হাবু সম্পর্কে অর্জুনের একটা কৌতূহল আছে। অনেকদিন ধরে দেখে আসছে সে এই লোকটাকে। অমলদা কোথেকে ওকে পেয়েছিলেন, কেমন করে হাবু এতসব শিখে গেল, তা কখনওই গল্প করেননি। আজকাল অমলদা অনাবশ্যক কথা বলেন না। হাবুর গায়ে ভীষণ জোর, বুদ্ধি মাঝে-মাঝে খুলে যায়, কিন্তু বোবা-কালা মানুষটি অমলদার পাহারাদার ওরফে রাঁধুনি ওরফে মালি ওরফে সবকিছু হয়ে দিব্যি রয়ে গেছে। মোটরবাইকের পেছনে বসে হাবু শক্ত হাতে তাকে ধরে আছে এখন। ওকে আঙুল আগা করতে বলে কোনও লাভ নেই, হাবু শুনতেই পাবে না।
সনাতন নামের সেই লোকটা যখন অমলদার বাড়িতে এসেছিল তখন মমাটেই খুশি হয়নি হাবু। তখন সনাতন যেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। লোকটা সত্যি অদূর ভবিষ্যৎ দেখতে পেত। হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল কে জানে। অমলদা সনাতনকে কোত্থেকে জোগাড় করেছিলেন তাও রহস্য। হাকিমপাড়ায় ঢুকে মোটরবাইক যখন বাঁক নিচ্ছে তখন পিঠে মৃদু টোকা মারল হাবু। অর্জুন বাইকটাকে রাস্তার একপাশে দাঁড় করাতেই টপ করে নেমে পড়ল হাবু। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী হল?
যে মানুষ ওর সঙ্গে কথা বলছে তার ঠোঁটনাড়া দেখতে পেলে হাবু যেন বুঝতে পারে। অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে হাত নেড়ে ওপাশের দোকানগুলো দেখিয়ে হাঁটা শুরু করল। অর্থাৎ কিছু কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরবে। অনেকদিন আগে অর্জুন একবার অমলদাকে জিজ্ঞেস করেছিল, বোবা কালা একজন মানুষের সঙ্গে থাকতে অসুবিধে হয় না? অমলদা মাথা নেড়েছিলেন, আমার খুব সুবিধেই হয়। বাড়িটা নিস্তব্ধ থাকে। নিজের মনে কাজ করতে পারি। অনবরত কারও বকবকানি শুনতে হয় না।
গেটের সামনে পৌঁছে ব্রেক কষল অর্জুন। অনেকখানি ঘষটে গিয়ে দাঁড়াল বাইকটা। মাঝে-মাঝে তার ইচ্ছে হয় সাকাসের বাইকওয়ালার মতো কোনও ছোট নালা বাইক নিয়ে টপকে যেতে। এখনও ঠিক সাহসটা আসছে না।
গেট খুলে পা বাড়াতেই অমলদার হাসির শব্দ শোনা গেল। বেশ প্রাণখোলা। হাসি। অনেককাল অমলদাকে এভাবে হাসতে শোনা যায়নি। আর-একটু এগোতে একটা গলা কানে এল, তার মানে নিরোর সময় বাঙালি বলে কোনও জাত ছিল না? ইস, এখন নিজেকে একেবারে যাকে বলে ভূঁইফোড়, তাই মনে হচ্ছে।
এই গলা ভোলার নয়। বসার ঘরের দরজা খোলা। বারান্দায় উঠে দরজায় দাঁড়াতেই বিষ্ঠুসাহেবকে দেখতে পেল অর্জুন। পা ছড়িয়ে বসে আছেন। রোগা বেঁটেখাটো মানুষটাকে এখন আরও বুড়ো দেখাচ্ছে। ঘাড় ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকাতেই তিনি চিৎকার করলেন, আরে, তৃতীয় পাণ্ডব, এ যে একেবারে নবীন যুবক, ভাবা যায়?
অর্জুন ঘরে ঢুকে ভদ্রলোককে প্রণাম করল, কেমন আছেন?
বিষ্টসাহেব দু হাতে বাতাস কাটলেন, নতুন শক্তি পেয়েছি হে। আমেরিকানরা আমার শরীরের যেসব জায়গা রোগের কামড়ে বিকল, তা ছেটেকেটে বাদ দেওয়ার পর আর কোনও প্রবলেম নেই। নিজের বুকে হাত দিলেন তিনি, বাইপাস সার্জারি।
অর্জুনের খুব ভাল লাগছিল। সে বিষ্টসাহেবের পাশে গিয়ে বসল। তার। চোখের সামনে এখন কালিম্পং-এর দিনগুলো, লাইটার খুঁজতে আমেরিকায় যাওয়া আর বিষ্টসাহেবের হাসিখুশি মুখ ক্রমশ রোগে পার হয়ে যাওয়া ছবিগুলো ভেসে গেল। বিষ্টুসাহেব যে আবার এমন তরতাজা কথা বলবেন তা কল্পনা করতে পারেনি সে। অমলদা বললেন, অর্জুনকে তো দেখা হয়ে গেল, এবার খাওয়াদাওয়া করে বিশ্রাম করুন। অনেকদূর পাড়ি দিতে হয়েছে আপনাকে।
মাথা নাড়লেন ছোট্টখাট্টো মানুষটি। একমুখ হাসি নিয়ে চুপ করে রইলেন খানিক। তারপর বললেন, নো পরিশ্রম। জে এফ কে থেকে হিথরো পর্যন্ত ঘুমিয়ে এসেছি। হিথরোতে কয়েক ঘণ্টা চমৎকার কেটেছে। হিথরো থেকে দিল্লি নাক ডাকিয়েছি। দিল্লিতে এক রাত হোটেলে। উত্তেজনায় ভাল ঘুম হয়নি অবশ্য। আব দিল্লি থেকে বাগডোগরা আসতে ঘুমের প্রশ্নই ওঠে না। দেশের মাটিতে ফেরার উত্তেজনার সঙ্গে কোনও কিছুর তুলনা করাই চলে না। এখন আমি একটুও ক্লান্ত নই।
আপনি একাই এতটা পথ এলেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
ইচ্ছে ছিল তাই, কিন্তু আর-একজনকে বয়ে আনতে হল। বিষ্ণুসাহেব চোখ বন্ধ করলেন, মেজর এসেছেন সঙ্গে। তিনি গিয়েছেন কালিম্পঙে।
অ্য, মেজর এসেছেন। প্রায় চেঁচিয়ে উঠল অর্জুন।
হঠাৎ অর্জুনের গায়ে হাত বোলালেন বিষ্টসাহেব, নাঃ, এই ছেলেটা দেখছি একদম বড় হয়নি। সেই ফ্রেশনেশটা এখনও ধরে রেখেছে। বড় হলেই মানুষ কেমন গম্ভীর হয়ে যায়। এবার কদিন জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে, কেমন?
জমিয়ে আড্ডা বলে কথা! অর্জুন ভেবে পাচ্ছিল না সে কী করবে। অমলদা, বিষ্টুসাহেব, মেজর ও সে। কতদিন পরে এক জায়গায় হওয়া যাবে। সে জানত মেজর আসছেন দিন-দুয়েকের মধ্যেই। এখানে ওঁরা কয়েকদিন থাকবেন।
বেলা বাড়ছিল। বিষ্ঠুসাহেবের ইচ্ছে ছিল অর্জুন এখানেই খেয়ে নিক। কিন্তু অমলদাই আপত্তি করলেন। বাড়িতে বলা নেই, অর্জুনের মা নিশ্চয়ই খাবার নিয়ে বসে থাকবেন। তাই বাড়ি গিয়ে স্নান-খাওয়া সেরে অর্জুন বিকেলে চলে আসুক।
বিষ্ঠুসাহেব ভেতরে চলে গেলে অমলদা বললেন, যাও, আর দেরি কোরো। ও হ্যাঁ, কিছুটা আশা করি এগিয়েছ এর মধ্যে।
হ্যাঁ। ইতিহাস জানলাম। তবে আলগা-আলগা।
পাঁচশো বছরের আগে যাওয়ার দরকার নেই। শ্রীচৈতন্যদেব থেকে শুরু করো। ওই সময় কেউ তো ইতিহাস লিখব বলে লেখেনি।
আপনি মোটামুটি বাঙালির ইতিহাসটা জানেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
যেটুকু না জানাটা অপরাধ সেটুকুই জানি। অমলদা হাসলেন, অর্জুন, তুমি তোমার কজন পূর্বপুরুষের নাম জান?
অর্জুন মনে করার চেষ্টা করল। বাবা-ঠাকুদার নাম ধর্তব্যের মধ্যে আসছে না। বাবার ঠাকুদার নাম সে জানে। মা বলেছিলেন বাড়িতে একটা কাগজে চৌদ্দপুরুষের নাম নাকি লিখে রেখেছিলেন বাবা। তিনি মারা যাওয়ার পর সে আর ওই কাগজপত্র দেখেনি। তাই পূর্বপুরুষ বলতে তার আগের তিন পুরুষেই এখন তাকে থেমে যেতে হচ্ছে। হঠাৎ এটা মনে হতে লজ্জা করল অর্জুনের। আমরা বাহাদুর শার পূর্বপুরুষের নাম জানি অথচ নিজের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে উদাসীন। বাবার লেখা কাগজটা যদি না পাওয়া যায়, মায়ের যদি সেসব মনে না থাকে তাহলে তাদের বংশের অতীত মানুষগুলো চিরকালের জন্য অন্ধকারে হারিয়ে যাবেন।
অমলদা বললেন, ঠিকই, জেনে রাখা ভাল, কিন্তু দরকার পড়ে না বলে তিন-চার পুরুষের বেশি খবর রাখি না। চার পুরুষ মানে একশো বছর। কালাপাহাড় ছিলেন তোমার কুড়ি পুরুষ আগে। ব্যাপারটা তাই গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। বিকেলে এসো, এব্যাপারে কথা বলা যাবে।
মোটরবাইকে উঠে অর্জুনের হঠাৎ একটা কথা মাথায় এল। এই যে আমরা পুরুষ-পুরুষ করি, কেন করি? কেন বাবা-ঠাকুদাকে ধরে প্রজন্ম মাপা হচ্ছে এবং তাকে পুরুষ আখ্যা দেওয়া হবে? মা-দিদিমাকে ধরে নারী শব্দটাকে পুরুষের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে না কেন? আজ যখন ছেলেমেয়ে সমান জায়গায় এসে গিয়েছে তখন মেয়েরা এই পুরুষ-মাপা প্রথাটার বিরুদ্ধে কথা বলতেও তো পারে!
দুপুরের খাওয়া সেরে আবার বাইক নিয়ে বের হল অর্জুন। জলপাইগুড়ির ইতিহাস জানেন এমন একজনকে খুঁজে পাওয়া দরকার। তার ছেলেবেলায় চারুচন্দ্র সান্যাল নামে একজন পণ্ডিত ব্যক্তি মারা গিয়েছেন, যাঁর নখদর্পণে এসব ছিল বলে সে অমলদার কাছে শুনেছে। রূপশ্রী সিনেমার সামনে এসে সে বাইক থামাল। জগুদা আর-এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। ভদ্রলোকের মুখে দাড়ি, কাঁধে ব্যাগ, ধুতি-পাঞ্জাবি পরনে। তাকে দেখে জগুদা হাত তুললেন। মালবাজার ঘুরে এখন জগুদার অফিস শিলিগুড়িতে। ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করেন। এই অসময়ে এখানে কোনও প্রশ্ন করা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছিল না সে।
জগুদা তাঁর সঙ্গীকে বললেন, এই যে, এর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব আপনাকে বলেছিলাম। এরই নাম অর্জুন, আমাদের শহরের গর্ব। বিলেত আমেরিকায় গিয়েছিল সত্যসন্ধান করতে। আর ইনি হলেন ত্রিদিব দত্ত। মন্দির নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। কলকাতার কলেজে পড়ান।
মন্দির নিয়ে গবেষণা করার কথা শোনামাত্র অর্জুনের মনে পড়ল কালাপাহাড়ের কথা। কালাপাহাড় তো একটার-পর-একটা মন্দির ভেঙেছেন। ইনি নিশ্চয়ই সেসব খবর রাখেন। সে নমস্কার করল। ত্রিদিববাবু বললেন, আমরা এখানকার দেবী চৌধুরানির তৈরি মন্দির দেখতে গিয়েছিলাম। তখনই ভাই তোমার কথা ইনি বলছিলেন।
আমার কথা কেন?
এ-দেশে মন্দিরের সঙ্গে অপরাধের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। এই কিছুকাল আগেই ডাকাতরা ডাকাতি করার আগে কালীর মন্দিরে পুজো দিতে যেত। সেই প্রসঙ্গে অপরাধ নিয়ে আলোচনা করতে করতে অপরাধ-সাহিত্য থেকে গোয়েন্দাদের কথা এসে গেল। আমি ভাবতে পারছি না জলপাইগুড়ির মতো শহরে কেউ শুধু এই কাজ করে কীভাবে বেঁচে থাকতে পারে? এখানে কেস কোথায়?
অপরাধী তো সব জায়গায় থাকে। অর্জুন বলতে বলতে দেখল ভদ্রলোকের কাঁধের কাপড়ের ব্যাগের ফাঁক দিয়ে একটা ছোট লাঠির ডগা দেখা যাচ্ছে। লাঠিটা বেশ চকচকে এবং গোল।
জগুদা বললেন, চললে শেথায় অর্জুন?
একটু ইতিহাস খুঁজতে। জগুদা, জলপাইগুড়ির ইতিহাস ভাল কে জানেন?
মলয়কে বলতে পারো। ওরা এসব নিয়ে থাকে। এই সময় একটা জিপ এসে দাঁড়াল সামনে। জিপটাকে অর্জুন চেনে। ভাড়া খাটে। জগুদা বললেন, হাতে সময় থাকলে আমাদের সঙ্গে ঘুরে আসতে পারো।
কোথায় যাচ্ছেন?
জল্পেশের মন্দির দেখতে। ত্রিদিববাবু এর আগেও ওখানে গিয়েছেন কিন্তু আর-একবার ওঁর যাওয়া দরকার।
অর্জুন মনে করতে পারছিল না আজ সকালে মাস্টারমশাই কালাপাহাড় সম্পর্কে বলতে গিয়ে জল্পেশের মন্দিরের কথা উল্লেখ করেছিলেন কি না। কিন্তু কালাপাহাড় যদি এই অঞ্চলে থেকে থাকেন তা হলে ওই মন্দির নিশ্চয়ই তাঁর চোখে পড়েছিল। জল্পেশের মন্দির তো আরও প্রাচীন।
নিরালার পাশে মোটরবাইক রেখে অর্জুন জিপে উঠে বসল। এখন তিনটে বাজে। হয়তো ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। কিন্তু অর্জুনের মনে হচ্ছিল একবার যাওয়া দরকার। হাসপাতালের সামনে দিয়ে রায়কতপাড়া পেরিয়ে জিপ ছুটছিল। ত্রিদিববাবু এবং জগুদা ড্রাইভারের পাশে বসেছিলেন। পেছনে বসে পিছলে যাওয়া রাস্তার দিকে তাকিয়ে। অর্জুন চুপচাপ ভাবছিল। রাজবাড়ির গেটের সামনে দুটো ছেলে হাতাহাতি করছে। তাদের ঘিরে ছোট্ট ভিড়। তারপরেই জিপ শহরের বাইরে। তিস্তা ব্রিজ সামনে। হঠাৎ অর্জুনের মনে হল সে অতীত নিয়ে বড্ড বেশি ভাবছে। অথচ শ্রীযুক্ত হরিপদ সেন বর্তমানের কালাপাহাড় নামক এক অজ্ঞাত মানুষের কাছ থেকে যে হুমকি দেওয়া চিঠি পেয়েছেন তার কোনও হদিস নেওয়া হচ্ছে না।
হরিপদ সেন তাঁর পিতামহের-প্রপিতামহের কিছু কাগজপত্রের প্যাকেট অমলদাকে দিয়ে গিয়েছেন। সেখানে কী লেখা আছে তা অমলদা এখনও বলেননি। আজকাল সব ব্যাপারেই অমলদার উৎসাহ এমন তলানিতে এসে ঠেকেছে যে, হয়তো এখনও খুলেই দেখেননি ওগুলো। আগামীকাল হরিপদবাবু শিলিগুড়ি থেকে আবার আসবেন অমলদার বাড়িতে। সেই সময় অমলদা তাঁকে টাকাটা ফেরত দিয়ে দিলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আর তা হলে তো সব কাজ চুকে যাবে। অর্জুনের মনে হল আগামীকাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত। এখনই হাতড়ে বেড়ানোর কোনও মানে হয় না। জিপ ততক্ষণে তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে দোমহানির দিকে ছুটছে। দুপাশে মাঠের মধ্যে দিয়ে পিচের রাস্তাটা বেঁকে গেছে ঘোড়ার পায়ের নালের মতো। মানুষজনের বসতি খুব কম। বাইপাস ছেড়ে জিপ ঢুকল বাঁ দিকে। শহর থেকে মাত্র বারো মাইল দূরে জল্পেশের মন্দিরে সে আগেও এসেছে। এসবই তার চেনা। মন্দিরে কোনও শিবের মূর্তি নেই, আছে অনাদিলিঙ্গ। কেউ বলেন কোচবিহারের মহারাজ প্রাণনারায়ণ একটি স্তম্ভের মাথায় গাভীদের দুধ ছড়িয়ে দিতে দেখে এখানে এই মন্দির স্থাপন করেন।
অর্জুন প্রসঙ্গটা তুলতেই ত্রিদিববাবু বললেন, খুব গোলমেলে ব্যাপার। প্রাণকৃষ্ণ দত্ত সন্দেহ করেছেন এটি এক বৌদ্ধমন্দির ছিল। মেলার সময় ভোট-তিব্বত থেকে ঘোড়া কুকুর কম্বল নিয়ে বৌদ্ধরা এখানে আসতেন। জল্পেশ্বর নামে এক রাজার কথাও শোনা যায় যিনি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন বলে কেউ দাবি রেখেছে। আসামের ঐতিহাসিকরা বলেন ভিতরগড়ের পৃথুরাজারই নাম জল্পেশ্বর, যিনি বখতিয়ার খিলজিকে পরাজিত করেছেন। ভদ্রলোক মারা যান ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে। তার মানে মন্দিরের আয়ু প্রায় আটশো বছর। মাটির ভেতর থেকে শিবলিঙ্গ উঠে এসেছে ওপরে। পঞ্চাশ বছর আগে মন্দিরে সংস্কারের সময় একটা পরীক্ষা চালানো হয়। বোঝা যায় লিঙ্গটি সাধারণ পাথর নয়, উল্কাপিণ্ড। আকাশ থেকে খসে মাটিতে ঢুকে পড়ে। এই আকাশ থেকে নেমে আসতে দেখে এখানকার মানুষ এঁকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করতে শুরু করে।
এই উল্কাপিণ্ডটা কবে পড়েছিল?
সময়টা ঐতিহাসিকরা আবিষ্কার করতে পারেননি। জিপ থামল একটা অস্থায়ী হাটের মধ্যে। বোঝা যায় সপ্তাহে এখানে হাট বসে, এখন চালাগুলো ফাঁকা। মন্দিরের সামনে হাতির মূর্তি। ত্রিদিববাবু বললেন, হিন্দু মন্দিরের সঙ্গে হাতি খুব একটা মেলে না। সম্ভবত এক সময় এখানে হাতির উপদ্রব হত। পাথরের হাতি তৈরি করে পাহারায় বসিয়ে তাদের ভয় দেখানোর পরিকল্পনা হয়েছিল।
জল্পেশ্বর মন্দিরের ভেতর অর্জুন ঢুকেছে। অতএব সেদিকে তার কোনও আগ্রহ ছিল না। ত্রিদিববাবু আর জগুদা চলে গেছেন তাঁদের কাজে। অর্জুন দেখল মন্দিরের পাশেই লম্বা বারান্দার একতলা ব্যারাকবাড়ি। সেখানে সম্ভবত দূরের ভক্তরা এসে ওঠেন। মানুষজন খুব কম। মন্দিরের এপাশে একটি পুকুর। সে ভাল করে দেখল। মন্দিরের গায়ে কোনও আঘাতের চিহ্ন দেখা যায় কি না। কিছুই চোখে পড়ল না।
পুকুরের ধারে এসে একটা সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিল অর্জুন, কিন্তু সামনে নিল। একজন বৃদ্ধ সন্ন্যাসী আসছেন। তাঁর পায়ে খড়ম, শরীরে সাদাধুতি লুঙ্গির মতো পরা, গলায় রুদ্রাক্ষ এবং মুখে পাকা দাড়ি। তিনি হাসলেন, আহা, মন চেয়েছিল যখন, তখন খাও। আমাকে দেখে সঙ্কোচ কেন?
অর্জুন আরও লজ্জা পেল। সে প্যাকেটটা পকেটে রেখে দিল। সন্ন্যাসীর মুখে বেশ স্নিগ্ধ ভাব, মন্দিরে না গিয়ে এখানে কেন?
এমনিই। মন্দিরের চেহারা দেখছিলাম। আপনি এখানে অনেকদিন আছেন?
দিন গুনিনি। তবে আছি!
এই মন্দিরে কবে শেষবার সংস্কারের কাজ হয়?
হৈমন্তীপুরের কুমার জগদিন্দ্রদেব রায়কত সংস্কার করেন, তাও অনেকদিন হয়ে গেল। সময়ের হিসেব বাবা আমার গুলিয়ে যায়।
আচ্ছা, আপনি কি জানেন কালাপাহাড় এই মন্দিরের ওপর আক্রমণ করেছিলেন?
সন্ন্যাসী হাসলেন, এ-কথা কে না জানে! মন্দিরের চুড়োটা এরকম ছিল না। কালাপাহাড় তখনকার চুড়ো ভেঙে ফেলেছিলেন। কিন্তু ভগবানের কোনও ক্ষতি করেননি। শোনা যায় মন্দিরের ভেতরেও তিনি ঢোকেননি।
আপনি কালাপাহাড় সম্পর্কে কিছু জানেন?
আরে, তুমি বাবার মন্দিরে এসে কালাপাহাড় সম্পর্কে জানতে চাইছ কেন? মজার ছেলে তো! কালাপাহাড়ের শক্তি ছিল, ক্ষমতাও ছিল, সেইসঙ্গে অভিমান এবং অপমানবোধ প্রবল। ব্রাহ্মণরা ওঁকে ক্ষিপ্ত করে দিয়েছিল। এসব আমার শোনা কথা। এই জল্পেশের অনেক বৃদ্ধ মানুষ তাঁদের পিতা-পিতামহের কাছে শোনা কালাপাহাড়ের গল্প এখনও বলেন। তিনি এলেন বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে। তাতে পাঠান যেমন আছে, তেমন এ-দেশের হিন্দুরাও। দেবাদিদেব নাকি তাঁকে এমন আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলেন যে, তিনি মন্দিরের ভেতরে পা বাড়াতে পারেননি। তুমি থাক কোথায়?।
তোমাকে আমার কিছু দিতে ইচ্ছে করছে। কী দেওয়া যায়?
সন্ন্যাসীর মুখ থেকে কথা বের হওয়ামাত্র পাশের নারকোল গাছ থেকে একটা নারকোল খসে পড়ল মাটিতে ধুপ করে। সন্ন্যাসী সেটা কুড়িয়ে নিলেন, বাঃ, এইটেই নাও। নাড় করে খেয়ো।
নারকোল হাতে ধরিয়ে সন্ন্যাসী চলে গেলেন। অর্জুন হতভম্ব। এটা কী হল? একেই কি অলৌকিক কাণ্ড বলে? সে পুকুরের দিকে তাকাল। দুর্ভেদ্য জঙ্গল, বিশাল বিল এবং শিবমন্দির। হরিপদ সেন যে জায়গাটার কথা বলেছিলেন তা তো জল্পেশ্বর হতে পারে। যদিও এখন চারপাশে কোনও জঙ্গল নেই। কিন্তু পাঁচশো বছর আগে থাকতেও তো পারে। আর তখনই তার মনে পড়ল অমলদার সতর্কবাণী, প্রমাণ ছাড়া কোনও সিদ্ধান্তে শুধু নির্বোধরাই আসতে পারে।