৪১তম অধ্যায়
অভিমন্যুরণে কর্ণ পরাজয়
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! কর্ণের ভ্রাতা বারংবার গর্জ্জন ও শরাসনজ্যা বিকর্ষণপূর্ব্বক সত্বর অভিমন্যু ও কর্ণের রথের মধ্যস্থলে সমুপস্থিত হইয়া দশবাণ নিক্ষেপ পূর্ব্বক অভিমন্যুকে ও তাহার সারথিকে ছত্র, ধ্বজ ও অশ্বের সহিত বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর অভিমন্যু স্বীয় পিতা ও পিতামহের ন্যায় অমানুষ কর্ম্ম করিয়া পরিশেষে কর্ণের ভ্রাতার শরে পীড়িত হইলেন দেখিয়া কৌরবগণের আহ্লাদের আর পরিসীমা রহিল না। তখন মহাবীর অভিমন্যু দর্পসহকারে এক বাণ পরিত্যাগ করিয়া কর্ণের ভ্রাতার মস্তক ছেদন পূর্ব্বক ভূতলে পাতিত করিলেন। মহাবীর কর্ণ অভিমন্যুশর-নিহত ভ্রাতাকে বায়ুবেগে পর্ব্বত হইতে নিপতিত কণিকারের ন্যায় ভূতলে পতিত দেখিয়া সাতিশয় ব্যথিত হইলেন।
এই রূপে মহাবীর অর্জ্জুনতনয় কর্ণকে সমরবিমুখ করিয়া কঙ্কপত্রযুক্ত শরনিকরনিক্ষেপ করত অন্যান্য বীরগণের প্রতি ধাবমান হইলেন এবং সেই বিবিধ চতুরঙ্গ কৌরব সৈন্যগণকে ক্রোধভরে বাণবিদ্ধ করিতে লাগিলেন। কর্ণ অভিমন্যুর শরনিকরে সমাহত ও ব্যথিত হইয়া মহাবেগে রণস্থল হইতে প্রস্থান করিলেন; সৈন্যগণ তদ্দর্শনে রণে ভঙ্গ দিয়া পলায়ন করিতে লাগিল। বারিধারা ও শলভনিকর সদৃশ মহাবীর অভিমন্যুর শরসমূহে গগন মণ্ডল সমাচ্ছাদিত হইলে কোন বস্তুই দৃষ্টিগোচর হইল না। কৌরবপক্ষ সৈন্যগণ অভিমন্যুর শরে জর্জ্জরিত হইয়া সকলেই পলায়ন করিল। কেবল মহাবীর সিন্ধুরাজ সেই স্থানে অবস্থান করিতে লাগিলেন।
তখন মহাবীর অর্জ্জুনতনয় শঙ্খবাদনপূর্ব্বক কৌরবসৈন্য মধ্যে নিপতিত হইয়া কক্ষদহী দহনের ন্যায় বাণানলে শত্রুগণকে দগ্ধ করিতে লাগিলেন এবং মুহূর্ত্ত মধ্যে অসংখ্য রথ, নাগ, অশ্ব ও পদাতিগণকে সংহার করিয়া ভূতল কবন্ধময় করিলেন। কৌরব সৈন্যগণ অভিমন্যুর শরে নিতান্ত কাতর হইয়া জীবন রক্ষাৰ্থ চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইয়া স্বপক্ষগণকেই সংহার করিতে লাগিল। অর্জ্জুনতনয় বিক্ষিপ্ত বিষম বিপাঠ সকল রথ, নাগ ও অশ্ব সমুদায় নিধন করিয়া ধরাতলে পতিত হইল। আয়ুধ, অঙ্গুলিত্ৰাণ, গদা ও অঙ্গ সমবেত, হেমাভরণভূষিত সহস্র সহস্র ছিন্ন বাহু এবং অসংখ্য সায়ক, শরাসন, খড়্গ, নরকলেবর ও মাল্য কুণ্ডল সনাথ নরমস্তক সকল ধরা তলে নিপতিত হইতে লাগিল। রাশি রাশি দিব্যভূষণভূষিত আসন, ঈষাদণ্ড, অক্ষ, চক্র, যুগ, শক্তি, চাপ, অসি, ধ্বজ, চৰ্ম্ম ও শর সমুদায় এবং অসংখ্য মৃত ক্ষত্রিয়, মৃত গজ ও মৃত তুরঙ্গ নিপতিত হওয়াতে রণস্থল ক্ষণকাল মধ্যে অগম্য ও ভয়ানক হইয়া উঠিল। বধ্যমান রাজপুত্র সকল পরম্পর ক্রন্দন করিতে আরম্ভ করিলে সমরাঙ্গনে ভীরুজনভয়াবহ ঘোরতর শব্দ সমুত্থিত হইয়া চতুর্দ্দিক প্রতিধ্বনিত করিল। ঐ সময় মহাবীর অর্জ্জুননন্দন অসংখ্য শত্রু সৈন্য এবং রথ, অশ্ব ও গজ সমুদায় সংহার করত কৌরব সৈন্য মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া অনলের কক্ষদহনের ন্যায় অরাতিগণকে সংহার পূর্ব্বক চতুর্দ্দিকে ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন। সৈন্যগমনসম্ভূত প্রভূত পার্থিব ধুলি সমুত্থিত হওয়াতে আমরা তৎকালে সেই অসংখ্য গজ, অশ্ব ও মনুষ্যগণের প্রাণ নাশক মহবীর অভিমন্যুকে নয়নগোচর করিতে পাইলাম না বটে, কিন্তু ক্ষণকাল পরেই মহাবীর অর্জ্জুনতনয় মধ্যাহ্ন কালীন ভাস্করের ন্যায় অরাতিগণকে তাপিত করত সৈন্য মধ্যে দৃষ্ট হইয়া শোভা পাইতে লাগিলেন।”