রচয়িতা (অথর্ববেদ সংহিতা)
অথর্ববেদ সংহিতায় সূক্তসমূহের রচয়িতারূপে বহুসংখ্যক নূতন নাম পাওয়া যায়। এদের মধ্যে রয়েছে পরবর্তী মহাকাব্য ও পৌরাণিক যুগের কিছু কিছু বিখ্যাত নাম, যেমন বুদ্ধ, আজমীড় ও নারায়ণ। অবশ্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অথর্ব, ভৃগু ও অঙ্গিরার নাম উল্লিখিত হয়েছে। ঋগ্বেদের অন্তিম পর্যায়ে প্রজাপতি নামে যে দেবতার উদ্ভব ঘটেছিল, অথর্ববেদে তিনি অন্যতম রচয়িতা। তেমনি ঋগ্বেদের অন্যতম অর্বাচীন দেবতা ‘ব্ৰহ্মা’কে অথর্ববেদের বহু আধ্যাত্মিক ও ধর্মতত্ত্বমূলক সূক্তের রচয়িতারূপে কল্পনা করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, এ কল্পনা কৃত্রিম; ঐ সব সূক্তের রচয়িতা নয় বিষয়বস্তুই ব্ৰহ্মা বা পর্যতত্ত্ব। ঋষি ভৃগু কালের মতো বিমূর্ত ধারণার উপর ভিত্তি করেও সূক্ত রচনা করেছিলেন, আর অঙ্গিরা ব্যাধি, ডাকিনীবিদ্যা ও ইন্দ্ৰজালের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। ঋগ্বেদে যে যম-দেবতাকে নিতান্ত যান্ত্রিকভাবে কিছু সূক্তের রচয়িতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে এখানেও তিনি বহু সুক্তের রচয়িতা। ঋগ্বেদের বহু ঋষির নােম অথর্ববেদেও মন্ত্রদ্রষ্টারূপে উল্লিখিত; কিন্তু এখানে যে নূতন নামগুলি পাওয়া যায়, সেগুলি কৌতুহলাজনক : প্রধান শাখার রচয়িতা শৌনক, যম, প্ৰচেতা, শম্ভু এবং ক্ষত্ৰিয় ঋষি বিশ্বামিত্র বা কৌশিক–এই শেষোক্ত জন অথর্ববেদের কৌশিক সূত্রের রচয়িতারূপেও কথিত। প্রায়ই আমরা নিম্নোক্ত সমাসবদ্ধ শব্দ খুঁজে পাই : ভৃণ্ডরাথর্ব, ভৃগ্বঙ্গিরা, অথর্বাঙ্গিরা, প্ৰত্যঙ্গিরা, তিরশ্চিরঙ্গিরা। স্পষ্টতই অথর্ববেদের মৌলিক সূক্তগুলির প্রথম দ্রষ্টারূপে ভৃণ্ড, অথর্ব ও অঙ্গিরার নাম পরবর্তীকালে ঐতিহ্যগতভাবে নির্দিষ্ট কিছু সূক্তের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার ফলে শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট ব্যক্তি নাম বা গোষ্ঠী নামে পরিণত হয়। কুরু, কৌরুষ্টুতি ও কৌরুপথী নামগুলিতে এই ইঙ্গিত রয়েছে যে, দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল আৰ্যবসতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে কুরু নামটি গৌরবান্বিত হয়েছিল। অথর্ববেদ ব্রাহ্মণের রচয়িতা গোপথ সংহিতার কয়েকটি সূক্তেরও মন্ত্রদ্রষ্টারূপে পাওয়া যায়। ঋগ্বেদে অথর্ব কখনোই রচয়িতারূপে উল্লিখিত না হলেও অথর্ববেদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সূক্তে যেমন ব্রাত্য-সূক্তে, পৃথিবী ও অগ্নির প্রতি নিবেদিত সুক্তে এবং গভীর দার্শনিক ও কাব্যিক অন্তর্দৃষ্টি-মণ্ডিত স্কন্তসূক্তে তাকে মন্ত্রদ্রষ্টারূপে পাওয়া যাচ্ছে।
অথর্ববেদের সঙ্গে প্ৰধানত তিনটি নামই সম্পর্কিত : ভূণ্ড, অথর্ব ও অঙ্গিরা; এইজন্য এই বেদকে অথৰ্বাঙ্গিরস বেদ, ব্ৰহ্মবেদ বা ভৃগ্বঙ্গিরস বলা হয়ে থাকে। সোমযাগের পুরোহিতদের অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ পৃথক অগ্নিদেবের পুরোহিতরূপেই ভৃগু, অঙ্গিরা ও অথর্বার অস্তিত্ব স্বীকৃত। ‘অথর্’ শব্দটি অগ্নিবাচক প্রাচীন পারসিক শব্দ ‘অতর্’-এর এবং পরবর্তীকালের আতস্-এর উৎস থেকে উদ্ভূত এবং অঙ্গিরা শব্দটি ‘অগ্নি’ শব্দের ধ্বনিগত বিপর্যাস থেকে উদ্ভূত—দুটি ক্ষেত্রেই অস্তিত্ববাচক প্রত্যয় (মতুপ ও র) যোগে শব্দটি নিম্পন্ন হয়েছে। সুতরাং অথর্ব শব্দটি যে ইন্দোইরাণীয় যুগের সমকালীন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে এই শব্দটির তাৎপর্য অস্পষ্ট হয়ে যায় এবং অগ্নি শব্দের বুৎপত্তিজাত প্রতিশব্দ ‘অঙ্গিরস’, তার স্থান অধিকার করে নেয়। ‘অগ্নিরস’ শব্দের ইন্দো-ইয়োরোপীয় উৎস রয়েছে; গ্রিক ভাষায় এর সমজাতীয় শব্দ ‘আঙ্গেলস’ অর্থাৎ দূত। ঋগ্বেদে দূত শব্দ অগ্নির সাধারণ বিশেষণ এবং দৌত্য তার মৌলিক কর্মরাপে উল্লিখিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, ঋগ্বেদের বিখ্যাত দশরাজার যুদ্ধে সুদাসের বিরোধীপক্ষে অবস্থিত কৌম বা গোষ্ঠীর নামরূপে দ্রুহ্য ও তূর্বশের সঙ্গে ভূগুও উল্লিখিত হয়েছে। সম্ভবত, ভূণ্ড কৌম বা গোষ্ঠীর ইতিহাস ইন্দো-ইয়োরোপীয় পর্যায় থেকেই খুঁজে পাওয়া যায়। অগ্নিবাচক গ্রিক শব্দ ফ্লেগ্ম্-এর মধ্যে আমরা ভৃগুর প্রাথমিক সমজাতীয় শব্দের ধ্বনিরূপের সন্ধান পাই। অগ্নিকে নির্বাপিত হতে না দেওয়াই ছিল ভৃগুশ্রেণীভুক্ত পুরোহিতদের প্রাচীন দায়িত্ব।
চতুর্থ শুরুত্বপূর্ণ রচয়িতার নাম ব্ৰহ্মা। সম্ভবত, অথর্ববেদটি সংহিতা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরেই তিনি পূর্বোক্ত তিনটি শ্রেণীর পুরোহিতদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। অগ্নি আদিম মানুষের বিস্ময় ও ভীতি উদ্রেক করত; প্রাথমিক স্তরের যে সমস্ত ঐন্দ্ৰজালিক ক্রিয়ায় পটু পুরোহিতেরা অগ্নি মন্থন ও প্ৰজ্বলন করে তার সুরক্ষা ও প্রয়োগের ব্যবস্থা করতেন, সমাজে তারা সার্বভৌম সম্মানের অধিকারী হতেন। চিরাগত এই অভ্যাসের কতকটা আভাস অথর্ববেদের ‘ব্ৰহ্মা’ শ্রেণীর পুরোহিতদের গৌরবলাভের মধ্যে নিহিত। ইন্দো-ইয়োরোপীয় বা ইন্দো-ইরাণীয় উৎসজাত তিনজন প্ৰধান পুরোহিতই অথর্ববেদে অগ্নি উপাসনার সঙ্গে সম্পর্কিত; সুতরাং অনুমান করা যায় যে, সমান্তরাল সোমচৰ্যা থেকে পৃথক কিন্তু অনুরূপ প্রাচীন অগ্নিচর্যার অংশরূপেই অথর্ববেদ ও তার পুরোহিতদের কার্যকলাপ ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ‘অথৰ্বাঙ্গিরস’ শব্দের দুটি অংশের (অর্থাৎ অর্থবান ও অঙ্গিরস) তাৎপৰ্যই হ’ল অগ্নি এবং এই যুগ নামের মধ্যে অগ্নি-উপাসনা, তদপুযোগী প্ৰত্নকথা ও পুরোহিতদের ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন রয়েছে। বরুণ ও পাতাললোকের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত ভৃগু অথর্ববেদের অন্যতম প্রধান রচিয়তা। ঋগ্বেদের ষষ্ঠমণ্ডলে কথিত হয়েছে যে, অথর্বকর্তৃক অরণিকাষ্ঠের সাহায্যে অগ্নি উৎপাদনের রীতি অন্যান্যদের দ্বারা অনুসৃত হয়েছিল; পরবর্তী সাহিত্য অথৰ্ব ভেষজ বিদ্যার সঙ্গেও সম্পর্কিত।
পরবর্তীকালে যে অথর্ববেদ স্বীকৃতি লাভ করল, তার অন্যতম প্রধান কারণ সম্ভবত ছিল, রাজপুরোহিতরূপে অথর্ববেদের পুরোহিতদের বিশেষ গুরুত্ব ও সমাজে তাদের বিশেষ সুবিধাভোগীর ভূমিকা। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শেষদিকে যখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উত্থান হচ্ছিল, নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য পুরণের জন্য অলৌকিক সহায়তা লাভের আশায় রাজারা কোনও জাদুকরকে রাজসভা ও রাজপরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুরোহিতরূপে নিয়োগ করতে বিশেষ উৎসুক ছিলেন। গ্রামের ‘শামান’ বা জাদু-পুরোহিতই এই মহিমান্বিত শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছিলেন, এমন মনে করার কারণ নেই। তাদের মধ্যে যে সমস্ত পুরোহিতেরা আধ্যাত্মিক ও ঐন্দ্ৰজালিক রহস্য বিদ্যায় পারঙ্গম হয়ে উঠতেন, কেবলমাত্র তাদেরই রাজ-পুরোহিতরূপে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হ’ত, কিন্তু শামান পুরোহিত তার গ্রামবাসী যজমানদের মধ্যেই রয়ে যেতেন অনেকটা বর্তমান ওঝার ভূমিকাতে। যাই হােক, অথর্ববেদের পুরোহিতদের মধ্যে খুব বেশিসংখ্যক লোক এই নতুন সামাজিক প্রতিষ্ঠা পেতেন না, অধিকাংশ জাদু-বিদায় পারঙ্গম চিকিৎসক-পুরোহিতের পূর্বের মতোই ক্রিয়াকাণ্ড পরিচালনা করতেন। সুতরাং অথর্ববেদের পুরোহিতদের মধ্যেও সুস্পষ্ট শ্রেণীভেদ ছিল। ব্রহ্মৌদন, ব্ৰহ্মাগবী ও বিপুল দক্ষিণা নবোন্নীত রাজ-পুরোহিতেরাই ভোগ করতেন, অপরপক্ষে গ্রামের দরিদ্র শামান পুরোহিতদের সামান্য দক্ষিণাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হত।
অথর্ববেদের পুরোহিতরা রাজ-পুরোহিত রূপে নিযুক্ত হওয়ার পরে সমগ্ৰ গোষ্ঠী তাদের মহিমা স্বীকার করে নিল, ফলে প্রাচীন-পন্থী পুরোহিত সম্প্রদায় এই নবোদিত পুরোহিত শ্রেণীকে আর পূর্বের মতো অবহেলা করতে পারল না। এই রাজপুরোহিতরা যজ্ঞের গূঢ় রহস্যে পারঙ্গম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজা ও রাজন্যশ্রেণীর কল্যাণ কামনায় ইন্দ্ৰজালের প্রয়োগও শিখে নিলেন। অথর্ববেদ-বহির্ভূত অধিকাংশ শ্রৌতযাগে অথর্ববেদে শিক্ষিত পুরোহিত ‘ব্ৰহ্মা’ নামে অভিহিত হয়ে যজ্ঞের দায়িত্ব পালন করতেন; অন্যদিকে জনসাধারণের জন্য ঐন্দ্ৰজালিক অনুষ্ঠান পরিচালনায় গ্রামের ‘শামান’ বা জাদুপুরোহিতেরা নিযুক্ত থাকতেন। বিভিন্ন শ্রেণীর সুক্তে এই ত্ৰিবিধ বিভাজন স্পষ্টভাবে উপলব্ধ হয় এই সূক্তগুলির উদ্দিষ্ট হল : আত্মিক সমৃদ্ধি, যজ্ঞ, কঠোর সাধনা, এবং সুখের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত ব্ৰহ্মকর্মসমূহ এবং ভাষার উৎকর্ষলাভ। কিছু কিছু সূক্তে পূর্ণিমা, অমাবস্যা এবং তাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী রাত্রিসমূহের বিবৃতি পাওয়া যায়। এছাড়া, প্ৰায়শ্চিত্ত, অগ্নি, খাদ্যলােভ, বিষক্রিয়া থেকে মুক্তি, যজ্ঞবেদী, আহুতি প্রভৃতির মতো সাধারণ পার্থিব বিষয়বস্তুও কিছু কিছু সূক্তে বিধৃত হয়েছে। প্রথম সাতটি অধ্যায় এবং বিংশতিতম অধ্যায়ের ঋগ্বেদের বহুসংখ্যক সূক্ত থেকে ঋণ গৃহীত হয়েছে—যা সাধারণভাবে ঋগ্বেদের দ্বিতীয় পৰ্যায়ভুক্ত প্ৰথম, অষ্টম ও দশম মণ্ডল থেকে সংকলিত।