৪০তম অধ্যায়
ষোড়শ অধ্যায় – দৈবাসুরসম্পদবিভাগযোগ
“ভগবান বলিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! যাহারা দৈবসম্পদ্ লক্ষ্য করিয়া জন্মগ্রহণ করে, তাহারা অভয়, চিত্তশুদ্ধি, আত্মজ্ঞানোপায়ে [আত্মজ্ঞানসাধনে] পরনিষ্ঠা [ঐকান্তিকভাব], দান, দম, যজ্ঞ, স্বাধ্যায়, তপ, ঋজুতা, অহিংসা, সত্য, অক্রোধ, ত্যাগ, শান্তি, অখলতা, প্রাণীর প্রতি দয়া, অলোলুপতা [নির্লোভতা], মৃদুতা, হ্রী, অচপলতা [অচাঞ্চল্য], তেজ, ক্ষমা, ধৃতি, শৌচ, অদ্রোহ ও অনভিমানিতা এই ষড়বিংশতি গুণপ্রাপ্ত হইয়া তাহারা দম্ভ, দর্প, অভিমান, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা ও অজ্ঞানে অভিভূত হয়। দৈবসম্পদ লক্ষ্য করিয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছ, অতএব শোক করিও না।
“‘হে অর্জ্জুন! ইহলোকের দৈব ও আসুর এই দুই প্রকার ভূত সৃষ্ট হইয়াছে; দৈব বিষয় বিস্তারিতরূপে কহিয়াছি; এক্ষণে আসুর বিষয় কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। আসুরভাব লোক সকল ধর্ম্মে প্রবৃত্তি ও অধর্ম্ম হইতে নিবৃত্তির বিষয় অবগত নহে; তাহাদিগের শৌচ নাই, আচার নাই ও সত্য নাই; তাহারা জগৎকে সত্য ও ধর্ম্মাধর্ম্ম ব্যবস্থাবর্জ্জিত, ঈশ্বরশূন্য, ধর্ম্মাধর্ম্মাবাসনাবশে অনুৎপন্ন কেবল কেমহেতুক স্ত্রী-পুরুষ সম্ভূত কহে। সেই সকল অল্পবুদ্ধি লোক এইরূপ জ্ঞান আশ্রয় করিয়া মিলনচিত্ত, উগ্রকর্ম্মা ও অহিতকারী হইয়া জগতের ক্ষয়ের নিমিত্ত সমুদ্ভূত হয়; দম্ভ, অভিমান, মদ, অশুচিব্রত [অপবিত্র কার্য্য] ও দুষ্পূরণীয় কামনা অবলম্বন এবং মোহবশতঃ অসৎ প্রতিগ্রহ করিয়া ক্ষুদ্র দেবতার আরাধনায় প্রবৃত্ত হয়; আমরণ অপরিমেয় চিন্তাকে আশ্রয় করিয়া থাকে; কামোপভোগই পরম পুরুষার্থ বলিয়া নিশ্চয় করে; শত শত আশাপাশে বদ্ধ ও কামক্রোধের বশীভূত হইয়া কামভোগার্থ অন্যায়পূর্ব্বক অর্থসঞ্চয়ের চেষ্টা করে; আজি আমার এই মনোরথ পূর্ণ হইল ও এই মনোরথ পরিপূর্ণ হইবে, আমি এই শত্রুকে বিনাশ করিয়াছি, অন্য শত্রুকেও বিনাশ করিব, আমি ঈশ্বর, আমি ভোগী, আমি সিদ্ধ, আমি বলবান, আমি সুখী, আমি যাগ করিব, দান করিব ও আমোদ করিব, এই প্রকার অজ্ঞানে বিমোহিত, অনেকবিধ চিত্তবিভ্রম ও মোহজালে আচ্ছন্ন এবং কামভোগে আসক্ত হইয়া অতি কুৎসিত নরকে নিপতিত হয়। অহঙ্কার, বল, দর্প, কাম, ক্রোধ ও অসূয়া আশ্রয় করিয়া আপনার ও পরের দেহে আমার দ্বেষ করে এবং আপনা আপনি সম্মানিত, অহঙ্কৃত ও ধন-মান-মদে প্রমত্ত হইয়া দম্ভসহকারে অবিধিপূর্ব্বক নামমাত্র যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে। আমি সেই সমস্ত দ্বেষপরবশ, ক্রুর-স্বভাব, অশুভকারী নরাধমকে নিরন্তর সংসারে আসুরযোনিমধ্যে নিক্ষেপ করি। তাহারা আসুরযোনি প্রাপ্ত হইয়া আমাকে লাভ করিতে পারে না, সুতরাং অধম গতি প্রাপ্ত হইয়া থাকে।
“‘কাম, ক্রোধ ও লোব, নরকের এই ত্রিবিধি দ্বার। অতএব এই তিনটি পরিত্যাগ করিবে। যে ব্যক্তি নরকের এই ত্রিবিধি দ্বার হইতে মুক্ত হইয়াছেন, তিনি আপনার কল্যাণ আচরণ করেন এবং তৎপরে পরমগতি প্রাপ্ত হয়েন। যে ব্যক্তি শাস্ত্রবিধি পরিত্যাগ করিয়া স্বেচ্ছাচারে প্রবৃত্ত হয়, সে সিদ্ধি প্রাপ্ত হয় না, সুখ প্রাপ্ত হয় না ও পরম গতি প্রাপ্ত হয় না। অতএব কার্য্যাকার্য্য-ব্যবস্থা-বিষয়ে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ। তুমি শাস্ত্রোক্ত কর্ম্ম অবগত হইয়া তাহার অনুষ্ঠান কর।’”