[লণ্ডনে প্রদত্ত বক্তৃতা]
নারদ নামে এক ঋষি সত্যলাভের জন্য সনৎকুমার নামক আর একজন ঋষির কাছে গিয়াছিলেন। সনৎকুমার তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কোন্ কোন্ বিষয় ইতোমধ্যে অধ্যয়ন করিয়াছ?’ নারদ বলিলেন, ‘বেদ, জ্যোতিষ এবং আরও বহু বিষয় অধ্যয়ন করিয়াছি বটে, কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তৃপ্ত হইতে পারি নাই।’ আলাপ চলিতে লাগিল। প্রসঙ্গক্রমে সনৎকুমার বলিলেনঃ বেদ জ্যোতিষ ও দর্শন-বিষয়ক যে জ্ঞান, তাহা গৌণ; বিজ্ঞানগুলিও গৌণ। যাহা দ্বারা আমাদের ব্রহ্মোপলব্ধি হয়, তাহাই চরম জ্ঞান—সর্বোচ্চ জ্ঞান। এই ধারণাটি প্রত্যেক ধর্মের মধ্যেই দেখা যায়, এবং ঐজন্যই সর্বোচ্চ জ্ঞান বলিয়া ধর্মের দাবী চিরন্তন। বিজ্ঞানগুলির জ্ঞান যেন আমাদের জীবনের একটুখানি অংশ জুড়িয়া আছে। কিন্তু ধর্ম আমাদের কাছে যে জ্ঞান লইয়া আসে, তাহা চিরন্তন; ধর্ম যে সত্যের কথা প্রচার করে, সে সত্যের মত এ জ্ঞানও সীমাহীন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই শ্রেষ্ঠত্বের দাবী লইয়া ধর্ম বারবার সর্ববিধ জাগতিক জ্ঞানকে উপেক্ষা করিয়াছে, শুধু তাহাই নয়, জাগতিক জ্ঞানের দ্বারা ন্যায়সঙ্গত বলিয়া সমর্থিত হইতেও বহুবার অস্বীকার করিয়াছে। ফলে জগতের সর্বত্র ধর্মজ্ঞান ও জাগতিক জ্ঞানের মধ্যে একটা বিরোধ লাগিয়াই আছে। একপক্ষ আচার্য, শাস্ত্র প্রভৃতির অভ্রান্ত প্রমাণকে পথ-নির্দেশক বলিয়া দাবী করিয়াছে এবং এ-বিষয়ে জাগতিক জ্ঞানের যাহা বলিবার আছে, তাহার কিছুতেই কান দিতে চায় নাই। অপর পক্ষ যুক্তিরূপ শাণিত অস্ত্র দ্বারা ধর্ম যাহা কিছু বলিতে চায় তাহাই খণ্ড খণ্ড করিয়া কাটিয়া ফেলিতে চাহিয়াছে। প্রত্যেক দেশেই এই সংগ্রাম চলিয়াছে, এবং এখনও চলিতেছে। ধর্ম বারবার পরাজিত ও প্রায় বিনষ্ট হইয়াছে। মানুষের ইতিহাসে ‘যুক্তি-দেবতার উপাসনা’ ফরাসী-বিপ্লবের সময়েই প্রথম আত্মপ্রকাশ করে নাই; এই জাতীয় ঘটনা পূর্বেও ঘটিয়াছিল, ফরাসী-বিপ্লবের সময় উহার পুনরভিনয় মাত্র হইয়াছে। কিন্তু বর্তমান যুগে উহা অতিমাত্রায় বাড়িয়া উঠিয়াছে। জড়বিজ্ঞানগুলি এখন পূর্বাপেক্ষা আরও ভালভাবে প্রস্তুত হইয়াছে; আর ধর্মের প্রস্তুতি সে-তুলনায় কমিয়া গিয়াছে, ভিত্তিগুলি শিথিল হইয়া গিয়াছে। আর আধুনিক মানুষ প্রকাশ্যে যাহাই বলুক না কেন, তাহার অন্তরের গোপন প্রদেশে এ-বোধ জাগ্রত যে, সে আর ‘বিশ্বাস’ করিতে পারে না। আধুনিক যুগের মানুষ জানে যে, পুরোহিত-সম্প্রদায় তাহাকে বিশ্বাস করিতে বলিতেছে বলিয়াই, কোন শাস্ত্রে লেখা আছে বলিয়াই, কিংবা তাহার স্বজনেরা চাহিতেছে বলিয়াই কিছু বিশ্বাস করা তাহার পক্ষে অসম্ভব। অবশ্য এমন কিছু লোক আছে, যাহারা তথাকথিত জনপ্রিয় বিশ্বাসকে মানিয়া লইতে প্রস্তুত বলিয়া মনে হয়। কিন্তু এ-কথাও আমরা নিশ্চয় জানি যে, তাহারা বিষয়টি সম্বন্ধে চিন্তা করে না। তাহাদের বিশ্বাসের ভাবটিকে ‘চিন্তাহীন অনবধানতা’ আখ্যা দেওয়া চলে। এই সংগ্রাম এভাবে আর বেশীদিন চলিতে পারে না; চলিলে ধর্মের সব সৌধই ভাঙিয়া চুরমার হইয়া যাইবে।
প্রশ্ন হইল—ইহা হইতে অব্যাহতিলাভের উপায় আছে কি? আরও স্পষ্টভাবে বলিলে বলিতে হয়ঃ অন্যান্য বিজ্ঞানগুলির প্রত্যেকটিই যুক্তির যে-সকল আবিষ্কারের সহায়তায় নিজেদের সমর্থন করিতেছে, ধর্মকেও কি আত্ম-সমর্থনের জন্য সেগুলির সাহায্য লইতে হইবে? বহির্জগতে বিজ্ঞান ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে তত্ত্বানুসন্ধানের যে পদ্ধতিগুলি অবলম্বিত হয়, ধর্মবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও কি সেই একই পদ্ধতি অবলম্বিত হইবে? আমার মতে তাহাই হওয়া উচিত। আমি ইহাও মনে করি, যত শীঘ্র তা হয়, ততই মঙ্গল। এরূপ অনুসন্ধানের ফলে কোন ধর্ম যদি বিনষ্ট হইয়া যায়, তাহা হইলে বুঝিতে হইবে—সেই ধর্ম বরাবরই অনাবশ্যক কুসংস্কার-মাত্র ছিল; যতশীঘ্র উহা লোপ পায়, ততই মঙ্গল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, উহার বিনাশেই সর্বাধিক কল্যাণ। এই অনুসন্ধানের ফলে ধর্মের ভিতর যা-কিছু খাদ আছে, সে-সবই দূরীভূত হইবে নিঃসন্দেহ, কিন্তু ধর্মের যাহা সারভাগ, তাহা এই অনুসন্ধানের ফলে বিজয়-গৌরবে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবে। পদার্থবিদ্যা বা রসায়নের সিদ্ধান্তগুলি যতখানি বিজ্ঞানসম্মত, ধর্ম যে অন্ততঃ ততখানি বিজ্ঞানসম্মত হইবে শুধু তাহাই নয়, বরং আরও বেশী জোরালো হইবে; কারণ জড়বিজ্ঞানের সত্যগুলির পক্ষে সাক্ষ্য দিবার মত অভ্যন্তরীণ আদেশ বা নির্দেশ কিছু নাই, কিন্তু ধর্মের তাহা আছে।
যে-সব ব্যক্তি ধর্ম সম্বন্ধে কোন যুক্তিসঙ্গত তত্ত্বানুসন্ধানের উপযোগিতা অস্বীকার করেন, আমার মনে হয়, তাঁহারা যেন কতকটা স্ববিরোধী কাজ করিয়া থাকেন। যেমন খ্রীষ্টানরা দাবী করেন যে, তাঁহাদের ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম; কারণ অমুক-অমুক ব্যক্তির কাছে তাহা প্রকাশিত হইয়াছিল। মুসলমানরাও নিজেদের ধর্ম সম্বন্ধে একই দাবী জানান যে, একমাত্র তাঁহাদের ধর্মই সত্য, কারণ এই এই ব্যক্তির কাছে তাহা প্রত্যাদিষ্ট হইয়াছিল। কিন্তু খ্রীষ্টানরা মুসলমানদের বলেন, ‘তোমাদের নীতিশাস্ত্রের কয়েকটি বিষয় ঠিক বলিয়া মনে হয় না। একটা উদাহরণ দিই। দেখ, ভাই মুসলমান, তোমার শাস্ত্র বলে যে, কাফেরকে জোর করিয়া মুসলমান করা চলে; আর সে যদি মুসলমান-ধর্মে দীক্ষিত হইতে না চায়, তবে তাহাকে হত্যা করাও চলে। আর এরূপ কাফেরকে যে-মুসলমান হত্যা করে, সে যত পাপ, যত গর্হিত কর্মই করুক না কেন, তাহার স্বর্গলাভ হইবেই।’ মুসলমানরা ঐ-কথার উত্তরে বিদ্রূপ করিয়া বলিবে, ‘ইহা যখন শাস্ত্রের আদেশ, তখন আমার পক্ষে এরূপ করাই সঙ্গত। এরূপ না করাটাই আমার পক্ষে অন্যায়।’ খ্রীষ্টানরা বলিবে, ‘কিন্তু আমাদের শাস্ত্র এ-কথা বলে না।’ মুসলমানরা তাহার উত্তরে বলিবে, ‘তা আমি জানি না। তোমার শাস্ত্র-প্রমাণ মানিতে আমি বাধ্য নই। আমার শাস্ত্র বলে, সব কাফেরকে হত্যা কর। কোন্টা ঠিক, কোন্টা ভুল, তাহা তুমি জানিলে কিরূপে? আমার শাস্ত্রে যাহা লিখিত আছে, নিশ্চয়ই তাহা সত্য। আর তোমার শাস্ত্রে যে আছে, হত্যা করিও না, তাহা ভুল। ভাই খ্রীষ্টান, তুমিও তো এই কথাই বল; তুমি বল যে, যিহোবা য়াহুদীদিগকে যাহা বলিয়াছিলেন, তাহাই যথার্থ কর্তব্য; আর তিনি তাহাদিগকে যাহা করিতে নিষেধ করিয়াছিলেন, তাহা করা অন্যায়। আমিও তাহাই বলি; কতকগুলি বিষয়কে কর্তব্য বলিয়া এবং কতকগুলি বিষয়কে অকর্তব্য বলিয়া আল্লা আমার শাস্ত্রে অনুজ্ঞা দিয়াছেন; ন্যায়-অন্যায় নির্ণয়ের তাহাই চূড়ান্ত প্রমাণ।’ খ্রীষ্টানরা কিন্তু ইহাতেও খুশী নয়। তাহারা ‘শৈলোপদেশ’-এর (Sermon on the Mount) নীতির সহিত কোরানের নীতি তুলনা করিয়া দেখাইবার জন্য জিদ করিতে থাকে। ইহার মীমাংসা হইবে কিরূপে? গ্রন্থের দ্বারা নিশ্চয়ই নয়, কারণ পরস্পর বিবদমান গ্রন্থগুলি বিচারক হইতে পারে না। কাজেই এ-কথা আমাদের স্বীকার করিতেই হইবে যে, এই-সব গ্রন্থ অপেক্ষা অধিকতর বিশ্বজনীন কিছু একটা আছে; একটা কিছু আছে, যাহা জগতে যত নীতিশাস্ত্র আছে, সেগুলি অপেক্ষা উচ্চতর; একটা কিছু আছে, যাহা বিভিন্ন জাতির অনুপ্রেরণা-শক্তিগুলিকে পরস্পর তুলনা করিয়া বিচার করিয়া দেখিতে পারে। আমরা দৃঢ়কণ্ঠে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করি আর নাই করি, পরিষ্কার বোঝা যাইতেছে যে, বিচারের জন্য আবেদন লইয়া আমরা যুক্তির দ্বারস্থ হই।
এখন প্রশ্ন উঠিতেছেঃ এই যুক্তির আলোক অনুপ্রেরণাগুলিকে পরস্পরের সহিত তুলনা করিয়া বিচার করিতে সমর্থ কিনা; যেখানে আচার্যের সহিত আচার্যের বিরোধ, সেখানেও যুক্তি নিজের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখিতে পারিবে কিনা এবং ধর্ম-সংক্রান্ত সব বিষয়ই বুঝিবার সামর্থ্য তাহার আছে কিনা। যদি না থাকে, তবে আচার্যে আচার্যে, শাস্ত্রে শাস্ত্রে যে জঘন্য বিরোধ যুগযুগ ধরিয়া চলিয়া আসিতেছে, কোন কিছু দ্বারাই তাহার মীমাংসা হওয়া সম্ভব নয়; কারণ তাহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, সব ধর্মই শুধু মিথ্যা ও অতিমাত্রায় পরস্পর-বিরোধী এবং সেগুলির মধ্যে নীতির কোন স্থায়ী মান নাই। ধর্মের প্রমাণ মানুষের প্রকৃতিগত সত্যের উপর নির্ভর করে, কোন গ্রন্থের উপর নয়। গ্রন্থগুলি তো মানুষের প্রকৃতির বহিঃপ্রকাশ, তাহার পরিণাম। মানুষই এই গ্রন্থগুলির স্রষ্টা। মানুষকে গড়িয়াছে, এমন কোন গ্রন্থ এখনও আমাদের নজরে পড়ে নাই। যুক্তিও সমভাবে সেই সাধারণ কারণের, মনুষ্য-প্রকৃতির একপ্রকার বিকাশ। এই মনুষ্য-প্রকৃতির কাছেই আমাদের আবেদন জানাইতে হইবে। তবু একমাত্র যুক্তিই এই মানব-প্রকৃতির সহিত সরাসরি সংযুক্ত; সেজন্য যতক্ষণ তাহা মানব-প্রকৃতির অনুগামী হয়, ততক্ষণ যুক্তিরই আশ্রয় লওয়া উচিত। যুক্তি বলিতে আমি কি বুঝাইতে চাহিতেছি? আধুনিক কালের প্রত্যেক নর-নারী যাহা করিতে চায়, আমি তাহাই বলিতে চাহিতেছি—জাগতিক জ্ঞানের আবিষ্কারগুলিকে ধর্মের উপর প্রয়োগ করিতে বলিতেছি। যুক্তির প্রথম নিয়ম এই যে, বিশেষ জ্ঞান সাধারণ জ্ঞানের দ্বারা ব্যাখ্যাত হয়, সাধারণ জ্ঞান ব্যাখ্যাত হয় আরও ব্যাপক সাধারণ জ্ঞানের দ্বারা; যতক্ষণ না আমরা বিশ্বজনীনতায় গিয়া পৌঁছাই, ততক্ষণ এইভাবেই চলিতে হয়। যেমন, নিয়ম বলিতে কি বুঝায় সে ধারণা আমাদের আছে। একটা কিছু ঘটিলে আমাদের যদি বিশ্বাস হয় যে, কোন একটি নিয়মের ফলেই তাহা ঘটিয়াছে, তাহা হইলে আমরা তৃপ্ত হই; আমাদের কাছে উহাই কার্যটির ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যা-অর্থে আমরা ইহাই বুঝাইতে চাইঃ যে কার্যটি দেখিয়া আমরা অতৃপ্ত ছিলাম, এখন প্রমাণ পাইলাম যে, এই ধরনের হাজার হাজার কার্য ঘটিয়া থাকে; এটি সেই সাধারণ কার্যের অন্তর্গত একটি বিশেষ কার্য মাত্র। ইহাকেই আমরা ‘নিয়ম’ বলি। একটি আপেল পড়িতে দেখিয়া নিউটনের চিত্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল; কিন্তু যখন তিনি দেখিলেন যে, সব আপেলই পড়ে, মাধ্যাকর্ষণের জন্য ইহা ঘটে, তখন তিনি তৃপ্ত হইলেন। মানুষের জ্ঞানের ইহা একটি নিয়ম। আমি কোন বিশেষ জিনিষকে—একটি মানুষকে রাস্তায় দেখিলাম; মানুষ সম্বন্ধে বৃহত্তর ধারণার সহিত তাহার তুলনা করিলাম এবং তৃপ্ত হইলাম; বৃহত্তর সাধারণের সহিত তুলনা করিয়া আমি তাহাকে মানুষ বলিয়া জানিলাম। কাজেই বিশেষকে বুঝিতে হইলে সাধারণের সঙ্গে মিলাইয়া দেখিতে হইবে, সাধারণকে বৃহত্তর সাধারণের সঙ্গে এবং সবশেষে সব-কিছুকে বিশ্বজনীনতার সঙ্গে মিলাইয়া দেখিতে হইবে। অস্তিত্বের ধারণাই আমাদের সর্বশেষ ধারণা, সর্বাধিক বিশ্বজনীন ধারণা। অস্তিত্বই হইল বিশ্বজনীন বোধের চূড়ান্ত।
আমরা সবাই মানুষ; ইহার অর্থ—মনুষ্যজাতি-রূপ যে সাধারণ ধারণা, আমরা যেন তাহার অংশ-বিশেষ। মানুষ, বিড়াল, কুকুর—এ-সবই প্রাণী। মানুষ, কুকুর, বিড়াল—এই-সব বিশেষ উদাহরণগুলি প্রাণিরূপ বৃহত্তর ও ব্যাপকতর সাধারণ জ্ঞানের অংশ। মানুষ, বিড়াল, কুকুর, লতা, বৃক্ষ—এ-সবই আবার জীবন-রূপ আরও ব্যাপক ধারণার অন্তর্ভুক্ত। এগুলিকে এবং সব জীব, সব পদার্থকেই আবার অস্তিত্বরূপ একটি ধারণার অন্তর্ভুক্ত করা যায়; কারণ আমরা সবাই সেই ধারণার মধ্যে পড়ি। এই ব্যাখ্যা বলিতে শুধু বিশেষজ্ঞানকে সাধারণজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করা এবং আরও কিছু সমধর্মী বিষয়ের সন্ধান করা বোঝায়। মন যেন তাহার ভাণ্ডারে এই ধরনের অসংখ্য সাধারণজ্ঞান সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছে। মনের মধ্যে যেন অনেকগুলি প্রকোষ্ঠ আছে, সেগুলির মধ্যে এই-সব ধারণা ভাগে-ভাগে সাজান থাকে; আর যখনই আমরা কোন নূতন জিনিষ দেখি, মন তৎক্ষণাৎ এই প্রকোষ্ঠগুলির কোন একটি হইতে তাহার অনুরূপ জিনিষ বাহির করিবার জন্য সচেষ্ট হয়। যদি কোন খোপে আমরা অনুরূপ জিনিষ খুঁজিয়া পাই, তবে নূতন জিনিষটিকে সেই খোপে রাখিয়া দিই। আমরা তখন তৃপ্ত হই ও ভাবি, জিনিষটি সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করিলাম। জ্ঞান বলিতে ইহাই বুঝায়, ইহার বেশী কিছু নয়। মনের কোন খোপে অনুরূপ জিনিষ দেখিতে না পাইলে আমরা অতৃপ্ত হই। ইহার জন্য মনের মধ্যে পূর্ব হইতেই বর্তমান এমন একটি শ্রেণীবিভাগ খুঁজিয়া বাহির না করা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করিতে হয়। কাজেই জ্ঞান বলিতে শ্রেণীবিভাগ বুঝায়; এ-কথা পূর্বেই বলিয়াছি। তাছাড়া আরও আছে। জ্ঞানের দ্বিতীয় ব্যাখ্যা এই যে, কোন বস্তুর ব্যাখ্যা অবশ্যই উহার ভিতর হইতে আসা চাই, বাহির হইতে নয়। একখণ্ড পাথর উপরে ছুঁড়িয়া দিলে উহা আবার নীচে পড়িয়া যায় কেন? লোকে এরূপ বিশ্বাস করিত যে, কোন দৈত্য সেটিকে টানিয়া নামাইয়া আনে। বহু ঘটনা সম্বন্ধে মানুষের ধারণা ছিল যে, সেগুলি কেহ অলৌকিক শক্তি-প্রভাবে ঘটায়; আসলে কিন্তু সেগুলি প্রাকৃতিক ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। শূন্যে উৎক্ষিপ্ত পাথরকে একজন দৈত্য টানিয়া নামায়, এই ব্যাখ্যাটি পাথর-বস্তুটির ভিতর হইতে আসিত না, আসিত বাহির হইতে। মাধ্যাকর্ষণের জন্য পাথরটি পড়িয়া যায়, এই ব্যাখ্যাটি কিন্তু পাথরের স্বভাবগত গুণবিশেষ; এই ব্যাখ্যাটি বস্তুর অভ্যন্তর হইতে আসিতেছে। দেখা যায়, এভাবে ব্যাখ্যা করার ঝোঁক আধুনিক চিন্তার সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। এক কথায় বলা যায়, বিজ্ঞান বলিতে বোঝায় যে, বস্তুর ব্যাখ্যা তাহার প্রকৃতির মধ্যেই রহিয়াছে; বিশ্বের ঘটনাবলীর ব্যাখ্যার জন্য বাহিরের কোন ব্যক্তি বা অস্তিত্বকে টানিয়া আনার প্রয়োজন হয় না। রাসায়নিক পরিবর্তনের ব্যাখ্যা করিবার জন্য রসায়নবিদের কোন দানব বা ভূত-প্রেত বা এই ধরনের কোন কিছুর প্রয়োজন হয় না। কোন পদার্থবিদের বা অন্য কোন বৈজ্ঞানিকের কাছেও তাঁহাদের বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যার জন্য এই-সব দৈত্য-দানবাদির কোন প্রয়োজন নাই। বিজ্ঞানের এটি একটি ধারা; এই ধারাটি আমি ধর্মের উপর প্রয়োগ করিতে চাই। দেখা যায়, ধর্মগুলির মধ্যে ইহার অভাব রহিয়াছে এবং সেইজন্য ধর্মগুলি ভাঙিয়া শতধা হইতেছে। প্রত্যেক বিজ্ঞান অভ্যন্তর হইতেই—বস্তুর প্রকৃতি হইতেই ব্যাখ্যা চায়; ধর্মগুলি কিন্তু তাহা দিতে পারিতেছে না। একটি মত আছে যে, ঈশ্বর ব্যক্তিবিশেষ এবং তিনি বিশ্ব হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্ এক সত্তা; এই ধারণা অতি প্রাচীনকাল হইতে বিদ্যমান। ইহার সপক্ষে বারবার এই যুক্তি প্রযুক্ত হইয়াছে যে বিশ্ব হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্, অতিপ্রাকৃতিক একজন ঈশ্বরের প্রয়োজন রহিয়াছে; এই ঈশ্বর ইচ্ছামাত্র বিশ্ব সৃষ্টি করিয়াছেন, এবং ধর্ম বিশ্বাস করে, তিনিই বিশ্বের নিয়ন্তা। এ-সব যুক্তি তো আছেই, তাছাড়া দেখা যায় সর্বশক্তিমান্ ঈশ্বর সকলের প্রতি করুণাময় বলিয়াও বর্ণিত হইয়াছেন; এদিকে আবার সেই সঙ্গে জগতে বৈষম্যও রহিয়াছে। দার্শনিক এ-সব লইয়া মোটেই মাথা ঘামান না; তিনি বলেন, ইহার গোড়ায় গলদ রহিয়াছে—এই ব্যাখ্যা বাহির হইতে আসিতেছে, ভিতর হইতে নয়। বিশ্বের কারণ কি? বাহিরের কোন কিছু—কোন ব্যক্তি এই বিশ্ব পরিচালনা করিতেছেন! শূন্যে উৎক্ষিপ্ত প্রস্তরখণ্ডের নিম্নে পতনরূপ ঘটনার ক্ষেত্রে যেমন এরূপ ব্যাখ্যা পর্যাপ্ত বলিয়া বিবেচিত হয় নাই, ধর্মের ব্যাখ্যাতেও ঠিক তাই। ধর্মগুলি ভাঙিয়া খণ্ড খণ্ড হইয়া যাইতেছে, কারণ ইহা অপেক্ষা ভাল ব্যাখ্যা তাহারা দিতে পারে না।
প্রত্যেক বস্তুর ব্যাখ্যা উহার ভিতর হইতেই আসে, এই ধারণার সহিত সংশ্লিষ্ট আর একটি ধারণা হইল আধুনিক বিবর্তনবাদ; দুইটি ধারণাই একই মূল তত্ত্বের অভিব্যক্তি। সমগ্র বিবর্তনবাদের সরল অর্থ—বস্তুর স্বভাব পুনঃপ্রকাশিত হয়; কারণের অবস্থান্তর ছাড়া কার্য আর কিছুই নয়, কার্যের সম্ভাবনা কারণের মধ্যেই নিহিত থাকে; সমগ্র বিশ্বই তাহার মূল সত্তার অভিব্যক্তি মাত্র, শূন্য হইতে সৃষ্ট নয়। অর্থাৎ প্রত্যেক কার্যই তাহার পূর্ববর্তী কোন কারণের পুনরভিব্যক্তি, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে শুধু তাহার অবস্থান্তর ঘটে। সমগ্র বিশ্ব জুড়িয়া ইহাই ঘটিতেছে, কাজেই এই-সব পরিবর্তনের কারণ খুঁজিতে আমাদের বিশ্বের বাহিরে হাতড়াইবার প্রয়োজন নাই; বিশ্বের ভিতরেই সেই কারণ বর্তমান। বাহিরে কারণ খোঁজা নিষ্প্রয়োজন। এই ধারণাটিও ধর্মকে ভূমিসাৎ করিতেছে। যে-সব ধর্ম বিশ্বাতিরিক্ত একজন ঈশ্বরকে আঁকড়াইয়া ছিল, তিনি খুব বড় একজন মানুষ ছাড়া আর কিছুই নন; এই ধারণা এখন আর দাঁড়াইতে পারিতেছে না, যেন জোর করিয়া টানিয়া এ ধারণাকে ভূপাতিত করা হইতেছে; ধর্মকে ভূমিসাৎ করা হইতেছে বলিতে আমি ইহাই বুঝাইতেছি।
এই দুইটি মূলতত্ত্বকে তৃপ্ত করিতে পারে, এমন কোন কর্ম থাকিতে পারে কি? আমার মনে হয়, পারে। আমরা দেখিয়াছি, সর্বপ্রথমে সামান্যীকরণের মূলতত্ত্বগুলিকে তৃপ্ত করিতে হইবে। সামান্যীকরণের তত্ত্বগুলির সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তনবাদের তত্ত্বগুলিকেও তৃপ্ত করিতে হইবে। আমাদিগকে এমন একটি চরম সামান্যীকরণে আসিতে হইবে, যাহা শুধু সামান্যীকরণগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশী বিশ্বব্যাপকই হইবে না, বিশ্বের সব কিছুর উদ্ভবও তাহা হইতে হওয়া চাই। উহাকে নিম্নতম কার্যের সহিত সমপ্রকৃতির হইতে হইবে; যাহা কারণ, যাহা সর্বোচ্চ, যাহা চরম—যাহা আদি কারণ, তাহাকে পরম্পরাগত কতকগুলি অভিব্যক্তির ফলে সঞ্জাত দূরতম, নিম্নতম কার্যের সহিতও ভিন্ন হইতে হইবে। বেদান্তের ব্রহ্মই এই শর্ত পূরণ করেন; কারণ সামান্যীকরণ করিতে করিতে সর্বশেষে আমরা গিয়া যেখানে পৌঁছিতে পারি, এই ব্রহ্ম তাহাই। এই ব্রহ্ম নির্গুণ—অস্তিত্ব, জ্ঞান ও আনন্দের চরম অবস্থা (সচ্চিদানন্দস্বরূপ)। আমরা দেখিয়াছি, মনুষ্য-মন যে চরম সামান্যীকরণে পৌঁছিতে পারে, তাহাই ‘অস্তিত্ব’ (সৎ)। জ্ঞান (চিৎ) বলিতে আমাদের যে জ্ঞান আছে, তাহা বুঝায় না; ইহা সেই জ্ঞানের নির্যাস বা সূক্ষ্মতম অবস্থা; ইহাই ক্রম-অভিব্যক্ত হইয়া মানুষ বা অপর প্রাণীর মধ্যে জ্ঞানরূপে ফুটিয়া উঠে। বিশ্বের পিছনে যে চরম সত্তা রহিয়াছে—কাহারও আপত্তি না থাকিলে বলিতে পারি—এমন কি চেতনারও পিছনে যাহা রহিয়াছে, জ্ঞানের সূক্ষ্মসত্তা বলিতে তাহাই বুঝায়। ‘চিৎ’ বলিতে এবং বিশ্বের বস্তুসমূহের সত্তাগত একত্ব বলিতে যাহা বুঝায়, উহা তাহাই। আমার মনে হয়, আধুনিক বিজ্ঞান বার বার যাহা প্রমাণ করিয়া চলিয়াছে, তাহা এইঃ আমরা এক; মানসিক, শারীরিক, আধ্যাত্মিক—সব দিক্ দিয়াই আমরা এক। শরীরের দিক্ হইতে আমরা পৃথক্, এ-কথাও বলা ভুল। তর্কের খাতিরে ধরিয়া লইতেছি, আমরা জড়বাদী; সে ক্ষেত্রেও আমাদের এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে হইবে যে, সমগ্র বিশ্ব একটা জড়-সমুদ্র ছাড়া আর কিছুই নয়, আর সেই জড়-সমুদ্রে তুমি আমি যেন ছোট ছোট ঘূর্ণি। খানিকটা জড়পদার্থ প্রত্যেক ঘূর্ণির স্থানে আসিয়া ঘূর্ণির আকার লইতেছে, আবার জড়পদার্থরূপে বাহির হইয়া যাইতেছে, আমার শরীরে যে জড়পদার্থ আছে, কয়েক বছর পূর্বে তাহা হয়তো তোমার শরীরে ছিল বা সূর্যে ছিল বা হয়তো অন্য কোন গ্রহে বা অন্য কোথাও ছিল—অবিরাম গতিশীল অবস্থায় ছিল। তোমার দেহ, আমার দেহ—এ-কথার অর্থ কি? দেহ সবই এক। চিন্তার বেলাও তাই। চিন্তার একটি অসীম-প্রসারী সমুদ্র রহিয়াছে; তোমার মন, আমার মন সেই সমুদ্রেরই ভিতর দুইটি ঘূর্ণিবিশেষ। উহার ফল কি এখনই প্রত্যক্ষ করিতেছ না? তোমার চিন্তা আমার মনে এবং আমার চিন্তা তোমার মনে প্রবেশ করিতেছে কি করিয়া? আমাদের সমস্ত জীবনই এক; আমরা এক, এমন কি চিন্তার দিক্ দিয়াও এক। সামান্যীকরণের দিকে আরও অগ্রসর হইলে পাওয়া যায় জড়বস্তু ও চিন্তার সূক্ষ্মসত্তা আত্মাকে, যাহা হইতে উহারা অভিব্যক্ত হইতেছে; এই একত্ব হইতেই সবকিছু আসিয়াছে, সত্তার দিক্ হইতে সেগুলিকে এক হইতেই হইবে। আমরা সর্বতোভাবে এক, শরীর ও মনের দিক্ দিয়া এক; আর আত্মায় যদি আমাদের আদৌ বিশ্বাস থাকে, তাহা হইলে আত্মার দিক্ হইতেও যে আমরা এক, এ-কথা বলাই বাহুল্য। আধুনিক বিজ্ঞানে প্রতিদিনই এই একত্বের কথা প্রমাণিত হইয়া চলিয়াছে। গর্বিত লোককে বলা হয়ঃ তুমিও যা, ঐ ক্ষুদ্র পোকাটিও তাই; তোমার ও উহার মধ্যে বিপুল পার্থক্য আছে, এ-কথা ভাবিও না। উহার সঙ্গে তুমি এক। পূর্বজন্মে তুমিও একদিন ঐরকম পোকা ছিলে; পোকাই ক্রমোন্নত হইতে হইতে কালে এই মানুষ হইয়াছে, যে-মনুষ্যত্বের গর্বে তুমি এত গর্বিত! বস্তুর একত্বরূপ এই অপূর্ব তথ্যটি—যাহা কিছুর অস্তিত্ব আছে, তাহারই সহিত আমাদের এক করিয়া দেয়। এ তথ্যটি একটি মহান্ শিক্ষার বিষয়; কারণ আমাদের ভিতর অধিকাংশ লোকই উচ্চতর জীবনের সঙ্গে নিজেকে এক করিতে পারিলে খুশী হয়। কিন্তু কেহই নিম্নতর জীবনের সঙ্গে নিজেকে এক বলিয়া ভাবিতে চায় না। কাহারও পূর্বপুরুষ পশুতুল্য, দস্যু বা দস্যু-জমিদার হওয়া সত্ত্বেও যদি সমাজ-কর্তৃক পূজিত হইয়া থাকেন, তবে আমরা প্রত্যেকেই নিজেকে তাঁহার বংশধর বলিয়া পরিচয় দিবার জন্য তাঁহার সহিত একটা সম্পর্ক খুঁজিতে তৎপর হই; মানুষের এমনই নির্বুদ্ধিতা। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে কোন দরিদ্র ব্যক্তি সৎ এবং ভদ্র হইলেও আমরা কেহই তাঁহার বংশধর বলিয়া পরিচয় দিতে চাই না। কিন্তু আমাদের দৃষ্টি খুলিয়া যাইতেছে, সত্য ক্রমেই অধিকতর প্রকাশিত হইয়া পড়িতেছে। আর তাহাতে ধর্মের লাভ যথেষ্ট। আমি যে-বিষয়ে বক্তৃতা দিতেছি, সেই অদ্বৈততত্ত্ব ঠিক এই কথাই বলে। বিশ্বের মূল সত্তা ব্রহ্মই সব জীবাত্মার স্বরূপ। তিনিই তোমার জীবনের পরম ধন; তাই বা বলি কেন, তুমিই তিনি—‘তত্ত্বমসি’। বিশ্বের সঙ্গে তুমি এক। যে বলে অপরের সহিত তাহার এতটুকু পার্থক্য রহিয়াছে, সে তখনই দুঃখী হয়। এই একত্বের বোধ সম্বন্ধে যে সচেতন, সে নিজেকে বিশ্বের সঙ্গে এক বলিয়া জানে, সে-ই সুখের অধিকারী।
কাজেই দেখা যাইতেছে, উচ্চতম সামান্যীকরণ এবং বিবর্তনবাদের কথা বেদান্তে আছে বলিয়া বেদান্তের ধর্ম বৈজ্ঞানিক জগতের দাবী মিটাইতে পারে। কোন বস্তুর ব্যাখ্যা যে তাহার ভিতর হইতেই আসে, বেদান্ত সে কথা আরও সম্পূর্ণরূপে বুঝাইয়া দেয়। ব্রহ্মের বা বেদান্তোক্ত ভগবানের বাহিরে তদতিরিক্ত কোন সত্তা নাই, একেবারেই নাই। আসলে সবই তিনি, বিশ্বের মধ্যে তিনিই রহিয়াছেন; তিনিই বিশ্ব। ‘তুমিই নর, তুমিই নারী; যৌবন-মদ-দৃপ্তপদে বিচরণকারী যুবক তুমিই, স্খলিত-পদ বৃদ্ধও তুমি।’৬ এই এখানেই তিনি আছেন। আমরা তাঁহাকেই দেখি, তাঁহাকেই অনুভব করি। তাঁহাতেই আমরা বাঁচিয়া থাকি ও বিচরণ করি; তাঁহার অস্তিত্বেই আমাদের অস্তিত্ব। (বাইবেলের) ‘নিউ টেষ্টামেণ্ট’-এর ভিতর আমরা এই ভাব দেখিতে পাই। সেই একই ভাব—ভগবান্ বিশ্বে ওতপ্রোত। তিনিই বস্তুর মূল সত্তা, বস্তুর হৃদয়-স্বরূপ, প্রাণ-স্বরূপ। বিশ্বে তিনি যেন নিজেকেই অভিব্যক্ত করেন। সেই অসীম সচ্চিদানন্দ-সাগরের মধ্যে আমরা বাস করিতেছি; তুমি আমি যেন সেই সাগরেরই ক্ষুদ্র অংশ, ক্ষুদ্র বিন্দু, ক্ষুদ্র প্রণালী, ক্ষুদ্র অভিব্যক্তি। বস্তুর দিক্ দিয়া মানুষে-মানুষে, দেবতায়-মানুষে, মানুষে-প্রাণীতে, প্রাণীতে-উদ্ভিদে, উদ্ভিদে-পাথরে কোন পার্থক্য নাই। কারণ সর্বোচ্চ দেবদূত হইতে আরম্ভ করিয়া সর্বনিম্ন ধূলিকণা পর্যন্ত—সবই সেই এক সীমাহীন সাগরের অভিব্যক্তি। তফাত শুধু প্রকাশের তারতম্যে। আমার মধ্যে প্রকাশ খুব কম, তোমার মধ্যে হয়তো তার চেয়ে বেশী; কিন্তু উভয়ের বস্তু সেই একই। তুমি আমি সেই একই অনন্ত অস্তিত্ব-সাগরে অবস্থিত—উহারই দুইটি ক্ষুদ্র অংশ, ক্ষুদ্র নির্গত পথ বা ক্ষুদ্র প্রকাশ মাত্র। কাজেই ঈশ্বরই তোমার স্বরূপ, আমারও স্বরূপ। জন্ম হইতেই তুমি স্বরূপতঃ ঈশ্বর, আমিও তাহাই। তুমি হয়তো পবিত্রতার মূর্তি দেবদূত, আর আমি হয়তো মহাদুষ্কৃতিকারী দানব। তা সত্ত্বেও সেই সচ্চিদানন্দ-সাগরে আমার জন্মগত অধিকার আছে, তোমারও আছে। তুমি আজ নিজেকে অনেক বেশী মাত্রায় অভিব্যক্ত করিয়াছ। অপেক্ষা কর, আমি নিজেকে আরও বেশী অভিব্যক্ত করিব; কারণ সবই তো আমার ভিতরে রহিয়াছে। কোন স্বতন্ত্র ব্যাখ্যার প্রয়োজন নাই; কাহারও কাছে কিছু চাহিতে হইবে না। সমগ্র বিশ্বের সমষ্টি হইলেন ঈশ্বর স্বয়ং। ঈশ্বর কি তাহা হইলে জড়পদার্থ? না, নিশ্চয়ই নয়। কারণ পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা ভগবান্কে যে-ভাবে অনুভব করি, তাহাই তো জড়পদার্থ। বুদ্ধির মাধ্যমে ঈশ্বরকে যেভাবে অনুভব করি, তাহাই মন। আবার আত্মার মধ্য দিয়া ঈশ্বর আত্মারূপেই দৃষ্ট হন। তিনি জড়পদার্থ নন, জড়পদার্থের মধ্যে সত্যবস্তু বলিতে যাহা আছে, তিনি তাহাই। চেয়ারের মধ্যে যাহা সত্যবস্তু, তাহা ভগবানই। কারণ চেয়ারটিকে চেয়াররূপে ফুটাইয়া তুলিবার জন্য দুইটি জিনিষের প্রয়োজন। বাহিরে কিছু একটা ছিল, যাহাকে আমার ইন্দ্রিয়গুলি আমার নিকট আনিয়াছে; আমার মন তাহার সঙ্গে আরও কিছু যোগ করিয়াছে; আর সেই দুইয়ের সমবায়ে যাহা হইয়াছে, তাহাই হইল চেয়ার। ইন্দ্রিয় এবং বুদ্ধি-নিরপেক্ষ যে সত্তা চিরবিদ্যমান, তাহাই ভগবান্ স্বয়ং। তাঁহারই উপর ইন্দ্রিয়গুলি চেয়ার, টেবিল, ঘর, বাড়ী, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র প্রভৃতি সব কিছুই চিত্রিত করিতেছে। তাহাই যদি হয়, তবে আমরা সকলে একই প্রকার চেয়ার দেখিতেছি কেন? ভগবানের উপর—সচ্চিদানন্দের উপর একইভাবে এইসব বিভিন্ন বস্তু আঁকিয়া চলিতেছি কেন? সকলেই যে একইভাবে অঙ্কিত করে, এমন কথা নয়; তবে যাহারা একই ভাবে আঁকিতেছে, তাহারা সকলেই সত্তার একই স্তরে রহিয়াছে বলিয়া পরস্পরের চিত্রণগুলিকে এবং পরস্পরকে দেখিতে পায়। তোমার আমার মাঝখানে এমন লক্ষ লক্ষ প্রাণী থাকিতে পারে, যাহারা এইভাবে ভগবান্কে চিত্রিত করে না। সেই-সব প্রাণী এবং তাহাদের চিত্রিত জগৎ আমরা দেখিতে পাই না। এদিকে আবার আধুনিক পদার্থবিদ্যার গবেষণাগুলি হইতে এ-কথার প্রমাণ ক্রমশঃ বেশী করিয়া পাওয়া যাইতেছে। বস্তুর সূক্ষ্মতর সত্তাই সত্য; যাহা স্থূল, তাহা দৃশ্যমান। সে যাহাই হউক, আমরা দেখিয়াছি, আধুনিক যুক্তির সম্মুখে যদি কোন ধর্মীয় মতবাদ দাঁড়াইতে পারে, তবে তাহা হইলে একমাত্র অদ্বৈতবাদ; কারণ এখানে আধুনিক যুক্তির দুইটি দাবী পূর্ণ হয়, ইহাই সর্বোচ্চ সামান্যীকরণ; এই সামান্যীকরণ ব্যক্তিত্বের ঊর্ধ্বে, ইহা প্রত্যেক জীবের পক্ষেই সাধারণ। যে সামান্যীকরণ সাকার ঈশ্বরে শেষ হয়, তাহা বিশ্বজনীন হইতে পারে না; কারণ সাকার ঈশ্বরের ধারণা করিতে গেলে প্রথমেই তাঁহাকে সর্বতোভাবে দয়াময়—মঙ্গলময় বলিতে হইবে। কিন্তু এই জগৎ ভাল মন্দ উভয়েরই মিশ্রণে গঠিত—ইহার কিছুটা ভাল, কিছুটা মন্দ। আমরা ইহা হইতে কিছুটা বাদ দিয়া বাকী অংশকে সাকার ঈশ্বররূপে সামান্যীকরণ করি। সাকার ঈশ্বর এই-এই রূপ বলিলে এ-কথাও বলিতে হইবে যে, তিনি এই-এই রূপ নন। আর দেখিবে সাকার ঈশ্বরের সঙ্গে সর্বদা একটি সাকার শয়তানও আসিয়া পড়িবে। ইহা হইতে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, সাকার ঈশ্বরের ধারণায় যথার্থ সামান্যীকরণ হয় না; আমাদের আরও আগাইয়া যাইতে হইবে—নিরাকার ব্রহ্মে পৌঁছাইতে হইবে। নিরাকার ব্রহ্মের মধ্যে সুখ-দুঃখ সব লইয়াই বিশ্ব রহিয়াছে, কারণ বিশ্বে যাহা কিছু বর্তমান, সে-সবই ঈশ্বরের সেই নিরাকার স্বরূপ হইতে আসিয়াছে। অমঙ্গল প্রভৃতি সব কিছুই যাঁহার উপর আরোপ করিতেছি, তিনি আবার কি ধরনের ঈশ্বর? কথা হইল, ভালমন্দ—দুই-ই একই জিনিষের বিভিন্ন দিক্, বিভিন্ন প্রকাশ। ভাল ও মন্দ যে দুইটি পৃথক্ সত্তা—এই ভুল ধারণা আদিকাল হইতে রহিয়াছে। ন্যায় ও অন্যায় দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক্ জিনিষ, উহারা পরস্পরের সহিত সম্পর্করহিত—এই ধারণা, এবং ভাল ও মন্দ দুইটি চির-বিচ্ছেদ্য, চির-বিচ্ছিন্ন পদার্থ—এই ধারণা আমাদের এই জগতের বহু দুর্ভোগের কারণ হইয়াছে। সর্বদাই ভাল বা সর্বদাই খারাপ, এমন কোন জিনিষ দেখাইয়া দিতে পারে, এরূপ লোকের সাক্ষাৎ পাইলে আমি খুশী হইতাম। যেন কোন ব্যক্তি উঠিয়া দাঁড়াইয়া খুব ভালভাবে বুঝাইয়া দিতে পারিবে যে, আমাদের জীবনের কতকগুলি ঘটনা শুধু মঙ্গল আনে, আর কতকগুলি আনে কেবল অমঙ্গল। আজ যাহা মঙ্গলকর, কাল তাহা অমঙ্গলজনক হইতে পারে। আজ যাহা মন্দ, কাল তাহা ভাল হইতে পারে। আমার পক্ষে যাহা কল্যাণকর, তোমার পক্ষে তাহা অকল্যাণকর হইতে পারে। সিদ্ধান্ত হইল এই যে, অন্যান্য প্রত্যেক জিনিষের মতই ভালমন্দের মধ্যেও বিবর্তন আছে। একটা কিছু আছে, যাহাকে ক্রমবিবর্তনের পথে এক অবস্থায় আমরা ভাল বলি, আবার অন্য অবস্থায় মন্দ বলি। ঝড়ে আমার এক বন্ধু মারা গেল, ঝড়কে আমি অকল্যাণকর বলিলাম, কিন্তু সেই ঝড়ই হয়তো বায়ুর দূষিত বীজাণু নষ্ট করিয়া হাজার হাজার লোকের প্রাণ বাঁচাইল। লোকে ঝড়কে ভাল বলিল, আমি খারাপ বলিলাম। কাজেই ভালমন্দ আপেক্ষিক জগতের অন্তর্গত—ঘটনার অন্তর্গত। যে নিরাকার ব্রহ্মের কথা বলা হইতেছে, তিনি আপেক্ষিক ঈশ্বর নন। কাজেই তাঁহাকে ভাল বা মন্দ কোন আখ্যাই দেওয়া যায় না, ভাল বা মন্দ কোনটিই নন বলিয়া তিনি এ-সবের অতীত। অবশ্য তাঁহার অভিব্যক্তি হিসাবে ‘মন্দ’ অপেক্ষা ‘ভাল’ তাঁহার স্বরূপের অধিকতর নিকটবর্তী।
এরূপ নিরাকার সত্তা—নির্গুণ ঈশ্বর মানিলে ফল কি হইবে? আমাদের কি লাভ হইবে তাহাতে? আমাদের সান্ত্বনার স্থলরূপে, আমাদের সহায়করূপে ধর্ম কি আর মানবজীবনের অঙ্গরূপে থাকিতে পারিবে? মানুষের কাহারও সাকার ঈশ্বরের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করিবার যে আকূতি রহিয়াছে, তাহার কি হইবে? এ-সবই থাকিবে। সাকার ঈশ্বর থাকিবেন, দৃঢ়তর ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকিবেন। নিরাকার ব্রহ্মের দ্বারা তিনি আরও দৃঢ়প্রতিষ্ঠ হইবেন। আমরা দেখিয়াছি, নিরাকার ঈশ্বরকে বাদ দিয়া সাকার ঈশ্বর থাকিতে পারেন না। আমরা যদি বলিতে চাই যে, সৃষ্টি হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একজন ঈশ্বর আছেন, যিনি ইচ্ছামাত্র শূন্য হইতে এই বিশ্ব সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহা হইলে সে-কথা প্রমাণ করিতে পারা যায় না। ইহা অচল। কিন্তু নিরাকারের ভাব ধারণা করিতে পারিলে সেখানে সাকারের ভাবও থাকিতে পারে। সেই একই নিরাকার সত্তাকে বিভিন্নভাবে দেখিলে যাহা মনে হয়, বহু বিচিত্র এই বিশ্ব তাহাই। পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা যখন তাঁহাকে দেখি, তখন তাঁহাকে জড়জগৎ বলি। এমন কোন প্রাণী যদি থাকিত, যাহার ইন্দ্রিয় পাঁচটিরও বেশী, তবে এই জগৎকেই সে অন্যরূপে দেখিত। আমাদের মধ্যে কাহারও যদি এমন একটি ইন্দ্রিয় হয়, যাহা-দ্বারা সে বিদ্যুৎ-শক্তি প্রত্যক্ষ করিতে পারে, তবে এই বিশ্বকেই সে আবার অন্যরূপে দেখিবে। সেই একই অদ্বয় ব্রহ্মের বহু-রূপ, তাঁহাকে বিভিন্নভাবে দেখার ফলেই বিভিন্ন জগতের ধারণাগুলি উদ্ভূত হয়; মনুষ্য-বুদ্ধিতে সেই নিরাকার সত্তা সম্বন্ধে সর্বোচ্চ যে ধারণা আসা সম্ভব, তাহাই হইল সাকার ঈশ্বর। কাজেই এই চেয়ারটি—এই জগৎ যতখানি সত্য, সাকার ঈশ্বরও ততখানি সত্য; কিন্তু তাহার বেশী নয়। ইহা চরম সত্য নয়। নিরাকার ব্রহ্মই সাকার ঈশ্বর; এইজন্য সাকার ঈশ্বর সত্য। যেমন মানুষ হিসাবে আমি একসঙ্গে সত্য এবং অসত্য দুই-ই। তুমি আমাকে যেভাবে দেখিতেছ, আমি যে তাহাই, এ-কথা সত্য নয়—এ-কথা তুমি নিজেই যাচাই করিয়া দেখিয়া লইতে পার। তুমি আমাকে যাহা বলিয়া মনে কর, আমি তাহা নই; বিচার করিয়া দেখিলে এ-বিষয়ে তুমি তৃপ্ত হইতে পারিবে, কারণ আলো, বিভিন্ন স্পন্দন, বায়ুমণ্ডলের অবস্থা, আমার ভিতরে যাবতীয় গতি—এই-সবগুলির একত্র মিলনের ফলে আমাকে যেরূপ দেখা যাইতেছে, তুমি আমাকে সেইরূপই দেখিতেছ। এই অবস্থাগুলির ভিতর যে-কোন একটির পরিবর্তন ঘটিলেই আমি আবার অন্যরূপ দেখাইব। আলোকের বিভিন্ন অবস্থায় একই মানুষের আলোকচিত্র লইয়া তুমি এ-কথার যাথার্থ্য নিরূপণ করিতে পার। কাজেই তোমার ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমাকে যেমন দেখাইতেছে, ‘আমি’ বলিতে তাহাই বুঝাইতেছে। এ-সব সত্ত্বেও আমার মধ্যে এমন একটা কিছু আছে, যাহার পরিবর্তন নাই, যাহাকে অবলম্বন করিয়া আমার অস্তিত্বের বিভিন্ন অবস্থাগুলি প্রকাশ পাইতেছে। সেইটিই নৈর্ব্যক্তিক ‘আমি’, তাহাকে অবলম্বন করিয়াই হাজার হাজার বিভিন্ন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ‘আমি’ ফুটিয়া উঠিতেছে; আমি শিশু ছিলাম, আমি যুবা হইয়াছিলাম, আমি আরও বয়স্ক হইয়া চলিয়াছি। আমার জীবনের প্রতিটি দিনেই আমার দেহের ও চিন্তার পরিবর্তন ঘটিতেছে। এ-সব পরিবর্তন সত্ত্বেও সেগুলির সমষ্টির পরিমাণ কিন্তু চিরস্থির। সেইটিই নৈর্ব্যক্তিক ‘আমি’; এই-সব অভিব্যক্তি যেন তাহারই অংশস্বরূপ।
একই ভাবে এই বিশ্বের সমষ্টিফল অপরিবর্তনীয়, ইহা আমরা জানি। কিন্তু এই বিশ্ব-সংশ্লিষ্ট সব কিছুরই গতি আছে, সব কিছুই অবিরাম স্পন্দনশীল অবস্থায় রহিয়াছে; সব কিছুই পরিবর্তনশীল ও গতিশীল। আবার সেই সঙ্গেই দেখি যে, এই বিশ্ব অনড়; কারণ গতিশব্দটি আপেক্ষিক। চেয়ারটি স্থির, আমি নড়িতেছি; আমার এই গতি ঐ স্থির চেয়ারটির সঙ্গে আপেক্ষিক। গতি-সৃষ্টির জন্য অন্ততঃ দুইটি জিনিষের প্রয়োজন। সমগ্র বিশ্বকে যদি এক বলিয়া ধরা হয়, তাহা হইলে সেখানে গতির স্থান নাই। সে যে গতিশীল হইবে, তাহার গতি নির্ধারিত হইবে কিসের সহিত তুলনা করিয়া? কাজেই চরম সত্য অপরিবর্তনীয়, অবিচল। যাহা কিছু গতি ও পরিবর্তন, তাহা সবই ঘটে শুধু এই আপেক্ষিক ও সীমাবদ্ধ জগতে। সমষ্টি-সত্তা নৈর্ব্যক্তিক। যাঁহার নিকট আমরা নতজানু হই, প্রার্থনা করি, সেই ভগবান্—সাকার ঈশ্বর, স্রষ্টা বা বিশ্ব-নিয়ন্তা হইতে আরম্ভ করিয়া নিম্নতম অণু পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের বিকাশ এই নৈর্ব্যক্তিক সত্তার মধ্যে। যথেষ্ট যুক্তি দেখাইয়া এরূপ সাকার ঈশ্বরকে প্রতিপন্ন করা যায়। এরূপ সাকার ঈশ্বরকে নিরাকার ব্রহ্মেরই সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি বলিয়া ব্যাখ্যা করা যায়। তুমি আমি অতি নিম্নস্তরের প্রকাশ; আমরা যতদূর ধারণা করিতে পারি, তাহার সর্বোচ্চ প্রকাশ এই সাকার ঈশ্বর। আবার তুমি বা আমি সেই সাকার ঈশ্বর হইতে পারি না। বেদান্ত যখন বলেন, ‘তুমি আমি ব্রহ্ম’, তখন সেই ব্রহ্ম বলিতে সাকার ঈশ্বর বুঝায় না। একটি উদাহরণ দিতেছি। একতাল কাদা লইয়া একটি প্রকাণ্ড মাটির হাতী গড়া হইল; আবার সেই কাদার সামান্য অংশ লইয়া ছোট একটি মাটির ইঁদুরও গড়া হইল। ঐ মাটির ইঁদুরটি কি কখনও মাটির হাতী হইতে পারিবে? কিন্তু দুইটিকে জলের মধ্যে রাখিয়া দিলে দুইটিই কাদা হইয়া যায়। কাদা বা মাটি হিসাবে দুইটিই এক; কিন্তু ইঁদুর ও হাতী হিসাবে তাহাদের মধ্যে চিরদিন পার্থক্য থাকিবে। অসীম নিরাকার ব্রহ্ম যেন পূর্বোক্ত উদাহরণের মাটির মত। স্বরূপের দিক্ দিয়া আমরা ও বিশ্বনিয়ন্তা এক, কিন্তু তাঁহার অভিব্যক্তিরূপে, মানুষরূপে আমরা তাঁহার চিরদাস, তাঁহার পূজক। কাজেই দেখা যাইতেছে, সাকার ঈশ্বর থাকিয়া যাইতেছেন। এই আপেক্ষিক জগতের আর সব কিছুও রহিয়া গেল; ধর্মকে দৃঢ়তর ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করা হইল। কাজেই সাকার ঈশ্বরকে জানিতে গেলে আগে নিরাকার সত্তাকে জানা প্রয়োজন।
আমরা দেখিয়াছি, তর্কযুক্তির নিয়মানুসারে ‘সামান্য’-এর মধ্য দিয়াই শুধু ‘বিশেষ’কে জানা যায়। কাজেই যিনি সামান্যীকরণের চরম, সেই নৈর্ব্যক্তিক সত্তার, নিরাকার ব্রহ্মের মাধ্যমেই শুধু মানুষ হইতে ঈশ্বর পর্যন্ত সব বিশেষকেই জানা যায়। প্রার্থনা থাকিয়া যাইবে, তাহার অর্থ আরও পরিষ্কার হইয়া উঠিবে মাত্র। প্রার্থনার নিম্নস্তরে আছে আমাদের মনের কামনা পূরণের জন্য শুধু ‘দাও দাও’ ভাব—প্রার্থনা সম্বন্ধে এইসব অর্থহীন ধারণাকে বোধ হয় সরিয়া পড়িতে হইবে। যুক্তিমূলক ধর্মে ঈশ্বরের নিকট কিছু প্রার্থনা করিতে বলা হয় না; প্রার্থনা করিতে বলা হয় দেবতাদের কাছে। এরূপ হওয়াই খুব স্বাভাবিক। রোমান ক্যাথলিকরা সাধু-সন্তদের কাছে প্রার্থনা করেন; এটি খুব ভাল। কিন্তু ভগবানের নিকট প্রার্থনা করার কোন অর্থ হয় না। শ্বাসপ্রশ্বাস লইবার জন্য, একপশলা বৃষ্টি হওয়ার জন্য বা বাগানে সবজি ফলাইবার জন্য ভগবানের নিকট প্রার্থনা করা খুবই অস্বাভাবিক। ঈশ্বরের তুলনায় যাঁহারা আমাদেরই মত ক্ষুদ্র জীব, সেই সাধু-সন্তেরা অবশ্যই আমাদের সাহায্য করিতে পারেন। কিন্তু বিশ্বনিয়ন্তার নিকট আমাদের ছোটখাট সমস্ত প্রয়োজন মিটাইবার কথা বলা—শিশুকাল হইতেই বলা, ‘হে ঈশ্বর, আমার মাথা-ব্যথা সারাইয়া দাও’—এগুলি নিতান্তই হাস্যকর। জগতে এমন লক্ষ লক্ষ ব্যক্তি দেহত্যাগ করিয়াছেন, যাঁহাদের আত্মা এখনও রহিয়াছে; তাঁহারা দেবতা ও দেবদূত হইয়াছেন, তাঁহারা আমাদের সাহায্য করুন না! কিন্তু এজন্য ভগবান্কে বলা? নিশ্চয়ই নয়। তাঁহার নিকট চাহিতে হইলে নিশ্চয়ই আরও উচ্চতর জিনিষ চাহিতে হইবে। গঙ্গাতীরে বাস করিয়া জলের জন্য যে কূপ খনন করে, সে তো মূর্খ, হীরকের খনির কাছে বাস করিয়া যে কাঁচখণ্ডের জন্য মাটি খোঁড়ে, সে মূর্খ ছাড়া আর কি?
করুণাময়, প্রেমময় ঈশ্বরের নিকট আমরা যদি জাগতিক বস্তু চাহিতে যাই, তবে আমরা নির্বোধ ছাড়া আর কি? কাজেই তাঁহার নিকট জ্ঞান, ভক্তি, প্রেম ইত্যাদি প্রার্থনা করিব। কিন্তু যতদিন আমাদের দুর্বলতা আছে, যতদিন ‘তুমি প্রভু, আমি দাস’ এই ভাব লইয়া তাঁহার উপর নির্ভর করিয়া থাকিবার আকাঙ্ক্ষা আমাদের আছে, ততদিন এ-সব নিম্নস্তরের প্রার্থনাও থাকিবে এবং সাকার ঈশ্বরের উপাসনার ভাবও থাকিবে। কিন্তু যাঁহারা আধ্যাত্মিকতায় অনেক উন্নত হইয়াছেন, তাঁহারা এ-সব ছোটখাট প্রার্থনার ধার ধারেন না; তাঁহারা নিজেদের জন্য কিছু চাওয়ার কথা, নিজেদের কোন প্রয়োজনের কথা প্রায় ভুলিয়া গিয়াছেন। ‘আমি নই, সখা, তুমি!’—তাঁহাদের মধ্যে এই ভাবেরই প্রাধান্য। ইঁহারাই নিরাকার উপাসনার যোগ্য ব্যক্তি। নিরাকার ঈশ্বরোপাসনার অর্থ কি? তাহার অর্থ এরূপ দাসভাব নয়—‘হে প্রভু, আমি অতি অকিঞ্চন, আমায় কৃপা কর!’ ইংরেজী ভাষায় অনূদিত সেই প্রাচীন পারসী কবিতাটি তো আপনারা জানেনঃ আমি আমার প্রিয়তমকে দেখিতে আসিয়াছিলাম। আসিয়া দেখি দ্বার রুদ্ধ। দ্বারে করাঘাত করিতেই ভিতর হইতে কেহ বলিল, ‘তুমি কে?’ বলিলাম, ‘আমি অমুক।’ দ্বার খুলিল না। দ্বিতীয়বার আসিয়া করাঘাত করিলাম, একই প্রশ্ন হইল, একই উত্তর দিলাম। সেবারও দ্বার খুলিল না। তৃতীয়বার আসিলাম, একই প্রশ্ন হইল। আমি বলিলাম, ‘প্রিয়তম, আমি তুমিই!’ তখন দ্বার খুলিয়া গেল। সত্যের মাধ্যমে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করিতে হয়। সত্য কি? আমিই তিনি। আমি ‘তুমি’ নই—এ-কথা বলিলে অসত্য বলা হয়। তোমা হইতে আমি পৃথক্, এ কথার মত মিথ্যা, ভয়ঙ্কর মিথ্যা আর নাই। এই বিশ্বের সঙ্গে আমি এক, জন্ম হইতেই এক। বিশ্বের সঙ্গে আমি যে এক, তাহা আমার ইন্দ্রিয়ের কাছে স্বতঃসিদ্ধ। আমার চারিদিকে যে বায়ু রহিয়াছে, তাহার সহিত আমি এক, তাপের সঙ্গে এক, আলোর সঙ্গে এক; যাঁহাকে বিশ্ব বলা হয়, যাঁহাকে অজ্ঞানবশতঃ বিশ্ব বলিয়া মনে হয়, সেই সর্বব্যাপী বিশ্বদেবতার সঙ্গে আমি অনন্তকাল এক, কারণ হৃদয়ে যিনি চিরন্তন কর্তা, প্রত্যেকের হৃদয়াভ্যন্তরে যিনি বলেন, ‘আমি আছি’, যিনি মৃত্যুহীন চিরজাগ্রত অমর, যাঁহার মহিমার নাশ নাই, যাঁহার শক্তি চির-অব্যর্থ, তিনিই এই বিশ্বদেবতা, অপর কেহই নয়। তাঁহার সহিত আমি এক।
ইহাই নিরাকার উপাসনার সার। এই উপাসনার কি ফল হয়? ইহাতে মানুষের গোটা জীবনটাই পরিবর্তিত হইয়া যাইবে। আমাদের জীবনে যে-শক্তির একান্ত প্রয়োজন, ইহাই সেই শক্তি। কারণ যাহাকে আমরা পাপ বলি, দুঃখ বলি, তাহার একটিমাত্র কারণ আছে—আমাদের দুর্বলতাই সেই কারণ। দুর্বলতার সঙ্গে অজ্ঞান আসে, অজ্ঞানের সঙ্গে আসে দুঃখ। নিরাকারের উপাসনা আমাদিগকে শক্তিমান্ করিয়া তুলিবে। আমরা তখন দুঃখকে, হীনতার উগ্রতাকে হাসিয়া উড়াইয়া দিব; হিংস্র ব্যাঘ্র তখন তাহার ব্যাঘ্র-স্বরূপের পিছনে আমার নিজেরই আত্মাকে উদ্ঘাটিত করিয়া দেখাইবে। নিরাকার উপাসনার ফল এই হইবে। ভগবানের সহিত যাঁহার আত্মা এক হইয়া গিয়াছে, তিনিই শক্তিমান্; তাছাড়া আর কেহই শক্তিমান্ নয়। নাজারেথের যীশুর যে-শক্তির কথা তোমাদের বাইবেলে আছে, যে প্রচণ্ড শক্তিবলে বিশ্বাসঘাতককে তিনি উপেক্ষা করিয়াছেন, তাঁহাকে যাহারা হত্যা করিতে চাহিয়াছিল, তাহাদেরও তিনি আশীর্বাদ করিয়াছেন, সেই শক্তি কোথা হইতে আসিল? তোমাদের কি মনে হয়? এই শক্তি উদ্ভূত হইয়াছিল এই বোধ হইতে—‘আমি ও আমার পিতা এক’; এই শক্তির কারণ এই প্রার্থনা—‘পিতা, আমি যেমন তোমার সঙ্গে এক, সেইরূপ ইহাদের সকলকেই আমার সহিত এক করিয়া দাও।’ ইহাই নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা। বিশ্বের সহিত এক হইয়া যাও, তাঁহার সহিত এক হইয়া যাও। আর, এই নিরাকার ব্রহ্মের কোন বাহ্য প্রকাশের—কোন প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। ইন্দ্রিয় অপেক্ষা, নিজ নিজ চিন্তা অপেক্ষা তিনি আমাদের আরও নিকটে। তিনি আছেন বলিয়াই তাঁহার মাধ্যমে আমরা দেখি ও চিন্তা করি। কোন কিছু দেখিবার পূর্বে তাঁহাকেই দেখিতে হইবে। এই দেওয়ালটি দেখিতে হইলে পূর্বে তাঁহাকে দেখি, তারপর দেখি দেওয়ালটিকে; কারণ চিরকাল সব ক্রিয়ারই কর্তা তিনি। কে কাহাকে দেখিতেছে? তিনি আমাদের অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে রহিয়াছেন। দেহ ও মনের পরিবর্তন হয়; সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দ আসে আবার চলিয়া যায়; দিন ও বৎসর আবর্তন করিয়া চলিয়াছে; জীবন আসে, আবার চলিয়া যায়, কিন্তু তাঁহার মৃত্যু নাই। ‘আমি আছি, আমি আছি’—এই একই সুর চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয়। তাঁহারই মধ্যে, তাঁহারই মাধ্যমে আমরা সব জানি। তাঁহারই মধ্যে, তাঁহারই মাধ্যমে আমরা সব কিছু দেখি। তাঁহারই মধ্যে, তাঁহারই মাধ্যমে আমরা সব কিছু অনুভব করি, চিন্তা করি, বাঁচিয়া থাকি; তাঁহারই মধ্যে ও তাঁহারই মাধ্যমে আমাদের অস্তিত্ব। আর যে ‘আমি’কে ভুল করিয়া আমরা ছোট ‘আমি’, সীমায়িত ‘আমি’ বলিয়া ভাবি, তাহা শুধু আমার ‘আমি’ নয়, তাহা তোমাদেরও ‘আমি’, প্রাণিগণের—দেবদূতগণেরও ‘আমি’, হীনতম জীবেরও ‘আমি’। সেই ‘আমি আছি’ বোধ ঘাতকের মধ্যেও যেমন, সাধুর মধ্যেও ঠিক তেমনি; ধনীর মধ্যেও যা, দরিদ্রের মধ্যেও তাই; নর ও নারী, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী—সকলের মধ্যে এই বোধ এক। সর্বনিম্ন জীবকোষ হইতে সর্বোচ্চ দেবদূত পর্যন্ত প্রত্যেকের অন্তরেই তিনি বাস করিতেছেন এবং চিরদিন ঘোষণা করিতেছেন, ‘আমিই তিনি—সোঽহং, সোঽহম্।’ অন্তরে চিরবিদ্যমান এই বাণী যখন আমাদের বোধগম্য হইবে, উহার শিক্ষা গ্রহণ করিব, তখন দেখিব—সমগ্র বিশ্বের রহস্য প্রকট হইয়া পড়িয়াছে, দেখিব—প্রকৃতি আমাদের নিকট রহস্যের দ্বার খুলিয়া দিয়াছে। জানিবার আর কিছুই বাকী থাকিবে না। আমরা দেখিব, সমস্ত ধর্ম যে সত্যের সন্ধানে রত, যে সত্যের তুলনায় জড়বিজ্ঞানের সব জ্ঞানই গৌণ মাত্র, আমরা সেই সত্যের সন্ধান পাইয়াছি; ইহাই একমাত্র সত্যজ্ঞান, যাহা আমাদিগকে বিশ্বের এই বিশ্বজনীন ঈশ্বরের সঙ্গে এক করিয়া দেয়।