৪০তম অধ্যায়
দুঃশাসন পরাজয়
হে মহারাজ। শরবিক্ষতগাত্র মহাবীর অভিমন্যু গর্বিত বচনে স্বীয় অমিত্র মহাবীর দুঃশাসনকে কহিতে লাগিলেন, হে বৃথাক্রোধপরায়ণ, অধৰ্ম্মনিরত, বীরাভিমানী পুরুষ! অদ্য সৌভাগ্যক্ৰমে সংগ্রামে তোমাকে নয়নগোচর করিতেছি; তুমি যে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সমক্ষে সভা মধ্যে কটুক্তিদ্বারা ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে কোপিত করিয়াছিলে এবং কপটদূত আশ্রয় পূর্ব্বক বলমদে মত্ত হইয়া মহাবীর ভীমসেনকে যে কুবাক্য বলিয়াছিলে, আজি তাহার ফল প্রাপ্ত হইবে। অরে দুর্ম্মতি! আজি অবিলম্বেই পরবিত্তাপহরণ, ক্রোধ, অশান্তি, লোভ, অজ্ঞানতা, দ্রোহ, অত্যাহিত এবং আমার গুরুগণের রাজ্য হরণ প্রভৃতি অধৰ্ম্মের ফল লাভ করিবে। আমি সমরে সৈন্যগণ সমক্ষে শরনিকর দ্বারা অতি সত্বরে তোমাকে শাস্তি প্রদান করিয়া ক্রোধপরায়ণ দ্রুপদত্মজা ও অমর্ষ পরবশ মহাবীর বৃকোদরের নিকট আত্মণ্য লাভ করিব। যদি তুমি সমর পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন না কর; তবে আমার নিকট কখনই তোমার জীবন রক্ষা হইবে না।
মহাবীর অর্জ্জুনতনয় এইরূপে তর্জ্জন করিয়া দুঃশাসনের বিনাশের নিমিত্ত কাল, অগ্নি ও অনিলের ন্যায় তেজঃসম্পন্ন ভীষণ বাণ নিক্ষেপ করিলেন। অভিমন্যু নিক্ষিপ্ত সায়ক দুঃশাসনের জত্রুদেশ ভেদ করিয়া সর্পের বল্মীক প্রবেশের ন্যায় পুঙ্খের সহিত ভূতলে প্রবিষ্ট হইল। মহাবীর অর্জ্জুনতনয় শরাসন আকৰ্ণ আকর্ষণ পূর্ব্বক পুনরায় দুঃশাসনকে পঞ্চবিংশতি শরে বিদ্ধ করিলেন। মহাবাহু দুঃশাসন অভিমন্যুর শরে গাঢ়বিদ্ধ ও ব্যথিত হইয়া রথোপন্থে শয়ান ও মূর্চ্ছিত হইলেন। তখন সারথি তাঁহাকে অচেতন নিরীক্ষণ করিয়া সত্বরে সংগ্রাম স্থল হইতে অপসৃত করিলে সমুদায় পাণ্ডব, দ্রৌপদেয়, পাঞ্চাল ও কেকয়গণ এবং বিরাট দুঃশাসনকে দেখিয়া ঘোরতর সিংহনাদ করিতে আরম্ভ করিলেন। পাণ্ডবপক্ষ সৈন্যগণ সমর-পরিতুষ্ট হইয়া নানাবিধ বাদ্যবাদন করত বিস্মিত-চিত্তে প্রধান শত্রু দুঃশাসনের পরাজয়কারী মহাবীর অভিমন্যুর বিক্রম দেখিতে লাগিল। ধর্ম্ম, পবন, ইন্দ্র ও অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের প্রতিমূর্ত্তি লক্ষিত ধ্বজ-বিভূষিত স্যন্দনে সমারূঢ় মহাবীর দ্রৌপদীতনয়গণ, মহাবল পরাক্রান্ত সাত্যকি, চেকিতান, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, কৈকয়, ধৃষ্টকেতু এবং মৎস্য পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণ যুধিষ্ঠির প্রমুখ পাণ্ডবগণ সমভিব্যাহারে দ্রোণ সৈন্যগণকে ছিন্ন ভিন্ন করিবার মানসে সত্বরে ধাবমান হইলেন। তখন সমরে অপরাঙ্মুখ জয়াভিলাষী উভয়পক্ষ বীরগণের ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল।
কর্ণের সহিত অভিমন্যুর যুদ্ধ
এইরূপে অতি ভয়ঙ্কর সমর সমুপস্থিত হইলে কুরুরাজ দুৰ্য্যোধন কর্ণকে কহিলেন, অঙ্গরাজ! ঐ দেখ, আদিত্য তুল্য প্রতাপশালী মহাবীর দুঃশাসন সমরে শত্রু সৈন্যগণকে নিধন করিয়া পরিশেষে অভিমন্যুর বশীভূত হইয়াছে এবং পাণ্ডবগণ মহাবল সিংহের ন্যায় ক্রোধাবিষ্টচিত্তে অর্জ্জুনতনয়কে রক্ষা করিবার নিমিত্ত সমরক্ষেত্রে ধাবমান হইতেছে।
হে মহারাজ। তখন আপনার পুত্রের পরম হিতকারী মহাবীর কর্ণ ক্রোধান্বিত চিত্তে সুতীক্ষ্ন সায়ক সমুদায় দ্বারা অভিমন্যুকে বিদ্ধ করিয়া তাঁহার অনুচরগণের উপর তীক্ষ্ণ শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। দ্রোণসমীপে গমনাভিলাষী মহামতি অর্জ্জুনতনয় সত্বরে ত্ৰিসপ্ততিশরে কর্ণকে বিদ্ধ করিয়া কৌরবপক্ষ রথিশ্রেষ্ঠদিগকে ব্যথিত করিতে লাগিলেন; তথাপি তাঁহাদের মধ্যে কেহই সেই মহাবীর পুরন্দর-পৌত্রকে দ্রোণসমীপগমনে বিরত করিতে পারিলেন না। তখন সমুদায় ধনুর্দ্ধর অপেক্ষা অভিমানী জয়াভিলাষী পরশুরামের শিষ্য মহাবীর কর্ণ শত শত উত্তম অস্ত্রে অভিমন্যুকে পীড়িত করিতে লাগিলেন। কিন্তু মহাবলপরাক্রান্ত অমর সদৃশ অর্জ্জুনতনয় তাহাতে কিছুমাত্র ব্যথিত হইলেন না। তিনি শিলাশিত আনতপর্ব্ব বহুসংখ্য ভল্ল দ্বারা শূরগণের শরাসন ছেদন করিয়া কর্ণের উপর শরাঘাত করিতে লাগিলেন এবং শরাসন বিনির্মুক্ত আশীবিসন্নিভ শরনিকরে তাঁহার ছত্র, ধ্বজ, অশ্ব সমুদায় ও সারথিকে ছেদন করিলেন। অনন্তর মহাবীর কর্ণ অভিমন্যুর উপর সন্নতপৰ্ব্ব পাঁচ শর নিক্ষেপ করিলে, মহাবীর অর্জ্জুনতনয় অনায়াসে সেই সকল শর সহ্য করিয়া মুহূর্ত্ত মধ্যে এক বাণে তাঁহার ধ্বজ ও শরাসন ছেদন পূর্ব্বক ভূতলে পাতিত করিলেন। তখন কর্ণের ভ্রাতা তাঁহাকে তদবস্থ নিরীক্ষণ পূর্ব্বক সুদৃঢ় কাৰ্ম্মক সমুদ্যত করিয়া সত্বরে অভিমন্যুর প্রতি ধাবমান হইলেন। পাণ্ডবগণ ও তাহাদের অনুচরবর্গ কর্ণের সেইরূপ দুর্দ্দশা দেখিয়া উচ্চস্বরে চীৎকার, বাদিত্রবাদন ও অভিমন্যুর প্রশংসা করিতে লাগিলেন।