সন্তু চোখ মেলে দেখল, তার পাশে জোজো গভীরভাবে ঘুমিয়ে আছে। আলোয় ভরে গেছে ঘর। এখন কটা বাজে কে জানে? রোদুরের রং দেখে মনে হয়, বেশ বেলা হয়েছে। রঞ্জন আগের রাত্রেই বলে রেখেছিল, আজ সে অনেক দেরি করে উঠবে। কোনও তাড়া তো নেই।
জোজোকে না ডেকে সন্তু বাইরে বেরিয়ে এল।
দোতলায় আর কোনও মানুষজনের চিহ্ননেই। পাশের ঘরগুলো খালি। মোহন সিং-এর দলবল, সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক, সবাই উধাও।
হাওয়ায় একটু শীত শীত ভাব। সন্তু পরে আছে শুধু পাজামা আর গেঞ্জি, সেই অবস্থাতে সে চলে এল বারান্দার একধারে। এখান থেকে তুঙ্গভদ্রা নদী ভাল করে দেখা যায় না, বাঁধটা অনেকটা উঁচু, তাতে খানিকটা ঢাকা পড়ে গেছে।
সন্তু উঁকি দিয়ে দেখল, নীচের বাগানে একটা লোহার বেঞ্চে বসে আছেন কাকাবাবু। গায়ে একটা চাদর। অন্যমনস্কভাবে আঙুল বোলাচ্ছেন গোঁফে।
সন্তু নেমে এল বাগানে। কাকাবাবুর পায়ের কাছে একটা চায়ের ট্রে, তাতে দুটি কাপ, দুটি কাপেই চা ঢালা হয়েছিল। কিন্তু কাকাবাবু ছাড়া বাগানে আর কোনও লোককে দেখতে পাওয়া গেল না।
কাকাবাবু প্রথমটায় সন্তুকে দেখতে পেলেন না। কাকাবাবু কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছেন, সন্তু তাই কোনও কথা না বলে এগিয়ে গেল বাঁধের দিকে। এখানে নদী বেশ চওড়া, সকালের আলোয় রুপোর মতন ঝকঝক করছে। নদী দেখতে সন্তুর সব সময়ই ভাল লাগে। কোনও নদীই একরকম নয়। কতদিন আগে থেকে বইছে এই নদী, এর দুপারে কত মানুষ থেকে গেছে, কত গ্রাম-নগর ধ্বংস হয়েছে, তবু নদী ঠিক একইরকমভাবে বয়ে চলেছে।
সন্তুর ইচ্ছে হল—এই নদীতে নেমে একবার সাঁতার কাটবে। জোজোকে ডাকা দরকার। জোজো অবশ্য সাঁতার জানে না, জলকে ভয় পায়, তবু জোজোকে পারে দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে। একদম একলা-একলা জলে নামতে ভাল লাগে না। এখানে আর কেউ স্নান করছেও না, দু-একটা মাছধরা নৌকো দেখা যাচ্ছে শুধু।
সন্তু বাঁধ থেকে নেমে আসতেই কাকাবাবু তাকে দেখতে পেয়ে বললেন, সবাই এখনও ঘুমোচ্ছে? এবার ডাকো, ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরিয়ে পড়া যাক।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, আমরা কি একদম চান-টান করে বেরোব, না দুপুরে আবার ফিরে আসব?
কাকাবাবু বললেন, এখনও গরম পড়েনি, বেশ ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা আছে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়াই ভাল, হামপি দেখতে অনেকক্ষণ লাগবে। সবাই মিলে চান করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে না?
এই সময় দেখা গেল রঞ্জন আর রিঙ্কু নেমে আসছে বাগানের দিকে। রঞ্জনের চুল উসকোখুসকো, চোখে এখনও ঘুম লেগে আছে মনে হয়। রিঙ্কু কিন্তু এরই মধ্যে বেশ ফিটফাট হয়ে গিয়েছে।
রঞ্জন একটু দূর থেকেই বলল, সুপ্রভাত কাকাবাবু, আপনার কাছে ঘড়ি আছে? এই রিঙ্কু শুধু-শুধু আমাকে ধাক্কা মেরে-মেরে বিছানা থেকে তুলল। আমি যত বলছি, এখন সাড়ে ছটার বেশি হতেই পারে না। এখনও ভোর রয়েছে।
কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, আমার হাতে ঘড়ি নেই, কিন্তু আকাশে তো মস্ত বড় একটা ঘড়ি রয়েছে। সেটার দিকেই তাকিয়ে বলা যায়, এখন অন্তত সাড়ে আটটা বেজে গেছে।
রঞ্জন বলল, তা হলে তো ঠিকই আছে। দক্ষিণ দেশে নটার পর সকাল হয়, তার আগেকার সময়টাকে এরা বলে ভোর।
রিঙ্কু বলল, রঞ্জনকে না ডাকলে ও সারাদিন ঘুমোতে পারে, জানেন!
রঞ্জন বলল, তাতেই বোঝা যায়, আমার হেল…হেল.. মানে স্বাস্থ্য কত ভাল। আবার দরকার হলে আমি সারারাত জেগে থাকতে পারি। এখন একখানা বেশ ভাল করে অবগাহন স্নান করতে হবে, কী বলো শ্রীমান সন্তু? আমার সঙ্গে সন্তরণ প্রতিযোগিতা হবে নাকি? শুনেছি তুমি ভাল সাঁতার জানো। তুঙ্গভদ্রা নদী এপার-ওপার করার চ্যা…চ্যা… বাজি ফেলবে?
হঠাৎ রঞ্জন অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, আরে, বাংলা খেলা তো কাল রাত্তিরেই শেষ হয়ে গেছে। আমি এত কষ্ট করে বাংলা বলছি কেন? গুড মর্নিং-এর দলে সুপ্রভাত বলে ফেললুম! আজ সারাদিন প্রাণ ভরে ইংরেজি বলব!
রিঙ্কু বলল, শুধু-শুধু ইংরেজি বলার দরকারই বা কী? গুডমর্নিং-এর বদলে সুপ্রভাত শুনতে তো বেশ ভালই লাগে!
রঞ্জন বলল, তুমি বাজে কথা বোলো না। তোমার কাল সবচেয়ে বেশি ফাইন হয়েছে। টাকাটা তুমি আজই সন্তুর কাছে জমা করে দাও, মেরে দেবার চেষ্টা কোরো না।
কাল রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পর হিসেব করা হয়েছিল, কে কতগুলো ইংরেজি বলে ফেলেছে। রিঙ্কু আর রঞ্জন প্রায় সমান-সমান, রিঙ্কু আঠাশ টাকা আর রঞ্জনের সাতাশ।
রঞ্জন আবার সন্তুকে বলল, কী, আমার সঙ্গে সুইমিং কমপিটিশানে নামতে রাজি আছ? তুঙ্গভদ্রা এপার-ওপার, একশো টাকা বাজি। চ্যালেঞ্জ!
রিঙ্কু বলল, রাজি হয়ে যা, সন্তু! একশো টাকা পেয়ে যাবি। রঞ্জন সাঁতারই। জানে না?
রঞ্জন আকাশ থেকে পড়ার মতন অবাক হয়ে বলল, আমি সাঁতার জানি না? আমি একটা জেনুইন বাঙাল, আমাদের সাতপুরুষ পূর্ববাংলার নদী-নালার দেশে…তুমি জানো, ওখানে চার বছরের বাচ্চারাও পুকুরে ড়ুব-সাঁতার দিতে। শিখে যায়।
রিঙ্কু বলল, তুমি তো আর কোনওদিন পূর্ববাংলায় ছিলে না! তোমায় আমি কোনওদিন সাঁতার কাটতে দেখিনি।
রঞ্জন বলল, দেখোনি, আজ দেখিয়ে দিচ্ছি! আমি কলকাতার গঙ্গা কতবার এপার-ওপার করেছি! ও হ্যাঁ, জোজো কোথায়? সে নিশ্চয়ই আমার থেকেও বড় চ্যাম্পিয়ান? জোজো খুব সম্ভব কোনও সমুদ্র এপার-ওপার করেছে।
সন্তু বলল, জোজো এখনও জাগেনি।
কাকাবাবু বললেন, তোমাদের সাঁতারের কেরামতি এখন দেখতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তোমরা যদি স্নান করেই বেরোতে চাও তো বাথরুমেই স্নান করে নাও। আমার মনে হয়, মপি দেখতে হলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়াই ভাল।
রঞ্জন বলল, কাকাবাবু, আপনার আর সন্তুর চা খাওয়া হয়ে গেছে দেখছি। আমরাও এই বাগানে বসেই বেড-টি খাব! অ্যাই সন্তু, একটু চায়ের কথা বলে দে না ভাইটি!
সবাই এক সঙ্গে হেসে উঠল।
কাকাবাবু বললেন, সন্তু চা খায়নি আমার সঙ্গে। অন্য একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি চা খেতে-খেতে গল্প করছিলেন আমার সঙ্গে।
গেস্ট হাউসের একজন বেয়ারা এদিকেই আসছিল কাপগুলো নিতে, তাকেই বলে দেওয়া হল চায়ের কথা। দোতলার বারান্দায় দেখা গেল জোজোকে। সন্তু তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল।
রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কাকাবাবু, আমরা যে হামপি দেখতে যাচ্ছি, সেখানে আসলে কী দেখার আছে একটু বুঝিয়ে বলুন তো!
কাকাবাবু বললেন, হামপি এখানকার একটি গ্রামের নাম। এককালে ওইখানেই ছিল বিজয়নগর রাজ্যের রাজধানী। বিজয়নগরের কথা ইতিহাসে পড়েছ নিশ্চয়ই।
রঞ্জন বলল, আমি অঙ্কে খুব ভাল তো, সেইজন্য ইতিহাস আর ভূগোলে খুব কাঁচা। তা ছাড়া ইস্কুল ছাড়বার পর তো আর ইতিহাস পড়িনি! বিজয়নগর নামে একটা রাজ্য ছিল বুঝি?
রিঙ্কু ধমক দিয়ে বলল, অ্যাই রঞ্জন, তুমি বিজয়নগরের কথা জানো না! বিজয়নগর আর বাহমনি, এই দুটো রাজ্যের মধ্যে সবসময় লড়াই হত!
সন্তু বলল, হরিহর আর বুক নামে দুই ভাই বিজয়নগর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিল দক্ষিণ ভারতে। দিল্লিতে তখন পাগলা রাজা মহম্মদ বিন তুঘলকের আমল। সেটা ফোরটিনথ সেঞ্চুরির মাঝামাঝি।
রঞ্জন সন্তুর কাঁধে হাত দিয়ে বলল, বাহ্, তোর তো বেশ ইতিহাসে মাথা। সেঞ্চুরি পর্যন্ত মনে আছে। হ্যাঁ বুঝলাম, বিজয়নগর নামে একটি রাজ্য ছিল, তার রাজারা সবসময় মারপিট করত। তারপর?
কাকাবাবু বললেন, হামপিতে সেই এককালের বিরাট শহর বিজয়নগরের রুইনস আছে। সেইগুলোই দেখতে যাচ্ছি।
রঞ্জন অবহেলার সঙ্গে বলল, ওঃ, হিস্টোরিক্যাল রুইনস? তার মানে তো দু-চারটে ভাঙা দেওয়াল আর আধখানা মন্দির, আর-একটা লম্বা ধ্যাড়েঙ্গা গেট। যে-জায়গাটায় হাতি থাকত সেই জায়গাটাই দেখিয়ে গাইডরা বলবে, এটাই ছিল মহারানির প্রাসাদ। এই তো? এ-আর দেখতে কতক্ষণ লাগবে? বড়জোর একঘন্টা! এই হিস্টোরিক্যাল রুইনস-টুইনসগুলো সাধারণত খুব বোরিং হয়।
রিঙ্কু বলল, মোটেই না! আমার এসবগুলো দেখতে খুব ভাল লাগে।
রঞ্জন বলল, ঠিক আছে, আমি গাছতলায় শুয়ে থাকব। তোমরা যত খুশি পেট ভরে দেখো দুঘন্টা, তিনঘন্টা, তার বেশি তো লাগবে না! লাঞ্চের আগেই শেষ হয়ে যাবে। আমি বলি কী, এই গেস্ট হাউস ছাড়ার দরকার নেই, আমরা এখানেই ফিরে আসব আবার। রাত্তিরটা জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে।
জোজো বাগানে এসে সন্তুর পাশে দাঁড়িয়েছে। সে জিজ্ঞেস করল, হামপিতে যদি ভাঙাচোরা জিনিস ছাড়া আর কিছুই দেখবার না থাকে, তা হলে ওই মোহন সিং সেখানে যেতে আমাদের বারণ করল কেন? কাকাবাবুকে শাসালই বা কেন?
রঞ্জন বলল, দ্যাট ইজ আ মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন। আমিও ঠিক সেই কথাই ভাবছিলুম। আমরা হামপি বেড়াতে গেলে ওর অসুবিধের কী আছে? তা ছাড়া ওই গণ্ডারটা কাকাবাবুকে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা কাজ দিতে চেয়েছিল।
কাকাবাবু বললেন, এখন একটু-একটু মনে পড়ছে, ওই মোহন সিং-এর ভাই। সুরয সিংকে আমি একবার জব্দ করেছিলুম। সুরয সিং এখন জেল খাটছে। সেইজন্যেই আমার ওপর মোহন সিং-এর রাগ থাকতে পারে। পঞ্চাশ হাজার টাকার লোভটা কেন দেখিয়েছিল বুঝতে পারছি না। আমাকে কোনও ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিল বোধহয়।
রিঙ্কু বলল, ওর কথায় আমরা ভয় পাব নাকি! আমরা হমপি দেখতে এসেছি, সেখানে যাবই। কাকাবাবুর সঙ্গে ওরকম একটা জায়গা দেখার চান্স আর কখনও পাব? কাকাবাবু সবকিছু ভাল বুঝিয়ে দিতে পারবেন। চলো, চলো, সবাই তৈরি হয়ে নাও!
আধঘন্টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়া হল। গেস্ট হাউসটা না ছেড়ে সেখানে রেখে যাওয়া হল কিছু জিনিসপত্র। সবাই ওঠার পর রঞ্জন গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল, ওই মোহন সিং ব্যাটা সিনেমায় ডাকাতের পার্ট করে, ব্যবহারটাও ডাকাতের মতন। আবার ওদের দলে একজন আশি নব্বই বছরের থুথুরে বুড়ো, সে নাকি একজন নামকরা পণ্ডিত, এই অদ্ভুত কম্বিনেশনটা আমি বুঝতে পারছি না।
রিঙ্কু বলল, ওরা দলবল মিলে সবাই হামপিতে গেছে নিশ্চয়ই। চলো,একটু পরেই সব বোঝা যাবে।
ওদের দু জনের এই কথা শুনে কাকাবাবু একটু মুচকি হাসলেন, কিন্তু কোনও মন্তব্য করলেন না।
কিছুদূর যাবার পর একটা ছোট্ট শহর মতন দেখা গেল। সেটার নাম হসপেট। কিছু দোকানপাট, হোটেল আর রেল স্টেশন আছে।
গেস্ট হাউসে শুধু ডিম আর পাউরুটি ছাড়া আর কিছু ছিল না বলে ওরা সেখানে ব্রেকফাস্ট খায়নি। ডিম আর টোস্ট তো রোজই খাওয়া হয়, বাইরে বেড়াতে এসেও ওসব খেতে ভাল লাগে না। রিঙ্কুর আজ পুরি-তরকারি-জিলিপি খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে।
সেরকম দু-তিনটে দোকান দেখা গেল। রঞ্জন গাড়ি দাঁড় করাল একটা দোকানের সামনে। সকালবেলার শীত-শীত ভাবটা এরই মধ্যে চলে গেছে, আজ অবশ্য সঙ্গে খাবার জল নেওয়া হয়েছে তিন বোতল।
গাড়ি থেকে নামতে নামতে কাকাবাবু বললেন, এখান থেকে হামপি আর ছ-সাত কিলোমিটার দূরে। কিন্তু একসময় বিজয়নগর রাজ্য শুরু হয়েছিল প্রায় এখান থেকেই। এইদিক দিয়েই পর্তুগিজরা আসত গোয়া থেকে। ওরা ঘোড়া বিক্রি করত। বিজয়নগরের রাজারা ঘোড়া আমদানি করত ইওরোপ থেকে। পর্তুগিজরা সেই ঘোড়া সাপ্লাই দিত।
জোজো জিজ্ঞেস করল, ইউরোপ থেকে ঘোড়া কিনত কেন? আমাদের দেশে তখন ঘোড়া পাওয়া যেত না?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, পাওয়া যেত। কিন্তু সেগুলো ছোট-ছোট। ইওরোপের ঘোড়া অনেক বড় আর তেজি বেশি। তখনকার দিনে যে রাজার যত বেশি শক্তিশালী অশ্বারোহী সৈন্যবাহিনী থাকত, তারাই যুদ্ধে জিতে যেত।
সন্তু বলল, আমাদের দেশের ঘোড়াগুলো সব টাট্টু ঘোড়া?
কাকাবাবু বললেন, সব নয়, বেশির ভাগ। ভাল জাতের ঘোড়া বিদেশ থেকেই এসেছে।
রঞ্জন বলল, সেইসব ভাল ভাল ঘোড়া যুদ্ধেই মরে গেছে নিশ্চয়ই। এখানকার টাঙার ঘোড়াগুলো দেখুন, বেতো-বেতো, রোগা-রোগা?
এই শহরের রাস্তা দিয়ে টাঙ্গার মতন একরকম গাড়ি যাচ্ছে অনেক। রঞ্জনের কথাই ঠিক, সেগুলোর কোনও ঘোড়াই তাগড়া নয়।
পাঁচজনের এই দলটি গিয়ে বসল একটা রেস্তোরাঁর দোতলায়। এর মধ্যে রঞ্জনের চেহারাটাই আগে চোখে পড়ে। লম্বা-চওড়া, মুখভর্তি দাড়ি, আজ সে মাথায় একটা টুপি পরেছে ক্রিকেট খেলোয়াড়ের মতন। অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
খাবারের অর্ডার দেবার পর রঞ্জন বলল, হামপিতে যাবার পর যতদূর মনে। হচ্ছে ওই মোহন সিং-এর সঙ্গে দেখা হবেই। সে যদি আবার ধমকাধমকি শুরু করে, তা হলে আমাদের স্ট্র্যাটেজি কী হবে, সেটা আগে ঠিক করে ফেলা যাক। রিঙ্কু বলল, ইশ, ধমকালে হলই নাকি! বিজয়নগরটা কী ওর মামাবাড়ি? ও যদি গায়ে পড়ে আর-একটা কথা বলতে আসে, তা হলে ওকে আমি পুলিশে ধরিয়ে দেব!
রঞ্জন বলল, কাকাবাবু, জানেন তো, রিঙ্কুর ধারণা, ভারতবর্ষের সব পুলিশ ওর হুকুম শুনতে বাধ্য।
রিঙ্কু বলল, কেন শুনবে না? একজন লোক যদি অন্যায় করে, পুলিশ। তাকে ধরবে না?
জোজো বলল, তোমরা আমার ওপর ছেড়ে দাও! এবার মোহন সিং কিছু করতে এলে আমি একাই ওকে ঢিট করব!
রঞ্জন বলল, তা জোজো পারবে। জোজো সব পারে।
টেবিলের ওপর থেকে একটা ছোেট প্লাস্টিকের বাটি তুলে নিল জোজো। সেই বাটিতে রয়েছে শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো। এদিককার লোকেরা খুব ঝাল খায়, সব খাবারে শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো মিশিয়ে নেয়। জোজো পকেট থেকে রুমাল বার করে তাতে ঢেলে নিল লঙ্কার গুঁড়োগুলো। তারপর রুমালটায় পুঁটুলি বেঁধে পকেটে রাখল।
সন্তু বলল, হাতটা ধুয়ে নে জোজো। নইলে কখন নিজের হাত চোখে লাগিয়ে কান্নকাটি শুরু করবি।
রিঙ্কু বলল, ওসব করবার দরকার নেই। লোকটাকে আমি ঠিক পুলিশে ধরাব!
রঞ্জন বলল, অর্থাৎ কিছুই ঠিক হল না। কাকাবাবু কিছু বলছেন না, তার মানে তিনি কিছু একটা ঠিক করে রেখেছেন। যাকগে! বিজয়নগর দেখার পর আমরা কোথায় যাব?
রিঙ্কু বলল, এরপর আমরা গোয়া যাব!
রঞ্জন বলল, সে তো অনেক দূরে! অতখানি কে গাড়ি চালাবে?
সন্তু বলল, রঞ্জনদা, ওই যে তুঙ্গভদ্রা নদী আমরা দেখলাম, সেই নদী কোনও এক জায়গায় কৃষ্ণা নদীতে মিশেছে। সেইখানটায় একবার গেলে হয় না?
রঞ্জন বলল, গ্রেট আইডিয়া, একসঙ্গে দুটো নদীর জল লুটোপুটি, হুটোপুটি করছে, সেটা তো দেখতেই হবে। সেখানে আমরা সাঁতার কাটব, কী বলল সন্তু?
রঞ্জন একথায় এত উৎসাহিত হয়ে গেল যে, ঝটপট সাত-আটখানা পুরি আর আলুর দম খেয়ে নিয়েই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তাড়াতাড়ি, সবাই তাড়াতাড়ি করো। আগে আমরা ইতিহাস-ফিতিহাস দেখা সেরে নিই, তারপর চলে যাব তুঙ্গভদ্রার ধার দিয়ে দিয়ে কৃষ্ণা নদীর দিকে। আহা, কৃষ্ণা নদী, কী সুন্দর নাম!
রঞ্জনের তাড়ায় গরম গরম কফি পেয়ালায় ঢেলে খেতে হল জোজো আর সন্তুকে। তারপর আবার গাড়িতে চড়া।
হামপিতে ঢোকার মুখে একদল গাইড দাঁড়িয়ে থাকে। বিজয়নগরের ভাঙা রাজধানী অনেকটা ছড়ানো, দেখবার জিনিসগুলো বেশ দূরে-দূরে, গাইডের সাহায্য ছাড়া খুঁজে পাওয়া মুশকিল। রঞ্জনদের গাড়িটা গেটের কাছে থামতেই চার-পাঁচজন গাইড ছুটে এল।
কাকাবাবু বললেন, গাইড নেবার দরকার নেই। জায়গাগুলো আমার মোটামুটি মনে আছে।
গাইডরা সবাই মিলে একসঙ্গে বলতে লাগল, অনেক নতুন নতুন জায়গা বেরিয়েছে। অনেক জায়গা খুঁড়ে নতুন জিনিস বেরিয়েছে।
রঞ্জন বলল, আরে ভাই, হামলোগ নতুন জিনিস দেখনে নেহি আয়া। হামলোগ পুরনো ইতিহাস দেখে গা!
একজন গাইড তবু জোর করে সামনের দরজা খুলে কাকাবাবুর পাশে উঠে পড়তে যাচ্ছিল, কাকাবাবু একটা হাত তুলে তাকে আটকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আমাদের গাইড হতে চান তো? তার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। রাম রায় যখন বিজয়নগর আক্রমণের কথা শুনলেন, তখন তিনি কী করছিলেন?
লোকটি থতমত খেয়ে বলল, রাম রায়?
কাকাবাবু বললেন, আপনি রাম রায়ের নামও শোনেননি.? তা হলে আপনি আমাদের গাইড হবেন কী করে? আমার সঙ্গের এই ছেলেমেয়েরা যে অনেক প্রশ্ন করবে?
গাইডটি গাড়ির দরজা থেকে একটু সরে গেল। তারপর দাঁত-মুখ খিচিয়ে, ডান হাতের বুড়ো আঙুল তুলে কলা দেখিয়ে বলল, ঠিক আছে, যাও না, যাও! তোমরা কিছুই দেখতে পাবে না! কিছুই দেখতে পাবে না!
রঞ্জন আবার গাড়ি স্টার্ট দিল বটে, কিন্তু ভুরু কুঁচকে বলল, লোকটা কি আমাদের অভিশাপ দিল নাকি?
রিঙ্কু হাসতে হাসতে বলল, লোকটা খুব রেগে গেছে! ও বেচারা কী করে বুঝবে যে বিখ্যাত আরকিওলজিস্ট রাজা রায়চৌধুরী এই গাড়িতে আছেন, আর তিনি ওকে ইতিহাসের পড়া ধরবেন?
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, রাম রায় কে ছিলেন? এখানকার শেষ রাজা?
কাকাবাবু বললেন, উঁহু, রাজা নন। ব্যাপারটা বোঝাতে গেলে অনেকটা লম্বা ইতিহাস বলতে হয়।
রঞ্জন বলল, না, না, দরকার নেই। ইতিহাস যত ছোট হয়, ততই ভাল। ফজলি আমের চেয়ে যেমন ল্যাংড়া আম মিষ্টি সেইরকমই, বড় ইতিহাসের চেয়ে…মানে, আমরা যখন ওইসব ভাঙা দেওয়াল-টেওয়াল দেখব, তখন ছোট্ট করে ইতিহাসটা শুনে নেব।
রিঙ্কু ধমক দিয়ে বলল, রঞ্জন, তোমার শুনতে ইচ্ছে না করে চুপ করে থাকো। কাকাবাবু, আপনি বলুন তো?
কাকাবাবু বললেন, সামনে অত ভিড় কিসের বলো তো? পুলিশ-টুলিসও দেখা যাচ্ছে।
রাস্তাটা সবে একটা বাঁক নিয়েছে, একটু দূরে দেখা গেল প্রচুর লোক জমে আছে। আরও কিছু লোক সেই দিকে ছুটছে। একটা বোমা ফাটার মতন জোর শব্দও হল।
কাকাবাবু বললেন, ওইখানেই মেইন গেট। কিছু একটা ঘটেছে মনে হচ্ছে।
একটা বড় গেট দেখা যাচ্ছে। সেখানেই লোকেরা ঠেলাঠেলি করছে, কয়েকজন পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে সরিয়ে দিতে চাইছে তাদের।
রঞ্জন সেই গেটের উলটো দিকের মাঠে গাড়িটা থামিয়ে বলল, আপনারা বসুন, আমি দেখছি।
গাড়ির চাবিটা আঙুলে ঘোরাতে-ঘোরাতে সে এগিয়ে গেল। একটু বাদেই হাসতে হাসতে ফিরে এসে বলল, আজ আর ভেতরে ঢোকাই যাবে না। আজ সব বন্ধ।
রিঙ্কু ভুরু কুঁচকে বলল, ভেতরে ঢোকা যাবে না মানে? কেন ঢোকা যাবে না?
রঞ্জন দাড়ি চুমরে বলল, এখন ওই গাইডটার অভিশাপের মানে বুঝতে পারছি। ও সব জানত। আমাদের সঙ্গে গাড়িতে পর্যন্ত এসে কিছুই না জানার ভান করে পয়সা আদায় করার তালে ছিল।
রিঙ্কু বলল, গাইডের কথা বাদ দাও! ভেতরে যাওয়া যাবে না কেন, কী হয়েছে?
রঞ্জন বলল, বললুম না, আজ বন্ধ। ভিজিটারস নট অ্যালাউড! ওখানে একটা সিনেমার শুটিং হচ্ছে। পুলিশ কাউকে কাছে যেতে দিচ্ছে না।
রিঙ্কু আরও রেগে গিয়ে বলল, সিনেমার শুটিং হচ্ছে বলে আমরা যেতে পারব না? কতদূর থেকে এসেছি, এমনি-এমনি ফিরে যাব? আমি গিয়ে ওদের বলছি! এটা বেআইনি!
রিঙ্কুর সঙ্গে-সঙ্গে সন্তু আর জোজোও নেমে গেল গাড়ি থেকে। কাকাবাবু গাড়ির মধ্যে বসে থেকেই দরজাটা খুলে দিলেন হাওয়া খাওয়ার জন্য। রঞ্জন নাকে একটিপ নস্যি নিয়ে বলল, এইবার দেখা যাবে রিঙ্কুর তেজ কেমন গ্যাস বেলুনের মতন ফুটো হয়ে যায়! ওর সাধের পুলিশরাই ওকে কড়কে দেবে!
রিঙ্কুরা ফিরে এল মিনিট-দশেক বাদে। ওদের মুখ-চোখ দেখেই বোঝা গেল কিছু সুবিধে হয়নি। রিঙ্কু রাগে একেবারে ছটপট করছে।
রঞ্জন মজার সুরে জিজ্ঞেস করল, কী হল? পারমিশন পেয়ে গেছ? সন্তু বলল, শুটিং-এর সময় কাউকে ঢুকতে দেবে না।
জোজো বলল, খুব জোর একটা ফাইটিং সিন হচ্ছে মনে হচ্ছে। ওরা বলল, বিকেল পাঁচটার আগে কাউকে ভেতরে যেতে দেবে না।
রঞ্জন রিঙ্কুকে খোঁচা মেরে বলল, তুমি পুলিশের কাছে নালিশ করলে না? সিনেমা তো করছে মোহন সিং! তোমার পুলিশরা কী বলল?
রিঙ্কু রাগে-দুঃখে প্রায় কেঁদে ফেলে বলল, এইসব ঐতিহাসিক জায়গা এখন ন্যাশনাল মনুমেন্টস। সিনেমার শুটিং হচ্ছে বলে পাবলিক সেখানে ঢুকতে পারবে না? এটা অন্যায়, অত্যন্ত অন্যায়! কতকগুলো কনস্টেবল ওখানে রয়েছে, তারা কোনও কথাই শুনতে চায় না।
রঞ্জন বলল, তা হলে এখন কী করা যায় সেটা বলো? বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এখানে এই রোদুরের মধ্যে বসে থাকার কোনও মানে হয় না!
রিঙ্কু বলল, এখানে বসে থাকব না, বিকেলে আবার ফিরে আসব।
রঞ্জন বলল, তাতেও কোনও সুবিধে হবে না। সিনেমার শুটিং পাঁচটা বললে সাতটায় শেষ হবে। কিংবা আজ হয়তো শেষই হবে না। কালও এইরকম চলবে। আমি যা বুঝতে পারছি, হামপি দেখার কোনও আশা আমাদের নেই। এইজন্যই মোহন সিং এখানে আসতে বারণ করেছিল। খুব খারাপ কিছু বলেনি?
রিঙ্কু বলল, তুমি বলতে চাও, আমরা এই জায়গাটা না দেখে ফিরে যাব? অসম্ভব!
রঞ্জন বলল, তা ছাড়া আর উপায় কী বলল! আমি তো তোমাদের বাধা দিইনি! অবশ্য আমি পার্সোনালি খুব একটা হতাশ হইনি। আমার ভাই অত ইতিহাসের দিকে ঝোঁক নেই। ভাঙা দেওয়াল, ভাঙা দুর্গ আর মন্দির-টন্দির সব জায়গাতেই প্রায় এক। তোমরা চাও তো, অন্য জায়গায় তোমাদের ওইসব জিনিস দেখিয়ে দেব। এখন আমি সাজেস্ট করছি, এখানে শুধু-শুধু বসে থেকে কোনও লাভ নেই। চলো, কৃষ্ণা আর তুঙ্গভদ্রা নদীর সঙ্গমের দিকে যাই, রাস্তায় খাবারদাবার কিনে নেব, সেখানে পিকনিক করব, একসঙ্গে দুটো নদীর জলে সাঁতার কাটব! ইতিহাসের চেয়ে জ্যান্ত প্রকৃতি অনেক ভাল!
রিঙ্কু বলল, আমরা বিজয়নগর না দেখে ফিরে যাব? কাকাবাবু, আপনি কিছু বলছেন না?
কাকাবাবু আকাশের দিকে চেয়েছিলেন। আকাশে অনেকগুলি চিল কিংবা শকুন উড়ছে একসঙ্গে। সম্ভবত বোমার শব্দে তারা এখান থেকে উড়ে গেছে।
কাকাবাবু সেখান থেকে চোখ নামিয়ে বললেন, রঞ্জন, তোমার ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহ নেই। কিন্তু এখানে অন্য একটা ভারী চমৎকার দেখার বা শোনার জিনিস আছে। রাজধানী বিজয়নগর প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেলেও এর ভেতরে একটা মন্দির আছে, সেটা খুব বেশি ভাঙেনি। তার নাম এরা এখন বলে, বিঠলস্বামী টেম্পল! সেই মন্দিরটার মজা কী জানো তো, সেটা হচ্ছে মিউজিক্যাল টেম্পল! তার মানে, সেই মন্দিরের এক-একটা থামে একটু জোরে আঘাত করলে নানারকম সুর বেরোয়।
রঞ্জন চোখ বড় বড় করে বলল, থামে আঘাত করলে সুর বেরোয়?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, সাতটা থামে টোকা মারলে তুমি সা-রে-গা-মা শুনতে পাবে। আর-এক জায়গায় পুরো একটা গানের সুর। একটা থামে তবলার লহরা!
রঞ্জন গান-বাজনা খুব ভালবাসে। সে খুব কৌতূহলের সঙ্গে কাকাবাবুর কথা শুনল। তারপর বলল, এটা আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না, কাকাবাবু! মন্দিরের থামে টোকা দিলে সা-রে-গা-মা, তবলার লহরা শোনা যায়? যাঃ, হতেই পারে না! আষাঢ়ে গপ্পো?
জোজো গম্ভীরভাবে বলল, ইস্তাম্বুলে এরকম মন্দির আছে! রঞ্জন বলল, ইস্তাম্বুলে তো আমরা এখন যেতে পারছি না ভাই! তা ছাড়া ইস্তাম্বুলে কোনও মন্দির আছে বলেও শুনিনি।
রিঙ্কু বলল, রঞ্জন, তুমি বড্ড ইয়ে হয়ে গেছ! কাকাবাবু কি তোমায় মিথ্যে কথা বলবেন?
রঞ্জন বলল, আমি সে-কথা বলছি না। তবে, সিয়িং ইজ বিলিভিং! মানে, নিজের চোখে না দেখলে, নিজের কানে না শুনলে এসব কথা বিশ্বাস করা যায় না! তুমি আমার সঙ্গে বাজি ধরবে! কত, একশো টাকা?
কাকাবাবু বললেন, তুমি ওর সঙ্গে বাজি ধরছ কেন? কথাটা তো বলেছি আমি! চলো, তা হলে মন্দিরটা দেখে আসা যাক।
রঞ্জন বলল, যাব কী করে? যাবার উপায় নেই বলেই তো আপনি আমাকে এত ধোঁকায় ফেলে দিলেন!
কাকাবাবু বললেন, কেন যাওয়া যাবে না? ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়।
কাকাবাবু গাড়ি থেকে নেমে পড়তেই রঞ্জন একগাল হেসে বলল, ও তাই বলুন! আপনার আইডেন্টিটি কার্ড দেখলেই পুলিশরা আপনাকে রাস্তা ছেড়ে দেবে! আপনাকে কেউ আটকাবে না, সেকথা এতক্ষণ বললেই হত।
রিঙ্কু কিংবা সন্তু-জোজোর মুখে অবশ্য কোনও আশার ভাব ফুটল না। তারা। এইমাত্র পুলিশের সঙ্গে তর্ক করে এসেছে। অতি সাধারণ সব কনস্টেবল, তারা কোনও কথাই বুঝতে চায় না। সিনেমা কোম্পানির কিছু লোকও সেখানে রয়েছে, তারা খালি চেঁচিয়ে বলছে, হঠাও, ভিড় হঠাও।
এরা কি কাকাবাবুকে পাত্তা দেবে?
কাকাবাবু গাড়ি থেকে নেমে ক্রাচ দুটো বগলে নিয়ে বললেন, তোমরা গাড়ি বন্ধ করে চলে এসো আমার সঙ্গে।
ভিড় ঠেলে কাকাবাবু এগিয়ে গেলেন একেবারে সামনে। সন্তু মনে মনে একটু ভয় পাচ্ছে। সে জানে, কাকাবাবু কোনওদিন কাউকে আইডেন্টিটি কার্ড দেখান না। এমনকী কাকাবাবুর সেরকম কোনও কার্ড আছে কি না তাই-ই সে জানে না।
এই দলটাকে খুব সামনে এগিয়ে আসতে দেখে দুজন কনস্টেবল রুক্ষভাবে বলল, হঠো, হঠো, দূর হঠো!
কাকাবাবু আঙুল তুলে একটু দূরের একজন ষণ্ডামাকা লোককে দেখিয়ে পুলিশদের বললেন, আমরা এই সিনেমা ইউনিটের লোক। ওই লোকটাকে ডাকো, ও ঠিক বুঝবে! ৪০৬
ডাকো, ও ঠিক বুঝতে আমরা এই সিনেমা ইউণ্ডামাকা লোককে।
রঞ্জন সেই লোকটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, আমাকে গলাধাক্কা দিয়েছিল! কী যেন নাম ওর, বিরজু সিং, তাই না?
কাকাবাবু হেসে বললেন, এবার দ্যাখো না, কী মজা হয়!
পুলিশরা কাকাবাবুর কথা শুনেও দ্বিধা করছিল, কাকাবাবু আবার তাদের বললেন, আমরা মোহন সিং-এর মেহমান। কেন দেরি করছ, ওই বিরজু সিং-কে এখানে ডেকে আনো!
এবার একজন সেপাই ছুটে গেল। বোঝা গেল যে, মোহন সিং-এর নামটা এদের খুব চেনা, সেই নামটাকে ওরা ভক্তি করে কিংবা ভয় পায়।
সেপাইয়ের কথা শুনে এগিয়ে এল বিরজু সিং। কাকাবাবুকে দেখে সে যেন ভূত দেখার মতন চমকে উঠল। ভুরু দুটো কপালে তুলে সে বলল, আপ? রাজা রায়চৌধুরী?
কাকাবাবু হেসে বললেন, আমি একা নই। মোহন সিং-কে খবর দাও, আমার সঙ্গে আরও চারজন আছে, আমরা ভেতরে যাব
বিরজু সিং আর কোনও কথা না বলে উলটো দিকে ফিরে এক দৌড় দিল।
দূরে আবার শোনা গেল বোমা ফাটার মতন শব্দ। কতকগুলো ঘোড়া চি-হি-হি করে উঠল। অবশ্য আসল জায়গাটা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না।
একটু বাদেই দূর থেকে ধুলো উড়িয়ে ছুটে এল একটা ঘোড়া। তার পিঠে জরি মখমলের পোশাক-পরা একজন বিরাট চেহারার লোক। কোমরবন্ধের একদিকে তলোয়ার, আর-একদিকে পিস্তল। মাথায় পালক দেওয়া শিরস্ত্রাণ। ইতিহাস বইয়ের পাতায় এই রকম মানুষের ছবি আঁকা থাকে।
সিনেমার পার্টের জন্য মেকআপ নিলেও সন্তুরা চিনতে পারল মোহন সিংকে। জোজো পকেটে হাত দিয়ে চেপে ধরল শুকনো লঙ্কার পুঁটলিটা, রঞ্জন হাতে নিল নস্যির কৌটো!
ঘোড়া চালিয়ে মোহন সিং থামল একেবারে কাকাবাবুর সামনে। প্রায় এক মিনিট হাঁ করে তাকিয়ে থেকে সে আস্তে-আস্তে বলল, রাজা রায়চৌধুরী, আপনি সত্যি এসেছেন? এসে বলেছেন কী যে আপনি আমার মেহমান?
কাকাবাবু হাল্কাভাবে বললেন, হ্যাঁ, এসে পড়লাম। আমাদের সিনেমার শুটিং দেখার খুব ইচ্ছে। পুলিশরা ঢুকতে দিচ্ছিল না, তাই তোমার নাম বললাম। কেন, তোমার কোনও আপত্তি আছে নাকি?
ঘোড়া থেকে নেমে মোহন সিং কাকাবাবুর একেবারে নাকের সামনে এসে দাঁড়াল।
একটু দূরে বিরজু সিং আরও কয়েকটি গুণ্ডা ধরনের লোক নিয়ে আসছে।
কাকাবাবু পিছন ফিরে একজন পুলিশকে বললেন, আমাদের গাড়িটার ওপর একটু নজর রেখো ভাই। আমরা খানিক বাদেই ফিরে আসব।
তারপর তিনি মোহন সিং-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, চলো, এবার যাওয়া যাক!
মোহন সিং হঠাৎ যেন বদলে গেল। বেশি-বেশি বিনয় দেখিয়ে সে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, নমস্তে, নমস্তে! আইয়ে, আইয়ে! আপনার মতন গুণী লোক শুটিং দেখতে এসেছেন, এ তো অতি ভাগ্যের কথা। জানেন মিঃ রায়চৌধুরী, এর আগে অনেক মন্ত্রী আর সরকারি অফিসার শুটিং দেখতে চেয়েছিল, কারও কথায় পাত্তা দিইনি। কিন্তু আপনাদের কথা আলাদা!
কাকাবাবু বললেন, আমরা বেশিক্ষণ থাকব না। মোহন সিং, আপনার মেকআপ দেখে মনে হচ্ছে, আপনি শুটিং করতে করতে চলে এসেছেন? আপনার ব্যস্ত হবার কোনও দরকার নেই। আমরা ঘুরে-ঘুরে চারপাশটা দেখেই চলে যাব।
মোহন সিং বলল, আপনার যতক্ষণ ইচ্ছে হয় থাকবেন। প্রোফেসর শর্মাজি আমাদের বলে রেখেছেন যে, মিঃ রাজা রায়চৌধুরী এলে তাঁকে খাতির-যত্ন করবে। আপনি এই জায়গাটার হিস্ট্রির বিষয়ে অনেক কিছু জানেন। শুটিং-এর সময় আপনি অ্যাডভাইস দিতে পারবেন।
জোজো হঠাৎ উঃ করে চেঁচিয়ে উঠল।
সবাই সেদিকে ফিরতেই জোজো বলল, আমার চোখে কী যেন কামড়েছে হঠাৎ!
তারপরেই দুহাতে চোখ চাপা দিয়ে সে আর্তনাদ করতে লাগল, উঃ, জ্বলে গেল! চোখ জ্বলে গেল! আমি অন্ধ হয়ে যাব।
রঞ্জন সন্তুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
রিঙ্কু ব্যস্ত হয়ে বলল, জল! কোথায় জল পাওয়া যাবে? ওর চোখে জলের ঝাপটা দিতে হবে।
মোহন সিং পেছন ফিরে হুকুম দিল, বিরজু, এই মেহমানদের টেষ্টে নিয়ে যাও। চা-পানি পিলাও। আমি শর্মাজিকে খবর দিয়ে আসছি।
অন্ধ মানুষের মতন জোজোকে ধরে ধরে নিয়ে চলল সন্তু। জোজো অনবরত উঃ, আঃ, মরে গেলুম বলে যাচ্ছে। সন্তু তার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, তোকে হাতটা ভাল করে ধুয়ে নিতে বলেছিলুম না!
একটু দূরেই পরপর তিনটে তাঁবু খাটানো। বাইরে রঙিন ঝালর আর ফুলের মালা দিয়ে সাজানো। একটা তাঁবু বেশ বড়, তার মধ্যে অনেকগুলি চেয়ার। একপাশে তবলা, ঢোল, সেতার, সারেঙ্গি এইসব রাখা। আর-একপাশে অনেকগুলো তলোয়ার, খন্তা, কোদাল আর শাবল।
ওদের সেই তাঁবুর মধ্যে এনে বিরজু সিং বলল, আপলোগ বৈঠিয়ে। আমি এক্ষুনি পানি নিয়ে আসছি।
একটু পরেই একজন লোক এক জাগ জল নিয়ে এল। রিঙ্কু সেটা নিয়ে বলল, জোজো, চোখ খোলো। আমি ঝাপটা দিয়ে দিচ্ছি।
জোজো কিছুতেই চোখ খুলতে পারছে না, রঞ্জন এসে চেপে ধরল তার হাত। সন্তু জোর করে তার চোখের পাতা খুলে দেবার চেষ্টা করল, রিঙ্কু জল ছিটিয়ে দিতে লাগল তার মুখে।
রঞ্জন বলল, নিজের অস্ত্রে নিজেই ঘায়েল!
রিঙ্কু বলল, চুপ। এখন ওসব বলে না!
মিনিট-পাঁচেক বাদে জোজো অনেকটা সুস্থ হল। তার জামা ভিজে গেছে। অনেকখানি। একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে সে বসে রইল আচ্ছন্নের মতন।
কাকাবাবু বললেন, কিছু ক্ষতি হবে না। এত জলের ঝাপটায় চোখটা বরং পরিষ্কার হয়ে গেল। তা হলে আর দেরি করে কী হবে? চলো, যাওয়া যাক। জোজো, আর কোনও অসুবিধে নেই তো?
জোজো এখনও চোখ খুলছে না। সে বলল, না, ঠিক আছে, যেতে পারব।
রঞ্জন বলল, জোজো চোখ বুজে বুজে শুটিং দেখবে। তাতেই বোধহয় বেশি ভাল দেখা যাবে!
বিরজু সিং বলল, না, না, আপনারা বসুন। শুটিং শুরু হতে দেরি আছে। এই রোদুরের মধ্যে কোথায় ঘুরবেন। এখানে বসে আরাম করুন।
কাকাবাবু বললেন, শুটিং শুরু না হলেও আমরা ততক্ষণ মন্দির-টন্দিরগুলো দেখি। বিঠলস্বামীর মন্দিরটা এদের দেখাব বলেছি।
বিরজু বলল, ওই মন্দিরের সামনে একটা অন্য সেট তৈরি হচ্ছে। বাঁশ বাঁধা হচ্ছে। এখন গেলে কিছুই দেখতে পাবেন না। বিকেলবেলা আপনাদের নিয়ে যাব সেখানে!
কাকাবাবু বললেন, বিকেল পর্যন্ত তো আমরা এখানে থাকব না?
এই সময় মোহন সিং ফিরে এসে বলল, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনারা এসেছেন শুনে প্রোফেসর শর্মাজি খুব খুশি হয়েছেন। উনি একবার ডাকছেন আপনাকে। জরুরি কথা আছে। আপনি পাঁচ মিনিটের জন্য ঘুরে আসবেন? আপনার লোকেরা ততক্ষণ বসুক এখানে।
কাকাবাবু ক্রাচ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ঠিক আছে, শমজির সঙ্গে একবার দেখা করে আসি। কতদূর যেতে হবে?
মোহন সিং বলল, এই তো কাছেই। উনি এইরকম আর-একটা তাঁবুতে আছেন। উনি এই ফিল্মে পার্টও করছেন জানেন তো? দেখবেন চলুন, কীরকম মেকআপ নিয়েছেন।
কাকাবাবু ভুরু তুলে বললেন, তাই নাকি? উনি সিনেমায় পার্ট করছেন? এই বয়েসে?
মোহন সিং বলল, জি হ। উনি রাম রায় সেজেছেন! খুব মানিয়েছে! সেই থুথুরে বুড়ো লোকটি সিনেমায় পার্ট করছে শুনে-সন্তুরঞ্জনদের মুখে একটা হাসির ঢেউ খেলে গেল।
কাকাবাবু ওদের বললেন, তোরা বোস তা হলে। আমি চট করে ঘুরে আসি। অন্য কোথাও চলে যাসনি যেন!
কাকাবাবুকে নিয়ে ওরা চলে যাবার পর সন্তু তাঁবুর এক কোণায় গিয়ে একটা তলোয়ার তুলে নিল হাতে। রঞ্জনও আর-একটা তুলে নিয়ে সামনের দিকে দুবার ঘুরিয়ে বলল, কী সন্তু, হবে নাকি সোর্ড-ফাইট?
সন্তু বলল, আমি তলোয়ার খেলতে জানি না। আপনি শিখেছেন বুঝি?
রঞ্জন দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, অনেকদিন আগে। স্টুয়ার্ট গ্র্যাঞ্জারের চেয়ে একটু কম ভাল পারি। এদেশে চ্যাম্পিয়ান।
সন্তু বলল, সিনেমার জন্য অনেক সেট বানাতে হয়। মাটি-ফাটি খুঁড়তে লাগে বোধহয়। সিনেমায় যত রাজবাড়ি-ফাড়ি দেখা যায়, সবই তো নকল!
তাঁবুর পর্দা সরিয়ে রিজু সিং আবার ঢুকতেই ওরা তলোয়ার দুটো রেখে দিল।
বিরজু সিং-এর হাতে একটা ট্রে-তে চার গেলাস শরবত। বেশ লম্বা-লম্বা গেলাস, তাতে ভর্তি শরবতের ওপর বরফের টুকরো ভাসছে।
রঞ্জন প্রথমেই হাত বাড়িয়ে একটা গেলাস তুলে নিয়ে বলল, আরে, এসব আবার কেন?
বিরজু বলল, বাইরে বহুত গরম। একটু ঠাণ্ডা খেয়ে নিন!
রঞ্জন বলল, জোজো, খেয়ে নে, তোর চোখ ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
রিঙ্কু বলল, আমি শরবত খাব না।
বিরজু তার কাছে এসে বলল, খান, খেয়ে দেখুন। পেস্তা আর মালাইয়ের শরবত। শুটিং-এর সময় সবাই দু-তিন গেলাস করে খায়।
রঞ্জন প্রথম চুমুক দিয়ে বলল, চমৎকার! আমারও দু-তিন গেলাস খেতে। ইচ্ছে করছে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিঙ্কুকে নিতে হল গেলাসটা।
বিরজু সিং রঞ্জনকে বলল, আপনি আর-এক গেলাস নেবেন? আমি আনছি।
রঞ্জন বলল, না, না, আমার আর চাই না। এমনিই বলছিলাম।
রঞ্জন দ্বিতীয় চুমুকেই সবটা শেষ করে ফেলল। বিরজু সিং বেরিয়ে গেল তাঁবু থেকে।
রিঙ্কু বলল, আমার ভাল লাগছে না। বড্ড বেশি মিষ্টি! সবটা খাব না!
সন্তু আর জোজো প্রায় শেষ করে এনেছে। রঞ্জন বলল, রিঙ্কু, তুমি সবটা খাবে না? তা হলে আমাকে দিয়ে দাও!
জোজোর হাত থেকে খসে পড়ল গেলাসটা। মেঝেতে দড়ির কার্পেট পাতা, তাই গেলাসটা ভাঙল না।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কী হল রে? গেলাসটা ফেলে দিলি?
জোজো একটা বিরাট হাই তুলে বলল, আমার ঘুম পাচ্ছে।
সন্তু নিচু হয়ে গেলাসটা তুলতে যেতেই ঝিমঝিম করে উঠল তার মাথা। কী হচ্ছে তা বোঝবার আগেই সে জ্ঞান হারিয়ে ঘুরে পড়ে গেল কার্পেটের ওপর।