৪০তম অধ্যায়
অর্জ্জুনের পাশুপত অস্ত্ৰলাভ
“হে ধনঞ্জয়! তুমি পূৰ্ব্বজন্মে নর-নামা মহাপুরুষ ছিলে এবং নারায়ণ-সমভিব্যাহারে অনেক অযুতবৎসর তপস্যা করিয়াছিলে। তুমি ও পুরুষোত্তম বিষ্ণু এই উভয় ব্যক্তিতেই পরমতেজ সন্নিবেশিত হইয়াছে, তোমরাই তেজঃপ্রভাবে এই জগতের ভার বহন করিতেছ। হে প্ৰভো! তুমি শক্রাভিষেকসময়ে জলদের ন্যায় গভীরগর্জ্জনশালী মহাশরাসন গ্রহণপূর্ব্বক নারায়ণ-সমভিব্যাহারে দানবগণকে বিনাশ করিয়াছিলে। এই তোমার করোচিত সেই গাণ্ডীব ধনু, যাহা আমি মায়াপূর্ব্বক গ্রহণ করিয়াছিলাম। হে কুরুনন্দন! তোমার তূণীরদ্বয় পুনরায় অক্ষয় ও শরীর রোগশূন্য হইবে। আমি তোমার প্রতি প্ৰসন্ন হইয়াছি; তুমি যথার্থ পরাক্রমশালী, তাহার সন্দেহ নাই; এক্ষণে স্বাভিলষিত বর গ্রহণ কর। হে অরতিনিসূদন! এই মর্ত্যলোকে তোমার সদৃশ পুরুষ আর কেহই নাই; স্বর্গেও তোমা অপেক্ষা প্ৰধান ক্ষত্ৰিয় নয়নগোচর হয় না।
অর্জ্জুন কহিলেন, “হে ভগবন! যদি অনুগ্রহ করিয়া আমাকে বর প্রদান করিতে অভিলাষ করিয়াছেন, প্ৰসন্ন হইয়া সেই ব্রহ্মশিরোনামক ঘোরদর্শন পাশুপত অস্ত্ৰ প্ৰদান করুন, যে ভীমপরাক্রম অস্ত্ৰ যুগান্তসময়ে সমস্ত ব্ৰহ্মাণ্ড এককালে সংহার করিয়া থাকে; আমি ঘোরতর সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া আপনার প্ৰসাদে যে অস্ত্রদ্বারা কর্ণ, ভীষ্ম, কৃপ ও দ্রোণকে পরাজয় করিব; আমি যে অস্ত্রদ্বারা দানব, রাক্ষস, ভূত, পিশাচ, গন্ধর্ব্ব ও পন্নগগণকে সংগ্রামে দগ্ধ করিব; যে অস্ত্ৰ মন্ত্রপূত করিলে সহস্ৰ সহস্ৰ শূল, উগ্রদর্শন গদা ও আশীবিষসদৃশ রাশি রাশি শর সমুৎপন্ন হয়; আমি যে অস্ত্ৰ লইয়া ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ ও কটুভাষী সূতপুত্র কর্ণের সহিত সংগ্রাম করিব। হে ভগনেত্ৰহন ভগবান! আমার এই প্রথম অভিলাষ; আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমাকে এই বিষয়ে কৃতকৃত্য ও সমর্থ করুন।”
মহাদেব কহিলেন, “হে পার্থ। আমি তোমাকে সেই পরমদায়িত পাশুপতাস্ত্ৰ প্ৰদান করিতেছি। তুমি উহা ধারণ, মোক্ষণ ও প্রতিসংহার করিতে সমর্থ হইবে। মনুষ্যগণের কথা দূরে থাকুক, ইন্দ্ৰ, যম, কুবের, বরুণ ও পবন ইহারাও এই অস্ত্রাভিজ্ঞ নহেন। তুমি এই অস্ত্ৰ কদাপি সহসা কোন পুরুষের উপর নিক্ষেপ করিও না, ইহা অল্প-তেজস্ক ব্যক্তির উপর নিপতিত হইলে সমস্ত জগৎ বিনাশ করিবে। চরাচরমধ্যে এই অস্ত্রের অবধ্য কেহই নাই। মন, চক্ষু, বাক্য বা শরাসনদ্বারা এই বাণ প্রয়োগ করিলে অবশ্যই শত্ৰুকুল নির্মূল হইয়া যায়।”
ধনঞ্জয় মহাদেবের বাক্য শ্রবণানন্তর শুচি হইয়া তাহার সমীপে গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে বিশ্বেশ! আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমাকে উক্ত অস্ত্ৰবিষয়িণী শিক্ষা প্ৰদান করুন।” তখন দেবাদিদেব মহাদেব ত্যাগ ও সংহারের মন্ত্র-সমভিব্যাহারে সেই মূর্ত্তিমান শমনসোদর অস্ত্ৰ অর্জ্জুনকে প্রদান করিলেন। তখন সেই অদ্ভুত অস্ত্ৰ ত্ৰ্যম্বক উমাপতির ন্যায় অর্জ্জুনকেও ভজনা করিল; অর্জ্জুনও প্রীতিপ্ৰসন্নমনে উহা গ্ৰহণ করিলেন।
এইরূপে অর্জ্জুন অস্ত্ৰপ্ৰাপ্ত হইবামাত্র পর্ব্বত, কানন, আকর, সাগর, নগর ও গ্রামসমন্বিত সমুদয় মেদিনীমণ্ডল কম্পান্বিত হইতে লাগিল; সহস্ৰ সহস্ৰ শঙ্খ, দুন্দুভি ও ভেরীনিনাদ সমুত্থিত হইয়া উঠিল এবং বারংবার নির্ঘাত-শব্দ হইতে লাগিল। দেবদানবগণ সেই জ্বাজ্বল্যমান মূর্ত্তিমান ঘোর অস্ত্ৰ অর্জ্জুনের পার্শ্বস্থ হইয়াছে, দেখিলেন। দেবাদিদেব মহাদেব অমিততেজঃ অর্জ্জুনের গাত্ৰস্পৰ্শ করিবামাত্র তদীয় শরীরস্থ সমস্ত অশুভ বিনষ্ট হইয়া গেল। তখন ভগবান শূলপাণি অর্জ্জুনকে স্বর্গে গমন করিতে অনুজ্ঞা করিলেন; পাণ্ডুনন্দনও তাঁহাকে প্ৰণাম করিয়া, কৃতাঞ্জলিপুটে অনিমিষ-নয়নে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। অনন্তর মহাদুৰ্গতি সর্ব্বদেবগ্রগণ্য ভগবান ভবানীপতি এইরূপে পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুনকে দানব ও পিশাচগণের অন্তকারী মহাধনু গাণ্ডীব প্রদান করিয়া, তাঁহার সমক্ষেই উমাদেবী-সমভিব্যাহারে সেই পতগমহর্ষিগণোপসেবিত গিরিবরাগ্রগণ্য হিমাচল পরিত্যাগপূর্ব্বক আকাশমার্গে প্রস্থান করিলেন।