একচত্বারিংশ অধ্যায়
রাজার প্রতি শৃঙ্গীর শাপ
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, মহাতেজা শৃঙ্গী স্বীয় জনকের স্কন্ধে মৃতসর্প রহিয়াছে শুনিয়া সাতিশয় সংক্রুদ্ধ হইলেন এবং মৃদুমধুরস্বরে কৃশকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কৃশ! কিরূপে আমার পিতার স্কন্ধে মৃতসর্প সংলগ্ন হইল?” কৃশ কহিলেন, “সখে! অদ্য মৃগয়াবিহারী রাজা পরীক্ষিৎ এই তপোবনে মৃগয়া করিতে আসিয়াছিলেন, তিনিই তোমার পিতার স্কন্ধে মৃতসর্প সমর্পণ করিয়া গিয়াছেন।” তখন শৃঙ্গী ক্রোধে দুই চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া কহিলেন, “আমার পিতা সেই দুরাত্মা নরাধম রাজার কি অপরাধ করিয়াছিলেন, সত্য করিয়া বল, আজি তোমাকে আমার তপোবল দেখাইতেছি।”
কৃশ কহিলেন, “অভিমন্যুতনয় রাজা পরীক্ষিৎ অদ্য মৃগয়া করিতে আসিয়াছিলেন। তিনি এক মৃগকে বাণবিদ্ধ করেন। বাণাহত মৃগ প্রাণভয়ে দৌড়িতে লাগিল; রাজাও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। পরিশেষে রাজা পরীক্ষিৎ মৃগের অনুসরণক্রমে নিবিড় কাননে প্রবিষ্ট হইলেন; মৃগও ক্রমশঃ তদীয় দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইল। রাজা বহুক্ষণ অরণ্যমধ্যে পর্য্যটন করিয়াও তাহার অনুসন্ধান পাইলেন না; তখন তিনি ক্ষুৎপিপাসায় একান্ত কাতর হইয়া তোমার পিতার সন্নিধানে গমনপূর্ব্বক বারংবার জিজ্ঞাসিতে লাগিলেন, ‘মহাশয়! আপনি একটি শরবিদ্ধ মৃগকে এ স্থান দিয়া পলায়ন করিতে দেখিয়াছেন?’ তোমার পিতা মৌনব্রতাবলম্বী, সুতরাং ভালমন্দ কিছুই বলিলেন না। তন্নিমিত্ত রাজা ক্রুদ্ধ হইয়া নিজ শরাসনের অগ্রভাগ দ্বারা এক মৃতসর্প উত্তোলনপূর্ব্বক তাঁহার স্কন্ধদেশে সংলগ্ন করিয়া দিলেন। তোমার পিতা তথাপি সেইরূপ মৌনাবলম্বন করিয়াই রহিলেন। পরে রাজা পরীক্ষিৎ স্বীয় রাজধানী হস্তিনানগরে প্রস্থান করিলেন।”
শৃঙ্গী কৃশের মুখে নিরপরাধ পিতার এইরূপ অপমানবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া কোপোপরক্ত-নয়নে [ক্রোধবশতঃ রক্তচক্ষে] আচমনপূর্ব্বক রাজাকে এই বলিয়া অভিসম্পাত করিলেন, “যে নৃপাধম মৌনব্রতাবলম্বী মদীয় বৃদ্ধ পিতার স্কন্ধে মৃতসর্প সমর্পণ করিয়াছে, আমার বাক্যানুসারে তীক্ষ্ণবিষধর পন্নগেশ্বর তক্ষক সপ্তরাত্রির মধ্যে ব্রাহ্মণের অপমানকারী সেই পাপাত্মাকে যমসদনে প্রেরণ করিবে।” শৃঙ্গী রাজাকে এইরূপে শাপগ্রস্ত করিয়া গোচারণস্থ স্বকীয় পিতা শমীকের সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, সত্যই তাঁহার স্কন্ধে মৃতসর্প রহিয়াছে। তিনি তদ্দর্শনে পুনর্ব্বার সাতিশয় সংক্রুদ্ধ হইয়া মনোদুঃখে রোদন করিতে লাগিলেন। পরে স্বীয় পিতাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “পিতাঃ! দুরাত্মা পরীক্ষিৎ বিনাপরাধে আপনার এই অপমান করিয়াছে শুনিয়া আমি তাহাকে এই উগ্রশাপ প্রদান করিয়াছি যে, পন্নগরাজ তক্ষক সেই কুরুকুলাধমকে দংশন করিয়া অদ্য হইতে সপ্তম দিবসে যমালয়ে প্রেরণ করিবে।”
শমীক কুপিত পুৎত্রের এই অহিতানুষ্ঠান শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে পুৎত্র! তুমি রাজা পরীক্ষিৎকে শাপ দিয়া অতি কুকর্ম্ম করিয়াছ। আমি ইহাতে প্রীত হইলাম না। তপস্বিগণের এরূপ ধর্ম্ম নহে। আমরা সেই রাজার অধিকারে বাস করি। তিনিও ন্যায়পূর্ব্বক আমাদিগকে রক্ষা করিয়া থাকেন; কখন কোন অত্যাচার করেন না। ন্যায়পরায়ণ রাজা যদিও কদাচিৎ কোন অপরাধ করেন, তাহা আমাদিগের অবশ্যই সহ্য করা উচিত। আরও দেখ, যদি রাজা আমাদিগকে রক্ষা না করেন, তাহা হইলে আমাদিগের যৎপরোনাস্তি কষ্ট হইবার সম্ভাবনা। ধর্ম্মপরায়ণ ভূপতিগণ আমাদিগকে রক্ষা করেন বলিয়াই আমরা বিপুল ধর্ম্ম উপার্জ্জন করিতেছি। অস্মদুপার্জ্জিত ধর্ম্মে রাজাদিগেরও ধর্ম্মতঃ অধিকার আছে। অতএব হে পুৎত্র! রাজা যদিও কোন অপরাধ করেন, তাহা আমাদের ক্ষমা করা উচিত। বিশেষতঃ রাজা পরীক্ষিৎ আপন প্রপিতামহ পাণ্ডুর ন্যায় আমাদিগকে রক্ষা করিতেছেন। প্রজাগণের রক্ষণাবেক্ষণই রাজার প্রধান ধর্ম্ম ও অবশ্য কর্ত্তব্য কর্ম্ম। সেই মহানুভব রাজা পরীক্ষিৎ ক্ষুধিত ও পরিশ্রান্ত হইয়া আমার আশ্রমে আগমন করিয়াছিলেন। ইহা স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, তিনি আমার মৌনব্রতাবলম্বনের বিষয় না জানিয়া এই কুকর্ম্ম করিয়াছেন। আর দেশ অরাজক হইলে তাহাতে সর্ব্বদাই নানাবিধ দোষ ঘটে এবং লোকসকল উচ্ছৃঙ্খল ও উদ্বিগ্ন হইয়া কোন ধর্ম্মকার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে পারে না। রাজা উচ্ছৃঙ্খল লোকদিগের প্রতি দণ্ডবিধান করেন। রাজদণ্ড-ভয়ে পুনর্ব্বার ধর্ম্ম ও শান্তির সংস্থাপন হয় এবং ধর্ম্ম হইতে স্বর্গ সংস্থাপিত হয়। রাজার প্রভাবেই সমুদয় যজ্ঞক্রিয়া সুচারুরূপে অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে, যজ্ঞানুষ্ঠান দ্বারা দেবগণ পরম প্রীত হয়েন, দেবগণ হইতে বৃষ্টি হয়, বৃষ্টি দ্বারা শস্য জন্মে এবং শস্য দ্বারা মনুষ্যগণের পরমোপকার দশে। ভগবান্ মনু কহিলেন, রাজা মনুষ্যদিগের বিধাতাস্বরূপ ও দশ শ্রোত্রিয়ের সমান। সেই রাজা ক্ষুধিত ও পরিশ্রান্ত হইয়া আমার মৌনব্রতের বিষয় না জানিতে পারিয়াই এবম্ভূত গর্হিত ব্যাপারে প্রবৃত্ত হইয়া থাকিবেন, সন্দেহ নাই। অতএব তুমি কি নিমিত্ত বালকতাপ্রযুক্ত হঠাৎ সেই রাজর্ষির প্রতি এই কুকর্ম্মের অনুষ্ঠান করিলে? সেই ভূপতি কোনমতেই আমাদের শাপ-প্রদানের পাত্র নহেন।”