০৩. সান্দিকোনা স্কুলের হেডমাস্টার

সান্দিকোনা স্কুলের হেডমাস্টার বাবু পরিমল চন্দ্রের মুখে হাসি। তাঁর অংক খেলা যে এত জমে যাবে তিনি ভাবেন নি। প্রথমে ভেবেছিলেন অংক খেলার আয়োজন করা হবে স্কুলের কমনরুমে। সকাল থেকেই মানুষের সমাগম দেখে খেলাটা তিনি স্কুলের মাঠে নিয়ে এসেছেন। তিনটা ব্ল্যাকবোর্ড আনা হয়েছে। প্রতিটি বোর্ডভর্তি অংক। সবই বড় বড় সংখ্যার গুণ, ভাগ। ব্ল্যাকবোর্ডগুলি পর্দা দিয়ে ঢাকা। স্কুলের ঘণ্টা বাজানো হবে তখনই পর্দা সরানো হবে। শুরু হবে অংক খেলা। রফিক অংক করবে মুখে-মুখে, বাকি পাঁচজন করবে ক্যালকুলেটার দিয়ে, দুজন করবে লগ-টেবিল দিয়ে।

অঞ্চলের গণ্যমান্যদের দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। তারা সবাই এসেছেন। সান্দিকোনা থানার ওসি সাহেবও সিভিল ড্রেসে এসেছেন। পোস্ট মাস্টার সাহেব এসেছেন। ব্র্যাক নামের এনজিওর লোকজনও আছেন। তাঁরা অবশ্যি যেখানেই জনসমাগম হয় সেখানেই থাকেন। সান্দিকোনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাহেব এসেছেন। চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে তাঁর বড়মেয়ের জামাই এসেছেন। এই দ্রলোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক। গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছেন। তিনি শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। শ্বশুর সাহেব জামাইকে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখাতে এনেছেন। এই সঙ্গে কিছু মজা যদি পায় তাতেই-বা ক্ষতি কি?

বাবু পরিমল চন্দ্রের মুখ হাসি-হাসি হলেও একটু শংকিত বোধ করছেন। তাঁর শংকার কারণ খেলা ঠিকমত জমবে তো? তিনি শুধু লোকমুখে শুনেছেন রফিক বড় বড় অংক মুখে-মুখে করতে পারে। বাস্তবে এই পরীক্ষা কখনো করা হয় নি। যদি দেখা যায় আজ সে কিছুই পারছে না তাহলে বিরাট অপমান হবে।

বাবু পরিমল চন্দ্রের শংকার আরেকটা কারণ হল অঞ্চলের বিশিষ্টজনরা এসেছেন। তাদের সম্মানে চা-নাশতার ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল। চায়ের ব্যবস্থা হয়েছে, নাশতার আয়োজন এখনো কিছু হয় নি। স্কুলের ইমার্জেন্সি ফান্ড থেকে দুশ টাকা নিয়ে স্কুলের দপ্তরিকে বাজারে পাঠানো হয়েছে নিমকি মিষ্টি আনার জন্যে। এটা নিয়েও পরে নিশ্চয়ই ঝামেলা হবে। স্কুলবোর্ডের সভায় তাঁকে প্রশ্ন করা হবে ইমার্জেন্সি ফান্ডের টাকা অংক খেলার মত ফালতু বিষয়ে তিনি কেন খরচ করলেন? এমনিতেই স্কুল ফান্ডে কোন টাকাপয়সা নেই। যেখানে সামান্য চক কেনার টাকাও নেই সেখানে খেলাধুলার জন্যে দুশ টাকা। মনে হচ্ছে আজ তার খবর আছে।

বিকাল চারটায় খেলা শুরু হবার কথা। চারটার আগেই মাঠ ভর্তি হয়ে গেল। সান্দিকোনা ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জালাল সাহেবকে সভাপতির আসনে বসানো হয়েছে। তাঁর ভাবভঙ্গি থেকে বোঝা যাচ্ছে তিনি দীর্ঘ বক্তৃতা দেবেন। দীর্ঘ বক্তৃতা দেবার আগে তাঁর চোখ ঘোলাটে হয়ে যায়। এখনো তাই হয়েছে। তিনি আগে বিএনপি করতেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবার পর আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। বক্তৃতা দেবার সময় পুরনো অভ্যাসে বেফাসে জিয়াউর রহমান সাহেবের কথা হঠাৎ হঠাৎ বলে খুবই বেকায়দায় পড়ে যান। তখন তাঁর বক্তৃতা আরো দীর্ঘ হয়।

হিন্দু মুসলমান হলে যেমন যে-কোন গরু দেখলেই, গরুর পিঠে থাবা দিয়ে জিজ্ঞেস করে—এর গোশত খেতে কেমন হবে? ওনারও সেই অবস্থা হয়েছে। তিনি যে-কোন উপলক্ষেই জ্বালাময়ী আওয়ামী বক্তৃতা দেন। অংক খেলাতেও তিনি এই কাণ্ড করবেন।

জালাল সাহেব হাতের ইশারায় পরিমল বাবুকে ডেকে নিচু গলায় বললেন–শুরু করছেন না কেন?

পরিমল বাবু বললেন, এক্ষুণি শুরু হবে স্যার।

আমার ভাষণটা শুরুতে দিয়ে দেই?

আপনি সভাপতি, আপনি বলবেন সবার শেষে।

শেষে তো লোক থাকবে না। ফাঁকা মাঠে ভাষণ দিয়ে লাভ কি? ভাষণ তো মাঠের জন্যে না, মানুষের জন্যে।

লোক থাকবে। কেউ যাবে না।

মাইকের ব্যবস্থা রাখেন নাই কেন? খালি গলায় ভাষণ ভাল হয় না। সব কিছুরই দস্তর আছে। আগরবাত্তি ছাড়া যেমন মিলাদ হয় না। মাইক ছাড়া ভাষণ হয় না। যান চট করে মাইক আনার ব্যবস্থা করেন।

পরিমল বাবু মাথা চুলকাতে লাগলেন। জালাল মাস্টার বিরক্ত মুখে বললেন নিউ স্টার থেকে মাইক নিয়ে আসেন। খরচ আমি দিব। খেলার শেষে পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে?

জ্বি না।

এটা কেমন কথা? আমার ভাষণের শেষে পুরস্কার বিতরণ।

পুরস্কারের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয় নাই।

আমার তরফ থেকে পুরস্কার। সিলভার মেডেল। একজন কাউকে আমার বাড়িতে পাঠায়ে দেন। অনেক সিলভার মেডেল তৈরি করেই রেখেছি। একটা যেন নিয়ে আসে।

জ্বি আচ্ছা স্যার।

একটা খেলার আয়োজন করেছেন, কিন্তু ব্যবস্থা অতি দুর্বল। আমি আবার জামাইকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। জামাই-এর সামনে বেইজুতির ব্যবস্থা করবেন। না। সভাপতিকে ফুলের মালা দিতে হয়। সাধারণ নিয়ম। ফুলের মালা কোথায়?

স্যার ব্যবস্থা করছি।

কাগজের মালা যেন না হয়। কাগজের মালা দেয়া হয় কোরবানির গরুর। গলায়। খেলার বিচারক কারা? আমার জামাইকে বিচারকমণ্ডলীর প্রধান করে দিন। সে ফিজিক্সের শিক্ষক। অংকের বিচারক হবার মতো যোগ্যতা আর কারোর নাই। ঠিক বললাম না?

অবশ্যই স্যার।

ইয়াসিন সাহেবকেও দেখি খবর দিয়েছেন। তাকে আবার যেন মঞ্চে ডাকবেন না। ইয়াসিন সাহেবের সঙ্গে আমি এক মঞ্চে বসি না।

উনাকে ডাকব না।

জালাল সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, যেখানে আমাকে বলেছেন সেখানে আপনি কি করে ইয়াসিন সাহেবকে দাওয়াত দেন এটাই তো বুঝলাম না। সাধারণ কমনসেন্সও থাকবে না?

স্যার আমি উনাকে দাওয়াত দেই নাই। উনি নিজ থেকে চলে এসেছেন। রফিক উনার বাড়িতেই থাকে।

আপনার কর্মকাণ্ডে আমি খুবই বিরক্ত হয়েছি। যাই হোক অনুষ্ঠান শুরু করুন।

মাইক আসুক তারপর শুরু করি।

অনুষ্ঠান শুরু করে দিন, মাইক আর মেডেল পরে আসুক। সভাপতির ভাষণের সময় মাইক থাকলেই হবে। অনুষ্ঠানের শেষে দেশাত্ববোধক গানের আসর থাকলে ভাল হত।

পরিমল বাবু মন খারাপ করে অনুষ্ঠান শুরু করলেন। এতসব ঝামেলা হবে। তিনি ভাবেন নি। এদিকে আবার ইয়াসিন সাহেব হাত-ইশারায় তাকে ডাকছেন। তিনি ইশারা না-শোনার ভান করে অনুষ্ঠান শুরু করে দিলেন। পরিমল বাবু নিতান্ত আনিচ্ছার সঙ্গে একটি ছোট্ট বক্তৃতাও দিলেন–

সুধীবৃন্দ আমাদের অংক খেলা শুরু হচ্ছে। কোমলমতি শিশু-কিশোরদের অন্তরে অংক ভীতি দূর করা এবং অংকের প্রতি তাদের আগ্রহ তৈরি করার উদ্দেশ্যেই এই অংক খেলার প্রতিযোগিতা। অত্র অঞ্চলে বিশিষ্ট সমাজসেবী, জনদরদি রাজনীতিবিদ জনাব জালাল উদ্দিন আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতির আসনে বসতে রাজি হয়ে আমাদেরকে ধন্য করেছেন। আপনারা শুনে আনন্দিত হবেন যে অংক প্রতিযোগিতায় বিজয়ীর জন্যে তিনি একটি রৌপ্য-পদক ঘোষণা করেছেন।

আজকের এই প্রতিযোগিতায় তিনজন বিচারক আছেন। বিচারকমণ্ডলীর প্রধান ফরহাদ খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার লেকচারার। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে তিনি সম্পর্কে আমাদের জামাই। তাঁর শ্বশুর হলেন জনাব জালাল উদ্দিন। জনাব ফরহাদ খান যে শত ব্যস্ততার মধ্যে বিচারকের অপ্রিয় দায়িত্ব পালনে রাজি হয়েছেন এতে আমাদের আনন্দের সীমা নাই। আমরা আমাদের অন্তরের অন্তস্তল থেকে তাঁকে জানাচ্ছি মোবারকবাদ।

 

খেলা শুরুর ঘোষণা দেয়া হলেও অংক খেলা শুরু হতে হতে পাঁচটা বেজে গেল। ফুলের মালার জন্যেই দেরি। গ্রামাঞ্চলে চট করে মালা বানাবার মতো ফুল জোগাড় করা বেশ কঠিন। ঠিক পাঁচটায় দপ্তরি ঘণ্টা বাজাল। ব্ল্যাকবোর্ডর উপর থেকে পর্দা সরানো হল। সব মিলিয়ে দশটি বিরাট অংক। অংকগুলির উত্তর খামবন্ধ অবস্থায় বিচারকদের কাছে দেয়া হল।

হেডমাস্টার পরিমল বাবু বললেন, সাইলেন্স! কেউ কোন শব্দ করবেন। না। এই বলে তিনি চেয়ারে বসতে যাবেন তখন রফিক উঠে দাঁড়াল।

পরিমল বাবু বললেন, কিছু বলবেন?

রফিক বলল, অংকগুলি হয়ে গেছে স্যার। উত্তর কাগজে লেখে দিয়েছি।

পরিমল বাবু হতভম্ব হয়ে বিচারকদের দিকে তাকলেন। দুই মিনিটই পার হয় নি। এর মধ্যেই অংক হয়ে গেছে বলছে এর মানে কি? কোন ফাজলামি না তো?

বিচারকদের কাছে কাগজ দেয়া হল। ফরহাদ খান কাগজ দেখলেন। খামে বন্ধ উত্তর দেখলেন। অবিশ্বাসের চোখে পরিমল বাবুর দিকে তাকালেন। ফিসফিস করে বললেন, ব্যাপারটা কি? কোন ট্রিস কি আছে? উত্তরগুলি কি তিনি আগেই জানেন?

জ্বি না, জানেন না।

কোন ব্রিকস নিশ্চয়ই আছে। আপনি কি নিশ্চত অংকের উত্তরগুলি কেউ তাকে পাস করে নি?

পরিমল বাবু আমতা-আমতা করতে লাগলেন। তিনিও খুবই হকচকিয়ে গিয়েছেন। এখন তাঁর কাছেও মনে হচ্ছে কোন ট্রিকস থাকলে থাকতেও পারে।

ফরহাদ খান বললেন, অংক খেলাটা আরেক বার হোক। এবার একটাই অংক থাকবে। আমি সেই অংক বোর্ডে লিখব। ঘড়ি ধরে থাকব দেখি তিনি মুখে-মুখে সমাধান করতে পারেন কি না। আর যদি পারেন তাহলে কতক্ষণে পারেন।

পুরো বোর্ড জুড়ে বিশাল একটা সরল অংক লেখা হল। সেখানে গুণ, ভাগ, যোগ, বিয়োগ সবই আছে। বোর্ডের উপর থেকে পর্দা সরানো হল। ফরহাদ খান ঘড়ি ধরে থাকলেন। রফিক উত্তর দেবার জন্যে সময় নিল ২১ সেকেন্ড।

বাবু পরিমলচন্দ্ৰ দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। অনুষ্ঠান শুরু হতে-না-হতে শেষ। এখনো মাইক এসে পৌঁছায় নি। দপ্তরি নিমাই মিষ্টি-নিমকি নিয়ে আসে নি। স্কুল মাঠে জড়ো হওয়া লোকজন বুঝতেই পারে নি অংক খেলা শেষ হয়ে গেছে। সভাপতি জালাল আহমেদ খুবই বিরক্ত দুই-তিন মিনিটের একটা অনুষ্ঠানের মানে কি? তাঁকে বক্তৃতা দিতে উঠতে হবে অথচ মাইক এসে পৌছায় নি। তিনি ভেবেছিলেন অংক খেলা চলার সময়ে ভাষণটা মনেমনে ঠিক করে ফেলবেন। শুরু করবেন বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে। ভাষা আন্দোলনের পর মহান মুক্তিযুদ্ধ…সবই এলোমেলো হয়ে গেল, এবং তাঁর পানির পিপাসা পেয়ে গেল। আয়োজকরা এমন গাধা যে টেবিলে একগ্লাস পানি পর্যন্ত রাখেনি। সব রামছাগলের দল। গলায় যে ফুলের মালা দিয়েছে সেখানে কালো পিঁপড়া ছিল। তার একটা তাঁর ঘাড়ে কামড় দিয়েছে। পিপড়াশুদ্ধ ফুলের মালা গলায় দিয়ে দিবে এটা কেমন কথা?

একটা মানুষ চোখের নিমিষে জটিল সব অংক করে ফেলেছে—এই ব্যাপারটা তাঁকে মোটেও অভিভূত করতে পারে নি। দেশে গাধা-ছাত্র আছে এরা দশ দিনে দশটা অংক করতে পারবে না। পারলেও ভুল করবে। তার বিপরীতে বুদ্ধিমান মানুষও থাকবে যারা অংক দ্রুত করে ফেলবে। তাতে অবাক হবার কি আছে। রফিক অংকগুলি করেছে চোখ খোলা রেখে। তিনি যুবক বয়সে ময়মনসিংহ টাউন হলে একবার ম্যাজিক দেখেছিলেন। সেখানে ম্যাজিশিয়ান চোখ বন্ধ অবস্থায় বোর্ডে লেখা বিরাট অংক করে ফেলল। সেই ম্যাজিশিয়ানের নামও তাঁর মনে আছে প্রফেসর আহাম্মদ আলী।

প্রফেসর আহাম্মদ আলীর কাছে রফিক কিছুই না। রফিককে রূপার মেডেল না দিলেও চলে। তারপরেও দিচ্ছেন কারণ রাজনৈতিক। এলাকার মানুষদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখতে হবে।

মাইক এবং মেডেল দুই-ই চলে এসেছে। জালাল সাহেব লক্ষ করলেন সভার লোকজন চলে যাচ্ছে। তিনি বক্তৃতা শুরু করলে লোকজন যদি আরো যাওয়া শুরু করে তাহলে খুবই খারাপ ব্যাপার হবে। তিনি পরিমল বাবুকে চোখের ইশারায় ডাকলেন। গলা নিচু করে বললেন, লোকজন তো চলে যাচ্ছে।

পরিমল বাবু কিছু বললেন না। জালাল সাহেব চাপা গলায় বললেন, মাইক ফিরত পাঠায়ে দিন। ভাষণ দিব না সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শুধু পুরস্কার বিতরণী হবে। একটা প্রাইজ দিলে হবে না, দুটা প্রাইজ দিতে হবে। ফার্স্ট আর সেকেন্ড। ফার্স্ট প্রাইজ রূপার মেডেল। আর সেকেন্ড প্রাইজ একশ টাকা। সেকেন্ড কে হয়েছে?

সেকেন্ড কেউ হয় নাই।

আপনি হেডমাস্টার। রামছাগলের মতো কথা আপনার মুখে মানায় না। ফাস্ট থাকলেই সেকেন্ড থাকে। বিচারকমণ্ডলীকে জিজ্ঞেস করে জেনে আসুন সেকেন্ড কে? আরেকটা কথা, ভবিষ্যতে এই জাতীয় অনুষ্ঠান করার আগে আমার সঙ্গে পরামর্শ করে নিবেন।

হেডমাস্টার সাহেব বিচারকমণ্ডলীর সঙ্গে কথা বলে ফিরে এসে শুকনো মুখে। জানালেন বিচারকমণ্ডলী বলেছে কেউ সেকেন্ড হয় নাই।

 

সন্ধ্যা থেকে আকাশ মেঘলা করে বৃষ্টি পড়ছে। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস দিচ্ছে। বাতাসের বেগ বেশ প্রবল। এই বাতাসের নাম মশা মারা বাতাস। এ রকম দমকা বাতাসে মশার পাখা ছিড়ে যায়। মশা-মারা পড়ে। ঝড়ের সময় দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখলেও মশা-মারা বাতাসে দরজা-জানালা খোলা রাখতে হয়।

রফিকের ঘরের দরজা-জানালা খোলা। সে একটা পাতলা চাদর গায়ে জড়িয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তার টেবিলের উপর হারিকেন। একেকবার বাতাসের ঝাপ্টা আসছে হারিকেনের শিখা দপ করে বেড়ে উঠছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি হারিকেন নিভে গেল। হারিকেনের পাশে বই-খাতা নিয়ে শেফা বসে আছে।

স্যার ঘুমিয়ে আছেন। তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে ইচ্ছা করছে না। বইখাতা নিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে তার ভাল লাগছে। চাদর দিয়ে স্যারের মুখ ঢাকা। মুখ ঢাকা না থাকলে ভাল হত। মাঝে মাঝে স্যারের মুখের দিকে তাকানো যেত। জাগ্রত মানুষের মুখ দেখতে এক রকম, আর ঘুমন্ত মানুষের মুখ দেখতে। আরেক রকম। মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন তাকে খুব অসহায় লাগে। খুব মায়া লাগে মানুষটার জন্যে। এ বাড়ির কেউ জানে না রফিক স্যার যখন ঘুমিয়ে থাকেন তখন সে মাঝেমধ্যে তাকে এসে দেখে যায়। বেশিরভাগ সময়ই জানালা দিয়ে দেখে। তবে কয়েকবার সে ঘরে ঢুকেও দেখে গেছে। সে জানে কাজটা ঠিক না। নিশিরাতে সে একজনের ঘর থেকে বের হচ্ছে। কি ভয়ংকর কথা!

তবে এ ধরনের কাজ এখন আর করা যাবে না। কারণ কিছুদিন থেকেই তার মা তাকে চোখে চোখে রাখছেন। এই যে সে স্যারের ঘরে বসে আছে, সে নিশ্চিত যে তার মা-ও আশেপাশেই আছেন। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে তার দিকে লক্ষ রাখছেন। সে নিজে যখন মা হবে তখন সেও নিশ্চয়ই এ রকম করবে। নিজের মেয়েকে চোখে চোখে রাখবে।

শেফা খাতা খুলল। সে খুব মন দিয়ে লেখাপড়া করছে এ রকম ভান করা দরকার। খাতায় কিছু লেখা দরকার। অংক করা যায়। কিন্তু অংক করতে ইচ্ছা করছে না। মেট্রিক পরীক্ষায় সে যে কয়টা বিষয়ে ফেল করবে অংক হচ্ছে তার একটা। তার ধারণা, সে খুব কম হলেও তিনটা বিষয়ে ফেল করবে। অংক, ইংরেজি এবং বিজ্ঞান। এই তিনটা বিষয়ের মধ্যে সবচে কম নাম্বার সে পাবে অংকে। যদিও বাড়িতে একজন অংকের জাহাজ আছে। অংকের জাহাজের অংক করতে কাগজ-কলম লাগে না। সে মুখে-মুখে অংক করে। অংকের জাহাজ এই মুহূর্তে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছে। কি আশ্চর্য ব্যাপার সন্ধ্যাবেলা কেউ ঘুমায়?

যথেষ্ট ঘুম হয়েছে। এখন তাকে জাগিয়ে দেয়া দরকার। টেবিলে খুটখাট শব্দ করতে হবে। চেয়ারের পায়া ধরে টানাটানি করতে হবে। ঘুম পাড়াবার জন্যে ঘুমপাড়ানি গান আছে। ঘুম থেকে তোলার জন্যে ঘুমভাঙানি গান থাকলে ভাল হত। দুই লাইন ঘুম ভাঙানি গান গাওয়া হবে, যে ঘুমিয়ে ছিল সে লাফ পিয়ে উঠবে। ফ্যালফ্যাল করে এদিকে-ওদিকে তাকাবে। মেয়েদের ঘুম ভাঙানি গাম আছে। একটা সে নিজেই জানে–

আর কত ঘুমাইবা কন্যা চউখ দুইটা মেল
কান্ধে নিয়া রঙিলা গামছা বন্ধু চইল্যা গেল।

শেফা কেউ শুনতে না পায় এমনভাবেই ফিসফিস করে দুলাইন গাইল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রফিক ধড়মড় করে উঠে বসল। সে ফ্যালফ্যাল করেই তাকাচ্ছে। শেফা থমত খেয়ে বলল, মাগরিবের নামাজ বাদ দিয়া সন্ধ্যাবেলা ঘুম? বাপজান শুনলে খুবই রাগ হবেন।

রফিক বলল, শব্দ কিসের?

বৃষ্টির শব্দ। বৃষ্টি হইতেছে সঙ্গে বাতাস। বৃষ্টি-বাতাস একসঙ্গে হইলে কি হয় জানেন?

না।

শেফা গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, বৃষ্টি-বাতাস একসঙ্গে হইলে চখাচখির বিবাহ হয়–।

বৃষ্টি হয় বাতাস হয় চখাচখির বিবাহ হয়।

রফিক বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, এইসব শ্লোক কি সত্যি আছে, না তুমি বসে বসে বানাও?

শেফা জবাব দিল না। সে তার খাতায় বৃষ্টি-বাতাসের সঙ্গে চখাচখির বিবাহ-সংক্রান্ত শ্লোকটা লিখে ফেলছে। মিল দিয়ে আরেকটা লাইন লিখে ফেলতে হবে। এই লাইনে শ্লোক হয় না। শ্লোকের জন্যে খুব কম করে হলেও দুটা লাইন লাগে। মাঝেমধ্যে তার মাথায় চট করে সুন্দর সুন্দর মিল আসে। মাঝেমধ্যে কিছুই আসে না। আজ আসবে কি না কে জানে। শেফা লিখল—

বৃষ্টি হয় বাতাস হয় চখাচখির বিবাহ হয়,
বড় সুখের এই বিবাহ কোনদিন ভাঙার নয়।

বারান্দায় বালতি পেতে বৃষ্টির পানি ধরা হচ্ছে। সেই পানিতে মুখ ধুয়ে রফিক শেফার সামনের চেয়ারে বসল। শেফা খাতা থেকে মুখ না তুলে বলল, স্যার আপনে যে রূপার মেডেল পেয়েছেন, সেই মেডেলে কি লেখা জানেন?

না, কি লেখা?

খাদিজা খাতুন রৌপ্য-পদক। খাদিজা হলেন আমাদের জালাল সাহেবের মা।

ও।

উনি তাঁর মার নামে, বাবার নামে, তাঁর দাদার নামে অনেক রূপার মেডেল বানায়ে ঘরে রেখে দিয়েছেন। কেউ কিছু করলেই তারে একটা রূপার মেডেল দিয়ে দেন।

তাই নাকি?

একবার তার বাড়িতে ভিক্ষা করতে এক ফকির এসেছে। এই ফকির আবার কান নাড়াতে পারে। চোখ বন্ধ করে সে গরুর মতো নিজের দুই কান নাড়ায়। সেই কান নাড়ানো দেখে জালাল সাহেব তাঁকেও একটা মেডেল দিয়েছেন। খাদিজা খাতুন রৌপ্য-পদক।

রফিক হেসে ফেলল। শেফা গম্ভীর মুখে বলল, আপনাকে হাসানের জন্যে ঘটনাটা বলি নাই। আসলেই দিয়েছেন। এখন সেই ফকির গলায় মেডেল ঝুলায়ে ভিক্ষা করে। সে হয়েছে মেডেল পাওয়া ভিক্ষুক।

শেফার মুখ গম্ভীর। রফিক হাসছে। সে হাসতে হাসতেই বলল—তোমার অদ্ভুত গুণ কি জান শেফা? তোমার অদ্ভুত গুণটা হচ্ছে—তুমি খুবই হাসির কথা মাঝে মাঝে বল কিন্তু একটুও হাস না। তখন তোমাকে রোবট মনে হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট। অষ্টম ধারার রোবট। যার নিজের কোন ইমোশন নেই কিন্তু অন্যের ইমোশন সম্পর্কে সে জানে।

শেফা বলল—এইসব কি হাবিজাবি বলতেছেন?

তোমাকে মনে হয় তুমি শেফা না তুমি আসলে শেফ্‌। আমি আসলে কি?

শেফ্‌। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট। তোমার মাথায় ব্রেইনের বদলে আছে কপোট্রন।

শেফা খাতা বন্ধ করে বলল-মাঝে মাঝে আপনে পাগলের মতো কথা বলেন। মাঝে মাঝে আপনাকে পাগল মনে হয়। তোমার কাছে মনে হয় আমি পাগল?

সবসময় মনে হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয়। একদিন দুপুরবেলা আপনি ঘুমাচ্ছেন আমি কি কাজে যেন আপনার ঘরে ঢুকেছি। ও আচ্ছা মনে পড়েছে টেবিলের ওপর অংকের বইটা ফেলে গিয়েছিলাম, সেই বই নিতে গিয়েছি হঠাৎ তাকায়ে দেখি ঘুমের মধ্যে আপনি ছটফট করতেছেন। একবার এপাশ ফিরেন আরেকবার ঐপাশ ফিরেন। আপনার কপালে ঘাম। আপনি বিড়বিড় করে কথাও বলতেছেন।

কি কথা?

কি কথা তা বলতে পারব না। আমি তো আর কথা শুনার জন্যে আপনার কাছে যাই নাই। অংকের বই নেয়ার জন্যে গিয়েছিলাম। বই নিয়ে চলে গিয়েছি।

যে কথা শুনেছিলে তার একটা-দুটা শব্দও কি মনে নাই?

না।

আবার যদি কখনো এরকম দেখ—মন দিয়ে শুনবে। আমি ঘুমের মধ্যে কি বলছি মনে রাখার চেষ্টা করবে।

জি আচ্ছা।

কথাবার্তার এই পর্যায়ে দমকা বাতাস হল। হারিকেন নিভে গেল। শেফা মনে মনে বলল, বাতি নিভেছে বেশ হয়েছে। অন্ধকারই ভাল। এই অন্ধকারে হাত বাড়ালেই মানুষটাকে ছোঁয়া যাবে। মানুষটা ভাবতেও পারবে না এই কাজটা শেফা ইচ্ছা করে করেছে। শেফা এমন কোন খারাপ মেয়ে না যে ইচ্ছা করে পুরুষ মানুষ ছুঁয়ে দেবে। কিন্তু খারাপ মেয়ে হতে ইচ্ছা করছে। শেফার খানিকটা কান্না পেয়ে গেল। তার কি কোন অসুখ করেছে? খারাপ ধরনের কোন অসুখ। যে অসুখে মানুষকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। যে অসুখে কারণ ছাড়াই কান্না পায়। মানুষটা যখন সামনে থাকে তখন কান্না পায়, যখন সামনে থাকে না তখনও কান্না পায়।

শেফা খুবই আশ্চর্য বোধ করছে। ঘরে এতক্ষণ হল বাতি নেই অথচ তার মা ছুটে আসছেন না। জ্বলন্ত হারিকেন নিয়ে তার মার তো ইতিমধ্যেই ছুটে চলে আসার কথা। বিদ্যুৎ চমকাল। শেফা বিদ্যুতের আলোয় দেখল মানুষটা মাথা নিচু করে বসে আছে। মনে হচ্ছে কোন কিছু নিয়ে মানুষটা চিন্তিত। তার এত কিসের চিন্তা? এই পৃথিবীতে চিন্তা করে কিছু হয় না। যা হবার তা চিন্তা করলেও হবে চিন্তা না করলেও হবে। তার কথাই ধরা যাক-না কেন—সে জানে সে মেট্রিক পাস করতে পারবে না। খুব কম করে হলেও তিনটা বিষয়ে ফেল করবে। তার জন্যে সে তো গালে হাত দিয়ে চিন্তা করতে বসে নি। চিন্তা করলে যদি পাস হত তাহলে চিন্তা করত।

আলো হাতে কে যেন আসছে। শেফা ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল। অনেকক্ষণ সে অন্ধকারে ছিল এর মধ্যে হাত বাড়িয়ে একটু খুঁয়ে ফেললেই হত। এ রকম কি আর কখনো হবে? আর কখনো কি হারিকেন নিভে যাবে? শেফার কান্না পাচ্ছে। সে দাঁত দিয়ে ঠোট কামড়ে কান্না চাপার চেষ্টা করছে। কান্না এমনই জিনিস যে চাপার চেষ্টা করলে কান্না বেড়ে যায়। শেফা কান্না আটকাতে পারল না। মা হারিকেন নিয়ে এসে যদি দেখেন শেফার চোখে পানি ওমি তিনি দুইএ দুই চার না বানিয়ে বাইশ বানিয়ে ফেলবেন। রাতে ঘুমুবার সময় হেনতেন শতেক প্ৰশ্ন। কাদছিলি কেন? ঘটনা কি?

আমেনা বেগম হারিকেন হাতে ঘরে ঢুকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর তাকালেন রফিকের দিকে। শান্ত গলায় বললেন, রফিক তোমার খুঁজে কে জানি আসছে। বাংলাঘরে বসছে।

রফিক সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। আমেনা বেগম বললেন, তোমার চাচা মাগরেবের ওয়াক্তে তোমার খুঁজ করেছিলেন। তোমাকে নিয়ে নামাজে যাবার ইচ্ছা ছিল। তিনি সামান্য রাগ করেছেন।

রফিক বিড়বিড় করে বলল, শরীরটা ভাল না। শুয়েছিলাম, কখন ঘুমায়ে পড়েহি বুঝতে পারি নাই।

আমেনা বেগম বললেন, যাও দেখে আস কে আসছে।

রফিক ঘর থেকে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমেনা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন-তুই আমার ঘরে আয়।

শেফা বলল, তোমার ঘরে যাব কেন?

কথা আছে।

কথা এইখানে বল। আমি পড়তে বসেছি। পড়া ছেড়ে উঠতে পারব না।

তুই কাঁদছিলি কেন?

ইচ্ছা হয়েছে এই জন্যে কাঁদতেছি।

বাঘবন্দি খেলা আমার সাথে খেলবি না। তুই এমন কোন বড় খেলোয়াড় না। কি হয়েছে বল। এমন কি ঘটনা ঘটেছে যে চোখে পানি।

কিছুই ঘটে নাই।

এমন কিছু কি ঘটেছে যে আমাকে বলা যাবে না? অন্ধকারে এই ছেলে কি গায়ে হাত-টাত দিয়েছে?

না।

বল কোথায় হাত দিয়েছে?

বললাম তো–না।

না-টা এমন চাপা গালায় বলতেছিস কেন?

আমি স্বাভাবিকভাবেই বলেছি। তোমার কাছে মনে হচ্ছে চাপা গলা।

এই মাস্টারের কাছে তুই আর পড়বি না।

আচ্ছা।

তোর বাবাকে বলব তার এই বাড়িতে থাকারও দরকার নাই।

আচ্ছা।

তুই আর কখনো এই ছেলের সামনে পড়বি না।

আচ্ছা।

এখন উঠে আয়। এই মাস্টারের কাছে যখন আর পড়তে হবে না, তখন আর ঘরে থাকার দরকার কি?

শেফা বই-খাতা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। মার সঙ্গে ঘর থেকে বের হতে হতে বলল, মা তোমার প্রতিটি কথাই আমি শুনেছি। এখন আমি তোমাকে একটা কথা বলব। এই কথাটা তোমাকে শুনতে হবে।

আমেনা বেগম ভীত গলায় বললেন, কথাটা কি?

শেফা সহজ ভঙ্গিতে বলল, মা আমি উনাকে বিয়ে করব। তুমি ব্যবস্থা করে দাও। বাবাকে বলে ব্যবস্থা কর।

আমেনা বেগম অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি একটু আগে মেয়েকে বলেছেন—সে কোন বড় খেলোয়াড় না। এখন মনে হচ্ছে এই মেয়ে অনেক বড় খেলোয়াড়। এই মেয়ের সঙ্গে বাঘবন্দি খেলা যাবে না।

শেফা হঠাৎ অতি নাটকীয় এক কাণ্ড করে বসল, হাত থেকে বই-খাতা ফেলে ধপ করে বসে পড়ে মার পা জড়িয়ে ধরল। পায়ের পাতায় মুখ ঘষতে ঘষতে বলল, মা তুমি আমাকে বাঁচাও। উনাকে বিয়ে না করতে পারলে আমি মরে যাব।

 

রফিকের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন জালাল সাহেবের জামাই ফরহাদ খান। ফরহাদ খান একা আসেন নি। তাঁর সঙ্গে তিনজন আছে। একজনের হাতে হারিকেন। অন্য দুজন খালি হাতে থাকলেও তাদের গায়ের চাদরের নিচে কিছু একটা আছে। তারা প্রায়ই চাদরের নিচে হাত দিচ্ছে এবং হাত বের করে আনছে। জালাল খাঁন নিজে কখননা বাডিগার্ড ছাড়া চলাফেরা করেন না। জামাই-এর ক্ষেত্রেও সেই ব্যবস্থা রেখেছেন। অস্ত্রধারী দুইজন বাংলাঘরের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। তারা দুজনই অত্যন্ত ভীত। কারণ তারা শুধু যে ইয়াসিন সাহেবের এলাকায় আছে তা না, তারা ইয়াসিন সাহেবের বাংলাঘরে আছে। বলতে গেলে বাঘের ঘরে বাস।

বাংলাঘরে চেয়ার-টেবিল আছে, একপাশে পাটি পাতা খাটও আছে। রফিক বসে আছে খাটে। ফরহাদ খান একটা চেয়ার টেনে তার মুখোমুখি বসেছেন। ফরহাদ খানের হাতে কিছু কাগজপত্র এবং কলম। ফরহাদ খানের সঙ্গে আসা হারিকেনধারীও ঘরে আছে। সে তার হারিকেন হাতছাড়া করে নি। হারিকেন উঁচু করে ধরেছে যাতে হারিকেনের আলো রফিকের মুখে পড়ে। এই হারিকেন ছাড়াও ঘরে আরো একটা হারিকেন আছে। বাংলাঘরের টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে। ফরহাদ খান উঁচু গলায় কথা বলছেন। রফিক নিচু স্বরে জবাব দিচ্ছে বলে ফরহাদ সাহেবকে উত্তর শোনার জন্যে প্রতিবারই ঝুঁকে কাছে আসতে হচ্ছে।

রফিক সাহেব কেমন আছেন? জ্বি ভাল।

আজ আপনার অংক করা দেখলাম। বিস্মিত হয়েছি বললে কম বলা হবে। বিস্মিত হয়েছি আবার নিজের মধ্যে কিছু কনফিউশনও আছে। আমি সেই কনফিউশনগুলি দূর করতে এসেছি। আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব। আপনি কি জবাব দেবেন?

রফিক হ্যাঁ-সূচক ঘাড় কাত করল। ফরহাদ খান বললেন, আমি এই কাগজে এগারোটা সংখ্যা লিখছি, একটু তাকান সংখ্যাটির দিকে।

রফিক তাকাল। কাগজে লেখা—৮৭৯০০৪২১৬৭৩।

ফরহাদ খান কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রাখতে রাখতে বলল, সংখ্যাগুলি কি আপনার মুখস্থ হয়ে গেছে?

রফিক বলল, জ্বি হয়েছে।

এক থেকে নয়ের ভেতরে একটা ডিজিট এখানে নেই। সংখ্যাটা কি?

পাঁচ।

সংখ্যাগুলি উল্টালে কত হবে?

৩৭৬১২৪০০৯৭৮।

এর বর্গমূল কত হবে? মূল সংখ্যাটার। উল্টানোটার না।

এর বর্গমূল ১৯৩৯৩৯ দশমিক ১৬৮২।

ঘনমূল বলতে পারবেন? ঘনমূল জানেন তো?

জ্বি জানি। এর ঘনমূল হল ৩৩৫০ দশমিক ৫০৫৬।

রফিক সাহেব আপনি যে একজন বিস্ময়কর মানুষ তা কি আপনি জানেন?

জ্বি জানি।

আপনার পড়াশোনা কি?

আমি বি.এসসি পাস করেছি।

রেজাল্ট কি ছিল?

ভাল ছিল না। সেকেন্ড ডিভিশান।

এখন করছেন কি?

আমি মূলারদি গার্লস হাইস্কুলে পার্ট টাইম অংক করাই।

আপনার কি কোন ছবি আছে?

পাসপোর্ট সাইজ দুটা ছবি আছে।

আপনি একটা ছবি আমাকে দেবেন, আমি আপনাকে নিয়ে একটা আর্টিকেল লিখে ভোরের কাগজে দেব।

জ্বি আচ্ছা।

শুরুতে আপনাকে যে সংখ্যাগুলি দিয়েছিলাম সেগুলি কি আপনার মনে আছে?

জ্বি মনে আছে, ৮৭৯০০৪২১৬৭৩।

এই সংখ্যাগুলির একটা বিশেষত্ব আছে সেটা বলতে পারবেন?

এর কোন বিশেষত্ব নাই। এটা মৌলিক সংখ্যা না। তিন দিয়ে ভাগ করা যায়।

ফরহাদ খান নিজের বিস্ময়বোধ চাপা দেবার জন্যে সিগারেট ধরালেন।

ভেতরের বারান্দায় ইয়াসিন সাহেব তামাক খাচ্ছিলেন। তিনি বাংলাঘরের বারান্দায় হাঁটাহাঁটিতে ব্যস্ত দুই বডিগার্ডকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তারা ভীত মুখে সামনে দাঁড়িয়ে। ইয়াসিন সাহেব বললেন, তোমরা আছ কেমন?

তাদের একজন খুখুক করে কাশতে কাশতে বলল—যেমন দোয়া করেছেন।

উল্টাপাল্টা কথা বলবা না? তোমাদের জন্যে আমি দোয়া করব কি জন্যে। ভাল কথা গরমের মধ্যে চাদর গায়ে কেন?

শরীরটা খারাপ।

দুই জনেরই একসঙ্গে শরীর খারাপ?

তারা জবাব দিল না। ইয়াসিন সাহেব নীরবে কিছুক্ষণ তামাক টানলেন। তারপর হুক্কার নল নামিয়ে সহজ গলায় বললেন, তোমাদের চাদরের নিচে কি আছে আমি জানতে চাই না। তোমরা যে চাদরের নিচে জিনিস নিয়া আমার সাথে দেখা করতে এসেছ এতে আমি বড়ই অবাক হয়েছি। তোমরা উঠানে বৃষ্টির মধ্যে দাড়াও। কানে ধরে পঞ্চাশবার উঠবোস কর। যাও। এতে যদি আমার রাগ কমে তো কমল, না কমলে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।

তারা কোন রকম আপত্তি করল না। উঠোনে নেমে উঠবোস শুরু করল। ইয়াসিন সাহেব অন্দরে ঢুকলেন। জালাল সাহেবের জামাই এসেছেন। বিশিষ্ট মেহমান। জালাল সাহেবের জামাই মানে এই অঞ্চলের জামাই। তার মর‍্যাদা অন্যরকম। কাজেই নতুন জামাই এর আপ্যায়নের সুব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ঘরে মিষ্টি আছে কিনা কে জানে। না থাকলে আনাতে হবে।

 

আমেনা বেগম আজ রাতে স্বামীর সঙ্গে ঘুমুতে এসেছেন। সপ্তাহে একদিন তিনি স্বামীর সঙ্গে ঘুমুতে আসেন। আজ সপ্তাহের সেই দিন না। ইয়াসিন ভুরু কুঁচকে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। আমেনা বেগম লজ্জিত গলায় বললেন—শেফা বলেছে। আজ সে একা ঘুমাবে।

ইয়াসিন সাহেব বললেন, ও। বলেই তিনি পাশ ফিরলেন। ঘুমুবার চেষ্টা করা উচিত। তাঁর মাথা আজ কিঞ্চিৎ উত্তেজিত। জালাল সাহেবের দুই চাদরওয়ালাকে উঠবোস করানো হয়েছে। জালাল সাহেব এই অপমানের শোধ নিবেন না তা হয় না। ঘটনা ঘটবে। কিভাবে ঘটবে কে জানে। যে ভাবেই ঘটুক, ঘটনার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে।

আমেনা বেগম বললেন, ঘুমায়ে পড়েছেন?

ইয়াসিন সাহেব বললেন, না। কিছু বলবা?

শেফার মাস্টারের বিষয়ে দুটা কথা ছিল।

কি কথা?

ছেলেটারে আমার বড়ই পছন্দ। বাপ-মা মরা ছেলে। দেখলেই আদর লাগে। এইসব ছেলে খুবই আদরের কাঙ্গাল হয়। ছেলের আদব-লেহাজ ভাল।

ইয়াসিন সাহেব ঠাণ্ডা গলায় বললেন–কথা যা বলবা পরিষ্কার করে বলবা। পঁাচ দিয়া বলবা না। পাঁচের কথা আমার ভাল লাগে না। ঘটনা কি?

কোন ঘটনা না।

এই ছেলের সাথে কন্যার বিবাহ দিতে চাও?

আমেনা বেগম সুস্থির নিশ্বাস ফেলে চাপা গলায় বললেনবিবাহ হলে খুবই ভাল হয়। ছেলেটা আমার খুবই পছন্দের। চেহারা-ছবিও মাশাল্লাহ ভাল।

ইয়াসিন সাহেব সহজ গলায় বললেন, ঠিক করে বল। ছেলে তোমার পছন্দ না-কি তোমার কন্যার পছন্দ।

আমার খুব পছন্দ। শেফাও তারে মোটামুটি ভাল পায়।

আমেনা!

জ্বি।

আমার সাথে প্যাঁচ খেলবা না। আমি সোজা-সরল মানুষ। ঘটনা কি পরিষ্কার করে বল।

আমেনা বেগম ভীত গলায় বললেন, কোন ঘটনা না।

ইয়াসিন সাহেব বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললেন, আমি প্রশ্ন করতেছি। তুমি জবাব দাও। উল্টাপাল্টা জবাব দিবা না, থাপ্পড় খাইবা। মেয়েছেলের গায়ে হাত তোলা আমার খুবই অপছন্দ। কিন্তু প্রয়োজনে হাত তুলতে হবে। উপায় কি? এখন বল ছেলে কি তোমার কন্যার পছন্দ?

হুঁ।

তাড়াহুড়া করে বিয়ে দিতে চাইছে, কারণ কি? কোন ঘটনা ঘটেছে? কোন ঘটনার কথা বলতেছি বুঝতে পারতেছ? নাকি আরো খোলাসা করে বলব।

না না ছিঃ।

ছেলের জন্মের কোন ঠিক নাই—এতিমখানায় বড় হয়েছে। এটা জান?

জানি।

তার মৃগী রোগ আছে এটা জান?

তারপরেও কি করে বলো, এই ছেলে তোমার বড়ই পছন্দ।

মেয়ের মুখের দিকে তাকায়ে বলেছি। মেয়ে দেওয়ানা হয়েছে।

বুঝ দিলে বুঝ মানবে?

না।

এই অবস্থা?

জ্বি। কোন ঘটনা ঘটে নাই তুমি নিশ্চিত?

জ্বি।

ঠিক আছে আমি ব্যবস্থা নিতেছি। দুঃশ্চিন্তা করার কিছু নাই।

ইয়াসিন সাহেব বিছানায় শুয়ে পড়লেন। আমেনা বেগম ভয়ে-ভয়ে বললেন, কি ব্যবস্থা নিবেন।

আমি কি ব্যবস্থা নেই সেটা আমার বিষয়। এই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ আমার পছন্দ না। আমার সঙ্গে যে তোমার কথা হয়েছে এটাও শেফাকে বলবা না। সে যেন কিছুই না জানে।

জ্বি আচ্ছা। আপনি ছেলেটারে অন্য কোথাও চলে যেতে বলেন।

ইয়াসিন সাহেব নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন চলে যেতে বললে লাভ হবে না। তোমার কন্যা তাকে খুঁজে বের করবে। তোমার কন্যার মনের অবস্থা আমি তোমার আগেই টের পেয়েছি। তোমারে কিছু বলি নাই। একেক রোগের একেক চিকিৎসা। জ্বর হলে মাথায় পানি ঢালতে হয়। শরীর পচন ধরলে পচা অংশ ফেলে দিওয়া লাগে। এইটাই নিয়ম। শরীর নীরোগ রাখার জন্য অনেক অপ্রিয় কাজ করতে হয়। এখন যাও মেয়ের সাথে ঘুমাও। আমার সঙ্গে ঘুমানোর দরকার নাই।

আমেনা বেগম মেয়ের সঙ্গে ঘুমুতে গেলেন। সারারাত তার একফোঁটা ঘুম হল না।