সুশান্ত চ্যাটার্জি গৃহেই ছিল।
পর পর সব এক সাইজের এক প্যাটার্নের কোয়ার্টার। ১৮নং কোয়াটারই সুশান্ত চ্যাটার্জির। বাইরে থেকে কোন আলো দেখা যায় না। অন্ধকার।
ওরা গাড়ি থেকে নেমে নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে গেট ঠেলে দুজনে বারান্দার দিকে অগ্রসর হতেই অন্ধকারে আবছা দুটো ছায়ামূর্তি পাশাপাশি চেয়ারের উপর বসে আছে চোখে পড়ল এবং একজন তার মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে বোধ হয় ওদের গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়াল।
ঐ সঙ্গে অস্পষ্ট নারীকণ্ঠে শোনা গেল, জামাইবাবু, কারা যেন আসছে—
পুরুষকণ্ঠে প্রশ্ন আসে, কে?
জবাব দেয় অবনী সাহা, সুশান্তবাবু আমি অবনী সাহা, থানার ওসি।
সঙ্গে সঙ্গে বারান্দার ইলেকট্রিক আলো জ্বলে উঠল।
কিরীটীর নজরে পড়ল, সামনেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে বত্রিশ-তেত্রিশ বৎসরের এক যুবক।
যুবকের চেহারাটি সত্যিই সুন্দর। রোগা পাতলা চেহারা। গাত্রবর্ণ রীতিমত গৌর। মাথায়। কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। মুখখানি একটু লম্বাটে ধরনের। চোখ দুটো ভাসা-ভাসা। দেখলেই মনে হয় যেন সরল গোবেচারা গোছের মানুষ।
সমস্ত মুখখানি যেন কেমন বিষণ্ণ, ক্লান্ত। পরনে পায়জামা ও পাঞ্জাবি। পায়ে রবারের চপ্পল।
আসুন অবনীবাবু, বসুন।
সুশান্ত চ্যাটার্জি আহ্বান জানায়।
আজ ডিউটিতে তাহলে যাননি?
না। আপনিই তো বারণ করে গিয়েছেন। সাত দিনের ছুটি নিয়েছি।
খুব ভাল করেছেন। মনের এ অবস্থায় ডিউটি ভাল করে করতেও পারতেন না।
ডিউটি গত দেড় মাস থেকেই তো ভাল ভাবে করতে পারিনি! কেন? প্রশ্ন করেন অবনী।
কেন আর? শকুন্তলার জন্য।
ও সত্যিই ইদানীং জীবনটা আমার একেবারে যেন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। কী জানেন অবনীবাবু, যদিও এটা ক্রুয়েল তবু অকপটে বলছি, ও যদি নিজে থেকেই বিষ খেয়ে সুইসাইড না করত-শেষ পর্যন্ত একদিন আমিই ওর গলা টিপে হত্যা করে ফাঁসি যেতাম!
ছি ছি, কী বলছেন মিঃ চ্যাটার্জি?
কথাটা এতটুকু মিথ্যা নয়। ও যে ইদানীং কী ভাবে অত্যাচার করত আমাদের ওপর-অথচ সমস্ত ব্যাপারটা বেসলেস একেবারে, সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সবই তো সকালে আপনাকে বলেছি মিঃ সাহা।
হ্যাঁ, বলেছেন বটে।
বসুন না, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?
অবনী ও কিরীটী দুজনে দুটো চেয়ার টেনে বসে।
একটু বসুন, মিতাকে দু কাপ চায়ের কথা বলে আসি।
বাধা দিল কিরীটী, না না, মিঃ চ্যাটার্জি, বসুন, তার কোন প্রয়োজন নেই। এইমাত্র চা খেয়ে আসছি। বসুন আপনি।
ওঁকে তো চিনতে পারছি না, মিঃ সাহা?
অবনী মিথ্যা কথা বললেন, আমাদেরই একজন লোক, মিঃ রায়।
ও।
উনি আপনাদের কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান। অবনী বলেন।
কী কথা?
কিরীটীই এবারে জবাব দিল, এমন বিশেষ কিছু না। সে হবেখন। তার আগে শকুলা দেবী যে ঘরে ছিলেন সেই ঘরটা একবার দেখতে চাই মিঃ চ্যাটার্জি।
বেশ তো, চলুন।
.
রেলওয়ে কোয়ার্টার যেমন হয়।
সামনে ছোট একটি বারান্দা, তারপরই পূর্ব-মুখে একটা বড় সাইজের ঘর, লাগোয়া একটা বারান্দা। ও ছোট্ট একটা স্টোর-রুম।
বারান্দার একদিকে রান্নাঘর, অন্যদিকে পাশাপাশি দুটো ঘর, তার মধ্যে একটা ঘরের দরজায় তালা দেওয়া ছিল।
অন্য ঘরটার দরজা খোলা, ভিতরে আলো জ্বলছিল। ঘরের দরজায় পর্দা ঝুলছে, ভিতরটা নজরে পড়ে না। অবনী বললেন, তালা-দেওয়া ঐ ঘরটাতেই শকুন্তলা দেবী ছিলেন।
তালা দিল কে? কিরীটী শুধায়।
আমিই যাবার সময় তালা দিয়ে গিয়েছিলাম আজ সকালে।
অবনী পকেট থেকে চাবি বের করে ঘরের তালাটা খুলে দিলেন। তিনজনে অতঃপর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে।
ঘরটা অন্ধকার।
আলোটা জ্বালুন, অবনীবাবু।
সুশান্তই সুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বালাবার চেষ্টা করল কিন্তু আলো জ্বলল না, খুট করে একটা শব্দ হল মাত্র।
সুশান্ত বললে, ঘরের বাটা বোধ হয় ফিউজ হয়ে গিয়েছে!
কাল এ ঘরে আলো জ্বলেনি? কিরীটী ঐসময় শুধায়।
না। সুশান্ত বলে।
কেন?
ইলেকট্রিক আলো ইদানীং কুন্ত চোখে সহ্য করতে পারত না বলে ঘরে একটা মোমবাতি জ্বালানো থাকত।
মোমবাতি!
হ্যাঁ, দাঁড়ান, মোমবাতিটা জ্বেলে দিই।
অন্ধকারেই এগিয়ে গেল সুশান্ত এবং অনায়াসেই পাশ থেকে দেশালাইটা নিয়ে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিল।
নরম স্নিগ্ধ মোমের আলোয় ঘরটা মৃদুভাবে আলোকিত হয়ে উঠল ধীরে ধীরে।
কিরীটী চেয়ে দেখল, একটা বড় সাইজের মোমবাতি—প্রায় অর্ধেকেরও বেশী পুড়ে গিয়েছে।
একটা কাঠের চেস্ট-ড্রয়ারের উপর একটা ভাঙা কাঁচের প্লেটের উপরে মোমবাতিটা বসানো।
মাঝারি আকারের ঘরটা।
দুটি দরজা। একটি দরজা বন্ধ। বোধ হয় পাশের ঘরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। অন্যটি দিয়ে তারা একটু পূর্বে ভিতরে প্রবেশ করেছে।
তিনটি জানালা। দুটি দক্ষিণ দিকে, বন্ধ। অন্যটি পশ্চিম দিকে অন্দরমুখী।
সব কটি জানালাই বন্ধ ছিল। আসবাবপত্র ঘরে সামান্যই।
একটা শূন্য খাট, তার পাশে একটা গোলাকার টেবিল, তার উপরে কিছু ঔষধপত্রের শিশি, হরলিকসের বোতল, একটা জলের গ্লাস ও কাপ তখনও রয়েছে দেখা গেল।
পশ্চিম দিকে দেওয়াল ঘেঁষে একটা আলমারি—প্রমাণ সাইজের আয়না বসানো। তার পাশে একটা আলনায় কিছু শাড়ি ঝুলছে।
দেওয়ালের গায়ে একটা ক্যাম্প খাট ফোল্ড করা রয়েছে। একটি চেয়ার ও একটি টুল।
এ ঘরে কি একা শকুন্তলা দেবীই থাকতেন? কিরীটী প্রশ্ন করে।
না, আমিও থাকতাম। ঐ ক্যাম্প খাটটা পেতে আমিও এই ঘরেই শুতাম যখন বাড়িতে থাকতাম। জবাব দেয় সুশান্ত।
আর আপনার ছেলে রাহুল?
সে তার মাসীমণির কাছেই এখানে আসা অবধি শোয়।
মানে মিত্ৰাণী দেবীর সঙ্গে?
হ্যাঁ। আপনার ছেলে বাড়িতে নেই?
আছে। সকাল থেকে ওর জ্বর।
জ্বর!
হ্যাঁ, খুব জ্বর। মাঝে মাঝে ভুল বকছে।
ডাক্তার আসেননি?
হ্যাঁ। সুরেন ডাক্তার এসেছিল। ঔষধ দিয়ে গিয়েছে।
কিরীটী এবার বলে, চলুন, একবার পাশের ঘরটা দেখব যে ঘরে মিত্ৰাণী দেবী থাকেন। চলুন। সুশান্ত বলে।