দ্বিচত্বারিংশ অধ্যায়
পরীক্ষিৎকে শাপবৃত্তান্তজ্ঞাপন
শৃঙ্গী পিতার তিরস্কার-বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে পিতা! এই শাপ প্রদান করাতে আমার সাহস প্রকাশ করাই হউক বা দুষ্কর্ম্ম করাই হউক এবং ইহাতে আপনি সন্তুষ্টই হউন বা অসন্তুষ্টই হউন, যাহা করিয়াছি, তাহা মিথ্যা হইবার নহে। মহাশয়! আমি আপনাকে যথার্থ কহিতেছি, ইহা কখন অন্যথা হইবে না। আমি পরিহাসচ্ছলেও কখন মিথ্যা কহি না, অতএব মৎপ্রদত্ত শাপ কিরূপে মিথ্যা হইবে?” শমীক কহিলেন, “পুৎত্র! আমি উত্তমরূপে জানি, তুমি সাতিশয় উগ্র-প্রভাবশালী ও সত্যবাদী এবং পূর্ব্বে কখন মিথ্যা কহ নাই; সুতরাং তোমার সেই শাপ কখনই মিথ্যা হইবে না। কিন্তু হে পুৎত্র! পিতা বয়ঃস্থ সন্তানকেও শাসন করিতে পারেন, যেহেতু তদ্দ্বারা ক্রমে ক্রমে পুৎত্রের গুণ ও যশোবৃদ্ধির সম্ভাবনা; তুমি বালক, অতএব তুমি অবশ্যই আমার শাসনার্হ। আমি জানি তুমি সর্ব্বদা তপোনুষ্ঠান করিয়া থাক, তপঃপ্রভাবশালী মহাত্মারা অতিশয় কোপন-স্বভাব হইয়া থাকেন। কিন্তু হে বৎস! তুমি একে ত’ আমার পুৎত্র, বিশেষতঃ বালক, তাহাতে আবার অত্যন্ত সাহসের কার্য্য করিয়াছ, এই সকল ভাবিয়া-চিন্তিয়া আমি তোমাকে ভর্ৎসনা করিলাম। এক্ষণে তোমাকে কিছু উপদেশ দিতেছি, শ্রবণ কর। তুমি শান্তিগুণ অবলম্বন করিয়া বন্য ফল-মূলাদি আহার দ্বারা ক্রমে ক্রমে ক্রোধের উপশম কর, তাহা হইলে শাপদান জন্য তোমার আর ধর্ম্মক্ষয় হইবে না। দেখ, ক্রোধ সংযমী তপস্বিগণের বহুযত্নে সঞ্চিত ধর্ম্মরাশি লোপ করে। ধর্ম্মবিহীন লোকদিগের সদ্গতি লাভ হয় না। শমগুণই ক্ষমাশীল তপস্বিগণের সর্ব্বত্র সিদ্ধিদায়ক। কি ইহলোক, কি পরলোক ক্ষমাবানের সর্ব্বত্রই মঙ্গল। অতএব হে পুৎত্র! তুমি সর্ব্বদাই ক্ষমাশীল ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া কালযাপন কর। ক্ষমাগুণ অবলম্বন করিলে চরমে পরমপদ প্রাপ্ত হইবে। আমি শমপরায়ণ, অতএব এক্ষণে আমার যতদূর সাধ্য, সেই নরপতির উপকার করা কর্ত্তব্য। সম্প্রতি নৃপ-সন্নিধানে এই সংবাদ পাঠাই যে, আমার পুৎত্র বালক ও অতিশয় অপরিণতবুদ্ধি, সে ত্বৎকৃত মদীয় অবমাননা দর্শনে ক্রোধ-পরতন্ত্র হইয়া তোমাকে শাপ প্রদান করিয়াছে।”
দয়াবান্ মহাতপা শমীক ঋষি রাজা পরীক্ষিতের নিকট এই সংবাদ প্রদান করিবার নিমিত্ত শ্রুতশীলবিশিষ্ট [বেদাদি-শাস্ত্রজ্ঞান ও সৎস্বভাবসম্পন্ন] গৌরমুখ নামে শিষ্যকে প্রেরণ করিলেন। তিনি তাঁহাকে কহিয়া দিলেন যে, “তুমি অগ্রে রাজার ও রাজকার্য্যের কুশল জিজ্ঞাসিবে, তৎপরে এই অশুভ সংবাদ দিবে।” গোরমুখ গুরুর আজ্ঞানুসারে অবিলম্বে হস্তিনানগরে উপস্থিত হইয়া অগ্রে দ্বারপাল দ্বারা সংবাদ দিলেন, পরে রাজভবনে প্রবেশ করিলেন। রাজা তাঁহাকে দেখিয়া পরম সমাদরপূর্ব্বক পাদ্য-অর্ঘ্যাদি দ্বারা পূজা করিলেন। গৌরমুখ রাজকৃত সৎকার গ্রহণ ও কিয়ৎক্ষণ শ্রান্তি দূর করিয়া শমীকোপদিষ্ট বাক্য-সকল অবিকল করিতে লাগিলেন। তিনি কহিলেন, “মহারাজ! শান্ত, দান্ত, পরমধার্ম্মিক শমীক নামে এক মহাতপা মহর্ষি আপনার অধিকারে বাস করেন। আপনি শরাসনের অগ্রভাগ দ্বারা সেই মৌনব্রতাবলম্বী মহর্ষির স্কন্ধে এক মৃতসর্প অর্পণ করিয়া আসিয়াছিলেন। শমগুনাবলম্বী মহামুনি শমীক আপনার সেই অপরাধ ক্ষমা করিয়াছিলেন; কিন্তু তদীয় পুৎত্র শৃঙ্গী সাতিশয় উগ্রস্বভাব। তিনি আপনার গর্হিত অনুষ্ঠান দর্শনে ক্রোধে অধীর হইয়া আপনাকে এই অভিসম্পাত করিয়াছেন যে, সপ্তম দিবসে তক্ষক দংশনে আপনার প্রাণবিয়োগ হইবে। শমীক মুনি শাপনিবারণার্থ পুৎত্রকে যথেষ্ট অনুরোধ করিয়াছিলেন, কিন্তু কাহার সাধ্য যে, সে শাপ অন্যথা করে? মহর্ষি কোপান্বিত পুৎত্রকে কোনক্রমে শান্ত করিতে না পারিয়া আপনার হিতার্থে আমাকে এই শাপসংবাদ দিতে পাঠাইলেন।”
রাজা পরীক্ষিৎ গৌরমুখের মুখে এই দারুণ সংবাদ শুনিয়া এবং আপন দুষ্কর্ম্ম স্মরণ করিয়া অত্যন্ত বিষণ্ণ হইলেন। মুনিবর শমীক মৌনব্রতাবলম্বী ছিলেন, এই নিমিত্তই তাঁহাকে প্রত্যুত্তর প্রদান করেন নাই, ইহা শুনিয়া রাজার শোকাগ্নি দ্বিগুণ প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তখন তিনি ভাবিতে লাগিলেন, “শমীক মুনি এমত শান্তস্বভাব যে, তিনি মৎকৃত তাদৃশ অপমান সহ্য করিয়াও দয়া প্রদর্শন করিয়াছেন! হায়! আমি কি কুকর্ম্ম করিয়াছি, সেই পরম-কারুণিক মুনিবরের উপর তদ্রূপ অত্যাচার করা আমার নিতান্ত অন্যায় হইয়াছে।” এই ভাবিয়া রাজার আর পরিতাপের পরিসীমা রহিল না। রাজা বিনাপরাধে সেই মুনিবরের তাদৃশী অবমাননা করিয়াছেন বলিয়া যেরূপ শোকার্ত্ত হইলেন, আপনার মৃত্যুবার্ত্তা শ্রবণে সেরূপ হইলেন না। অনন্তর রাজা গৌরমুখকে এই বলিয়া বিদায় করিলেন যে, মহাশয়! আপনি অনুগ্রহ করিয়া সেই মুনিবরকে এই কথা বলিবেন, যেন তিনি আমার প্রতি সুপ্রসন্ন থাকেন।
রাজা এইরূপে গৌরমুখকে বিদায় করিয়া নিতান্ত উদ্বিগ্নমনে আপন মন্ত্রিগণ সমভিব্যাহারে মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন। মন্ত্রণানন্তর এক একস্তম্ভ-সুরক্ষিত [একটি মাত্র স্তম্ভের উপর সুব্যবস্থায় স্থাপিত] প্রাসাদ নির্ম্মাণ করাইয়া তথায় নানাবিধ ঔষধ, বহুসংখ্যক চিকিৎসক ও মন্ত্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণগণ নিযুক্ত করিলেন এবং সেই প্রাসাদে সুরক্ষিতরূপে অবস্থান করিয়া মন্ত্রিগণ সমভিব্যাহারে রাজকার্য্য সম্পাদন করিতে লাগিলেন। তাঁহার সমীপে কেহই গমন করিতে পারিতেন না। অধিক কি কহিব, সর্ব্বত্রগামী বায়ুরও সে স্থানে সঞ্চার রহিল না।
বিষবিদ্যা-বিশারদ দ্বিজোত্তম কাশ্যপ মুনি শ্রবণ করিয়াছিলেন যে, রাজা পরীক্ষিৎ ভুজঙ্গশ্রেষ্ঠ তক্ষকের দংশনে প্রাণপরিত্যাগ করিবেন। তন্নিমিত্ত তিনি মনে মনে বিবেচনা করিয়াছিলেন যে, তক্ষক রাজাকে দংশন করিলে আমি মন্ত্রৌষধিবলে তাঁহাকে সঞ্জীবিত করিব, তাহা হইলে আমার ধর্ম্ম ও অর্থ উভয়ই লাভ হইবে। পরে নির্দ্ধারিত সপ্তম দিন উপস্থিত হইলে তিনি রাজাকে রক্ষা করিবার বাসনায় একাগ্রচিত্ত হইয়া রাজভবনে গমন করিতেছেন, এমন সময়ে বৃদ্ধ-ব্রাহ্মণবেশধারী নাগরাজ তক্ষক পথিমধ্যে তাঁহাকে দেখিতে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে মুনিবর! তুমি অনন্যমনা হইয়া এত সত্বরগমনে কি অভিপ্রায়ে কোথায় চলিয়াছ?” কাশ্যপ কহিলেন, “অদ্য কুরুকুলোৎপন্ন রাজা পরীক্ষিৎ উরগ-রাজ তক্ষকের বিষানলে দগ্ধ হইবেন শুনিয়া তাঁহাকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত গমন করিতেছি।” তক্ষক কহিলেন, “হে ব্রাহ্মণ! আমিই সেই তক্ষক, আমি অদ্য সেই মহীপালের প্রাণসংহার করিব, তুমি ক্ষান্ত হও, আমি দংশন করিলে তোমার সাধ্য কি যে, তুমি তাঁহাকে রক্ষা কর।” কাশ্যপ কহিলেন, “তুমি দংশন করিলে আমি স্বীয় বিদ্যা-প্রভাবে অবশ্যই তাঁহাকে নির্বিবষ করিব, সন্দেহ নাই।”