মুনিবর বলে, শুন পরীক্ষিৎ-সুত।
ভরত-বংশের কথা কথনে অদ্ভুত।।
দুষ্মন্ত নামেতে রাজা জগতে বিদিত।
তাঁহার মহিমা কথা না হয় বর্ণিত।।
সংসারে আসিয়া বসুন্ধরা ভোগ করে।
ধর্ম্মেতে পৃথিবী পালে, দুষ্টেরে সংহারে।।
মহা পরাক্রান্ত রাজা রূপগুণবন্ত।
পৃথিবীতে একচ্ছত্র করিল দুষ্মন্ত।।
মৃগরাতে বড় রত মহাধনুর্দ্ধর।
মৃগয়া করিতে গেল বনের ভিতর।।
হস্তী হয় পদাতিক না যায় গণন।
সসৈন্যে বেড়িল রাজা এক মহাবন।।
সিংহ ব্যাঘ্র ভল্লুক বরাহ মৃগগণ।
অনেক মারিল রাজা না যায় গণন।।
যতেক রাজার সৈন্য মারি মৃগচয়।
শকটে পূরিল কেহ কান্ধে করি লয়।।
কোন কোন জন তথা খায় পুড়াইয়া।
তবে এক বনে গেল সে বন ছাড়িয়া।।
হিরণ্য নামেতে বন অতি মনোরম।
চৈতরথ সমান সে মুনির আশ্রম।।
নানাজাতি বৃক্ষ তথা ফুল ফল ধরে।
নানাজাতি পক্ষী তথা সদা কেলি করে।।
মধুচক্র ডালে ডালে আছে তরুগণে।
বায়ুতেজে পুষ্পবৃষ্টি হয় অনুক্ষণে।।
নানা পক্ষিগণ তাহে সদা ক্রীড়া করে।
ভক্ষকে না করে ভক্ষ্য মুনিরাজ ডরে।।
মালিনী নামেতে নদী দেখিয়া নিকটে।
মুনিগণ বৈসেন তাহার দুই তটে।।
অগ্নিহোত্র ধূম গিয়া পরশে গগন।
ব্রহ্মার বদনে যেন বেদ উচ্চারণ।।
মুনির আশ্রম বুঝি দুষ্মন্ত নৃপতি।
ডাকিয়া বলেন রাজা সৈন্যগণ প্রতি।।
মুনি সম্ভাষিয়া আমি না আসি যাবৎ।
এইখানে সর্ব্বজন থাকহ তাবৎ।।
এত বলি নরপতি পুরোহিত লৈয়া।
কণ্বের আশ্রমে রাজা উত্তরিল গিয়া।।
প্রবেশ করিল গিয়া মুনি অন্তঃপুর।
দেখিল সে কণ্ব নাই, চিন্তে নৃপবর।।
হেনকালে শকুন্তলা মুনির নন্দিনী।
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া তুষ্ট কৈল নৃপমণি।।
দেখিয়া কন্যার রূপ নৃপতি মোহিত।
জিজ্জাসিল কন্যা প্রতি হয়ে বিমোহিত।।
দুষ্মন্ত নৃপতি আমি শুন সুবদনি।
হেথা আইলাম আমি ভেটিবারে মুনি।।
কোথায় গেলেন মুনি কহত সুন্দরি।
তুমি বা কাহার কন্যা কহ সত্য করি।।
কন্যা বলে, গেল পিতা ফলের কারণ।
মুহূর্ত্তেক রহ হেথা, আসিবে এখন।।
মুনির নন্দিনী আমি, শুন নৃপবর।
এত শুনি নরপতি করিল উত্তর।।
তোমার সদৃশ রূপ কোথাও না দেখি।
মুনিকন্যা সত্য তুমি কহ শশিমুখি।।
পরম তপস্বী মুনি ফল মূলাহারী।
দারত্যাগী জিতেন্দ্রিয় মহা ব্রহ্মচারী।।
তাঁহার তনয়া তুমি হইলা কি মতে।
কত সত্য সুবদনি আমার সাক্ষাতে।।
কন্যা বলে, শুন মম জন্মের কাহিনী।
যেমতে হইনু আমি মুনির নন্দিনী।।
বিশ্বামিত্র মুনি জান বিখ্যাত সংসারে।
চিরদিন তপস্যা করেন অনাহারে।।
তাঁর তপ দেখি কম্পমান পুরন্দর।
আমার ইন্দ্রত্ব লবে এই মুনিবর।।
সর্ব্ব দেবগণ মিলি ভাবে নিরন্তর।
মেনকারে ডাকি বলে দেব পুরন্দর।।
রূপে গুণে তব তুল্য নাহি ত্রিভুবনে।
মম কার্য্য সিদ্ধ কর আপনার গুণে।।
বিশ্বামিত্র তপেতে কম্পিত মম কায়।
তাঁর তপ ভঙ্গ কর করিয়া উপায়।।
শুনিয়া মেনকা অতি বিষণ্ন বদন।
যোড় হাত করি ইন্দ্রে করে নিবেদন।।
সংসারে বিখ্যাত বিশ্বামিত্র মহাঋষি।
মহাতেজা ক্রোধী সেই পরম তপস্বী।।
বশিষ্ঠের শত পুত্র প্রকারে মারিল।
ক্ষত্রকুলে জন্মি তবু ব্রাহ্মণ হইল।।
কৌশিকী নামেতে নদী আজ্ঞাতে সৃজিল।
সহজাঙ্গে ব্যাধি করি পুনর্মুক্ত কৈল।।
দ্বিতীয় করিল সৃষ্টি বিখ্যাত জগতে।
আপনি করহ ভয় যাঁহার তপেতে।।
তাঁর তপ নষ্ট করে হেন কোন্ জন।
কর্ম্ম না হইবে, হৈবে আমার মরণ।।
অগ্নি সূর্য্য সম তেজ লোচন যুগলে।
তাঁহার তপস্যা ভঙ্গ করি কোন্ ছলে।।
তোমার বচন আমি লঙ্ঘিবারে নারি।
তব কার্য্য সিদ্ধ হৌক, আমি বাঁচি মরি।।
কামদেব আর বায়ু দেহ তো সহায়।
তবে যেমনেতে হয়, করিব উপায়।।
ইন্দ্র আজ্ঞা কৈল সঙ্গে যাহ দুইজন।
দেবরাজ আজ্ঞা পেয়ে চলিল তখন।।
হেমন্ত পর্ব্বতে বৈসে সেই মুনিবর।
মুনি দেখি মেনকার কাঁপির অন্তর।।
অতিশয় সুবেশা হইয়া বিদ্যাধরী।
মুনির নিকটে ক্রীড়া করে মায়া করি।।
হেনকালে বায়ু বহে অতি খরতর।
উড়াইয়া বস্ত্র তার ফেলিল অন্তর।।
আস্তে ব্যস্তে মেনকা উঠিয়া বস্ত্র ধরে।
বিবিধ প্রকারে পবনেরে নিন্দা করে।।
এ সকল কৌতুক দেখিল মুনিবর।
শরীরেতে ভেদিল কামের পঞ্চশর।।
মেনকা ধরিয়া মুনি গেল নিজ দেশ।
কামে মত্ত নিত্য করে শৃঙ্গার বিশেষ।।
হেনমতে বহুদিন গেল ক্রীড়ারসে।
তপ জপ সকল ত্যজিল কামবশে।।
একদিন সন্ধ্যাকালে বিশ্বামিত্র মুনি।
সন্ধ্যা হেতু বলে শীঘ্র জল দেহ আনি।।
শুনিয়া মেনকা হাসি বলিল বচন।
এতদিনে ভাল সন্ধ্যা হইল স্মরণ।।
এত শুনি মুনি হৈল কুপিত অন্তর।
দেখিয়া মেনকা ভয়ে পলায় সত্বর।।
হৈয়াছিল যেই গর্ভ মুনির ঔরসে।
অরণ্যে প্রসব করি গেল নিজ দেশে।।
মুনি তপ নষ্ট করি গেল নিজ স্থানে।
আমারে ফেলিয়া গেল নির্জ্জন কাননে।।
সিংহ ব্যাঘ্র পশুগণ কেহ না হিংসিল।
পক্ষীগণ বেড়িয়া যে আমারে রহিল।।
তপস্যা করিতে গেল কণ্ব সেই বনে।
অনাথা দেখিয়া তাঁর দয়া হৈল মনে।।
গৃহে আমি পালন করিল মুনিবর।
তাই আমি তাঁর কন্যা, শুন দণ্ডধর।।
শকুন্তে বেড়িয়াছিল নিকুঞ্জ কাননে।
শকুন্তলা নাম মুনি রাখে সে কারণে।।
মম জন্মকথা এক মুনি জিজ্ঞাসিল।
কহিলেন কণ্ব তাঁরে তাহে জানা গেল।।
আদিপর্ব্বে দিব্য শকুন্তলা উপাখ্যান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।