ত্রিচত্বারিংশ অধ্যায়
পরীক্ষিতের তক্ষকদংশন
তক্ষক কহিলেন, “হে কাশ্যপ! যদি আমি কোন বস্তু দংশন করিলে তুমি চিকিৎসা দ্বারা তাহাকে রক্ষা করিতে পার, তবে সম্মুখস্থ এই বটবৃক্ষে দংশন করিতেছি, তুমি ইহাকে রক্ষা করিয়া আপনার মন্ত্রপ্রভাব দেখাও।” কাশ্যপ কহিলেন, “হে ভুজগেন্দ্র! তুমি দংশন কর, আমি এই মুহূর্ত্তে ইহাকে পুনর্জ্জীবিত করিতেছি।” ভুজঙ্গেশ্বর রক্ষক মহাত্মা কাশ্যপের এই বাক্য শ্রবণ করিয়া সম্মুখস্থ সেই বটবৃক্ষে দংশন করিলেন। বটবৃক্ষ তক্ষকের তীব্র বিষানলে মূল অবধি পল্লবাগ্র পর্য্যন্ত প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল এবং ক্ষণকালমধ্যে ভস্মসাৎ হইয়া গেল। তখন তক্ষক কাশ্যপ মুনিকে কহিলেন, “হে দ্বিজোত্তম! এই বৃক্ষকে পুনর্জ্জীবিত করিতে যত্নবান্ হও।” মহর্ষি কাশ্যপ তক্ষকের বাক্য শ্রবণ করিয়া সেই ভস্মীভূত বৃক্ষের ভস্মরাশি গ্রহণপূর্ব্বক তক্ষককে কহিলেন, “হে ভুজগেন্দ্র! আমার বিদ্যাবল দেখ, আমি তোমার সমক্ষেই এই ভস্মীভূত বনস্পতিকে পুনর্জ্জীবিত করিতেছি।” অনন্তর দ্বিজসত্তম কাশ্যপ স্বীয় বিদ্যাপ্রভাবে সেই ভস্মীকৃত ন্যগ্রোধ পাদপকে পুনর্জ্জীবিত করিলেন। প্রথমে অঙ্কুর, তৎপরে পত্রদ্বয়, তদনন্তর পত্রসমূহ, পরিশেষে শাখা-প্রশাখা প্রভৃতি সমুদয় অংশ সুচারুরূপে প্রস্তুত হইল।
এইরূপে মহর্ষি কাশ্যপের মন্ত্রবলে ঐ বটবৃক্ষ পুনর্জ্জীবিত হইল দেখিয়া তক্ষক তাঁহাকে কহিলেন, “হে ব্রহ্মন্! তুমি যে বিদ্যাবলে আমার বা আমার মত অন্য সর্পের বিষক্ষয় করিবে, ইহা বড় আশ্চর্য্যের বিষয় নহে, যেহেতু, ভবাদৃশ মন্ত্রবিশারদ তেজস্বী লোকের কিছুই দুঃসাধ্য নহে। এক্ষণে জিজ্ঞাসা করি, তুমি কি নিমিত্ত তথায় গমন করিতেছ? তুমি যে বস্তুর লাভাকাঙ্ক্ষায় সেই নৃপের নিকট যাইতেছ, তাহা অতি দুষ্প্রাপ্য হইলেও আমি তোমাকে দিব। ব্রহ্মশাপে রাজার আয়ুঃশেষ হইয়াছে, অতএব তুমি তাঁহার রক্ষণ-বিষয়ে কৃতকার্য্য হইতে পার কি না সন্দেহ। যদি তুমি তাঁহাকে রক্ষা করিতে না পার, তাহা হইলে তোমার ত্রিলোকী-বিশ্রুত যশোরাশি নিস্তেজ দিবাকরের ন্যায় একেবারে অন্তর্হিত হইবে।”
কাশ্যপ তক্ষক-বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে ভুজঙ্গম! আমি ধনার্থী হইয়া তথায় গমন করিতেছি, তুমি আমাকে প্রচুর ধন দাও, তাহা হইলেই আমি নিবৃত্ত হইতেছি।” তক্ষক কহিলেন, “হে দ্বিজোত্তম! তুমি যত ধন আকাঙ্ক্ষা করিয়া রাজার নিকট গমন করিতেছ, আমি তদপেক্ষা অধিক দিতেছি, তুমি নিবৃত্ত হও।” দ্বিজোত্তম কাশ্যপ তক্ষকের বাক্য-শ্রবণানন্তর দিব্যজ্ঞান-প্রভাবে ধ্যান করিয়া দেখিলেন যে, সত্যই রাজা পরীক্ষিতের আয়ুঃশেষ হইয়াছে। তখন তিনি তক্ষকের নিকট হইতে স্বাভিলষিত অর্থ লইয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন।
এইরূপে মহাত্মা কাশ্যপ প্রতিনিবৃত্ত হইলে তক্ষক অবিলম্বে হস্তিনানগরে উপস্থিত হইলেন। গমনসময়ে শুনিলেন, রাজা বিষহর মন্ত্র ও ঔষধ সংগ্রহ করিয়া অতি সাবধানে রহিয়াছেন। তখন তিনি মনে মনে চিন্তা করিলেন যে, রাজাকে মায়াপ্রভাবে বঞ্চিত করিতে হইবে, অতএব এক্ষণে কি উপায় অবলম্বন করা কর্ত্তব্য? তদনন্তর নাগরাজ তক্ষক অন্যান্য সর্পগণকে আদেশ করিলেন, “তোমরা ব্রাহ্মণরূপ ধারণপূর্ব্বক বিশেষ প্রয়োজন আছে’ এই ছল করিয়া অব্যগ্রচিত্তে রাজসমীপে গিয়া ফল, পুষ্প, কুশ ও জল প্রদান দ্বারা তাঁহাকে আর্শীর্ব্বাদ করিবে।” নাগগণ তক্ষক কর্ত্তৃক এইরূপ আদিষ্ট হইয়া ব্রাহ্মণ-বেশ পরিগ্রহণপূর্ব্বক রাজ-সন্নিধানে গমন করিয়া কুশ, জল ও ফল দিয়া রাজাকে আশীর্ব্বাদ করিলে রাজা সেই সমস্ত গ্রহণ করিলেন; পরে কার্য্য সমাধানানন্তর তাঁহাদিগকে বিদায় করিলেন। ছদ্মতাপসরূপী [কৃত্রিম মুনিবেশধারী] ভুজঙ্গমেরা গমন করিলে রাজা অমাত্যগণ ও সুহৃদ্গণকে কহিলেন, “আইস, আমরা সকলে একত্র হইয়া এই সকল তাপসদত্ত সুস্বাদু ফল ভক্ষণ করি। দুর্দ্দৈববশতঃ ভূপতির ফলভোজনে প্রবৃত্তি হইল। যে ফলের মধ্যে তক্ষক গুপ্তভাবে ছিলেন, দৈবনির্ব্বন্ধক্রমে তিনি সেই ফলটিই স্বয়ং ভক্ষণ করিতে লইলেন। ভক্ষণ করিবার সময় ঐ ফল হইতে এক অণু পরিমাণ কৃষ্ণনয়ন তাম্রবর্ণ কীট বহির্গত হইল। রাজা সেই কীট গ্রহণ করিয়া সচিবদিগকে কহিতে লাগিলেন, “সূর্য্যদেব অস্তাচলে গমন করিতেছেন, আজি আর আমার বিষের ভয় নাই। এক্ষণে এই কীট তক্ষক হইয়া আমাকে দংশন করুক। তাহা হইলে শাপেরও মোচন হয় এবং ব্রাহ্মণের বাক্যেও সত্য হয়।” মন্ত্রীরাও কালপ্রযোজিত হইয়া তাঁহার সেই বাক্যে অনুমোদন করিলেন। মরণো রাজার দুর্ব্বুদ্ধি ঘটিল। তিনি সেই কীট স্বীয় গ্রীবায় রাখিয়া হাসিতে লাগিলেন। কীটরূপী তক্ষক নিজ দেহ দ্বারা তৎক্ষণাৎ রাজার গ্রীবাদেশ বেষ্টন করিল। তখন রাজার চৈতন্য হইল, তক্ষক অতিবেগে রাজার গ্রীবাদেশ বেষ্টনপূর্ব্বক ভীষণ গর্জ্জন করিয়া তাঁহাকে দংশন করিল।