরিত্যাগ করিবেন। বেদচতুষ্টয় আনুপূর্ব্বিক অনুশীলন করিলে ইহলোকেই ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার ও তাদাত্ম্যলাভ হইয়া থাকে।”