০৩. নেলী খালার আসল বিপদ
সকালে ক্ষেন্তির মার চ্যাঁচামেচি শুনে ঘুম ভাঙলো। ঘুমের ঘোরে দরজার বাইরে ওর চ্যাঁচানো শুনে মনে হলো বাড়িতে বুঝি ডাকাত পড়েছে। হঠাৎ শুনি ও বলছে, ও ছোট মেয়া আর কত ঘুম পাড়বে? উঠে দেখ নাগো! মেম খালারা আসিছে।
নেলী খালাকে ক্ষেন্তির মা বলে মেম খালা। গত বছর কদিনের জন্য বেড়াতে এসে ছিলেন নেলী খালা। তখন থেকে ক্ষেন্তির মা ওঁর দারুণ ভক্ত।
নেলী খালার কথা শুনে ঘুম-টুম সব হাওয়া হয়ে গেল। তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। বাবু তখনো ঘুমোচ্ছিলো। ওর ঘুম ভাঙিয়ে বললাম, শিগগির নিচে চলল, নেলী খালারা এসেছেন।
দোতলার বাথরুমে মুখ ধুয়ে নিচের তলার ডাইনিং রুমে এসে দেখি সবাই খাবার টেবিলে বসে আছেন। নেলী খালার মুখটা শুকনো মনে হলো। সারারাতের জার্নির জন্য হতে পারে। আমাদের দেখে মিষ্টি হাসলেন–এই যে হিরোরা! কাল সারারাত নিশ্চয়ই জেগে ছিলে। চোখে তো এখনো ঘুম লেগে আছে!
মা বললেন, ওরা এ রকমই। এতে কী কথা ওদের জমে থাকে আল্লাই জানেন।
আমি আর বাবু চেয়ার টেনে বসলাম। নেলী খালাকে বললাম, তোমরা এতো তাড়াতাড়ি আসবে ভাবি নি। মা কাল বলছিলেন, সব কিছু গুছিয়ে আসতে আসতে আরো তিন, চার দিন লাগবে।
নেলী খালা কাষ্ঠ হেসে বললেন, গোছাবো কী, প্রাণ নিয়ে বেঁচে এসেছি এই তো ঢের।
নানু গম্ভীর গলায় বললেন, নেলী, খাওয়ার সময় ওসব কথা থাক না।
বাবু আমাকে টেবিলের আড়ালে লুকিয়ে চিমটি কাটলো। আমি প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, নেলী খালা, এবার কিন্তু গতবারের মতো হুট করে চলে যেতে পারবে না। দেড় মাস আমার ছুটি। মেজো কাকারাও এবার এখানে থাকবেন। তুমিও জানুয়ারির আগে কোথাও যাবে না।
দেড় মাস কি বলছো, দেড় দিনও থাকতে পারবো বলে তো মনে হয় না। নেলী খালা বিষণ্ণ গলায় বললেন, তবে আব্বু ইচ্ছে করলে থাকতে পারো।
মামা তো থাকবেনই নেলী। মা বললেন, তুমিও বাছা অতো তাড়াতাড়ি যেতে পারবে না। জাহেদকে আমি বুঝিয়ে বলবো।
মার কথা শুনে মনে হলো এ নিয়ে ওঁদের ভেতর আগে কথা হয়েছে। নেলী খালাকে একা না পেলে কিছুই জানা যাবে না। অথচ সব কিছু না জানা অব্দি মনটা ছটফট করছিলো। তবে নেলী খালার চেহারা দেখে এটুকু অনায়াসে বোঝা যায়–বড়ো রকমের ঝামেলায় পড়েছেন।
বাবু বললো, স্ক্যাটরা আসে নি নেলী খালা?
এসেছে। মৃদু হাসলেন নেলী খালা। রাতের ট্রেন জার্নি ও মোটেই পছন্দ করে নি। আমাদের কামরায় থাকতে দেয় নি বলে মন খারাপ করে আছে। বড়িবি ওকে ঘোরাতে নিয়ে গেছে।
আমি আগেও দেখেছি স্ক্যাটরার প্রসঙ্গ উঠলে নেলী খালা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। বললাম, ক্যাটরার মতো সেনসিটিভ কুকুরের কথা আমি কোনো বইতেও পড়ি নি।
এই এক কথাতে নেলী খালার মনটা ভালো হয়ে গেলো। মিষ্টি হেসে বললেন, আবু জানে ওকে আমি কত যত্ন করে ট্রেনিং দিয়েছি। আমাদের বিপদের সময়ে ও ছিলো সবচেয়ে বড়ো সহায়।
এই বলে হঠাৎ থেমে গেলেন নেলী খালা। বুঝলাম নানু পছন্দ করবেন না বলে বিপদের কথা তিনি আর বলতে চাইলেন না।
নাশতা খাওয়ার পর চা খেতে খেতে ভাবছিলাম নুলিয়াছড়ির বিপদের কথা শুনবো। বাবা সেটা আঁচ করতে পেরে বললেন, আবির, বাবু, তোমরা ওপরে যাও। তোমাদের নানুর সঙ্গে দরকারি কিছু কথা আছে আমাদের।
আমি অসহায়ভাবে নেলী খালার দিকে তাকালাম। সবার অজান্তে নেলী খালা চোখ টিপে ওপরে যেতে ইশারা করলেন। আমার সঙ্গে বাবুও সেটা দেখতে পেলো। আমরা
দুজন চা শেষ করে ওপরে এসে কথার ঝাঁপি খুলে বসলাম। এবারের প্রসঙ্গ বলাই বাহুল্য নেলী খালা।
বাবু, লক্ষ্য করেছে, নেলী খালার চেহারা কেমন যেন ক্লান্ত আর বিষণ দেখাচ্ছিলো।
বাবু গম্ভীর হয়ে আমার কথায় সায় দিলো–মনে হচ্ছে বড়ো রকমের বিপদেই পড়েছিলেন।
পড়েছিলেন বলছো কেন? আমার তো মনে হয় বিপদ এখনো কাটে নি।
নুলিয়াছড়ি থেকে চলে এসেছেন–এখন আর বিপদ কোথায়? বাবু একটু অবাক হলো।
আমার মনে হয় বিপদ এখনো কাটে নি। অন্তত নেলী খালার চেহারা আর নানুর কথা শুনে তাই মনে হলো।
নানুর কথায় বিপদের কী পেলে?
নেলী খালা আমাদের সামনে বিপদের কথা আলোচনা করুক–নানু ঠিক পছন্দ করছিলেন না।
তাতে কী হলো?
মনে হচ্ছে বিপদ এখনো রয়ে গেছে। বাবু চিন্তিত গলায় বললো, কী জানি, আমার কিন্তু মনে হয় না, বিপদ ওঁদের পেছন পেছন এতোদুর আসবে।
আমার আনুমান যে ঠিক ছিলো দুপুরেই তার প্রমাণ পাওয়া গেলো। খাওয়াদাওয়া শেষ করার পর বিশ্রাম নেয়ার কথা বলে নেলী খালা এক ফাঁকে হুট করে আমাদের চিলেকোঠার ঘরে চলে এলেন। ওঁকে দেখে বাবু অবাক হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলো–নেলী খালা ঠোঁটে আঙুল তুলে ইশারায় চুপ করতে বললেন। তারপর দরজার ছিটকিনি বন্ধ করে বিছানায় উঠে বসলেন।
জানি, সব কিছু না শুনলে তোমাদের পেটের ভাত হজম হবে না, টেনশনের চোটে ঘুম হবে না, সারাক্ষণ মনে মনে আমাকে গাল দেবে। তাই সব বলার জন্য লুকিয়ে চলে এসেছি। শানু আপা এখনো মনে হচ্ছে ঘুমোন নি।
নেলী খলার কথা শুনে আমি মৃদু হাসলাম–মা বিছানায় শোয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে গভীর ঘুমে ডুবে যান। তুমি নিশ্চিন্তে গলাটা আরো খুলে কথা বলতে পারো।
নেলী খালা মিষ্টি হাসলেন। সকালবেলা ওঁকে যতোটা বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিলো তার চেয়ে এখন অনেক ফ্রেশ লাগছে। বললেন, শানু আপাকে পাকড়াশীর শয়তানির কিছু কথা লিখেছিলাম। সব কথা লিখি নি। জানি, শানু আপার হার্টের অবস্থা ভালো নয়। তবে তোমাদের বলা যেতে পারে।
আমরা দুজন নেলী খালার কথা গোগ্রাসে গিলছিলাম। একটু থেমে তিনি বললেন, পাকড়াশী আমাকে দুবার খুন করার চেষ্টা করেছিলো।
বলো কী! বাবু আর আমি দুজন একসঙ্গে আঁতকে উঠলাম।
প্রথমবার আমার জীপের ব্রেকের তার কেটে দিয়েছিলো। প্রত্যেক রোববার সকালে আমি কক্সবাজার যাই। সেই রোববারেও জীপ নিয়ে বেরিয়েছি। পাহাড় থেকে নামতে গিয়ে হঠাৎ দেখলাম ব্রেক কাজ করছে না। ড্রাইভিংটা ভালোভাবে রপ্ত করেছিলাম বলে কোনো রকমে স্কেট করে একটা গাছের সঙ্গে লাগিয়ে জীপটা থামিয়েছিলাম। দেড় গজ এদিক-ওদিক হলে দেড় শ ফুট নিচে ছিটকে পড়ে ছাতু হয়ে যেতাম।
কথাগুলো নেলী খালা খুব সহজভাবে বললেন। ততক্ষণে আমার আর বাবুর মাথার চুল সব দাঁড়িয়ে গেছে। এসব কী বলছো নেলী খালা! এ যে ইংরেজি থ্রিলার ছবির মতো মনে হচ্ছে!
আমার কথা শুনে নেলী খালা কাষ্ঠ হাসলেন–পাকড়াশীর মতো ভিলেন থ্রিলারেও খুব কম পাবে। আরেকবার চেষ্টা করেছিলো খাবারে বিষ মিশিয়ে। স্ক্যাটরা তো সেবার মরতে বসেছিলো। দুজন বিদেশী লোক মিথ্যে পরিচয় দিয়ে গেস্ট হয়ে এসেছিলো। লোক দুটো ছিলো থাই। কী অমায়িক ব্যবহার! আসার পথে বাজারে কারা নাকি ওদের ভয় দেখিয়েছিলো আমার এখানে না আসতে–সে সবও বলেছে। একদিন খাবার টেবিলে রান্নার প্রসঙ্গ উঠতে একজন বললো, ও নাকি দারুণ থাই স্যুপ রাঁধতে জানে। তোমরা তো জানো, নুতন নতুন রান্না করা আমার একটা হবি। থাই স্যুপের রেসিপিটা কোথাও পাচ্ছিলাম না। ওরা বলতেই আমি আহ্লাদে গলে গিয়ে বললাম, যতক্ষণ বেঁধে না খাওয়াচ্ছো ততক্ষণ কী করে মানি তুমি দারুণ রাঁধতে পারো। ওরা এটাই চাচ্ছিলো। পরদিন দুপুরে রান্না করলো। বাজারও ওরা করেছিলো। দুপুরে সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছি। সবার সামনে স্যুপের বাটি, চমৎকার গন্ধ, চামচে করে মুখে তুলতে যাবো, এমন সময় হঠাৎ কোত্থেকে একটা তেলেপোকা এসে আমার বাটিতে পড়লো। বড়িবি কাছেই ছিলো। ছুটে এসে পেয়ালার স্যুপটুকু জানালা দিয়ে কলতলায় ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে ওর হাত ফসকে পেয়ালাটাও বাইরে চলে গেলো। বেচারি দৌড়ে গেলো সেটা আনতে। একটু পরে শুনি ওর চিৎকার। ছুটে গিয়ে দেখি স্ক্যাটরার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছে আর গোঙাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে। বড়িবি বললো, কলতলায় পড়া স্যুপ খেয়ে নাকি এ অবস্থা। সঙ্গে সঙ্গে স্ক্যাটরাকে জীপে তুলে নিয়ে ছুটলাম কক্সবাজারের ভেটেরিনারি হসপিটালে। ওখানে ওর স্টমাক ওয়াশ করে ইনজেকশন দিয়ে আনতে আনতে রাত হয়ে গেলো। বাড়িতে এসে শুনি গেস্ট দুজন হাওয়া। আমাকে দুপুরে পাগলের মতো ওভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে আব্বু থাই দুটোর কাছে। দুঃখ প্রকাশ করে ওদের বসতে বলে জাহেদকে খবর দিতে গিয়েছিলেন। জাহেদ শুনেই বললো, এ কাজ আপনাদের গেস্টরাই করেছে। ওরা এসে দেখে পাখি উড়ে গেছে। পরে আব্দুর পেয়ালার স্যুপ পরীক্ষা করে ওতে আর্সেনিক পাওয়া গিয়েছিলো।
নেলী খালার কথা শেষ হওয়ার পর বাবু আপন মনে–কী শয়তান! বলে শিউরে উঠলো।
আমার গলা শুকিয়ে তখন কাঠ হয়ে গেছে। ঢোক গিলে বললাম, তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে, ওই সময় যদি তেলেপোকাটা তোমার বাটিতে না পড়তো–
তোদের নেলী খালাকে পরকালের টিকেট কাটতে হতো। এই বলে নেলী খালা মুখ টিপে হাসলেন।
বাবু অবাক হয়ে বললো, নেলী খালা, আপনি হাসছেন!
নেলী খালা হাসিমুখে বললেন, মরার আগে যারা মরার ভয়ে আধমরা হয়ে থাকে ওদের কাপুরুষ বলে বাবু।
বাবু লজ্জা পেলো। আমতা-আমতা করে বললো, না মানে আমি বলছিলাম, আপনি ভীষণ সাহসী।
সহজ গলায় নেলী খালা বললেন, সেবার নুলিয়াছড়িতে তোমরাও কম সাহস দেখাও নি!
আমি বললাম, এ দুটো ঘটনার সঙ্গে পাকড়াশী জড়িত, এটা তুমি টের পেলে কী করে?
দুবারই পাকড়াশী চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। ইনফ্যাক্ট পাকড়াশী হাজত থেকে বেরিয়ে এসেই আমাকে ঠাণ্ডা গলায় বলেছিলো, মিস চৌধুরী, আজ পর্যন্ত অনেকে আমার পেটে লাথি মারার চেষ্টা করেছে। দুঃখের বিষয় তাদের সবাইকে অসময়ে পৃথিবীর মায়া কাটাতে হয়েছে। আপনার জন্যেও আমার দুঃখ হচ্ছে। এরপর জীপ দুর্ঘটনার দুদিন পর লেটার বসে চিঠি পেলাম। সাদা খামের ভেতর লাল এক টুকরো কাগজে শুধু লেখা, আপনার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। থাই স্যুপের ঘটনার দুদিন পর আবার সেই একই চিঠি। কাল সকালে নুলিয়াছড়ির বাড়ি ছেড়ে বেরুবার আগে লেটার বসে দেখি আগের মতো সাদা খাম। খুলে দেখি সেই লাল কাগজে লেখা–আমার দুঃখ আপনার সঙ্গে যাচ্ছে। আশা করি অচিরেই সব দুঃখ শেষ হবে।
থানায় ডায়েরি করাও নি?
আমার কথার জবাবে নেলী খালা ম্লান হাসলেন–থানা-পুলিশের ওপর তোরা খুব ভরসা করিস, তাই না! পাকড়াশী সব কটাকে টাকা খাইয়ে গোলাম.বানিয়ে রেখেছে।
আমার মনে পড়লো, মাকেও নেলী খালা লিখেছিলেন থানা-পুলিশ সব ওদের দলে। আমি বললাম, জাহেদ মামা ছাড়া ওখানে আর কেউ এসব জানে?
মুহূর্তের জন্য নেলী খালার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হলো। মিষ্টি হেসে তিনি বললেন, আসার সময় চিঠিতে সব জানিয়ে এসেছি।
অবাক হয়ে বাবু জিজ্ঞেস করলো, কার কথা বলছেন?
কেন বুড়ো মুৎসুদ্দী! রহস্যভরা গলায় নেলী খালা বললেন, নুলিয়াছড়ির চিল্লানোরাস মুৎসুদ্দীর কথা নিশ্চয় ভুলে যাও নি।
মানে তানভীর সাহেব? তিনি কি এখনো কক্সবাজার আছেন? বাবু যাচাই করতে চাইলো নেলী খালা সত্যি কথা বলছেন কিনা।
ওঁর পোস্টিংই তো ওখানে। নির্বিকার গলায় বললেন নেলী খালা।
আমি জানতে চেয়েছিলাম ভাইয়া এসব জানে কিনা। নেলী খালা আমার কথা ঠিকই বুঝেছেন, অথচ বাবুকে কিছুই বুঝতে দিলেন না। আবার আগের কথায় ফিরে গেলাম, তুমি তাহলে ভাবছো পাকড়াশী পাথারিয়া গিয়েও তোমাদের জ্বালাতে পারে?
আমি অতোটা ভাবি নি। এটা জাহেদের ধারণা। জাহেদকেও ও গ্রেট করেছে। বলেছে বদলিটা কোনো সাজা নয়, ওকেও নাকি উচিত সাজা দেবে পাকড়াশী। যাতে ভবিষ্যতে ওকে ঘটাবার সাহস কারো না হয়।
বাবু বললো, আমার মনে হয়, নেলী খালা, আপনার ধারণাই ঠিক। আপনারা যখন নুলিয়াছড়ি ছেড়ে চলেই এসেছেন, তখন পাকড়াশীর কোনো অসুবিধে হওয়ার তো কথা নয়। প্রথম থেকেই তো ওখানে আপনাদের থাকার ব্যাপারে ওর আপত্তি ছিলো।
সে জন্যেই তো এতো বিপত্তি।
আমার কথার ধরন দেখে নেলী খালা আর বাবু দুজনেই হেসে ফেললো। নেলী খালাকে হাসতে দেখে মনে ভারি আনন্দ হলো। বললাম, সকালে আমাদের ওপরে পাঠিয়ে দিয়ে এতো কী আলোচনা করলে তোমরা?
তোর বাবা জানতে চাইছিলেন সব কথা। আব্বু আর আমি আগেই ঠিক করেছিলাম, পাকড়াশী যে আমাদের মেরে ফেলতে চেয়েছিলো এ কথা তোদের বড়িতে আলোচনা করবো না। শানু আপা এমনিতেই নার্ভাস টাইপের মানুষ। সামান্য কিছু হলেই উত্তেজিত হয়ে পড়েন। যতটুকু বলেছি তাতেই মনে হলো মুচ্ছো যাবেন। এই বলে নেলী খালা উঠে দাঁড়ালেন–কাল সারা রাত ট্রেনে ঘুম হয় নি। একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার।
নেলী খালা দরজার ছিটকিনি খুলতে যাবেন–এমন সময় বাবু বললো, আসল কথাটাই তো জানা হলো না নেলী খালা?
কোন কথা? একটু অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন নেলী খালা।
জাহেদ আমার সঙ্গে তোমার বিয়ের খাওয়াটা কবে হবে সেটাই তো জানা হলো না।
তবে রে পাজি ছেলে! ছুটে এসে বাবুর পিঠে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিলেন নেলী খালা–এসব হচ্ছে বড়োদের ব্যাপার। রহস্যভরা গলায় তিনি বললেন, আমি কি একবারও জানতে চেয়েছি ললি টুনিরা মাসে তিন-চারটা করে চিঠি কাদের লেখে?
লজ্জায় লাল হয়ে গেলো বাবু। নেলী খালা ওর চিবুক নেড়ে আদর করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
.
০৪. একটি আনন্দঘন উৎসব
নেলী খালার বিয়ে সম্পর্কে বড়োরা কি ভেবেছে সেটা জানার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হলো পরদিন সকাল পর্যন্ত, যতক্ষণ না জাহেদ মামা এলেন। ললি একবার চিঠিতে লিখেছিলো, জাহেদ মামাকে দেখলে মনে হয় হলিউডের ওয়েস্টার্ন ছবির সুদর্শন রুক্ষ নায়কটি বুঝি সিনেমার পর্দা থেকে নেমে এসেছেন। লম্বায় ছ ফুটের কম হবেন না, গায়ের রঙ তামাটে, ধারালো চেহারা সব কিছু মিলিয়ে বাঙালি মনে হয় না। অথচ নেলী খালার চুলের ছাঁট আর পোশাক যতই ইউরোপিয়ান হোক না কেন, তাঁর চেহারা একেবারেই বাঙালি–অনেকটা দুর্গা প্রতিমার মতো। প্রথম এসেছিলেন বয়কাট চুল নিয়ে, মার বকুনি খেয়ে চুল ছাটা বন্ধ করাতে এখন ঘাড় পর্যন্ত নেমেছে। সেবার নানু যখন নুলিয়াছড়িতে চমৎকার এক রাতের পার্টিতে নেলী খালার সঙ্গে মেজর জাহেদ আহমেদের বিয়ের কথা বলেছিলেন, তা তখন শুধু আমরা কেন, উপস্থিত সবাই বলেছিলো দুজনকে চমৎকার মানাবে।
জাহেদ মামার সঙ্গে আমাদের দেখা হলো সকালে নাশতার টেবিলে। আটটার সময় আমি আর বাবু যখন তৈরী হয়ে নিচে গেছি, দেখি জাহেদ মামা বসে আছেন নেলী খালার পাশে। বাবা মা আর মেজো কাকা টেবিলের আরেক দিকে। নানু ঘড়ি ধরে সাতটায় ব্রেকফাস্ট করেন বলে তিনি সেখানে ছিলেন না। আমাদের দেখেই জাহেদ মামা হৈচৈ করে উঠলেন–এই যে ক্ষুদে গোয়েন্দার দল, এতোক্ষণে বুঝি ঘুম ভাঙলো! যাবে নাকি পাথারিয়া? বেড়াবার জন্য এমন চমৎকার জায়গা আর কোথাও পাবে না।
জাহেদ মামার কথা শুনে মা অবাক হয়ে বললেন, সে কী বাছা! নিজেরা কোথায় গিয়ে উঠবে তারই কিছু ঠিক হলো না, বলছো কী এসব?
জাহেদ মামার হঠাৎ মনে পড়লো আমাদের বাড়িতে তিনি আজই নতুন এসেছেন এবং জায়গাটা নুলিয়াছড়ি নয়, তখনই নিজেকে সামলে নিলেন। লাজুক হেসে বললেন, না আপা, বলছিলাম কি, আমরা ওখানে গিয়ে ঠিকঠাক হয়ে বসে ওদের বেড়াতে নিয়ে যাবো।
তাই বলো। মা আশ্বস্ত হলেন–আমি ভাবলাম কালই বুঝি তুমি ওদের বগলদাবা করে নিয়ে যাবে।
নেলী খালা বললেন, তুমিও চলো না শানু আপা কদিন বেড়িয়ে আসবে। এতে করে নুলিয়াছড়ি যেতে বললাম, গেলে না।
মা গম্ভীর হয়ে বললেন, তোমাকে তো আগেও বলেছি নেলী, এ বাড়ি ছেড়ে আমার নড়বার উপায় নেই।
মার কথা শুনে নেলী আপা একটু অপ্রস্তুত হলেন। ভাইয়া চলে যাওয়ার পর মা একদিনের জন্যেও বাড়ি ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকেন নি। ওঁর ধারণা, ভাইয়া একদিন হঠাৎ করে বাড়ি আসবে আর তিনি সেই সময় বাড়িতে না থাকলে ও ভীষণ বিপদে পড়বে।
বাবা প্রসঙ্গ পাল্টে রহস্যভরা গলায় বললেন, জাহেদ একা শপিং করতে পারবে তো, না আমাকে সঙ্গে যেতে হবে?
জাহেদ মামা বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, না না, আমি একাই পিরবো। আপনি মিছেমিছি ক্লাস নষ্ট করবেন কেন?
বাবা মুখ টিপে হেসে বললেন, আজ না হয় ক্লাস পালালাম, কী বলো নেলী?
নেলী খালা লজ্জা পেয়ে বললেন, আমি কী বলবো!
ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলেও আমি নিরীহ গলায় জানতে চাইলাম, আজ কী হবে বাবা?
বাবার মুখে তখনো চাপা হাসি-আজ তোমাদের নেলী খালার বিয়ে।
অবাক হয়ে বাবু বললো, আজই! কেমন করে?
যেমন করে বিয়ে হয়! রাতে কাজী এসে বিয়ে পড়াবেন!
বাহ। আমরা ভেবেছি নেলী খালার বিয়েতে কত মজা করবো! কার্ড ছাপা হবে, সবাই আসবে, হৈচৈ হবে। বরযাত্রীদের গেট আটকানো–আরও কত কী করবো বলে ঠিক করে রেখেছি–
বাবুর কথা শুনে বোঝা গেলো এভাবে হুট করে নেলী খালার বিয়ে হয়ে যাবে, এটা ও মেনে নিতে পারছে না। আমাকে চিঠিতেও লিখেছিলো, নেলী খালার বিয়েতে নিশ্চয়ই ললি টুনিরা আসবে। ওদের নিয়ে কী সব মজা করবে নানারকম প্ল্যান এঁটেছিলো বাবু। এখন দেখা যাচ্ছে সবই ভেস্তে গেলো। বেচারার জন্য আমার ভারি মায়া হলো।
বাবা ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, জাহেদকে পরশু নতুন জায়গায় রিপোর্ট করতে হবে। তাছাড়া তোমাদের নানুও চান না বিয়ে নিয়ে এ সময়ে কোনো হৈচৈ হোক।
মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপন মনে বললেন, আমার একটামাত্র মেয়ে। আমার নিজেরই বা ছাই নেলী ছাড়া কে আছে! কী ভেবেছি আর কী হলো!
নেলী খালা মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, তুমি যখন কোথাও যাবে না শানু আপা, তখন আমরাই তোমার এখানে পরের বার এসে বড়ো করে একটা পার্টি দেবো। তখন তুমি যা খুশি কোরো।
মেজো কাকা এতক্ষণ পর বললেন, নুলিয়াছড়িতে কি হয়েছে সব ভুলে যাও নেলী। তোমাকেও বলছি জাহেদ, পাকড়াশীকে তোমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ও এখানে কিছুই করতে পারবে না। আজ যতটুকু আনন্দ করা যায় আমরা তাই করবো। শানু ভাবী, তুমি এক্ষুণি বাজারের ফর্দ তৈরি করো। জাহেদ, তোমার কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব থাকলে আসতে বলল। ছেলেরা ঘর সাজাবে।
বাবা মৃদু হেসে বললেন, সবাইকে কাজে লাগালি মেজো, আমি কী করব?
মেজো কাকা গম্ভীর হয়ে বললেন, তুমি আপাতত আমার সঙ্গে বাজারে যাবে, তারপর ভাবীকে রান্নাঘরে সাহায্য করবে। আমারও একটু শপিং আছে।
বাবা রান্না করবেন শুনে মা ফিক করে হেসে ফেললেন–তোমার ভাই যদি আমার সঙ্গে রান্নাঘরে থাকে, তাহলে আজ আর কাউকে কিছু খেতে হবে না জামি।
কেন, আমি কী করেছি! অবাক হয়ে জানতে চাইলেন বাবা।
মনে নেই বুঝি! মুখ টিপে হেসে মা বললেন, বিয়ের পর কোত্থেকে ইংরেজি এক রান্নার বই এনে কি উদভুটে সব রান্না করতে! পাড়াসুদ্ধো লোক টের পেতো। বাড়ির কেউ তো খেতোই না, চাকররা পর্যন্ত বাহানা করে বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতো না।
বাবা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ওসব কথা এখনো বুঝি তোমার মনে আছে! সবই যখন বললে, তখন তোমার মামা আমার রান্না খেয়ে কি বলেছিলেন সেটা বলছে না কেন?
আব্বু বুঝি আপনার রান্না খুব পছন্দ করতেন? জানলে চাইলেন নেলী খালা।
করবেন না কেন? মা এমনভাবে বললেন যেন নানু মহা অন্যায় করে ফেলেছেন। দুনিয়াতে এমন কোনো অখাদ্য রান্না আছে–তোর আব্বু সোনা হেন মুখ করে খান নি! কোরিয়ায় যখন ছিলেন তখন শুনেছি–মা গো, সাপের স্যুপ আর বানরের মাথার মগজ ভাজি খেয়েছেন। এই বলে ঘেন্নায় শিউরে উঠলেন মা।
মেজো কাকা বললেন, থাক, আর বলতে হবে না। তুমি ভয় পেয়ো না ভাবী। ভাইয়াকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাবো।
মা টেবিল ছেড়ে উঠলেন–সবাই তাহলে যে যার কাজে লেগে যাও। হাতে সময় একেবারেই নেই।
জাহেদ মামাও উঠে পড়লেন–আমি তাহলে বেরুচ্ছি।
দুপুরের আগে ফিরে এসো কিন্তু। এই বলে মা রান্নাঘরের দিকে গেলেন।
আমি আর বাবু এক লাফে তিনটি করে সিঁড়ি টপকে প্রথমে এলাম চিলেকোঠার ঘরে। দুজনে মিলে ঠিক করলাম কিভাবে ঘর সাজাবো।
আমি বললাম, নেলী খালাদের ঘরটা ফুল দিয়ে সাজাবো। মেঝেতে কার্পেট সরিয়ে আল্পনা দেবো।
বাবু বললো, এতো ফুল পাবে কোথায়?
বাগানে যা আছে সব তুলবো। দরকার হলে কিনবো।
তোমাদের এখানে রঙিন রাংতা পাওয়া যায়?
যায় বৈকি! একবার আমরা স্কুলের নাটকের জন্য কিনেছিলাম। শাঁখারি বাজারে অনেক দোকান আছে।
আমাদের ইনটেরিয়ার ডেকোরেশন ক্লাসে ঝালর বানানো শিখিয়েছিলো। রঙিন রাংতা কোটে ঝালর আর ফুল বানালে দারুণ লাগবে!
এমন সময় আমাদের দুজনকে চমকে দিয়ে নেলী খালা ঘরে ঢুকলেন। যেন ষড়যন্ত্র করছেন–এমনভাবে চাপা গলায় বললেন, জাহেদ তোমাদের জন্য পাঁচ শ টাকা দিয়ে গেছে। বলেছে গেট ধরতে পারো নি বলে যেন মন খারাপ না করো।
একশ টাকার পাঁচখানা নোট বাবুর পকেটে গুঁজে দিয়ে নেলী খালা চলে গেলেন।
উত্তেজনায় বাবুর চোখ দুটো চকচক করে উঠলোএ টাকাটা আমরা ঘর সাজাবার কাজে খরচ করতে পারি।
একসঙ্গে হঠাৎ এতোগুলো টাকা পেয়ে আমিও কম উত্তেজিত হই নি। বললাম, ঘর সাজাবার জন্য এতো টাকা লাগবে না। আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। যা বাঁচবে সেগুলো দিয়ে আমরা নেলী খালাদের জন্য উপহার কিনবো।
দারুণ বলেছে আবির। এই বলে বাবু ফুর্তির চোটে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
ঝটপট কাপড় বদলে দুজন মাকে বলে বেরিয়ে পড়লাম। শাঁখারি বাজারের মঞ্চমায়া থেকে বাৰু দুই দিস্তা রাংতা আর নানা রঙের ফিতা কিনলো। কোতোয়ালি ফাঁড়ির ফুলওয়ালাদের কাছে গেলাম ফুলের অর্ডার দেয়ার দেয়ার জন্যে। ওরা বিকেলের পর থেকে ফুল বিক্রি করে। চারজন মিলে চল্লিশটা রজনীগন্ধার স্টিক আর দুই ডজন গোলাপ দিতে পারবে বলে জানালো। নেবে এক শ টাকা।
বাবু বললো, আরো বেশি পেলে ভালো হতো।
আমি বললাম, আমাদের বাগানে দেখেছো কত রজনীগন্ধা! এ বছর অনেক হয়েছে।
বাবু জিজ্ঞেস করলো, ফুল কেনার টাকা বাদে হাতে কত থাকছে?
জাহেদ মামার পাঁচশটাকার ভেতর তিন শর মতো থাকবে। আমি আরো পঞ্চাশ টাকা দিতে পারবো।
আমার কাছে আছে দু শটাকা। নেলী খালাদের জন্য কী উপহার কিনবে ঠিক করো।
আমাকে একবার নেলী খালা বলেছিলেন তিনি সবচে বেশি খুশি হন বই উপহার পেলে।
কী বই কিনবে?
আগে বাংলাবাজার চলো। দোকানে গিয়ে দেখি কী বই কেনা যায়।
অন্য সময় হলে হেঁটেই যেতাম। সেদিন তাড়া ছিলো বলে আট আনা দিয়ে রিকশা নিলাম।
বাবু বললো, আগে যদি জানতাম, দারুণ সব বই আনতে পারতাম।
এখানেও অনেক ভালো বই পাওয়া যায়।
তুমি তো জানো না, ওখানে প্রত্যেক বছর বইয়ের দোকানে সেল-এর সময় পানির দামে বিরাট বিরাট সেট বিক্রি হয়।
বাংলাবাজারে মাওলা ব্রাদার্স-এর সামনে এসে রিকশা বিদায় করলাম। একদিকে ইণ্ডিয়ান, আরেক দিকে আমাদের দেশের বই দেয়ালজোড়া তাক ভর্তি সাজানো। বইয়ের দোকানে এলে আমার হুশ থাকে না। বই দেখে অনায়াসে কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারি। বাবুকে বললাম, তাড়াতাড়ি পছন্দ করো।
বাবু বেশি সময় নিলো না। এগারো খণ্ডের শরৎ রচনাবলী পছন্দ করলো ও। চকলেট রঙের রেকসিনে বাঁধানো সোনার হরফে লেখা প্রচ্ছদ। উপহার দেয়ার জন্য। চমৎকার পছন্দ। সাড়ে তিন শটাকা দিয়ে পুরো শরৎ রচনাবলী কিনে যখন বাড়ি ফিরলাম ঘড়িতে তখন এগারোটা বাজে। কী এনেছি কাউকে টের পেতে দিলাম না।
জিনিসপত্র চিলেকোঠার ঘরে রেখে এসে নেলী খালাকে বললাম, সন্ধ্যে পর্যন্ত তোমার ঘর আমাদের দখলে থাকবে। এর মধ্যে ভেতরে আসতে পারবে না। তোমার দরকারি জিনিসপত্র যা আছে নিয়ে মার পাশের ঘরে চলে যাও।
নেলী খালা কাঁধ নাচিয়ে শ্রাগ করে তাঁর ছোট সুটকেসটা নিয়ে নিচে চলে গেলেন। আমরা বসলাম, সাদা রেডিমিক্সড পেইন্ট দিয়ে আল্পনা আঁকতে। ছবিতে আমার হাত যে স্কুলে সবার চেয়ে ভালো, এ কথা ড্রইং টীচার অনেকবার বলেছেন। আল্পনা আঁকতে গিয়ে দেখলাম বাবুর হাতও কম পাকা নয়।
নেলী খালার ঘর সাজাতে পুরো পাঁচ ঘন্টা লাগলো। এর ভেতর এক ফাঁকে আমি ইসলামপুর থেকে ফুল নিয়ে এলাম। ফুল আনতে গিয়ে দেখি ফুলওয়ালার ডালার ওপর রজনীগন্ধার মস্তো মোটা দুটো মালা। বাবুকে অবাক করে দেয়ার জন্য পঞ্চাশ টাকা দিয়ে মালা দুটো কিনলাম। ততক্ষণে বাবু রঙিন রাংতার ফুল আর ঝালর দিয়ে দেয়াল সাজিয়ে ফেলেছে। বললাম, নেলী খালার বিয়ে যতটা সাদামাটা হবে ভেবেছিলাম, ততটা কিন্তু হচ্ছে না।
বাবু ফুলের মালা গাঁথতে গাঁথতে বললো, তবু যদি নেলী খালাকে বউ সাজানো যেতো! জেঠিমা জোর করে হলুদ মাখিয়েছেন বটে, নেলী খালা বলেছেন মুখে ওসব ফোঁটা-টোটা দিতে পারবেন না।
আমি মালা দুটো বের করে বললাম, এটা পরালে চলবে তো বাবু?
মালা দেখে বাবু আনন্দে আটখানা হলো–কী দারুণ জিনিস এনেছে আবির। এতো সুন্দর মালা আমি ভাবতেও পারি নি এখানে পাবে!
এখন কাউকে দেখাবো না। সময় এলে বের করবো। এই বলে আমিও মালা গাঁথতে বসলাম। একটু পরে ক্ষেন্তির মা এসে চা খেতে ডাকলো। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে আমরা ঘর সাজাচ্ছিলাম। সবশেষে নেলী খালার খাটটা রজনীগন্ধার মালা দিয়ে সাজিয়ে যখন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ঘরটাকে দেখলাম, মনে হলো রূপকথার কোনো ছবি। তারপর উপহারের প্যাকেট এনে টেবিলে রেখে পরিতৃপ্ত মনে চা খেতে নামলাম।
খাবার টেবিলে শুধু নেলী খালা আর মেজো কাকাকে দেখলাম। স্ক্যাটরা শুয়ে আছে নেলী খালার পায়ের কাছে। দুদিন ধরে বেচারা মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নুলিয়াছড়ির অতবড়ো বাড়ি আর লনের মজা কি আমাদের রূপলাল লেনের পুরনো বাড়ির এক চিলতে উঠোনে পাবে!
মা যে রান্নাঘরে ব্যস্ত, খাবার ঘর থেকেই গন্ধে টের পাচ্ছিলাম। মেজো কাকাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা কোথায়?
কাজীর অফিসে গেছে। এই বলে মেজো কাকা আড়চোখে নেলী খালাকে দেখলেন।
নেলী খালা বললেন, আবির, বাবু, তোমাদের ঘরে আমি দুটো প্যাকেট রেখে এসেছি। কিছুক্ষণ আগে তোমাদের জাহেদ মামা এসে দিয়ে গেছেন।
আর জাহেদ মামা বলাচ্ছো কেন নেলী! একটু পরেই তো জাহেদ খালু হয়ে যাবে। কি রে, তোরা খালু ডাকবি তো?
নেলী খালাকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য বললাম, আমরা বিয়ের পরও মামা ডাকবো। খালু কেমন আলু আলু শোনায়।
নেলী খালা ফিক করে হেসে ফেললেন। মেজো কাকা গম্ভীর হওয়ার ভান করলেন–তাহলে নেলী মামী ডেকো।
এবার নেলী খালা মুখ খুললেন, জামি ভাই, আপনি সেই দুপুর থেকে আমার পেছনে লেগেছেন। আমাকে আর জাহেদকে ওরা যা খুশি ডাকবে।
মেজো কাকা কি যেন বলতে যাবেন, এমন সময় রান্নাঘর থেকে মা ডাকলেন, জা,ি একবার শুনে যাও তো!
মেজো কাকা সঙ্গে সঙ্গে উঠে ভেতরে গেলেন। এই ফাঁকে নেলী খালাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কোনো শাড়িটা পরবে ঠিক করেছো?
নেলী খালা একটু লজ্জা পেলেন–জাহেদ একটা জামদানি শাড়ি কিনেছে। শাড়ি অবশ্য সাত-আটটা কিনেছে। বেনারসিও আছে। আমার পছন্দ জামদানি। এই বলে তিনি চেয়ার থেকে উঠলেন। বললেন, শানু আপা একা কুলোতে পারছেন না। ওঁকে একটু সাহায্য করা দরকার।
আমি বললাম, তোমাকে মা আজ মোটেই রান্নাঘরে ঢুকতে দেবেন না।
নেলী খালা মৃদু হেসে চলে গেলেন। বাবু বললো, ড্রইং রুমটা এখনো গোছানো হয় নি। জলদি করো।
কথা বলতে বলতে চা এমনিতে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিলো। এক চুমুকে শেষ করে বললাম, তুমি ওপরের ঘর থেকে চার-পাঁচটা রজনীগন্ধার স্টিক আর কটা গোলাপ নিয়ে এসো ফুলদানির জন্য।
মার হাতে-বোনা কুশন কভারগুলো বের করে কুশনগুলোকে পরালাম। বাইরের বারান্দায় আগেই আল্পনা এঁকেছিলাম। দুটো ফুলদানিতে গোলাপ আর রজনীগন্ধা সাজালাম। সন্ধ্যের সময় বসার ঘরের লাইটগুলো সব জ্বালিয়ে দিলাম। ক্যাসেটে চাপালাম বিসমিল্লা খাঁর সানাই। সারা ঘর উৎসবের আনন্দে ঝলমল করে উঠলো।
ড্রইং রুম সাজানো শেষ করেই আমরা আমাদের চিলেকোঠার ঘরে গেলাম। বিছানার ওপর দেখি আমাদের দুজনের নাম লেখা দুটো প্যাকেট। খুলতেই বেরুলো লেভিস-এর জিনস আর জ্যাকেট। বাবুরটা নীল, আমারটা হালকা শ্যাওলা সবুজ। সেজেগুজে সাড়ে ছটায় নিচে নামলাম।
সাতটার দিকে জাহেদ মামা এলেন। অবাক হয়ে দেখি পেছন পেছন দুটো বড়ো মিষ্টির বাক্স হাতে ঘরে ঢুকলেন নুলিয়াছড়ির চিল্লানোরাস মুৎসুদ্দী–থুড়ি, কর্নেল তানভীর হোসেন চৌধুরী। বাবু ওঁকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলোআপনি কবে ঢাকা এলেন তানভীর আঙ্কল?
জাহেদের সঙ্গেই এসেছি। মৃদু হেসে কর্নেল বললেন, তোমরা ললি টুনিকে ফেলে বুঝি নেলী খালা আর জাহেদ মামার বিয়েতে মজা করছে। জানতে পারলে ওরা কিন্তু তোমাদের সঙ্গে কথা বলবে না।
ওঁর কথা শুনে বাবা, মেজো কাকা আর নানু বেরিয়ে এলেন। জাহেদ মামা পরেছেন নীলচে কালো স্যুট, শার্টের রঙ হালকা নীল, টাই গাঢ় নীলের ভেতর হালকা নীলের ফোঁটা। দেখাচ্ছিলো ঠিক রবার্ট রেডফোর্ডের মতো। মুখে লজ্জা শোনো মৃদু হাসি। জাহেদ মামার বাবা-মা কেউ নেই। আছেন এক ভাই, থাকেন বিলেতে। কর্নেল চৌধুরী এসেছেন ওঁর মুরুব্বি হয়ে।
বাবা এগিয়ে এসে কর্নেল চৌধুরীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, ছেলেদের কাছে আপনার কথা এতো শুনেছি যে বলার নয়।
মেজা কাকু মৃদু হেসে বললেন, আমেরিকায় বসে আমাকেও শুনতে হয়েছে।
কর্নেল চৌধুরী হা হা করে হাসলেন–এরা না থাকলে আমাদের আরো বহুদিন অন্ধকারে পথ হাতড়াতে হতো। এই বলে আমার আর বাবুর পিঠ চাপড়ে দিলেন।
এমন সময় দরজার কাছে, আসোলামু ওয়ালাইকুম শুনে তাকিয়ে দেখি একজন মুখ ভর্তি কালো দাড়িওয়ালা, জোব্বা পরা, মোটাসোটা আর পাশে বিশাল এক খাতা বগলে ছাগুলে দাড়ি রোগা লিকপিকে আরেক জন। দেখামাত্র চিনে ফেললাম কাজী আর তাঁর এ্যাসিসটেন্টকে। বাবা সালামের জবাব দিয়ে আসুন কাজী সাহেব, বলে তাদের সোফায় নিয়ে বসালেন।
কাজী সাহেব আয়েশ করে বসে বললেন, আমি তো বাসা টোকাই ফাঁইচ্ছিলাম না। সামিয়ানা নাই, গেট নাই, মানুষজন নাই, রাস্তায় জিজ্ঞাস কইরলাম বিয়া বাড়ি কোনোটা, কেউ কইতে ফাঁইরলো না। শ্যাষে ঠিকানা কওয়াতে এই বাড়ি দেখাই দিলো।
মেজো কাকা মুখ টিপে হেসে বললেন, শামিয়ানা, গেট না থাকলেও খাসির বিরিয়ানী, রোস্ট, রেজালা সবই আছে।
হা হা হা, তাতো থাইকবই। না হইলে আর বিয়া-শাদি কেন। বলে কাজী সাহেব এমনভাবে হাসলেন যেন মেজো কাকা দারুণ এক হাসির কথা বলেছেন। তারপর ঘড়ি দেখে প্রশ্ন করলেন, তা সময় ত হই গেছে। নওশা মিয়া কখন আইসবেন?
মেজো কাকা জাহেদ মামাকে দেখিয়ে বললেন, এই তো নওশা, আপনার বুঝি পছন্দ হয় নি?
হা হা হা, কী যে কন ভাইসাব, পছন্দ না হইব ক্যান! ইনি ত মালুম হয় বাদশাজাদা, সিনিমা, থিটার করেন নি?
না, ইনি আর্মির মেজর। হাসি চেপে গম্ভীর গলায় বললেন মেজো কাকা।
যে জন্য তিনি গম্ভীর হলেন তার ফল পাওয়া গেলো সঙ্গে সঙ্গে। কাজী সাহেবের মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। ঢোক গিলে বললেন, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ, মাশাল্লাহ্, মাশাল্লাহ! তা আমরা কি আরো দেরি কইরবো?
বাবা বললেন, না, দেরি কিসের। আগে শরবতটুকু খান।
জাহেদ মামারা আসার সঙ্গে সঙ্গে বড়িবি পেশতার শরবত আর মিষ্টি রেখে গিয়েছিলো টেবিলে। কাজী সাহেব আর তার এ্যাসিসটেন্ট সঙ্গে সঙ্গে ঢকঢক করে শব্দ করে শরবত খেয়ে দুটো করে রাজভোগ আর ছানার আমৃতি খেলেন। ঢেকুর তুলে আলহামদুলিল্লাহ বললেন দুজনেই। তারপর মোটা খাতা খুলে কাজী সাহেব জাহেদ মামা আর নেলী খালার নাম, পিতার নাম এসব লিখলেন। মেজো কাকা হলেন নেলী খালার উকিল আর কর্নেল চৌধুরী আর বাবা হলেন সাক্ষী! কাজী সাহেবের শেখানো কথাগুলো ভেতরে গিয়ে নেলী খালাকে বলে তাঁর মত আনলেন। এরপর শুরু হলো মোনাজাত। বেশি টাকা পাওয়ার আশায় অনেকক্ষণ ধরে অনেক ভালো ভালো কথা বলে মোনাজাত করলেন কাজী সাহেব। ছাগুলে দাড়ি এ্যাসিসটেন্ট ঘন ঘন এবং জোরে জোরে আমিন, আমিন বলছিলো।
মোনাজাত শেষ হওয়ার পর কাজী সাহেব বললেন, আমাদের আরো দুইটা শাদি পড়ানো বাকি আছে।
মেজো কাকা বললেন, আপনার দুজন তাহলে এখনই খেয়ে নিন। আবির, বাবু যাও, টেবিলে এদের খাওয়া দিতে বলল।
আমি আর বাবু কাজী আর লিকপিকে এ্যাসিসটেন্টকে ডাইনিং রুমে নিয়ে খাওয়ালাম। দুজনে বড় দুটো মুরগির রোস্ট, চার টুকরো বড়ো রুই মাছের পেটি, দুবাটি রেজালা আর কিমা মটর খেলেন প্রচুর বিরিয়ানীর সঙ্গে। খেতে খেতে রান্নার খুব প্রশংসা করলেন। আধ ঘন্টা পর হেউ হেউ ঢেকুর তুলতে তুলতে আলহামদুলিল্লাহ্ বলে উঠলেন। মেজো কাকা তাদের এগিয়ে দিয়ে এলেন। বাবু মুখ টিপে হেসে বললো, কাজী সাহেবরা মাত্র ওয়ান থার্ড ডিনার করলেন। মনে রেখো আরো দু বাড়ি এখনো বাকি আছে।
বাবুর কথা শুনে আমার হাসি সামলানো দায় হলো! মেজো কাকা ড্রইং রুম থেকে। চেঁচিয়ে বললেন, আবির, বাবু, তোমাদের নেলী খালাকে নিয়ে এসো, কাজী সাহেবরা বিদায় হয়েছেন।
নিচের তলার গেস্ট রুমে ছিলেন নেলী খালা। পরেছেন হালকা বেগুনি জামদানি, ভেতরে সোনালি জরি আর সাদা সুতোর নকশা। অলঙ্কার পরা তিনি মোটেই পছন্দ করেন না, তবু মার জন্য হাতে দুটো সোনার বালা, গলায় রুবির লকেট, কানে ছোট্ট দুটো রুবির ফুল পরেছেন, তাতেই মনে হচ্ছিলো পরির মতো। নতুন বউদের মতো মুখে কোনো ফোঁটা নেই, শুধু কপালে শাড়ির রঙের সঙ্গে ম্যাচ করা টিপ–একদম অন্যরকম নেলী খালা।
মেজো কাকার কথা শুনে নেলী খালা ঘর থেকে যেই বেরুতে যাবেন মা চাপা গলায় বললেন, নেলী, মাথায় ঘোমটা দাও।
নেলী খালা একটু অবাক হয়ে বললেন, বাইরের কেউ তো নেই, সবই তো ঘরের!
আহ্, যা বলছি তাই করো। এই বলে মা নেলী খালার মাথার আঁচল তুলে কাঁধে হাত দিয়ে নিয়ে এলেন বসার ঘরে।
মেজো কাকা বললেন, বাহ্, চমৎকার লাগছে তো! জাহেদের পাশে বসো। আমি ছবি তুলবো।
হঠাৎ বাবু–বাবা, এক মিনিট অপেক্ষা করো। বলে একছুটে ওপরে গেলো। অন্য সবাই একটু অবাক হলেও আমি মুখ টিপে হাসলাম।
বাবু সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দাড় করে নেমে এলো, হাতে রজনীগন্ধার বিশাল দুই মালা। একটা আমাকে দিয়ে বললো, চলো, পরিয়ে দেব।
আমরা দুজন নেলী খালা আর জাহেদ মামাকে মালা পরালাম। মেজো কাকা ছবি তুললেন। লজ্জায় লাল হওয়া ওঁদের দুজনকে অপরূপ সুন্দর লাগছিলো। মা পর্যন্ত হাসিমুখে বললেন, এততক্ষণে কিছুটা বর-কনে মনে হচ্ছে।
জাহেদ মামা সঙ্গে সঙ্গে মালা খুলে ফেললেন। তার দেখাদেখি নেলী খালাও। মেজো কাকা বললেন, ব্যস্ত হয়ে লাভ নেই নেলী। ছবি তুলে ফেলেছি।
মা বললেন, তোমরা খাবার টেবিলে এসো। খেয়েদেয়ে গল্প করা যাবে।
খেতে বসে টের পেলাম কাজীরা কেন এতো বেশি বেশি খেয়েছিলেন। মার রান্না হয়েছিলো অপূর্ব। সবার প্রশংসার চোটে মা অস্থির হয়ে গেলেন। কর্নেল চৌধুরী যে এতো মজার গল্প করতে পারেন সে আর বলার নয়। রাত একটা বাজলো গল্পের আসর শেষ হতে। তবে আমাকে আর বাবুকে বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ওপরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো। মেজো কাকা বললেন, এবার বড়োদের গল্প। তোমরা তোমাদের ঘরে যাও ঘুমোতে।
ওপরে এলাম বটে, ঘুম কী আর আসে! বাবু বললো, চলো, ললি, টুনিকে নেলী খালার বিয়ের খবর জানিয়ে চিঠি লিখি।
আলাদা আলাদা লিখবে, না একসঙ্গে? জানতে চাইলাম আমি।
একসঙ্গে, একসঙ্গে! চেঁচিয়ে উঠলো বাবু। দারুণ এক সারপ্রাইজ দেয়া হবে। আমি যে ঢাকা এসেছি এ খবরও ওরা জানে না।