০৩.
ক্যাম্পের বাইরে সরু একটা রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে বড় বড় গাছ। গাছের ছায়ায় শুকনো পাতা মাড়িয়ে রিটিন অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে থাকে। রাস্তাটা ঘুরে যেতেই রিটিন ছোট একটা পানীয়ের ঘর দেখতে পেল। ঘরটা চোখে পড়তেই সে বুঝতে পারল তার আসলে খুব তৃষ্ণা পেয়েছে।
ঘরের সামনে দাঁড়াতেই দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল। ঘরের এক কোনায় সোনালি চুলের একটা কম বয়সী মেয়ে বসে আছে। মেয়েটি প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজের ভেতরকার উদ্বেগটুকু লুকিয়ে রাখতে কিন্তু রিটিন বুঝতে পারল মেয়েটার ভেতরে চাপা উত্তেজনা।
রিটিন ছোট একটা গ্লাসে এক গ্লাস উত্তেজক পানীয় ঢেলে নেয়, তারপর গ্লাসটি নিয়ে মেয়েটির কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসে। মেয়েটির সাথে চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি নার্ভাস ভাবে একটু হাসল। বলল, “ক্যাম্প থেকে এসেছ?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
“মিশিকেও গত রাতে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেছে। এতক্ষণে মনে হয় ছেড়ে দেয়ার সময় হয়েছে।”
রিটিন ভাবল জিজ্ঞেস করে মিশি কে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল না। মেয়েটা নিজে থেকেই বলল, “মিশি আমার অনেক দিনের বন্ধু। এই শীতে আমরা বিয়ে করব।”
রিটিন চলল, “ও আচ্ছা। চমৎকার।”
“হ্যাঁ। অনেক কষ্ট করে, অনুমতি পেয়েছি। ক্যাটাগরি সি মানুষদের বিয়ের অনুমতি দিতে চায় না।”
রিটিন তার গ্লাসের পানীয়ে চুমুক দিয়ে বলল, “মিশিকে ক্যাম্পে নিয়ে গেছে কেন?”
মেয়েটা নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করল, বলল, “শুধু শুধু। একেবারেই শুধু শুধু। কোনো কারণ নেই। ব্রেন স্ক্যানিং করে যখন দেখবে শুধু শুধু ধরে নিয়েছে তখন ছেড়ে দেবে, তাই না?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। স্ক্যান করে কিছু পায়নি।”
মেয়েটা ছটফটে চোখে রিটিনের চোখের দিকে তাকাল, বলল, “কিছু পায়নি?”
“না। কিন্তু ব্রেনের ভেতরে কী আছে সব জেনে গেছে।”
মেয়েটার চোখে এবারে উদ্বেগের একটা চিহ্ন ফুটে উঠল। শুকনো ঠোঁটগুলো জিব দিয়ে ভেজানোর চেষ্টা করে বলল, “সব জেনে যায়?”
“হ্যাঁ।” রিটিন মাথা নাড়ল, “পুরো মাথাটার ভেতরে ঢুকে যায়। একটা একটা করে স্মৃতি খুলে খুলে দেখে–”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। আমি যে এভোকাডো খেতে পছন্দ করি না সেটা পর্যন্ত জানে।”
মেয়েটা তার হাতের পানীয়ের গ্লাসে একটা ছোট চুমুক দিয়ে বলল, “মিশির ব্রেনে নিশ্চয়ই খারাপ কিছু পাবে না।”
রিটিন বলল, “না, নিশ্চয়ই পাবে না।”
মেয়েটা অস্বস্তিতে ছটফট করতে থাকে। একটু পর গলা পরিষ্কার করে বলল, “কিন্তু যদি ভুলে কিছু একটা পেয়ে যায় তাহলে কী হবে?”
রিটিন বলল, “ভুল করে কিছু পাবার কথা না।”
মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, “তা ঠিক।”
রিটিন তার পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে চোখের কোনা দিয়ে মেয়েটাকে লক্ষ করে। মেয়েটা বাইরে যতই শান্ত ভাব দেখাক ভেতরে ভেতরে সে অস্থির হয়ে আছে।
ঠিক এরকম সময় দরজাটা খুলে গেল এবং রিটিনের বয়সী একজন মানুষ ঘরের ভেতর এসে ঢুকল। মেয়েটি সাথে সাথে লাফ দিয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “মিশি।”
মিশি মেয়েটার কথা শুনল বলে মনে হয় না। সে পানীয় ডিসপেন্সরের কাছে গিয়ে নিজের জন্যে একটা পানীয় বেছে নেয়। মেয়েটা দুই হাত উপরে তুলে মিশির দিকে ছুটে যেতে থাকে, চিৎকার করে বলতে থাকে, “আমি তোমার জন্যে সেই সকাল থেকে বসে আছি, মিশি–”
রিটিন দেখল মিশি একটু অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকাল, বলল, “তুমি আমাকে বলছ?”
“তোমাকে না বললে আমি কাকে বলব? মিশি–মিশি–”
রিটিন দেখল মেয়েটি মিশিকে জাপটে ধরল আর সাথে সাথে মিশি একটা ঝটকা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। মেয়েটা প্রস্তুত ছিল না, পড়ে যেতে যেতে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে অবাক হয়ে কাতর গলায় বলল, “মিশি–”
মিশি বলল, “আমি মিশি না।”
মেয়েটা প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “কী বলছ তুমি?”
“আমি ঠিকই বলছি। আমার নাম ক্লড।”
“মিশি! তুমি কী বলছ এসব? তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি গ্লানা।”
মানুষটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল, “আমি তোমাকে চিনি না। কখনো দেখিনি।”
রিটিন দেখল মেয়েটা আতঙ্কে থর থর করে কেঁপে উঠল। কাঁপা গলায় বলল, “মিশি–মিশি–”
মানুষটা কঠিন গলায় বলল, “আমি মিশি না। তুমি কিছু একটা ভুল করছ।”
“না, আমি ভুল করছি না মিশি! তোমার মনে নেই তোমাকে ক্যাম্পে নিয়ে গেল, তুমি আমাকে বললে-”
মানুষটা মাথা নাড়ল, বলল, “না, আমি কাউকে কিছু বলিনি। তোমার দেখাও ভুল হয়েছে।”
“আমার কোথাও ভুল হয়নি মিশি, তুমি মনে করার চেষ্টা করো, আমি আর তুমি”
মানুষটা একধরনের বিস্ময় নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর কঠিন গলায় বলল, “তুমি কেন আমাকে এসব বলছ? আমি তোমাকে চিনি না, আমি তোমাকে কখনো দেখিনি”
মেয়েটা হঠাৎ আকুল হয়ে কেঁদে উঠল, আর্তচিৎকার করে চলল, “মিশি, আমার মিশি–”
মানুষটা তার পানীয়টা নিয়ে সরে গিয়ে একধরনের বিস্ময় নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বলল, “মিশি, সোনা আমার–আমি সারাটি জীবন তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছি, এখন তুমি কেন আমাকে চিনতে পারছ না? আমার দিকে একবার তাকাও, ভালো করে তাকাও”
মানুষটা বিড়বিড় করে বলল, “তুমি ভুল করছ। ভুল-”
রিটিন উঠে দাঁড়াল, পানীয়ের গ্লাসটা টেবিলে রেখে সে মেয়েটার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরল, নরম গলায় বলল, “গ্লানা, আমার কথা শোনো”
মেয়েটা রিটিনের দিকে তাকাল। রিটিন নিচু গলায় বলল, “তোমার মিশির মস্তিষ্ককে প্রতিস্থাপন করে দিয়েছে–এই মানুষটি মিশি না।”
৩৪
“মিশি কোথায়?”
রিটিন মাথা নিচু করল, শোনা যায় না এরকম গলায় বলল, “মিশি নেই। মিশির এই শরীরটা আছে কিন্তু সেখানে মিশি নেই–সেখানে অন্য কোনো মানুষ–”
গ্লানা নামের মেয়েটা আর্তনাদ করে বলল, “না-না, আমি বিশ্বাস করি না, বিশ্বাস করি না–বিশ্বাস করি না–”
রিটিন শক্ত করে মেয়েটাকে ধরে রাখল, বিচিত্র একধরনের বেদনায় তার বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যেতে থাকে।
.
রিটিন দীর্ঘ সময় শহরের শেষ মাথায় নদীর তীরে একটা পাথরের বেঞ্চে বসে রইল। নদী থেকে একধরনের উথালপাতাল মন খারাপ করা বাতাস বইছে। নদীর তীরে বড় বড় ঝাউগাছ, বাতাসে তার পাতা শিরশির করে কাঁপছে, গাছের পাতার শব্দে তার মন আনমনা হয়ে যায়।
আজ সকালের ঘটনাটি তার ভেতরে সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। মিশি আর গ্লানার খুব সুন্দর একটা জীবন হতে পারত, চিন্তু ক্যাটাগরি সি মানুষের সেই সুন্দর জীবনের অধিকার নেই। এই পৃথিবীর একেবারে ছকে বাঁধা মানুষ না হলে ক্যাটাগরি সি মানুষকে পাল্টে দেয়া হয়। রিটিন অনেক চেষ্টা করেও হঠাৎ করে দেখা হওয়া রানা নামের মেয়েটির আকুল হয়ে কান্নার কথা ভুলতে পারছে না। এই মেয়েটির সাথে তার হয়তো আর কখনো দেখা হবে না। তার কথা মনে করে এরকম বিচলিত হওয়ার নিশ্চয়ই কোনো অর্থ নেই। কিন্তু তারপরও রিটিন বিচলিত হয়ে নদীর তীরে একা একা বসে রইল।
অন্ধকার নেমে আসার পর রিটিন উঠে দাঁড়ায়। সে এখন কোথায় যাবে জানে না। উদ্দেশ্যহীনভাবে শহরে ঘুরে বেড়াবে, যখন শরীর ক্লান্ত হয়ে উঠবে সে তার ছোট ঘরটাতে ফিরে যাবে। ঘরে যদি কোনো খাবারের প্যাকেট থাকে ভালো, যদি না থাকে কয়েক গ্লাস পানি খেয়ে ঘুমিয়ে যাবে। ঠিক কী কারণ জানা নেই এই জীবনটিকে টেনে নিতে রিটিন আর কোনো আগ্রহ অনুভব করছে না।
রিটিনের ধারণা ছিল সে পুরোপুরি উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছে, কিন্তু সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করল হেঁটে হেঁটে কীভাবে কীভাবে জানি সে একটা আলোকোজ্জ্বল উত্তেজক পানীয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। উপরে জ্বলজ্বলে আলোতে লেখা ‘ক্রিমিজিম’। গতকাল একটি মেয়ে তাকে বলেছে এখানে ঘাঘু ক্রিমিনালরা আড্ডা দেয়। কেউ যদি তার শরীর থেকে ট্র্যাকিওশান খুলে ফেলে দিতে চায় তাকে এখানে আসতে হবে। রিটিনের ট্র্যাকিওশানে এখন কোনো সমস্যা নেই–তার এখানে আসার কথা নয় কিন্তু সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করল সে ক্রিমিজিমের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
ভেতরে অনেক নারী-পুরুষ উত্তেজক পানীয় খেতে খেতে হইহল্লা করছে। ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার, তার মাঝে দ্রুতলয়ের একধরনের সঙ্গীতের সুর, রিটিন নিজের অজান্তেই সেই সুরের সাথে তাল দিতে দিতে সামনে এগিয়ে যায়।
ঘরের মাঝামাঝি পৌঁছানোর আগেই কম বয়সী একটা মেয়ে স্বচ্ছ একটা ট্রেতে বেশ কয়েক ধরনের পানীয়ের গ্লাস নিয়ে রিটিনের দিকে এগিয়ে আসে, মেয়েটি শরীরে কিছু একটা মেখে এসেছে, যার কারণে তার শরীর থেকে হালকা নীল একধরনের আলো বের হচ্ছে। মেয়েটি আহ্লাদী গলায় রিটিনকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী খাবে গো ছেলে? আমাদের নতুন পানীয়ের চালান এসেছে।”
“আমি কিছু খাব না।”
“তুমি কিছু না খেলে এখানে কেন এসেছ? এখানে এলে কিছু না কিছু খেতে হয়।”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “না, আমার মাথা শীতল রাখতে হবে। আমি এখানে একটা কাজে এসেছি।”
মেয়েটির গলার স্বর হঠাৎ হঠাৎ করে স্বাভাবিক হয়ে যায়। সে তীক্ষ্ণ চোখে রিটিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “কী কাজ?”
“আমি আমার শরীর থেকে ট্র্যাকিওশানটা বের করে ফেলতে এসেছি। শুনেছি এখানে নাকি সেটা করা যাবে!”
মেয়েটি পলকহীন চোখে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “তুমি কাকে খুন করে এসেছ?”
“আমি কাউকে খুন করিনি।”
“তাহলে তুমি কেন তোমার ট্র্যাকিওশান সরিয়ে ফেলতে চাইছ? তুমি জান শরীর থেকে ট্র্যাকিওশান সরিয়ে ফেললে একজন মানুষ আর একটি ব্যাকটেরিয়ার মাঝে কোনো পার্থক্য থাকে না?”
রিটিন হাসল, বলল, “আমি ক্যাটাগরি সি মানুষ। ক্যাটাগরি সি মানুষ আর একটি ব্যাকটেরিয়ার মাঝে এমনিতেই কোনো পার্থক্য নেই।”
শরীর থেকে হালকা নীল আলো বের হওয়া মেয়েটি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর দূরে একটি চতুষ্কোণ দরজা দেখিয়ে বলল, “ওই দরজাটি দিয়ে ভেতরে ঢোকো।”
রিটিন বলল, “ধন্যবাদ তোমাকে।”
মনে রেখো, “তুমি দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকবে কিন্তু আর কখনোই বের হতে পারবে না।”
রিটিন হাসল, বলল, “ব্যাকটেরিয়া নিজের ইচ্ছেয় কোথাও ঢোকে না, কোথাও বের হয় না।”
মেয়েটি বলল, “চমৎকার। যাও।”
রিটিন হেঁটে যেতে থাকে তখন পেছন থেকে মেয়েটি আবার তাকে ডাকল। রিটিন ঘুরে তাকাতেই মেয়েটি তার ট্রে থেকে হালকা গোলাপি রঙের একটা পানীয়ের গ্লাস তুলে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এক চুমুক দিয়ে এই পানীয়টা খেয়ে ফেলো। ভালো লাগবে। ভয় নেই তোমার মস্তিষ্ক উত্তেজিত হবে না।”
রিটিন পানীয়ের গ্লাসটা হাতে নেয়। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ধন্যবাদ।”
রিটিন এক চুমুকে পানীয়টি খেয়ে মেয়েটিকে গ্লাসটি ফেরত দিল। তার সারা শরীরে এক ধরনের কোমল উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে, নিজের ভেতর সে বিচিত্র এক ধরনের সজীবতা অনুভব করে। হঠাৎ করে তার বিষণ্ণতাটুকু কেটে সেখানে একধরনের ফুরফুরে আনন্দ এসে ভর করে।
মেয়েটি বলল, “অপরাধী জীবনে স্বাগতম। তোমার অপরাধী জীবন আনন্দময় হোক।”
রিটিন কোনো কথা না বলে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখটা মুছে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে এক মুহূর্ত দ্বিধান্বিতভাবে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল।
.
০৪.
ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার। রিটিন একটা চেয়ারে বসে আছে। সামনে বড় টেবিল, টেবিলের অন্য পাশে একজন মাঝবয়সী মানুষ। টেবিলের উপর একটা ল্যাম্প, ল্যাম্পটা সরাসরি তার দিকে ঘুরিয়ে রেখেছে, কাজেই মানুষটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। মানুষটা তৃতীয়বার তাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার শরীর থেকে তুমি ট্রাকিওশান সরিয়ে ফেলতে চাও?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
“তোমার শরীর থেকে ট্র্যাকিওশান সরিয়ে ফেললে তোমার দৈনন্দিন জীবনটা কীভাবে পাল্টে যাবে তুমি জান?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “না, জানি না। জানতেও চাই না।”
“কেন জানতে চাও না?”
“আমি বুঝতে পেরেছি ক্যাটাগরি সি মানুষ হিসেবে আমার বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। এর চাইতে একজন অপরাধীর জীবন হয়তো বেশি আকর্ষণীয়।”
মানুষটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “অপরাধী হয়ে তুমি কী কী অপরাধ করবে বলে ঠিক করেছ?”
রিটিন হেসে ফেলল, বলল, “আইন ভাঙা হলে সেটাকে বলা হয় অপরাধ। অনেক আইন আছে যেটা থাকা উচিত না। সেই আইনগুলো ভাঙাও অপরাধ কিন্তু আমি আনন্দের সাথে সেগুলো ভাঙব। শুধু মানুষ খুন করে কিংবা মাদকের ব্যবসা করে অপরাধী হতে হবে কে বলেছে?”
“একটা উদাহরণ দিতে পারবে?”
“ক্যাটাগরি সি মানুষ হিসেবে আমি যদি সময় পরিভ্রমণ নিয়ে কাজ করি সেটাও একটা অপরাধ-আমার সেই অপরাধ করতে কোনো দ্বিধা নেই।”
রিটিন টের পেল টেবিলের অন্য পাশের মানুষটি হঠাৎ সোজা হয়ে বসেছে। সামনে একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, “তুমি সময় পরিভ্রমণ বিষয়টির কথা কেন বললে?”
“আমি অনুমান করছি সময় পরিভ্রমণ নিয়ে একটা বড় আবিষ্কার হয়েছে। মানুষ হয়তো সময় পরিভ্রমণ করার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।”
“তুমি কেমন করে সেটি অনুমান করেছ?”
“আমার বাসায় শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটা রোবট রুটিন চেক আপের জন্যে এসেছিল। যেই মুহূর্তে আমি সময় পরিভ্রমণ কথাটি উচ্চারণ করেছি তখনই আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে অচেতন করে ধরে নিয়ে গেছে। আমার মস্তিষ্ক স্ক্যান করেছে। কাজেই আমি ধরে নিচ্ছি সময় পরিভ্রমণ খুব স্পর্শকাতর একটা বিষয়।”
“স্পর্শকাতর? কেন?”
“সম্ভবত ক্যাটাগরি সি মানুষের কাছেও কোনো না কোনোভাবে সময় পরিভ্রমণের প্রযুক্তি চলে এসেছে।”
টেবিলের অন্যপাশে বসে থাকা মানুষটা বেশ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে রইল, তারপর বলল, “তুমি যে কথাগুলো বলেছ সেগুলো তুমি সত্যি বলেছ কি না আমাদের জানা প্রয়োজন।”
রিটিন বলল, “আমি সত্যি বলেছি।”
“তোমার মুখের কথা যথেষ্ট নয়। আমাদের পরীক্ষা করে দেখতে হবে।”
“কীভাবে পরীক্ষা করবে?”
“সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে মস্তিষ্ক স্ক্যান করে দেখা। কিন্তু আমরা এখনো মস্তিষ্ক স্ক্যানার জোগাড় করতে পারিনি। তাই তোমার মস্তিষ্কের ভেতরে দেখতে পারব না। তোমাকে আমরা প্রশ্ন করব। প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় তোমার মস্তিষ্কের কোন জায়গাটা অনুরণিত হচ্ছে আমরা দেখব। সেখান থেকে বুঝতে পারব তুমি সত্যি কথা বলছ নাকি মিথ্যা কথা বলছ।”
রিটিন কোনো কথা বলল না।
মানুষটা বলল, “কেউ যখন আমাদের কাছে আসে আমাদের নিশ্চিত হতে হয় যে সে সত্যি কথা বলছে।”
রিটিন জিজ্ঞেস করল, “কেউ সত্যি কথা না বললে তখন তোমরা কী কর?”
মানুষটি বলল, “তুমি আমাকে সেটা জিজ্ঞেস কোরো না, আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না।”
রিটিন আর কোনো প্রশ্ন করল না, সে তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে।
.
রিটিনের পরীক্ষাটি হলো দীর্ঘ। প্রথমে তার শরীরে একটা ইনজেকশান দেয়া হলো, সেখানে কী ছিল কে জানে কিন্তু রিটিন অনুভব করতে থাকে কোনো বিষয় নিয়ে সে আর দীর্ঘ সময় চিন্তা করতে পারছে না। তাকে যখনই কোনো একটা প্রশ্ন করা হয় সে তাৎক্ষণিকভাবে তার উত্তর দিয়ে দেয়, উত্তরগুলো হয় সংক্ষিপ্ত এবং সুনির্দিষ্ট। পুরো সময়টিতে তার মাথার মাঝে অসংখ্য প্রোব লাগানো ছিল এবং সেই সিগনালগুলোর সাথে প্রশ্নের উত্তর মিলিয়ে তার সত্যি-মিথ্যা বের করে নেয়া হয়।
পরীক্ষার শেষের দিকে তাকে বলা হলো প্রত্যেকটা প্রশ্নে ভুল উত্তর দেয়ার জন্যে। রিটিন আবিষ্কার করল যেকোনো কারণেই হোক সেটি এখন তার জন্যে যথেষ্ট কঠিন। ভুল উত্তর দেয়ার জন্যে তাকে একটু চিন্তা করতে হয় কিন্তু সে এখন আর চিন্তা করতে পারছে না।
রিটিনের মনে হতে থাকে তার পরীক্ষা বুঝি কখনো শেষ হবে না। কিন্তু একসময় সেটি শেষ হলো। মাঝবয়সী মানুষটি এসে তার সাথে হাত মিলিয়ে নরম গলায় বলল, “পরীক্ষায় পাস করেছ। তোমাকে আমরা আমাদের সংগঠনে নিতে পারি। তোমার ট্র্যাকিওশান আমরা সরিয়ে দেব।”
রিটিন জড়িত গলায় বলল, “ধন্যবাদ।”
“তোমার শরীরে ইনজেক্ট করে দেয়া গ্লিফারুলটিকে মেটাবলাইজ করার জন্যে তোমার এখন ঘুমাতে হবে।”
“হ্যাঁ। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”
“এসো, আমার সাথে এসো।”
মানুষটি রিটিনকে ছোট একটা খুপরির মতো ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে পরিপাটি করে সাজানো একটা বিছানা। রিটিন কোনো কথা বলে সাথে সাথে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল এবং কিছু বোঝার আগেই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেল।
রিটিনের ঘুম ভাঙল প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে। বিছানায় উঠে বসার পর সে কোথায় সেটি বুঝতে তার কিছুক্ষণ সময় লাগল। হঠাৎ করেই তার সবকিছু মনে পড়ে যায়। রিটিন তখন বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে বের হয়ে আসে। দরজার বাইরে একটা টানা বারান্দা, বারান্দার শেষ মাথায় একটি ঘরে আলো জ্বলছে। রিটিন বারান্দা দিয়ে হেঁটে ঘরটিতে উঁকি দেয়, ঘরের মাঝখানে একটা চতুষ্কোণ গ্রানাইটের টেবিল, টেবিলে হাত রেখে মাঝবয়সী একজন মানুষ ভিডি টিউবে কিছু একটা দেখছে। রিটিনকে দেখে মানুষটি মুখে হাসি ফোঁটানোর চেষ্টা করে বলল, “ঘুম ভাঙল?”
রিটিন নিঃশব্দে মাথা নেড়ে ঘরটির ভেতরে ঢুকে মানুষটির সামনে একটা চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করল, “আমি কতক্ষণ ঘুমিয়েছি?”
মানুষটি ভিডিও টিউব থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, “অনেকক্ষণ।”
রিটিন বলল, “আমার খুব খিদে পেয়েছে।”
মানুষটি বলল, “পাবার কথা। পাশের ঘরে কিচেন, সেখানে খাবার রয়েছে। খেয়ে এসো। সবাই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
রিটিন অবাক হয়ে বলল, “আমার জন্যে?”
“হ্যাঁ। তোমাদের মতো কয়েকজন আছে তাদের নিয়ে ট্রানা এক সাথে বসবে। যাও খেয়ে এসো।”
রিটিন সচরাচর খায় কিচেনে বসে তার থেকে অনেক বেশি খেয়ে ফেলল। খাওয়া শেষে একটা গ্লাসে তার পছন্দের একটা পানীয় নিয়ে সে মানুষটির কাছে ফিরে আসে। মানুষটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো যাই।”
বেশ কয়েকটা সরু করিডর ধরে হেঁটে দুজনে একটা বন্ধ ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল, মানুষটি দরজা খুলে রিটিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “যাও। ভেতরে সবাই আছে।”
রিটিন ভেতরে ঢুকল। ঘরের মাঝখানে একটা কালো টেবিল, টেবিলের চারপাশে আরামদায়ক চেয়ার কিন্তু কেউ চেয়ারে বসে নেই। ঘরের মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাঁচজন মানুষ, দুজন পুরুষ, তিনজন মহিলা। মানুষগুলো সবাই মধ্যবয়স্ক, সম্ভবত এদের মাঝে রিটিনের বয়স সবচেয়ে কম। রিটিন ঘরে ঢোকার সাথে সাথে সবাই মুখ তুলে তার দিকে তাকাল, রুপালি চুলের একজন মহিলা বলল, “তুমি নিশ্চয়ই রিটিন। এসো রিটিন, আমরা তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।”
রিটিন তার পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “আমি দুঃখিত। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তোমাদের দেরি করিয়ে দিলাম।“
রুপালি চুলের মহিলাটি বলল, “না, তুমি দেরি করিয়ে দাওনি। তোমার শরীরের মেটাবলিজম যথেষ্ট বেশি, তুমি অনেক তাড়াতাড়ি উঠেছ। এসো বসো। আমার নাম ট্রানা। আমাকে তোমাদের ব্রিফিংয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।”
ঘরের মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলো এবারে টেবিলের চারপাশের আরামদায়ক চেয়ারগুলোতে বসে পড়ল। রিটিন টেবিলটা স্পর্শ করতেই সেখানে স্বচ্ছ একটা স্ক্রিন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সেখানে টেবিলের অনন্য মানুষগুলোর পরিচয় ভেসে উঠল। একজন মেকানিক, দুজন শিক্ষক এবং আরেকজন নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করত। মধ্যবয়স্ক মেকানিকটির বয়স পঁয়তাল্লিশ, মহিলা দুজন ত্রিশ এবং পঁয়ত্রিশ। রিটিনের বিপরীতে বসে থাকা কঠিন চেহারার নিরাপত্তাকর্মীর বয়স ত্রিশ, এদের মাঝে রিটিনের বয়স সবচেয়ে কম, মাত্র তেইশ।
ট্রানা বলল, “তোমাদের শরীর থেকে ট্র্যাকিওশান এখনো সরিয়ে নেয়া হয়নি, তাই টেবিলে রাখা ভিডি স্ক্রিনে তোমরা একে অন্যের পরিচয় জেনে নিতে পারছ। ট্রাকিওশান সরিয়ে নেয়ার পর তোমাদের আর কোনো পরিচয় থাকবে না। আমি সরাসরি কাজের কথায় চলে আসি।”
রিটিন তার চেয়ারে একটু নড়েচড়ে বসে উৎসুক চোখে ট্রানার দিকে তাকাল। ট্রানা বলল, “পৃথিবীর মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ক্যাটাগরি এ এবং সি। তোমরা যারা এখানে এসেছ সবাই ক্যাটাগরি সি। তোমরা সবাই তোমাদের জীবনে কোনো না কোনো বৈষম্যের শিকার হয়েছ, সেই বৈষম্য থেকে তোমাদের কোনো এক ধরনের আত্মোপলব্ধি হয়েছে, তোমরা বুঝতে পেরেছ এই বৈষম্যটি অমানবিক, মানুষ হিসেবে অসম্মানজনক। তোমরা কীভাবে তার প্রতিবাদ করবে সেটি বুঝতে পারোনি, তাই এখানে এসেছ কোনো কোনোভাবে প্রতিবাদ করার জন্যে। তোমাদের ধন্যবাদ।”
“প্রথমেই তোমাদের কিছু তথ্য দিই। পৃথিবীতে ক্যাটাগরি এ এবং সি মানুষের সংখ্যা সমান নয়। ক্যাটাগরি সি-এর মানুষ ক্যাটাগরি এ থেকে প্রায় দশ গুণ বেশি। অর্থাৎ পৃথিবীর দশ ভাগের এক ভাগ মানুষ অন্যদের উপর একধরনের কর্তৃত্ব করে যাচ্ছে–”
রিটিন জিজ্ঞেস করল, “ক্যাটাগরি এ এবং সি আছে। ক্যাটাগরি বি নেই কেন?”
ট্রানা হাসল, বলল, “আমি জানতাম তোমাদের কেউ না কেউ এই প্রশ্নটা করবে। সব মানুষকে শুধু দুটি ভাগে ভাগ করলে বিভাজনটি দৃষ্টিকটু মনে হতে পারে, তাই মাঝখানে একটা কাল্পনিক প্যাডিং রাখা হয়েছে। সবাই ধরে নেয় ক্যাটাগরি বিও নিশ্চয়ই আছে।”
টেবিলের চারপাশে বসে থাকা সবাই বিস্ময়ের মৃদু শব্দ করল, একজন মহিলা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ট্রানা বলল, “আমি জানি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছ না যে, অল্পসংখ্যক ক্যাটাগরি এ মানুষ বিপুলসংখ্যক ক্যাটাগরি সি মানুষকে পায়ের নিচে চাপা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু জেনে রাখো আমি তোমাদের ভুল বলছি না। গত কয়েক শতাব্দীর ভেতরে মানুষ অনেক ধরনের সামাজিক উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে গিয়েছে, সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে মানুষকে তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া, তাদের মাথার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া যে, তাদের জন্ম হয়েছে। নির্দিষ্ট একধরনের কাজ করার জন্যে। তারা শুধু সেই কাজটি করতে পারবে, এর চাইতে ভিন্ন কোনো কাজ করার ক্ষমতা তাদের নেই।”
রিটিন নিজের অজান্তেই তার মাথা নাড়ল। ট্রানা মুখে প্রায় জোর করে একধরনের হাসি ফুটিয়ে বলল, “মানুষের মাঝে বিভাজন করে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার এই পদ্ধতিটি অনেক প্রাচীন এবং খুবই কার্যকরি। গত কয়েক শতাব্দীতে মানুষের সমাজে কোনো সংঘাত হয়নি।”
“কিন্তু তোমরা যে রকম নিজ থেকে এই পদ্ধতিটির সমস্যাটি ধরতে পেরেছ, এর একটি সমাধান বের করতে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছ এবং নিজের জীবনের উপর অচিন্তনীয় একটা ঝুঁকি নিয়েছ। ঠিক সেরকম আরো অনেকেই তোমাদের আগে এই কাজটি করে এসেছে। তারা সংগঠিত হয়েছে, তারা সুনির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যখন সময় হবে তোমরা সেগুলো সম্পর্কে জানতে পারবে।”
কঠিন চেহারার নিরাপত্তারক্ষীটি বলল, “আমাদের একটা সশস্ত্র বিপ্লব করা উচিত–”
ট্রানা হেসে ফেলল, বলল, “সশস্ত্র বিপ্লব জাতীয় বিষয়গুলো কয়েক শতাব্দী আগেই পরিত্যক্ত হয়ে গেছে–তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আমাদের সশস্ত্র হতে হয়, ছোটখাটো গোলাগুলি বিস্ফোরণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। তোমরাও নিশ্চয়ই যাবে।”
নিরাপত্তারক্ষীটি বলল, “আমি নিজের হাতে ক্যাটাগরি এ মানুষকে খুন করতে চাই।”
ট্রানার হাসিমুখটিতে হঠাৎ একধরনের কাঠিন্য চলে আসে, সে মাথা নেড়ে বলল, “তোমাদের এখনই কিছু বিষয় বলে দেয়া দরকার। আমরা সংখ্যায় এখনো খুবই কম, কাজেই আমাদের টিকে থাকার উপায় মাত্র একটি। সেটি হচ্ছে আমরা কেউ নিজেদের ভিন্ন একটি মানুষ বলে মনে করব না। আমরা সবসময়ই মনে করব আমরা সবাই মিলে একটা অস্তিত্ব। কাজেই আমাদের কাউকেই নিজেদের গন্ডীর বাইরে যাওয়া চলবে না। যতদিন আমরা পৃথিবীর এই বিভাজনটি দূর করতে না পারব ততদিন আমরা আমাদের উপর দেয়া সুনির্দিষ্ট দায়িত্বের বাইরে কিছু করব না। আমার ক্যাটাগরি মানুষকে খুন করে ফেলার ইচ্ছা করলেও সেটা মুখে উচ্চারণ পর্যন্ত করব না।”
শিক্ষিকা একজন মহিলা বলল, “ট্রানা–”
ট্রানা মহিলাটির দিকে ঘুরে তাকাল, “বলো।”
“আমরা কি সত্যি একদিন পৃথিবীর এই বিভাজন দূর করতে পারব?”
ট্রানা হাসল, বলল, “সেই পুরানো কথাটি শুনোনি? লক্ষ্যে পৌঁছানো আমাদের উদ্দেশ্য নয়। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে চেষ্টা করা আমাদের উদ্দেশ্য।”
রিটিন বলল, “আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাব ট্রানা।”
“পৌঁছাব?”
“হ্যাঁ, আমরা নিশ্চয়ই পৃথিবীর মানুষের মাঝে এই ভাগাভাগি দূর করে ফেলতে পারব।”
ট্রানা একধরনের অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মেকানিক মানুষটি বলল, “আমরা কেমন করে অগ্রসর হব ট্রানা? আমাদের পরিকল্পনাটা কী?”
ট্রানা হাসল, বলল, “সময় হলেই জানতে পারবে। খুঁটিনাটি সবকিছু আমরা জানি না। নিরাপত্তার জন্যে সবাইকে সবকিছু জানানো হয় না। তবে তুমি জেনে রাখো আমাদের একটা পরিকল্পনা আছে।”
রিটিন বলল, “আমি বলব পরিকল্পনাটা কী?”
ট্রানা একটু অবাক হয়ে বলল, “তুমি জানো?”
“না। জানি না, অনুমান করতে পারি।”
“শুনি তোমার অনুমান।”
রিটিন গলার স্বরটা যথাসম্ভব গম্ভীর করে বলল, “পৃথিবীর মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সবার আগে তাদের সব রকম তথ্যের দরকার। সব তথ্য সংগ্রহ করা হয় ট্র্যাকিওশান দিয়ে। ট্রাকিওশানের তথ্য প্রক্রিয়া করার জন্যে নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও একটা তথ্যভান্ডার আছে, বিশাল নেটওয়ার্ক আছে। আমাদের সেই তথ্যভান্ডার ধ্বংস করে নেটওয়ার্ক ছিন্নভিন্ন করে দিতে হবে। সাথে সাথে পুরো পৃথিবীর সব মানুষ মুক্ত হয়ে যাবে!”
মেকানিক মানুষটি বলল, “তুমি মনে হয় ঠিকই বলেছ ছেলে। তোমার মাথায় বুদ্ধি আছে, কেমন করে তুমি ক্যাটাগরি সি হলে বুঝতে পারছি না!”
নিরাপত্তাকর্মী মানুষটি বলল, “ছেলে, তুমি একটা জিনিস ভুলে যাচ্ছ।”
“কী জিনিস?”
“পৃথিবীর সব তথ্য সংরক্ষণ করার জন্যে যে বিল্ডিংটি আছে সেটার ভেতরে কোনো মানুষ কখনো যেতে পারবে না। থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা ফেলেও সেটার দেয়ালে একটা ফাটল তৈরি করা যাবে না। এর ভেতরে যে নিরাপত্তা সেই নিরাপত্তা ভেঙে একটা মানুষ দূরে থাকুক একটা ব্যাকটেরিয়া পর্যন্ত যেতে পারবে না।”
রিটিন কঠিন মুখে বলল, “তুমি কেমন করে জানো?” “আমি নিরাপত্তাকর্মী। আমি জানি।”
রিটিন কঠিন মুখে বলল, “তবুও নিশ্চয়ই মূল তথ্যভান্ডার ধ্বংস করা যাবে। নিশ্চয়ই করা যাবে।”
নিরাপত্তাকর্মী কঠিন মুখে বলল, “মাত্র চার বিলিয়ন বছর অপেক্ষা করতে হবে। তাহলে সূর্য রেড জায়ান্টে পরিণত হয়ে পুরো পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলার সাথে সাথে তোমার তথ্য ভান্ডারকেও–” কথা শেষ করে মানুষটি কাঠ কাঠ শব্দে হেসে উঠল।
রিটিন হঠাৎ করে বুঝতে পারল কেন মানুষটি এত কম হাসে–কারণ নিরাপত্তাকর্মীর হাসিটির ভেতর কোনো আনন্দ ছিল না। আনন্দহীন হাসির মতো অসুন্দর জিনিস বুঝি পৃথিবীতে আর কিছু নেই।