৪১তম অধ্যায়
ইন্দ্রাদিদেবগণের অর্জ্জুনসমীপে আগমন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, এইরূপে পিনাকপাণি পশুপতি অস্তাচলগমনোন্মুখ ভাস্করের ন্যায় দেখিতে দেখিতেই অর্জ্জুনের দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইলেন। তখন তিনি “আমি সাক্ষাৎ শঙ্করকে নিরীক্ষণ করিলাম” বলিয়া যৎপরোনাস্তি বিস্ময়ান্বিত হইলেন ও মনে করিলেন, আমি ধন্য, অনুগৃহীত; যেহেতু, অদ্য সর্ব্বভূতভাবন ভগবান-ভবানীপতিকে সাক্ষাৎ ও করদ্ধারা স্পর্শ করিলাম। এত দিনের পর আমি কৃতাৰ্থ হইলাম, সংগ্রামে শক্ৰগণ পরাজিত হইল এবং প্রয়োজনও সিদ্ধ হইল।
অমিততেজাঃ অর্জ্জুন এইরূপ চিন্তা করিতেছেন, এমত সময়ে জলাধিপতি বরুণদেব বৈদূৰ্য্যমণিসন্নিভ অঙ্গলাবণ্যদ্বারা চতুর্দ্দিক সমুজ্জ্বল করিয়া নানাবিধ জলজন্তু, নাগ, নদ, নদী, দৈত্য, সাধ্য ও দৈরতগণ-সমভিব্যাহারে তথায় সমুপস্থিত হইলেন। অনন্তর অদ্ভুতদৰ্শন শ্ৰীমান ধনেশ্বর কুবের জাম্বুনদসদৃশ অঙ্গপ্রভাদ্বারা আকাশমার্গ সমুদ্যোতিত করিয়া উজ্জ্বল বিমানে আরোহণপূর্ব্বক যক্ষগণ-সমভিব্যাহারে অর্জ্জুনকে দর্শন করিতে আগমন করিলেন। পরে সর্ব্বভুত-বিনাশকারী, অচিন্ত্যাত্মা, দণ্ডপাণি, শ্রীমান ধর্ম্মরাজ যম নরমূর্ত্তিধর লোকভাবন পিতৃগণ-সমভিব্যাহারে বিমানালোকে গুহ্যক, গন্ধর্ব্ব, পন্নগ প্রভৃতি সমুদয় লোক আলোকময় করিয়া যুগান্তকালীন দ্বিতীয় মার্ত্তণ্ডের ন্যায় অর্জ্জুনসমীপে সমুপস্থিত হইলেন। তাঁহারা সেই দীপ্তিশালী বিচিত্ৰ মহাগিরিশিখরে আসীন হইয়া তপোবলসম্পন্ন অর্জ্জুনকে দেখিতে লাগিলেন। এমন সময়ে ভগবান সুররাজ ইন্দ্ৰ মহেন্দ্রাণী-সমভিব্যাহারে অমরগণে পরিবৃত হইয়া ঐরাবতে আরোহণপূর্ব্বক তথায় আগমন করিলেন। দেবরাজ ইন্দ্রের মস্তকে পাণ্ডুবৰ্ণ ছত্র ধ্রিয়মাণ হওয়াতে বোধ হইতে লাগিল, যেন তারকারাজ চন্দ্ৰমা শ্বেতবর্ণ মেঘে আবৃত হইয়া রহিয়াছেন। গন্ধর্ব্ব ও মহর্ষিগণ তাঁহাকে স্তব করিতে লাগিলেন। তিনি হিমাচলের শৃঙ্গে গমনপূর্ব্বক সমুদিত সূৰ্য্যের ন্যায় শোভমান হইয়া অবস্থিতি করিলেন।
অর্জ্জুনের যমদত্ত দণ্ডাস্ত্ৰলাভ
তখন দক্ষিণদিকস্থ পরমধর্ম্মজ্ঞ ধীমান যম মেঘগম্ভীরস্বরে অর্জ্জুনকে কহিতে লাগিলেন, “হে পাৰ্থ! দেখ, আমরা সমস্ত লোকপাল এখানে আসিয়াছি; তুমি দিব্য-জ্ঞানার্হ, আমরা তোমাকে দিব্যজ্ঞান প্ৰদান করিতেছি, শ্রবণ কর। হে পাৰ্থ! তুমি পূর্ব্বজন্মে মহাবলপরাক্রান্ত অমিতাত্মা নরনামে মহর্ষি ছিলে; কেবল ব্রহ্মার নিয়োগানুসারে মর্ত্যকলেবর পরিগ্রহ করিয়াছ! তুমি বসুসম্ভূত মহাবীৰ্য্যসম্পন্ন পরমধর্ম্মাত্মা পিতামহ ভীষ্মকে সংগ্রামে পরাজয় করিবে, দ্রোণরক্ষিত ক্ষত্ৰিয়গণ তোমার শারানলে দগ্ধ হইবে। যে-সমস্ত মহাবীৰ্য্যসম্পন্ন দানবদল মনুষ্যলোকে জন্ম পরিগ্রহ করিয়াছে, তাহারা ও নিবাত-কবচ প্রভৃতি অন্যান্য দানবগণ তোমার হস্তেই প্ৰাণ পরিত্যাগ করিবে। সর্ব্বলোকতপনশীল আমার পিতা সূৰ্য্যদেবের অংশসম্ভূত মহাবলপরাক্রান্ত কৰ্ণ তোমারই বধ্য। যাহারা দেব, দানব ও রাক্ষসগণের অংশে মানববংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাহারা সংগ্রামে তোমাকর্ত্তৃক নিপাতিত হইয়া স্ব স্ব কর্ম্মফলবিনির্জ্জিত গতি প্রাপ্ত হইবেন। তোমার কীর্ত্তি অক্ষয় হইয়া চিরকাল ভূমণ্ডলে বিরাজমান থাকিবে। তুমি সাক্ষাৎ মহাদেবকে প্রসন্ন করিয়াছ; তুমি বিষ্ণুসমভিব্যাহারে ভূভার হরণ করিবে। হে মহাবাহো! তুমি আমার এই অপ্রতিবারণীয় দণ্ড গ্রহণ কর, ইহাদ্বারা তুমি সুমহৎ কর্ম্মসকল সম্পন্ন করিবে।” তখন অর্জ্জুন পরামপ্রীতমনে ত্যাগ ও প্রতিসংহারের মন্ত্রসহ সেই যমদত্ত দণ্ড বিধিবৎ গ্রহণ করিলেন। তখন পশ্চিমদিক্স্থিত জলধরের ন্যায় শ্যামকিলেবর জলেশ্বর বরুণদেব কহিতে লাগিলেন, “হে পাৰ্থ! তুমি ক্ষত্ৰিয়শ্রেষ্ঠ ও ক্ষত্রধর্ম্মাবলম্বী। আমি জলাধিপতি বরুণ তোমার নিকট আসিয়াছি। হে পৃথুতাম্রাক্ষ! আমি তোমাকে ত্যাগ ও প্রতিসংহারের মন্ত্র-সমভিব্যাহারে অনিবাৰ্য্য বারুণপাশ প্রদান করিতেছি, গ্ৰহণ করা। আমি তারকাসুরসংগ্রামে এই পাশদ্বারা সহস্ৰ সহস্ৰ মহাবল পরাক্রান্ত দানবকে বদ্ধ করিয়াছিলাম। হে মহাসত্ত্ব! আমি প্রসন্ন হইয়া তোমাকে এই পাশ প্রদান করিতেছি, গ্রহণ করা। তুমি এই পাশদ্বারা যমকে বদ্ধ করিতে অভিলাষী হইলে তিনিও পরিত্ৰাণ পাইতে পরিবেন না। তুমি এই অস্ত্ৰ লইয়া সংগ্রামে বিচরণ করিলে পৃথী নিঃক্ষত্ৰিয়া হইবে সন্দেহ নাই।”
এইরূপে যম ও বরুণ অর্জ্জুনকে দিব্যাস্ত্ৰ প্ৰদান করিলে কৈলাসচলনিবাসী ধনাধ্যক্ষ কুবের কহিতে লাগিলেন, “হে মহাবলপরাক্রান্ত মহাপ্রাজ্ঞ পাণ্ডুতনয়! আমি কৃষ্ণের সহিত সাক্ষাৎকার লাভ করিয়া যেরূপ প্রীতিলাভ করিয়া থাকি, আদ্য তোমার সহিত সন্দর্শন হওয়াতেই তদ্রূপ প্রীত হইলাম। হে সব্যসাচিন মহাবাহো! হে পূর্ব্বদেব সনাতন! তুমি পুরাকল্পে প্রত্যহ আমাদের সহিত তপস্যা করিয়াছিলে। এক্ষণে তোমার সহিত সাক্ষাৎকারলাভ হইয়াছে; এই দিব্য অস্ত্ৰ প্ৰদান করিতেছি, গ্ৰহণ করা। তুমি এই অস্ত্রদ্বারা মনুষ্য ভিন্ন অন্যান্য দুর্জ্জয় যোদ্ধাকেও পরাজয় করিতে পরিবে এবং ধৃতরাষ্ট্রের সমুদয় সৈন্যগণকে শমনসদনে প্রেরণ করবে। অতএব তুমি এই অরতিকুলনাশক, অন্তৰ্দ্ধানকারী, ওজঃ, তেজ ও দ্যুতিকর মদীয় প্রিয়তম প্রস্বাপেন অস্ত্ৰ গ্ৰহণ কর। মহাত্মা শঙ্করের ত্রিপুরবিনাশকালে আমি এই অস্ত্ৰ নিক্ষেপ করিয়া মহাসুরগণকে দগ্ধ করিয়াছিলাম। এক্ষণে এই অস্ত্ৰ তোমার নিমিত্ত আনীত হইয়াছে। হে সত্য পরাক্রম! তুমিই এই অস্ত্ৰ-ধারণে সমর্থ।” মহাবলপরাক্রান্ত অর্জ্জুন কুবেরের বাক্যাবসানে যথানিয়মে তদীয় দিব্য অস্ত্ৰ গ্ৰহণ করিলেন।
তখন দেবরাজ ইন্দ্র অক্লিষ্টকর্ম্ম পার্থকে মেঘদুন্দুভি-গভীরস্বরে সান্ত্বনা করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে মহাবাহো কৌস্তেয়! তুমি পুরাতন মহর্ষি, এক্ষণে উৎকৃষ্ট সিদ্ধিলাভপূর্ব্বক দেবত্ব প্রাপ্ত হইয়াছ। হে অরতিনিপাতন! তোমাকে দেবকাৰ্য্য-সাধনের নিমিত্ত স্বর্গে গমন করিতে হইবে; অতএব সজ্জীভূত হও। মাতলি তোমার নিমিত্ত রথ লইয়া ভূতলে আগমন করিবে। তুমি সেই রথে আরোহণপূর্ব্বক স্বর্গে গমন করিলে তথায় আমি তোমাকে দিব্যাস্ত্ৰ-সমুদয় প্রদান করিব।”
ধীমান কুন্তীনন্দন ধনঞ্জয় সেই সমুদয় লোকপালকে গিরিশিখরে সমবেত দেখিয়া সাতিশয় বিস্ময়ান্বিত হইলেন এবং কায়মনোবাক্যে জল ও ফলদ্বারা তাহাদিগকে বিধিবৎ পূজা করিলেন। অনন্তর সুরগণ মহাবীর ধনঞ্জয়-সম্ভাষণাপূর্ব্বক দ্রুত পদসঞ্চারে স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলে পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুনও দেবগণ হইতে দিব্য অস্ত্ৰ-প্ৰাপ্ত হইয়া আপনাকে কৃতাৰ্থ ও পূর্ণাভিলাষ বোধ করিলেন।
কৈরাতপৰ্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত