০৩. মবিনুর রহমান নৌকার বিছানায়

মবিনুর রহমান নৌকার বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়লেন। গাঢ় ঘুম, এত গাঢ় যেন মৃত্যুর কাছাকাছি। এই ঘুমের মধ্যেই তিনি অতি বিচিত্র একটি স্বপ্ন দেখলেন। যেন কয়েকজন বুড়ো মানুষ তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সবার চেহারা এক রকম। তাকিয়ে থাকার ভঙ্গিও একরকম। সবার মুখেই এক ধরনের প্রচ্ছন্ন হাসি। সেই হাসি একই সঙ্গে কঠিন এবং কোমল। তারা কথা বলতে শুরু করলেন।

সবাই এক সঙ্গে কথা বলছেন। তাঁদেব গলার স্বর এক রকম। সবাই এক সঙ্গে কথা বলার জন্যই বোধকরি এক ধরনের অধ্যাভাবিক রেজোনেন্স তৈরি হচ্ছে। শব্দটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। শরীরের প্রতিটি কোষ ঝিনঝন করে বাজছে। তার চেয়েও বড় কথা, ঘুমের মধ্যেই মবিনুর রহমানের মনে হলো এই বৃদ্ধদের তিনি আগেও স্বপ্ন দেখেছেন।

অতি দূর শৈশবে। যার স্মৃতি অস্পষ্টভাবে হলেও রয়ে গেছে।

মবিনুর রহমান!

জি।

তুমি কি মাতৃগর্ভের স্মৃতি মনে করতে পারছ?

না।

মাতৃগর্ভে যখন ছিলে তখন চারদিকে ছিল নিশ্চিন্দ্র অন্ধকার। এখনো কি চারদিকে অন্ধকার নয়?

হ্যাঁ!

মাতৃগর্ভে তুমি এক ধরনের তরল পদার্থের উপর ভাসছিলে–যাকে তোমরা বলে। এমনোটিক ফ্লুয়িড। এখনো তুমি ভাসছ পানির উপর। দোল খাচ্ছ। খাচ্ছ না?

জি।

খানিকটা হলেও মাতৃগর্ভের মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। নয় কি?

হ্যাঁ, তৈরি হয়েছে। আপনারা কে?

আমরা হচ্ছি–নি।

হ্যাঁ— নি। আমরা স্বপ্ন তৈরি করি।

বুঝতে পারছি না।

এখন বুঝতে না পারলেও আস্তে আস্তে বুঝতে পারবে। আমরা তোমাকে বুঝতে সাহায্য করব। তোমাকে সাহায্য করার জন্যেই আমরা এসেছি। তুমি আমাদেরই একজন।

আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

তুমিও একজন নি।

আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

তোমার মধ্যে আছে প্ৰচণ্ড ক্ষমতা। তুমি এই ক্ষমতা ব্যবহার করা।

আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

মন দিয়ে শোন–তোমার ভেতর আছে প্ৰচণ্ড ক্ষমতা! অকল্পনীয় ক্ষমতা। ক্ষমতা ব্যবহার কর। স্বপ্ন দেখ। স্বপ্ন দেখ।

আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

মবিনুর রহমান ঘুমের ঘোরেই কাতর শব্দ করলেন, তারপর তলিয়ে গেলেন গভীর ঘুমে। ঘুম যখন ভাঙল তখন চারদিক আলো হয়ে আছে। অনেক বেলা হয়েছে, কড়া রোদ। দীর্ঘ আট বছর পর এই প্রথম মবিনুর রহমানের মনে হলো আজ স্কুলে না যেয়ে সারাদিন নৌকায় বসে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকলে কেমন হয়?