০৪২. ইন্দ্ৰলোকাভিগমনপর্ব্বাধ্যায়

৪২তম অধ্যায়

ইন্দ্ৰলোকাভিগমনপর্ব্বাধ্যায়

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজেন্দ্ৰ! লোকপালেরা প্ৰস্থান করিলে শত্রুবিনাশন অর্জ্জুন দেবরাজ-রথের আগমন প্রতীক্ষা করিতেছেন, ইত্যবসরে মাতলি রথ লইয়া তথায় উপস্থিত হইলেন। বায়ুবেগগতি দশসহস্ৰ তুরঙ্গম সেই দৃষ্টিবিলোভন মায়াময় রথ বহন করিতেছে। তাহার প্রচণ্ডবেগে জলদমালা ছিন্নভিন্ন হওয়াতে নভোমণ্ডল নির্ম্মল হইল এবং ঘনঘটার গভীরগর্জ্জনাসদৃশ নির্ঘোষে দিকসকল প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। তন্মধ্যে অসি, শক্তি, গদা, প্রাস, বিদ্যুৎ ও বজ্র প্রভৃতি অন্ত্রশস্ত্ৰসকল এবং মহাকায় জ্বলিতানন অতি ভীষণকায় নাগগণ ও ধবলোপল [শ্বেতপ্রস্তর]-সমূহ দেদীপ্যমান রহিয়াছে দেখিলেন। অনন্তর পার্থ কনকভূষণভূষিত ইন্দীবরশ্যাম বৈজয়ন্তীপতাকা-বিরাজিত রথে উজ্জ্বল সুবর্ণালঙ্কৃত সারথিকে নয়নগোচর করিয়া মনে মনে তাহাকে দেবতা বলিয়া বিতর্ক করিতে লাগিলেন।

অনন্তর মাতলি বিনীতভাবে অর্জ্জুনসমীপে আগমনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে রূপনিধান শক্রাত্মজ! দেবরাজ তোমাকে দেখিতে অভিলাষ করিয়াছেন; অতএব তুমি শীঘ্র তদীয় রথে আরোহণ কর। তোমার পিতা অমররাজ আমাকে আদেশ করিয়াছেন যে, কুন্তীতনয়কে এখানে আনয়ন কর; দেবতারা সকলে তাঁহাকে অবলোকন করিবেন। সম্প্রতি ত্ৰিদশাধিপতি দেব, ঋষি, গন্ধর্ব্ব ও অন্সরাগণে পরিবৃত হইয়া তোমার দিদৃক্ষায় [দর্শন ইচ্ছায়] কালপ্রতীক্ষা করিতেছেন। তুমি তাহার আদেশক্রমে অচিরাৎ ভূলোক পরিত্যাগপূর্ব্বক আমার সমভিব্যাহারে দেবলোকে প্রস্থান কর, তথায় লব্ধান্ত্র হইয়া পুনরায় প্রত্যাগমন করিবে।” অর্জ্জুন কহিলেন, “মাতলে! তুমি রথারোহণপূর্ব্বক ঘোটকসকল সুস্থির করিলে, পশ্চাৎ সুকৃতী ব্যক্তি যেমন সৎপথে আরোহণ করে, তদ্রূপ আমি দেবরথে আরূঢ় হইব। এই অনুত্তম রথ শত শত অশ্বমেধ ও রাজসূয় যজ্ঞেও দুর্লভ; মহাভাগ যাগশীল রাজগণ এবং দেবদানবেরাও ইহাতে আরোহণ করিতে পারেন না। ইহাতে তপোবিবর্জ্জিত জনগণের আরোহণ-প্রত্যাশা দূরে থাকুক, তাহারা এই দিব্যমহারথ দৰ্শন বা স্পর্শ করিতেও সমর্থ হয়েন না।”

ইন্দ্রসারথি মাতলি অর্জ্জুনের এই সকল বাক্য শ্রবণ করিয়া রথারোহণপূর্ব্বক রশ্মিদ্বারা অশ্বসকল সংযত করিলেন। অর্জ্জুন হৃষ্টমনে গঙ্গাস্নান করিয়া পবিত্র হইয়া নিয়মিত জপ সমাপন করিলেন এবং যথাবিধি পিতৃতর্পণ করিয়া শৈলরাজ মন্দরের স্তুতিবাদপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে গিরীন্দ্র! তুমি স্বৰ্গভিলাষী পুণ্যশীল সাধুলোকদিগের আশ্রয়; তোমার প্রসাদে ব্ৰাহ্মণ, বৈশ্য ও ক্ষত্ৰিয়-সকল সুরলোকপ্ৰাপ্ত হইয়া অমরগণ-সমভিব্যাহারে স্বচ্ছন্দে বিহার করিতেছেন। তোমাতে নানা তীৰ্থ বিরাজিত রহিয়াছে। অদ্রিরাজ! আমি তোমার নিকট পরমসুখে বাস করিয়াছিলাম, অধুনা তোমাকে আমন্ত্রণ করিয়া গমন করিতেছি; আমি তোমার সানু, কুঞ্জ, নদী, প্রস্রবণ ও অনেকানেক পুণ্যতীর্থ সন্দর্শন করিয়াছি; ইতস্ততঃ ভ্ৰমণ করিয়া নানাপ্রকার সুগন্ধি সুমধুর ফল ভক্ষণ করিয়াছি; সুধাসোদর [অন্তমিষ্ট-মিষ্টরসময়] তদীয় শরীরবিনিঃসৃত সুগন্ধ প্রস্রবণোদকে পিপাসা শান্তি করিয়াছি; যেমন শিশু-সন্তান পিতার ক্ৰোড়ে সুখে কালব্যাপন করে, তদ্রূপ। আমি তোমার অঙ্কে নিঃশঙ্ক অবস্থিতি করিয়াছি। আমি এতদিন বেদধ্বনিনিনাদিত অন্সরাগণসমাকীর্ণ পরমরমণীয় ত্বদীয় সানুদেশে সুখে বাস করিয়াছিলাম, এক্ষণে বিদায় হই।”

অর্জ্জুন শৈলাধীশের নিকট এইরূপে বিদায় লইয়া ভাস্করের ন্যায় মহারথ উদ্ভাসিত করিয়া। তদুপরি অধিরূঢ় হইলেন। ধীমান কুরুনন্দন সেই সূৰ্য্যসঙ্কাশ দিব্যরথে নীত হইয়া আকাশপথে গমন করিলেন। তিনি ক্ৰমে ক্রমে মর্ত্যলোকদিগের দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইয়া অদ্ভূতরূপ সহস্ৰ সহস্ৰ বিমান সন্দর্শন করিতে লাগিলেন। তথায় সূৰ্য্য, চন্দ্র বা পাবকের আলোক নাই; লোকসকল কেবল স্ব স্ব পুণ্যাজিত প্রভাদ্বারা দীপ্তি পাইতেছেন। যে-সকল তারকামণ্ডল বাস্তবিক বৃহৎ হইলেও বিপ্রকৃষ্টত্বপ্রযুক্ত [দূরত্বনিবন্ধন] দীপের ন্যায় অতীব ক্ষুদ্রতর প্রতীয়মান হইয়া থাকে, তথায় তাহারা স্ব স্ব কক্ষে বিলক্ষণ উজ্জ্বল ও বৃহদাকারসম্পন্ন। যে-সমস্ত মহাবীর সিদ্ধ রাজর্ষিগণ রণস্থলে কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, অর্জ্জুন দেখিলেন যে, তাহারা সকলে নিজ নিজ স্থানে স্বকীয় প্রভাপুঞ্জে প্রদীপ্ত হইয়া রহিয়াছেন। সূৰ্য্যের ন্যায় তেজস্বী সহস্ৰ সহস্ৰ গন্ধর্ব্ব তপোবলে স্বৰ্গজয় করিয়া তথায় উপনীত হইয়াছেন। অর্জ্জুন ঐ সকল গুহ্যক, ঋষি, অন্সরাগণ ও আত্মপ্রভ লোকসমূহ-সন্দর্শনে সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া মালতিকে জিজ্ঞাসা করাতে মালতি কহিলেন, “হে পাৰ্থ! তুমি ভূমণ্ডল হইতে যে-সমস্ত তারকা পৰ্য্যবেক্ষণ করিয়াছ, সেই সকল পুণ্যশীলেরা সুকৃতিফলে এই তারকারূপে স্ব স্ব স্থানে অবস্থিতি করিতেছেন।”

অনন্তর কুরুপাণ্ডবত্তম অর্জ্জুন দ্বারদেশস্থিত কৈলাশপ্রতিম চতুর্দ্দন্ত ঐরাবত গজ অবলোকন করিলেন। তিনি সিদ্ধমার্গে উপনীত হইয়া পার্থিবোত্তম মান্ধাতার ন্যায় শোভমান হইতে লাগিলেন। মহাযশাঃ অর্জ্জুন এইরূপে সকল রাজলোক অতিক্রম করিয়া সুরলোক উত্তীর্ণ হইয়া পরমরমণীয় ইন্দ্রপুরী অমরাবতী সন্দর্শন করিতে লাগিলেন।